সরল গরল-বিচারক নিয়োগ স্থগিত রাখা দরকার by মিজানুর রহমান খান

দুই বিচারকের শপথ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মিছিল ও বিক্ষোভের ঘটনা আকস্মিক ছিল না। কদিন আগেই আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের পরিবেশ ভবিষ্যতে হুমকির সম্মুখীন হবে। সেদিন প্রধান বিচারপতি বিএনপির বিক্ষুব্ধ আইনজীবীদের ভিড় ঠেলে তাঁর খাসকামরায় গিয়েছিলেন।


এর আগে আমরা প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারতে দেখেছিলাম। তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার আর কোনো আশঙ্কা নেই, তেমনটা ভাবতে পারলে আমরা নির্ভাবনায় থাকতাম।
বিএনপির আমলে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে মিছিল, স্লোগান ইত্যাদি ঘটানোর পর বিচারপতি মো. আবদুল মতিন একটি রায় দিয়েছিলেন, যাতে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সেদিন সেই রায় আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের মোটেই পছন্দ হয়নি। তাঁরা ওই রায় বিএনপিপন্থী হিসেবে দেখেছিলেন। আমরা লিখেছিলাম, দিন আসছে, যখন এই রায় আওয়ামী লীগারদের পছন্দ হবে। গতকালও তেমন একটি দিন ছিল। বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির মামলায় চেম্বার জজের সিদ্ধান্তে খুশি হননি। তাই তাঁরা মিছিল করেছেন, যা নিন্দনীয়।
কিন্তু সমস্যা ও সংকট আজ আর শুধু এটুকুতে সীমাবদ্ধ নেই। এটা ইতিমধ্যে অনেক গভীর ও বিসৃ্তত। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, সংবিধান সমুন্নত রাখার স্বার্থে দুই বিচারপতিকে শপথ পড়ানো হয়েছে। ১৯৯৪ সালে আমরা দেখেছি, শপথ না পড়িয়ে সংবিধান সমুন্নত রাখা যায়। এখন দেখছি, শপথ পড়িয়েও সংবিধান সমুন্নত রাখা যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠিত হয়েছিল। ইতিহাসে এবারই প্রথম আমরা ছয়জন অতিরিক্ত বিচারককে কিছুটা উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেতে দেখি। কিন্তু তা-ও প্রশ্নমুক্ত ছিল না। দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়েছিলেন, এমন একজনও নিয়োগ পান। সেই কমিশনে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি হিসেবে সদস্য ছিলেন বর্তমান আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। আমরা আঁচ পাই, দু-একজন ছাড়া কারও মনোনয়নে তাঁর আপত্তি ছিল না। কিন্তু এখন আমরা দেখলাম, সেই ছয়জনের মধ্যে মাত্র দুজন বিচারক টিকলেন। কী মাপকাঠিতে চারজন বাদ পড়লেন, দুজন টিকলেন, তা স্বচ্ছ নয়। এ ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে হাওয়া বদলালে শুধু রায় বদলায় না, বিচারক নিয়োগও বদলে যায়। সে কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারের স্বাধীনতা—এসব প্রশ্নের তত্ত্ব-তালাশের আগে বিচারক নিয়োগ ও এর সংখ্যার দিকে নজর দিতে হবে। আমরা এখন বিচারকের সংখ্যায়ও বিচার, বিচারক ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা-অধীনতা খুঁজি।
