রবীন্দ্রভাবনায় কৃষকের অধিকার by আতিউর রহমান
কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নে কৃষির বহুমুখীকরণের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে অকৃষি খাতের যেমন কুটিরশিল্প, রেশমশিল্প ও তাঁতশিল্পের সম্প্রসারণসহ আয়-উৎসারী কর্মকাণ্ডের কথা বলেছেন। কুষ্টিয়ায় বয়ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে পতিসরে ও শ্রীনিকেতনে ব্যাংক স্থাপন করেন
'আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার নিকট-পরিচয় হয়েছে। তখন চাষিদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ ছিল দেখাশোনা_ ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে। আমি জানি, ওদের মতো নিঃসহায় জীব অল্পই আছে, ওরা সমাজের যে তলায় তলিয়ে, সেখানে জ্ঞানের আলো অল্পই পেঁৗছায়, প্রাণের হাওয়া বয় না বললেই হয়।' (রাশিয়ার চিঠি, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পৃ. ৫৬২) রবীন্দ্রনাথ এসব অসহায় কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। প্রচলিত জমিদারি প্রথার প্রতি বৈরাগ্য আর হতদরিদ্র চাষি প্রজাদের প্রতি মমতা কবি চরিত্রের এক অনন্য দিক। প্রজাদরদি রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি বলেছেন, '...আমাদের দেশে জমিদার জমিদার মাত্র ! তিনি জুলুম করিয়া খাজনা আদায় করিতে পারেন, কিন্তু সমাজে তাহার অধিক অধিকার নাই।... বর্তমান জমিদারগণ যদি সেকালের দৃষ্টান্ত অনুসারে, কেবল রাজার মুখ না চাহিয়া, খেতাবের লক্ষ্য ছাড়িয়া জনহিত সাধন ও দেশের শিল্প সাহিত্যের রক্ষণ পালনে সহায়তা করেন তবেই তাঁহাদের ক্ষমতার সার্থকতা হয় এবং গৌরব বাড়িয়া উঠে।... সেই মহৎ গৌরব এখানকার জমিদাররা প্রতিদিন হারাইতেছেন। দেশ যখন চাহিতেছে রুটি তাঁহারা দিতেছেন প্রস্তর; বঙ্গভূমি তাহার জলকষ্ট, তাহার অন্নকষ্ট, তাহার শিল্পনাশ, তাহার বিদ্যাদৈন্য, তাহার রোগতাপ লইয়া তাঁহাদের মুখের দিকে চাহিয়াছে, আর তাঁহারা স্বদেশ প্রত্যাগত সাহেব-রাজকর্মচারীদের পাষাণ প্রতিমূর্তি গড়িয়া দিতেছেন।' (রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৮৬৯-৭৪)
রবীন্দ্রনাথ জমিদারদের মানবিক অধিকারে বিশ্বাসী হতে বলেছেন। তিনি নিরন্তর ভেবেছেন, কী করে কৃষক তার আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে, কী করে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, কী করে অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারে। সে জন্য কবি সবসময় এসব বঞ্চিত মানুষকে একত্র করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, মানুষ সংগঠিত হলে উন্নয়ন সহজ হয়। 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধে 'সমাজ' প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। সে জন্যই তিনি শিলাইদহ, পতিসর ও শ্রীনিকেতনে সমবায়ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করেন। সবার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিশ্বনাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথ 'বিজয়া সম্মিলনী'র (২১ কার্তিক ১৩১২) ভাষণে বলেছেন, 'যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।... মনে রাখিতে হইবে আজ স্বদেশের স্বদেশীয়তা আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে, ইহা রাজার কোনো প্রসাদ বা অপ্রসাদের উপর নির্ভর করে না... আমার স্বদেশ আমার চিরন্তন স্বদেশ... কোন মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিব না, কাহারো মুখের কথায় ইহাকে বিকাইতে পারিব না, একবার যে হস্তে ইহার স্পর্শ উপলব্ধি করিয়াছি, সে হস্তকে ভিক্ষা পাত্র বহনে আর নিযুক্ত করিব না।' (ঐ, পৃ. ১৪২)
রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র ও অসহায় কৃষকদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নে কৃষির বহুমুখীকরণের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে অকৃষি খাতের যেমন কুটিরশিল্প, রেশমশিল্প ও তাঁতশিল্পের সম্প্রসারণসহ আয়-উৎসারী কর্মকাণ্ডের কথা বলেছেন। কুষ্টিয়ায় বয়ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে পতিসরে ও শ্রীনিকেতনে ব্যাংক স্থাপন করেন। এক পত্রে কবি পতিসরের কৃষকদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রাম অধ্যক্ষদের উপদেশ দিয়েছেন, 'প্রজাদের বাস্তু বাড়ি ক্ষেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদিগকে উৎসাহিত করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাহির হয়, ফলও বিক্রয়যোগ্য। শিমুল-আঙ্গুর গাছ বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তাহার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে। ... কাছারিতে যে আমেরিকান ভুট্টার বীজ আছে তাহা পুনর্বার লাগাইবার চেষ্টা করিতে হইবে।' (রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৮৮)
রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের অধিকারবোধে আলোকিত করার কথা বলেছেন। 'চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্বন্ধে দুটো কথা সর্বদাই আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে_ জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর; দ্বিতীয়ত, সমবায়নীতি অনুসারে চাষের ক্ষেত্র একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না। মান্ধাতার আমলের হাল লাঙল নিয়ে আলবাঁধা টুকরো জমিতে ফসল ফলানো আর ফুটো কলসিতে জল আনা একই কথা। কিন্তু এ দুটো পন্থাই দুরূহ। প্রথমত চাষীকে জমির স্বত্ব দিলেই সে স্বত্ব পরমুহূর্তেই মহাজনের হাতে গিয়ে পড়বে, তার দুঃখভার বাড়বে বৈ কমবে না।' (রাশিয়ার চিঠি, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পৃ. ৫৬২-৬৩)
মূলত তখনকার চাষিরা অজ্ঞ ছিলেন, নিরক্ষর ছিলেন, আধুনিক বৈজ্ঞানিক চাষবাদ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না। তারা ছিলেন অতি সরল মনের। তাই জমি তাদের হলেও তা তাদের থাকবে না, মহাজনদের দ্বারা অপহৃত হবে।
১৯০৯ সালের ডিসেম্বরে লেখা 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে কবি প্রজাদের অধিকারচেতনা প্রকাশ করেছেন এভাবে_'প্রতাপাদিত্য। তুমি এই সমস্ত প্রজাদের খেপিয়েছ?
ধনঞ্জয়। খেপাই বই-কি! নিজে খেপি, ওদেরও খেপাই, এই তো আমার কাজ।
রবীন্দ্রনাথ কখনো চাননি সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা অধিকার অর্জন করতে। এমনকি তিনি সাম্যবাদী বল প্রয়োগের (যেমন সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া) দ্বারা সৃষ্ট নীতিকেও সমর্থন করেননি। তিনি দেখেছিলেন, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের নামে শাসন করছেন পুঁজিবাদী বা ধনতন্ত্রবাদীরা। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনে এতদঞ্চলের বিরাজমান ব্যবধান বা বৈষম্যকে কমিয়ে আনতে না পারলে কৃষক, শ্রমিক ও অসহায় মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়।