জাতীয় সংসদে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে বিচারকের সংখ্যা ও প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করার আগ পর্যন্ত নিয়োগ স্থগিত থাকুক, যদিও আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা ১১তে উন্নীত করা হয়েছে। আমাদের দেখানো হয়েছে যে দীর্ঘদিন আপিল বিভাগে অনেকগুলো পদ শূন্য রাখলেও তাতে সমস্যা নেই! নিচের আদালতে প্রায় আট লাখ, আপিল বিভাগে পাঁচ হাজারের বেশি এবং হাইকোর্ট বিভাগে সোয়া তিন লাখের বেশি মামলা ঝুলে আছে। বিচার বিভাগ কিংবা আইন মন্ত্রণালয় দেশের স্বাধীনতার চার দশকে কখনো বিচারকের সংখ্যায় কী করে বিচারের স্বাধীনতা কিংবা মামলা নিষ্পত্তির প্রশ্ন সম্পর্কিত, সে ব্যাপারে কোনো ধারণা দেয়নি। কিন্তু আপনি যদি নীতিনির্ধারকদের প্রশ্ন করেন, বিচারকের সংখ্যা যে বড় বাড়াচ্ছেন, কেন? লাভ কী? কার লাভ? আপনি হয়তো তৈরি উত্তর পাবেন, জনগণ আমাদের সরকারে পাঠিয়েছে কী জন্য শুনি? দ্রুত বিচার দিতে নয় কি? তা বছর বছর মামলা বাড়ছে, বিচারক না বাড়ালে চলবে কেন? আপনি নির্ঘাৎ লা-জওয়াব হবেন।
আসুন, মূলের মূল থেকে দেখি অবস্থাটা কী? ৩ জুন ১৯৭২ মূল সংবিধানের একটি খসড়া হয়েছিল। এর ৯৮ অনুচ্ছেদে লেখা হলো, ‘সংসদ আইনের মাধ্যমে বৃহত্তর কোনো সংখ্যা নির্দিষ্ট না করা পর্যন্ত হাইকোর্টের বিচারকসংখ্যা কুড়িজনের বেশি হবে না।’ গোড়াতে সুপ্রিম কোর্ট নয়, হাইকোর্ট গঠনের একটা চিন্তা ছিল। সেই হাইকোর্টের জন্য একটি আপিল বিভাগ গঠন করা হয়েছিল। সেই আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা অনধিক তিন ও সর্বাধিক পাঁচ নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু এরপর যখন চূড়ান্তভাবে সুপ্রিম কোর্ট করা হলো, তখন ভুল করা হলো। বিচারকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হলো না। বর্তমানের নিয়ম হলো, ‘রাষ্ট্রপতি যেরূপসংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন বোধ করবেন, সেরূপসংখ্যক অন্যান্য বিচারক নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হবে।’ আমরা সভ্য হলে কথা উঠত না। এটা যত খুশি তত বিচারক নিয়োগের ছাড়পত্র ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা-ই ঘটেছে। শুধু তা-ই নয়, এখন প্রায় ‘ওলটপালট করে দে মা’-এর মতো একটা অবস্থা প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীরা যত খুশি তত বিচারক উপহার দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ভারত ও পাকিস্তানের উভয় সংবিধানে আইন দ্বারা বিচারকসংখ্যা নির্দিষ্ট করার বিধান বিদ্যমান আছে এবং সে অনুযায়ী দুটি দেশে সংসদে পাস করা আইন আছে।