মানবিক অধিকারবাদী রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, জমিদারেরা গরিব চাষিকে শোষণ করে বড়লোক হন। চাষিকে মানুষের মর্যাদা দেন না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অধীন এক কর্মচারীকে খাজনা ও কর আদায়ে দরিদ্র কৃষকদের প্রতি মানবিক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এক পত্রে লিখেছেন, 'প্রজাদের অবস্থা ও উৎপন্ন ফসলের পরিমাণের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াই আদায় তহশীল করা শ্রেয়।... সর্বতোভাবে প্রজাদের সহিত ধর্মসম্বন্ধ রক্ষা করিয়া তাহাদের পূর্ণ বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে হইবে। আমরা যে সর্বপ্রকারে প্রজাদের হিত ইচ্ছা করি তোমাদের ব্যবহারে তাহা প্রতিপন্ন করিতে হইবে। তোমার অধীনস্থ মণ্ডলের অন্তর্গত পল্লীগুলির যাহাতে সর্বপ্রকারে উন্নতিসাধন হয় প্রজাদিগকে সেজন্য সর্বদাই সচেষ্ট করিয়া দিবে। প্রজাদিগের প্রতি যেমন ন্যায় ধর্ম ও দায় রক্ষা করিবে তেমনি অধীনস্থ কর্মচারীদিগকে বিশেষভাবে কর্মের শাসনে সংযত করিয়া রাখিবে।...' (আবুল আহসান চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ, পৃ. ৭৭-৭৮)
রবীন্দ্রনাথ যে আন্তরিকভাবেই চাইতেন, চাষিরই জমির মালিক হওয়া উচিত, তার প্রমাণ মেলে তাঁর লেখা দুটি চিঠি থেকে। আমেরিকা থেকে প্রতিমা দেবীকে তিনি লেখেন, '...বহুকাল থেকেই আশা করেছিলুম আমাদের জমিদারি যেন আমাদের প্রজাদেরই জমিদারি হয়_ আমরা যেন ট্রাষ্টির মতো থাকি।' আরেকটি পত্রে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, 'যে রকম দিন আসচে তাতে জমিদারির উপরে কোনদিন আর ভরসা রাখা চলবে না। ও জিনিসটার উপর অনেককাল থেকেই আমার মনে মনে ধিক্কার ছিল, এবার সেটা আরও পাকা হয়েচে। যেসব কথা বহুকাল ভেবেচি এবার রাশিয়ায় তার চেহারা দেখে এলুম। তাই জমিদারির ব্যবসায় আমার লজ্জা বোধ হয়।' (সন্তোষ কুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ও মানবাধিকার, পৃ. ২২৭) রবীন্দ্রনাথ কী রকম উদারতা ও দক্ষতাসহকারে জমিদারি পরিচালনা করেছেন, সে সম্পর্কে জধলংযধযর উরংঃৎরপঃ এধুবঃঃববৎ (১৯১৬) এ ঙ গধষষবু ও.ঈ.ঝ. লিখেছেন, "ওঃ সঁংঃ হড়ঃ নব রসধমরহবফ ঃযধঃ ধ ঢ়ড়বিৎভঁষ ষধহফষড়ৎফ রং ধষধিুং ড়ঢ়ঢ়ৎবংংরাব ধহফ ঁহপযধৎরঃধনষব. অ ংঃৎরশরহম রহংঃধহপব ঃড় ঃযব পড়হঃৎধৎু রং মরাবহ রহ ঃযব ঝবঃঃষবসবহঃ ঙভভরপবৎং্থ ধপপড়ঁহঃ ড়ভ ঃযব ঊংঃধঃব ড়ভ জধনরহফৎধহধঃয ঞধমড়ৎব, ঃযব ইবহমধষর ঢ়ড়বঃ যিড়ংব ভধসব রং ড়িৎষফ-রিফব. ওঃ রং পষবধৎ ঃযধঃ ঃযব ঢ়ড়বঃরপধষ মবহরঁং যব ধফফং ঢ়ৎধপঃরপধষ রফবধং ড়ভ বংঃধঃব সধহধমবসবহঃ, যিরপয ংযড়ঁষফ নব ধহ বীধসঢ়ষব ঃড় ঃযব ষড়ৎফ ুবসরহফধৎং." (আবুল আহসান চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ, পৃ. ৭৩)
প্রজাসাধারণের হিতসাধনই ছিল রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-জ্ঞান। সে জন্য তিনি জমিদারির আমলাতন্ত্রেও সংস্কার এনেছিলেন। জমিদারির সংস্কার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছেন, "এখন আমার কাজ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছে। আমাদের জমিদারির মধ্যে একটা কাজ পত্তন করে এসেছি। বিরাহিমপুর পরগনাকে ৫টা মণ্ডলে ভাগ করে প্রত্যেক মণ্ডলে একজন অধ্যক্ষ বসিয়ে এসেছি; এই অধ্যক্ষরা সেখানে 'পল্লী সমাজ' স্থাপনে নিযুক্ত। যাতে গ্রামের লোক নিজেদের হিত সাধনে সচেষ্ট হয়ে ওঠে... পথ-ঘাট পরিষ্কার করে, জলকষ্ট দূর করে, সালিশের বিচারে বিবাদ নিষ্পত্তি করে, বিদ্যালয় স্থাপন করে, জঙ্গল পরিষ্কার করে, দুর্ভিক্ষের জন্য ধর্মগোলা গড়ে তোলে ইত্যাদি সর্বপ্রকারে গ্রাম্য সমাজের হিতে নিজের চেষ্টা নিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়, তারই ব্যবস্থা করা গিয়েছে। আমার প্রজাদের মধ্যে যারা মুসলমান তাদের মধ্যে বেশ কাজ অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু হিন্দু পল্লীতে বাধার অন্ত নেই।" (রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ. ২২৬)