সুপ্রিম কোর্টের ২০০৯ বার্ষিক রিপোর্টে দেওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আমরা একটি চকিত বিশ্লেষণ করেছি। এই লেখায় যেভাবে বিষয়টিকে তুলে ধরলাম, তা লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিবেদনের নয়। এটা একটু সরলীকরণ দোষে দুষ্ট হলেও যে ধারণা মিলবে, তা অগ্রাহ্য করা যাবে না।
১৯৭২-৭৫। বঙ্গবন্ধুর এই আমলে বিচারক ও মামলা নিষ্পত্তির অনুপাত ১:৪৫৫। হাইকোর্টের একজন বিচারক গড়ে বছরে ৪৫৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। এ সময় গড় বিচারক ১০.৫। এই চার বছরে গড় মামলা নিষ্পত্তি চার হাজার ৭৮০।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮১। এই ছয় বছরে গড় বিচারক প্রায় ১৭ জন। এ সময় গড় মামলা নিষ্পত্তি সাত হাজার ৩৮৭টি। অনুপাত হলো ১:৪৩৯। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০। এই আট বছরে বিচারকের গড় সংখ্যা ছিল ২৪। মামলা নিষ্পত্তির গড় চার হাজার ৬৯৩। অনুপাত হলো ১:১৯৫। আমরা দেখলাম, বিচারক বাড়ছে। কিন্তু তাঁদের হাতে মামলা নিষ্পত্তির গড় সংখ্যা কমছে।
নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর আমরা উচ্চ আদালতে গুরুগর্জনকর বিচারক-বৃদ্ধি দেখি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বিচারকের গড় সংখ্যা ছিল ৩১। এই পাঁচ বছরে মামলা নিষ্পত্তির গড় সাত হাজার ৮৩০। অনুপাত হলো ১:২৪৯। মুজিব আমলের চেয়ে বিচারক তিন গুণ বাড়ল, অথচ বিচারকদের কর্মক্ষমতা বাড়ল না। ১৯৯৬ থেকে ২০০০। এই পাঁচ বছরে বিচারকের গড় সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭। মামলা নিষ্পত্তির গড় ১২ হাজার ১০৪। অনুপাত হলো ১:৩২৯।
জোট সরকারের আমলে এল চরম নৈরাজ্য। অযোগ্যতা ও দলীয়করণের অভিযোগ উঠল। কিন্তু ইচ্ছামতো সংখ্যা বাড়াতে যে সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটে, সে কথা উচ্চকিত হলো না। ২০০১ থেকে ২০০৬। বিচারকের গড় সংখ্যা ৫৮। মামলা নিষ্পত্তি ১৭ হাজার ৪৫১। অনুপাত হলো ১:৩০১। মুজিব আমলে একজন বিচারক গড়ে ৪৫৫ মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। আর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সালে একজন বিচারক গড়ে ২৫০টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। মামলা নিষ্পত্তির গুণগত মান ধরলেও সত্তর ও আশির দশকের অবস্থা উন্নত।
১৯৭৭ সাল। জিয়ার আমল। হাইকোর্টের ১৮ জন বিচারক মামলা নিষ্পত্তি করেন আট হাজার ১৯৫টি। ১৯৯৪ সাল। খালেদা জিয়ার আমল। বিচারক দ্বিগুণের বেশি। ৩৮ জন বিচারক মামলা নিষ্পত্তি করেন মাত্র আট হাজার ৪০১টি। অন্য কথায়, ১৮ জনের কাজ করলেন ৩৮ জনে। এটা কর্মবিমুখতা, অদক্ষতা কিংবা মামলা ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিতবহ নয় কি?