তিনি লক্ষ্য করেছেন, জমিদারেরা সামস্ত প্রথার ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে দরিদ্র প্রজাসাধারণকে শোষণের মাধ্যমে আয় বাড়ানোকেই নিজ কর্তব্য মনে করেন। তারা খাজনা ও শুল্ককর আদায়, উচ্চসুদের ঋণ ইত্যাদি সূত্র ধরে কৃষকদের উদ্বৃত্ত ফসল লোপাট করে। তিনি তাঁর সেরেস্তার আমলাদের কর্তৃত্ব ও শোষণ কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে জন্য জমিদার হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রজাদের কাছে অনন্য এক প্রজাহিতৈষী ব্যক্তিত্ব। তিনি বিরাহিমপুর (শিলাইদহ) ও কালীগ্রাম (পতিসর)_ এ দুই পরগনায় কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি করে বিচার সভা স্থাপন করেন। প্রজাদের পরস্পরের মধ্যে কোনো বিবাদ দেখা দিলে তা নিয়ে উভয় পক্ষই এই বিচার সভায় আসত। কেবল ফৌজদারি ছাড়া অন্য কোনো রকম মামলা নিয়ে কৃষকেরা আদালতে যেতেন না। এমনকি বিচার সভার বিচারে অসন্তুষ্ট হলে আপিলেরও বিধান করা হয়। প্রজাদের সম্মতিক্রমে সমস্ত পরগনার জন্য পাঁচজন সভ্য নিয়ে একটি আপিল সভা নির্বাচন করা হয়েছিল।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কৃষকের সন্তানেরাই দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা এখনও অব্যাহত। তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সবার আগে প্রয়োজন সবচেয়ে বঞ্চিত অবহেলিত কৃষকসমাজের অধিকার নিশ্চিত করা। তাদের সম্মান দেওয়া। কেননা, কৃষকের ঘামঝরা উৎপাদন আমাদের জাতীয় উন্নতির ভিত্তি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান নিয়ামক। তাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বাধীনতা আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন আগের সব অর্জনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'সমাজের সচেষ্ট স্বাধীনতা অন্য সকল স্বাধীনতা হইতেই বড়ো।' (রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৬২৪)
বর্তমান সময়ে দেশে যে কল্যাণধর্মী ও কৃষকবান্ধব উন্নয়ননীতি কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, তা রবীন্দ্রচেতনারই প্রতিফলন। কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করা, দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অধিকতর সম্পৃক্ত করা এখন সময়ের দাবি। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। সেদিকে খেয়াল রেখেই বর্তমানে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে, যাতে সুবিধাবঞ্চিত দেশের এই সম্ভাবনাময় জনশক্তিকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা যায়। আধুনিক প্রযুক্তির যে আকাশছোঁয়া অগ্রগতি হয়েছে, তার সুফল কী করে কৃষকদের দোরগোড়ায় পেঁৗছানো যায়, সেই ভাবনাও চলছে। কৃষকদের ভূমির অধিকার, ঋণপ্রাপ্তির অধিকার, উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তানদের শিক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতকরণের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বর্গাচাষি ও প্রান্তিক কৃষকদের ঋণসেবাসহ আধুনিক ব্যাংকিং সেবা পেঁৗছানোর উদ্যোগ নিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কৃষকের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে যুগোপযোগী কৃষিনীতি।
ড. আতিউর রহমান : গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক
'আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার নিকট-পরিচয় হয়েছে। তখন চাষিদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ ছিল দেখাশোনা_ ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে। আমি জানি, ওদের মতো নিঃসহায় জীব অল্পই আছে, ওরা সমাজের যে তলায় তলিয়ে, সেখানে জ্ঞানের আলো অল্পই পেঁৗছায়, প্রাণের হাওয়া বয় না বললেই হয়।' (রাশিয়ার চিঠি, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পৃ. ৫৬২) রবীন্দ্রনাথ এসব অসহায় কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। প্রচলিত জমিদারি প্রথার প্রতি বৈরাগ্য আর হতদরিদ্র চাষি প্রজাদের প্রতি মমতা কবি চরিত্রের এক অনন্য দিক। প্রজাদরদি রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি বলেছেন, '...আমাদের দেশে জমিদার জমিদার মাত্র ! তিনি জুলুম করিয়া খাজনা আদায় করিতে পারেন, কিন্তু সমাজে তাহার অধিক অধিকার নাই।... বর্তমান জমিদারগণ যদি সেকালের দৃষ্টান্ত অনুসারে, কেবল রাজার মুখ না চাহিয়া, খেতাবের লক্ষ্য ছাড়িয়া জনহিত সাধন ও দেশের শিল্প সাহিত্যের রক্ষণ পালনে সহায়তা করেন তবেই তাঁহাদের ক্ষমতার সার্থকতা হয় এবং গৌরব বাড়িয়া উঠে।... সেই মহৎ গৌরব এখানকার জমিদাররা প্রতিদিন হারাইতেছেন। দেশ যখন চাহিতেছে রুটি তাঁহারা দিতেছেন প্রস্তর; বঙ্গভূমি তাহার জলকষ্ট, তাহার অন্নকষ্ট, তাহার শিল্পনাশ, তাহার বিদ্যাদৈন্য, তাহার রোগতাপ লইয়া তাঁহাদের মুখের দিকে চাহিয়াছে, আর তাঁহারা স্বদেশ প্রত্যাগত সাহেব-রাজকর্মচারীদের পাষাণ প্রতিমূর্তি গড়িয়া দিতেছেন।' (রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৮৬৯-৭৪)
রবীন্দ্রনাথ জমিদারদের মানবিক অধিকারে বিশ্বাসী হতে বলেছেন। তিনি নিরন্তর ভেবেছেন, কী করে কৃষক তার আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে, কী করে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, কী করে অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারে। সে জন্য কবি সবসময় এসব বঞ্চিত মানুষকে একত্র করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, মানুষ সংগঠিত হলে উন্নয়ন সহজ হয়। 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধে 'সমাজ' প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। সে জন্যই তিনি শিলাইদহ, পতিসর ও শ্রীনিকেতনে সমবায়ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করেন। সবার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিশ্বনাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথ 'বিজয়া সম্মিলনী'র (২১ কার্তিক ১৩১২) ভাষণে বলেছেন, 'যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।... মনে রাখিতে হইবে আজ স্বদেশের স্বদেশীয়তা আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে, ইহা রাজার কোনো প্রসাদ বা অপ্রসাদের উপর নির্ভর করে না... আমার স্বদেশ আমার চিরন্তন স্বদেশ... কোন মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিব না, কাহারো মুখের কথায় ইহাকে বিকাইতে পারিব না, একবার যে হস্তে ইহার স্পর্শ উপলব্ধি করিয়াছি, সে হস্তকে ভিক্ষা পাত্র বহনে আর নিযুক্ত করিব না।' (ঐ, পৃ. ১৪২)
রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র ও অসহায় কৃষকদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নে কৃষির বহুমুখীকরণের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে অকৃষি খাতের যেমন কুটিরশিল্প, রেশমশিল্প ও তাঁতশিল্পের সম্প্রসারণসহ আয়-উৎসারী কর্মকাণ্ডের কথা বলেছেন। কুষ্টিয়ায় বয়ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে পতিসরে ও শ্রীনিকেতনে ব্যাংক স্থাপন করেন। এক পত্রে কবি পতিসরের কৃষকদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রাম অধ্যক্ষদের উপদেশ দিয়েছেন, 'প্রজাদের বাস্তু বাড়ি ক্ষেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদিগকে উৎসাহিত করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাহির হয়, ফলও বিক্রয়যোগ্য। শিমুল-আঙ্গুর গাছ বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তাহার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে। ... কাছারিতে যে আমেরিকান ভুট্টার বীজ আছে তাহা পুনর্বার লাগাইবার চেষ্টা করিতে হইবে।' (রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৮৮)
রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের অধিকারবোধে আলোকিত করার কথা বলেছেন। 'চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্বন্ধে দুটো কথা সর্বদাই আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে_ জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর; দ্বিতীয়ত, সমবায়নীতি অনুসারে চাষের ক্ষেত্র একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না। মান্ধাতার আমলের হাল লাঙল নিয়ে আলবাঁধা টুকরো জমিতে ফসল ফলানো আর ফুটো কলসিতে জল আনা একই কথা। কিন্তু এ দুটো পন্থাই দুরূহ। প্রথমত চাষীকে জমির স্বত্ব দিলেই সে স্বত্ব পরমুহূর্তেই মহাজনের হাতে গিয়ে পড়বে, তার দুঃখভার বাড়বে বৈ কমবে না।' (রাশিয়ার চিঠি, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পৃ. ৫৬২-৬৩)
মূলত তখনকার চাষিরা অজ্ঞ ছিলেন, নিরক্ষর ছিলেন, আধুনিক বৈজ্ঞানিক চাষবাদ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না। তারা ছিলেন অতি সরল মনের। তাই জমি তাদের হলেও তা তাদের থাকবে না, মহাজনদের দ্বারা অপহৃত হবে।
১৯০৯ সালের ডিসেম্বরে লেখা 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে কবি প্রজাদের অধিকারচেতনা প্রকাশ করেছেন এভাবে_'প্রতাপাদিত্য। তুমি এই সমস্ত প্রজাদের খেপিয়েছ?
ধনঞ্জয়। খেপাই বই-কি! নিজে খেপি, ওদেরও খেপাই, এই তো আমার কাজ।
রবীন্দ্রনাথ কখনো চাননি সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা অধিকার অর্জন করতে। এমনকি তিনি সাম্যবাদী বল প্রয়োগের (যেমন সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া) দ্বারা সৃষ্ট নীতিকেও সমর্থন করেননি। তিনি দেখেছিলেন, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের নামে শাসন করছেন পুঁজিবাদী বা ধনতন্ত্রবাদীরা। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনে এতদঞ্চলের বিরাজমান ব্যবধান বা বৈষম্যকে কমিয়ে আনতে না পারলে কৃষক, শ্রমিক ও অসহায় মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়।