বিশ্বায়ন ও একুশ শতকের পর্বে বিচার বিভাগের প্রস্তুতি দেখুন। ২০০০ সাল। ৪৩ জন বিচারক ১১ হাজার ৪৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। পরবর্তী ছয় বছরে বিচারকের সংখ্যা আবারও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। ৭১ জন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিন বর্ণিত ‘প্রলয়’পর্ব এটাই। এই ‘একাত্তুরে’ শাসনে ২০০৬ সালে ১৪ হাজারের কম মামলা নিষ্পত্তি হলো। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, মাত্র চার হাজার বেশি মামলা নিষ্পত্তির জন্য ২৮ জন বিচারক বাড়তি নিয়োগ দেওয়া হলো কেন? আওয়ামী লীগের (১৯৯৬ থেকে ২০০০) বিগত শাসনামলে ৪৩ জন বিচারক গড়ে বছরে ১২ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করেন। আর জোট সরকারের (২০০১ থেকে ২০০৬) আমলে ৭১ জন বিচারক বছরে গড় মামলা নিষ্পত্তি করেন ১৮ হাজারের কম। ১:৩২৯ বনাম ১:৩০১। বিচারক নিয়োগে এভাবে সংবিধানের শ্রাদ্ধকরণ চলছে। কেউ এদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
২০০৪ সালে হাইকোর্টের ৫৪ জন বিচারক ১৫ হাজার ৫৮১টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। পরের বছর বিচারকসংখ্যা ১৮ জন বেড়ে যায়। অথচ মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা বাড়ে মাত্র এক হাজার ৩১৩টি। ২০০৫ সালে ইতিহাসের সর্বোচ্চসংখ্যক (৭২) বিচারক হাইকোর্টে ছিলেন। অথচ ইতিহাসের সর্বোচ্চসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করেন ৫৫ জন বিচারক ২০০২ সালে। সে বছর মামলার সংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৪৮টি। সুতরাং আমরা দেখি, বিচারক বাড়িয়ে অমীমাংসিত (পেন্ডিং) মামলার রাশ টানা যায় না। যারা স্রেফ মামলাজট কমানোর দোহাই দিয়ে বিচারক নিয়োগ দিচ্ছেন, তাঁরা সন্দেহাতীতভাবে মিথ্যাচার করছেন।
ইদানীং শুনি, ২০ থেকে ২৫ জনের একটি তালিকা তৈরি হচ্ছে। হাইকোর্টে বিচারকের সংখ্যা আরও বাড়বে। আর এতে অন্য যা কিছুই ঘটুক না কেন, ‘সংবিধান সমুন্নত’ থাকবেই! জনগণকে হাইকোর্ট দেখিয়ে তাঁরা পার পাবেনই।
আপিল বিভাগের ‘ছয় শূন্য’ পদে নানা হিসাব-নিকাশজনিত নিয়োগ-প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে চলছে। স্বচ্ছতার কোনো সাড়াশব্দ আমরা পাই না। জল পড়ে কিন্তু পাতা নড়ে না। শুনেছি, সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন বিপাকে পড়েছিলেন। কারণ তিনি হঠাৎ বার্তা পেলেন যে আপিল বিভাগে চারজন বিচারক নেওয়া হবে। কারণ কী? এখানে কয়েক লাখ মামলা অমীমাংসিত রয়েছে! লিখিত চিঠিতে এ তথ্য জেনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হতবাক। কারণ, আপিল বিভাগে মামলা জমেছিল কয়েক লাখ নয়, কয়েক হাজার। যা হোক, সংখ্যাগত ‘ভ্রান্তি’ অপনোদন হলো। কিন্তু আমরা ঠিকই চারজন বাড়তি বিচারক পেলাম আপিল বিভাগে। বাংলাদেশের জন্ম-পরবর্তী প্রথম প্রজ্ঞাপন পেলাম। ৯ জুলাই ২০০৯ সালে তাতে লেখা হলো, আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা ‘সাত’ থেকে ১১তে উন্নীত করা হলো। সংসদের একটি আসন বাড়ুক, এ নিয়ে আমরা লঙ্কাকাণ্ড আশা করতে পারি। কিন্তু এখানে নিঃশব্দে চারটি স্থায়ী আসন সৃষ্টি হলো। ‘সাত’ সংখ্যাটি কোথা থেকে এল?