মানবিক অধিকারবাদী রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, জমিদারেরা গরিব চাষিকে শোষণ করে বড়লোক হন। চাষিকে মানুষের মর্যাদা দেন না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অধীন এক কর্মচারীকে খাজনা ও কর আদায়ে দরিদ্র কৃষকদের প্রতি মানবিক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এক পত্রে লিখেছেন, 'প্রজাদের অবস্থা ও উৎপন্ন ফসলের পরিমাণের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াই আদায় তহশীল করা শ্রেয়।... সর্বতোভাবে প্রজাদের সহিত ধর্মসম্বন্ধ রক্ষা করিয়া তাহাদের পূর্ণ বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে হইবে। আমরা যে সর্বপ্রকারে প্রজাদের হিত ইচ্ছা করি তোমাদের ব্যবহারে তাহা প্রতিপন্ন করিতে হইবে। তোমার অধীনস্থ মণ্ডলের অন্তর্গত পল্লীগুলির যাহাতে সর্বপ্রকারে উন্নতিসাধন হয় প্রজাদিগকে সেজন্য সর্বদাই সচেষ্ট করিয়া দিবে। প্রজাদিগের প্রতি যেমন ন্যায় ধর্ম ও দায় রক্ষা করিবে তেমনি অধীনস্থ কর্মচারীদিগকে বিশেষভাবে কর্মের শাসনে সংযত করিয়া রাখিবে।...' (আবুল আহসান চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ, পৃ. ৭৭-৭৮)
রবীন্দ্রনাথ যে আন্তরিকভাবেই চাইতেন, চাষিরই জমির মালিক হওয়া উচিত, তার প্রমাণ মেলে তাঁর লেখা দুটি চিঠি থেকে। আমেরিকা থেকে প্রতিমা দেবীকে তিনি লেখেন, '...বহুকাল থেকেই আশা করেছিলুম আমাদের জমিদারি যেন আমাদের প্রজাদেরই জমিদারি হয়_ আমরা যেন ট্রাষ্টির মতো থাকি।' আরেকটি পত্রে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, 'যে রকম দিন আসচে তাতে জমিদারির উপরে কোনদিন আর ভরসা রাখা চলবে না। ও জিনিসটার উপর অনেককাল থেকেই আমার মনে মনে ধিক্কার ছিল, এবার সেটা আরও পাকা হয়েচে। যেসব কথা বহুকাল ভেবেচি এবার রাশিয়ায় তার চেহারা দেখে এলুম। তাই জমিদারির ব্যবসায় আমার লজ্জা বোধ হয়।' (সন্তোষ কুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ও মানবাধিকার, পৃ. ২২৭) রবীন্দ্রনাথ কী রকম উদারতা ও দক্ষতাসহকারে জমিদারি পরিচালনা করেছেন, সে সম্পর্কে জধলংযধযর উরংঃৎরপঃ এধুবঃঃববৎ (১৯১৬) এ ঙ গধষষবু ও.ঈ.ঝ. লিখেছেন, "ওঃ সঁংঃ হড়ঃ নব রসধমরহবফ ঃযধঃ ধ ঢ়ড়বিৎভঁষ ষধহফষড়ৎফ রং ধষধিুং ড়ঢ়ঢ়ৎবংংরাব ধহফ ঁহপযধৎরঃধনষব. অ ংঃৎরশরহম রহংঃধহপব ঃড় ঃযব পড়হঃৎধৎু রং মরাবহ রহ ঃযব ঝবঃঃষবসবহঃ ঙভভরপবৎং্থ ধপপড়ঁহঃ ড়ভ ঃযব ঊংঃধঃব ড়ভ জধনরহফৎধহধঃয ঞধমড়ৎব, ঃযব ইবহমধষর ঢ়ড়বঃ যিড়ংব ভধসব রং ড়িৎষফ-রিফব. ওঃ রং পষবধৎ ঃযধঃ ঃযব ঢ়ড়বঃরপধষ মবহরঁং যব ধফফং ঢ়ৎধপঃরপধষ রফবধং ড়ভ বংঃধঃব সধহধমবসবহঃ, যিরপয ংযড়ঁষফ নব ধহ বীধসঢ়ষব ঃড় ঃযব ষড়ৎফ ুবসরহফধৎং." (আবুল আহসান চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ, পৃ. ৭৩)
প্রজাসাধারণের হিতসাধনই ছিল রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-জ্ঞান। সে জন্য তিনি জমিদারির আমলাতন্ত্রেও সংস্কার এনেছিলেন। জমিদারির সংস্কার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছেন, "এখন আমার কাজ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেছে। আমাদের জমিদারির মধ্যে একটা কাজ পত্তন করে এসেছি। বিরাহিমপুর পরগনাকে ৫টা মণ্ডলে ভাগ করে প্রত্যেক মণ্ডলে একজন অধ্যক্ষ বসিয়ে এসেছি; এই অধ্যক্ষরা সেখানে 'পল্লী সমাজ' স্থাপনে নিযুক্ত। যাতে গ্রামের লোক নিজেদের হিত সাধনে সচেষ্ট হয়ে ওঠে... পথ-ঘাট পরিষ্কার করে, জলকষ্ট দূর করে, সালিশের বিচারে বিবাদ নিষ্পত্তি করে, বিদ্যালয় স্থাপন করে, জঙ্গল পরিষ্কার করে, দুর্ভিক্ষের জন্য ধর্মগোলা গড়ে তোলে ইত্যাদি সর্বপ্রকারে গ্রাম্য সমাজের হিতে নিজের চেষ্টা নিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়, তারই ব্যবস্থা করা গিয়েছে। আমার প্রজাদের মধ্যে যারা মুসলমান তাদের মধ্যে বেশ কাজ অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু হিন্দু পল্লীতে বাধার অন্ত নেই।" (রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ. ২২৬)