২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো আপিল বিভাগে সাতজন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। আপিল বিভাগে মামলা ঝুলে থাকার ক্ষেত্রে ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা চার ডিজিটে (৯৩৩০) সীমাবদ্ধ ছিল। সে বছরে প্রথম চার ডিজিট থেকে পাঁচ ডিজিটে উন্নীত হলো এবং তা পর পর দুই বছর টিকে থাকল। ১৯৯৯ সালে ১০ হাজার ৯২৯ এবং ২০০০ সালে ১১ হাজার ৮১৬। ১৯৯৮ সালে আপিল বিভাগে ঝুলে থাকা মামলা ছিল নয় হাজার ৩৩০। তখন পর্যন্ত এটিই ছিল রেকর্ড। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত আপিল বিভাগ মোটামুটি পাঁচ সদস্য দিয়ে চলেছে। শুরুতে ছিলেন তিনজন।
১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে আপিল বিভাগে চার হাজার থেকে চার হাজার আট শর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে পেন্ডিং মামলার সংখ্যা। ১৯৯৪ সালে এটা ছিল ছয় হাজার ৪৩৩। এরপর পেন্ডিং মামলা যেন ফোঁস করে ওঠে। ১৯৯৫ সালে সাত হাজার ৫১১। এরপর ১৯৯৬ সালে আট হাজার ৪১০, ১৯৯৭ সালে আট হাজার ৭৫১, ১৯৯৮ সালে নয় হাজার ৩৩০—এভাবে শুধু বাড়তেই থাকে। কিন্তু এখানে আমরা দেখব যে অস্বাভাবিক হারে মামলা বাড়লেও পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ তা কিন্তু সামাল দেন। তাঁরা কিন্তু ওই মামলা-তরঙ্গের হাল ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন।
২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে সাত সদস্যের আপিল বিভাগে মামলা পেন্ডিং থাকার গড় হার ছিল ছয় হাজার ৮৩৩টি। পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগের ১৯৯২-৯৪ পর্বে পেন্ডিং মামলার পরিসংখ্যান কিন্তু এমনই ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ ২০০০-২০০২ সালে যেখানে সাত হাজার ৭২৪টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন, সেখানে সাত সদস্যের আপিল বিভাগ ঠিক পরবর্তী তিন বছরে সাত হাজার ৬৪৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। অঙ্কের হিসাবে পাঁচজন বরং সাতজনের চেয়ে ৭৫টি মামলা বেশি নিষ্পত্তি করেছেন। তাহলে আমরা আপিল বিভাগে ১১ জন বিচারক চাইব কেন? আপিল বিভাগে বিচারকসংখ্যা বাড়ায় মামলা নিষ্পত্তিতে তা কী প্রভাব ফেলেছে, তা কিছুটা আঁচ করা যায়। ১১ জন একযোগে বছরজুড়ে কাজ করেননি। তবে পাঁচজন ১২ মাস, দুজন ১০ মাস, চারজন প্রায় ছয় মাস কাজ করেছেন। ২০০৯ সালে ১১ জন বিচারকের আপিল বিভাগে ছয় হাজার ৩৫টি মামলার নিষ্পত্তি ঘটে। এতে কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির আগের রেকর্ড ভাঙেনি।
বিচারকের সংখ্যা নির্দিষ্ট না করে বর্তমানে যেভাবে বিচারক নিয়োগ চলছে, তা সংবিধানের চেতনাবিরুদ্ধ। আমাদের সংবিধানের সম্ভ্রম গুরুতররূপে পর্যদুস্ত হচ্ছে। শপথপাঠের প্রশ্নে প্রধান বিচারপতির যুক্তি সেই আলোকে বিবেচনা করলে খুবই গৌণ হয়ে পড়ে। সংবিধানে বিধান আছে যে যদি কখনো অস্থায়ী ভিত্তিতে অল্প সময়ের জন্য বিচারক নিতে হয়, তাহলে তা নেওয়া যাবে। এমনকি কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মেয়াদেও নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমরা দেখি যে বেঞ্চ বা বার থেকে এ ধরনের কোনো দাবি তোলা হয় না। বিএনপি-সমর্থিত বার বিচারাঙ্গনে ভাঙচুর বা বিশৃঙ্খলা করতে পারে। বড় ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু তারা তাই বলে সংখ্যা নির্দিষ্ট করার কথা বলে হয়তো নিজেদের ও দলের পায়ে কুড়াল মারবে