তিনি লক্ষ্য করেছেন, জমিদারেরা সামস্ত প্রথার ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে দরিদ্র প্রজাসাধারণকে শোষণের মাধ্যমে আয় বাড়ানোকেই নিজ কর্তব্য মনে করেন। তারা খাজনা ও শুল্ককর আদায়, উচ্চসুদের ঋণ ইত্যাদি সূত্র ধরে কৃষকদের উদ্বৃত্ত ফসল লোপাট করে। তিনি তাঁর সেরেস্তার আমলাদের কর্তৃত্ব ও শোষণ কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে জন্য জমিদার হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রজাদের কাছে অনন্য এক প্রজাহিতৈষী ব্যক্তিত্ব। তিনি বিরাহিমপুর (শিলাইদহ) ও কালীগ্রাম (পতিসর)_ এ দুই পরগনায় কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি করে বিচার সভা স্থাপন করেন। প্রজাদের পরস্পরের মধ্যে কোনো বিবাদ দেখা দিলে তা নিয়ে উভয় পক্ষই এই বিচার সভায় আসত। কেবল ফৌজদারি ছাড়া অন্য কোনো রকম মামলা নিয়ে কৃষকেরা আদালতে যেতেন না। এমনকি বিচার সভার বিচারে অসন্তুষ্ট হলে আপিলেরও বিধান করা হয়। প্রজাদের সম্মতিক্রমে সমস্ত পরগনার জন্য পাঁচজন সভ্য নিয়ে একটি আপিল সভা নির্বাচন করা হয়েছিল।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কৃষকের সন্তানেরাই দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা এখনও অব্যাহত। তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সবার আগে প্রয়োজন সবচেয়ে বঞ্চিত অবহেলিত কৃষকসমাজের অধিকার নিশ্চিত করা। তাদের সম্মান দেওয়া। কেননা, কৃষকের ঘামঝরা উৎপাদন আমাদের জাতীয় উন্নতির ভিত্তি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান নিয়ামক। তাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বাধীনতা আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন আগের সব অর্জনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'সমাজের সচেষ্ট স্বাধীনতা অন্য সকল স্বাধীনতা হইতেই বড়ো।' (রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৬২৪)
বর্তমান সময়ে দেশে যে কল্যাণধর্মী ও কৃষকবান্ধব উন্নয়ননীতি কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, তা রবীন্দ্রচেতনারই প্রতিফলন। কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করা, দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অধিকতর সম্পৃক্ত করা এখন সময়ের দাবি। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। সেদিকে খেয়াল রেখেই বর্তমানে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে, যাতে সুবিধাবঞ্চিত দেশের এই সম্ভাবনাময় জনশক্তিকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা যায়। আধুনিক প্রযুক্তির যে আকাশছোঁয়া অগ্রগতি হয়েছে, তার সুফল কী করে কৃষকদের দোরগোড়ায় পেঁৗছানো যায়, সেই ভাবনাও চলছে। কৃষকদের ভূমির অধিকার, ঋণপ্রাপ্তির অধিকার, উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তানদের শিক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতকরণের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বর্গাচাষি ও প্রান্তিক কৃষকদের ঋণসেবাসহ আধুনিক ব্যাংকিং সেবা পেঁৗছানোর উদ্যোগ নিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কৃষকের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে যুগোপযোগী কৃষিনীতি।
ড. আতিউর রহমান : গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক
No comments