না! একটা কথা বলে রাখি, বিচারকের আসন ও সংসদের আসন অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক হয়ে উঠছে। দলবাজির সংস্কৃতিতে বিচারকের আসন কখনো মুলো হিসেবে ঝোলানো হচ্ছে। দলের হয়ে অযাচিত উত্তেজনা সৃষ্টি কিংবা বিচারালয়ের দরজায় লাথি মারতে অনেকের অন্যতম লক্ষ্য থাকে টিকিট সংগ্রহ—সংসদে কিংবা বিচারের আসনে। প্রহসনের সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিকেও আমরা বিচারক হতে দেখি। গত নির্বাচনে আসন দেওয়া যায়নি, এখন এই আসন দেওয়া হলো—পুষিয়ে দেওয়া আর কি।
বছরে প্রায় ৫০ হাজার নতুন মামলা ঢুকছে। কিন্তু সেই তুলনায় নিষ্পত্তির হাল কী, সেই চিত্র তো আমরা দেখলাম। ২০০৯ সালে ৭৮ জন বিচারক গড়ে মাথাপিছু মাত্র ২৭৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। এর পরও সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম বার্ষিক প্রতিবেদনে ‘মামলাসংখ্যার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যাস্বল্পতার’ জন্য আক্ষেপ করেন। এমনকি তিনি অসুবিধা সত্ত্বেও অর্জিত ‘অগ্রগতিতে’ সন্তুষ্ট হয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগে এখন অমীমাংসিত আছে তিন লাখ ২৫ হাজার মামলা। ২০০৯ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে ২১ হাজার ৫০০। গত ১০ বছরে গড় মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির হার যথাক্রমে ৪২ হাজার ২৭২ এবং ১৭ হাজার ৫৪৮। তাহলে বর্তমানের ঝুলন্ত তিন লাখ ২৫ হাজার মামলার মীমাংসা আমরা কত দিনে আশা করব? ৭৮ জন বিচারক যদি আর কোনো কাজ না করে শুধু পেন্ডিং মামলার সুরাহা দেন, তাহলে তাঁদের সময় লাগার কথা কমপক্ষে ১৮ বছর। তবে এই সময়ে নতুন মামলা সাড়ে সাত লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আর এটা হবে তাঁদের জন্য প্রায় ৪০ বছরের কাজ।
মামলার অনুপাতে বিচারক বাড়ানো তাই একটা মস্ত গোলকধাঁধা। হে প্রভু! আমরা অন্ধকারে আছি। দিশা দাও। বিচারকের আসনকে অনেক সময় বিধাতার আসনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়েও ইদানীং নানামুখী অনভিপ্রেত তদবিরের কথা শুনি। মন্ত্রীর বাড়িতে রাত্রিকালীন সভার যেকোনো অনুশীলন অশনিসংকেত। মধ্যরাতে নাজমুল হুদার বাড়িতে বিচারকদের সমাবেশের পরিণতি আমরা কি দ্রুত ভুলছি? পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট গত মাসে ঠিক করেছেন, বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ার প্রার্থীদের শুনানি সংসদীয় কমিটিতে হবে। এর বিবরণ পুরোটাই লেখা হবে কিন্তু তা গোপন থাকবে। আমরাও তেমন একটা ব্যবস্থা চাই। সেখানে প্রশ্ন উঠবে, ‘আচ্ছা। মিথ্যা মামলায় খুনের আসামি হলে ক্ষতি নেই। তবে বলুন তো, একই দলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে আপনারই আবেদন আগের মেয়াদে নাকচ করল। এখন গ্রহণ করল কেন? মিথ্যা মামলার কত রং?’ বিচারকপ্রার্থী সেখানে সদুত্তর দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এরই নাম স্বচ্ছতা।
আগে বিচারকদের উপযুক্ত পদ সৃষ্টি করুন। সে পর্যন্ত নিয়োগ সাময়িক স্থগিত থাকুক। সুষ্ঠু মামলা ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবনের আগ পর্যন্ত বিচারক বাড়াতে পরামর্শ নয়। যাঁরা প্রকৃতই অযোগ্য ও অদক্ষ, আগে তাঁদের বিদায়ের ব্যবস্থা নিন। সংখ্যা বাড়িয়ে ‘বিএনপিপন্থীদের’ সংখ্যালঘু করার কোনো চেষ্টা মানে ‘কাচের ঘরে’ প্রকাণ্ড ঢিল ছোড়ায় লিপ্ত হওয়া।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.