আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৮১)-'আবার আসিব ফিরে ...' by আলী যাকের
প্রতিটি দিন পার হচ্ছিল, বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছিল। কিন্তু আমরা সব কিছু জেনেই অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম। কেবলই দেশের কথা মনে আসত। মনে আসত দেশের মাটি, শস্য ভরা মাঠ, নিশ্ছিদ্র বন আর মানুষের মুখ। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ত।
আবার গা-ঝাড়া দিয়ে নিজ নিজ কাজে আত্মনিয়োগ করতাম। অবাক লাগে, দেশ যখন ছেড়েছি তখন এ মনোভাব নিয়ে ছেড়েছি যে এই পরাধীন দেশে আর নয়। যেখানেই যাই না কেন, রাস্তায় ভিক্ষা করেও যদি জীবন চালাতে হয়, তা-ই করব; কিন্তু পরাধীন দেশে আর ফিরে যাব না। তখনো জানতাম না যে নিরস্ত্র বাঙালি কোনো দিন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবে, দেশকে মুক্ত করবে। এখন ধুন্ধুমার যুদ্ধ চলছে। মনে হচ্ছে দেশ একদিন মুক্ত হবেই। এখন উতলা হচ্ছি কেন? মানুষের মন বোধ হয় এ রকমই। আমরা সব সময় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, তারপর আর বিলম্ব সহ্য হয় না। আমার মনের অবস্থা এ রকম হলেই আমি কবির ভাইয়ের কাছ থেকে একটা অ্যাসাইনমেন্টের অনুমোদন নিয়ে বেরিয়ে পড়ি সীমান্তের উদ্দেশে। যেখানেই যত দূর আমাদের দেশকে মুক্ত করছেন মুক্তিযোদ্ধারা, তত দূর পর্যন্ত চষে ফেলি সর্বত্র। এমনও দিন গেছে, যখন আমি আমার অ্যাসাইনমেন্টের কথা দিব্যি ভুলে গেছি। বাংলাদেশের কোনো বৃক্ষের নিচে সবুজ ঘাসের ওপর চিতপাত শুয়ে থেকে কী এক নেশায় বুঁদ হয়ে গেছি। ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময় নানা গ্রামে পরিত্যক্ত বাড়িঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। এর মধ্যে বেশির ভাগই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছে। সামান্য দু-একটি মাথা উঁচু করে আছে এখনো। দরজা-জানালা নেই কোথাও। বুঝেছি, এসব বাড়িঘরের সব মানুষ হয় কোথাও পালিয়েছে, নয় তো বুলেটের শিকার হয়েছে। আমি আবার আবেগাহত হয়ে বাড়ির ভেতরে এদিক-ওদিক খুঁজেছি কোনো একটি আসবাব অথবা ক্ষুদ্র কোনো নিদর্শন, যাতে ওই সব বাড়িতে যারা থাকত, তাদের সম্পর্কে কিছু জানতে পারি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ মনোরথ হয়েছি। আবার মাঝেমধ্যে খুঁজে পেয়েছি একটা ছোট্ট পিতলের ঘটি কিংবা একপাটি খড়ম। একবার খুঁজে পেয়েছিলাম একটা বাচ্চা মেয়ের পরিত্যক্ত খেলার পুতুল। মনের ভেতরটা হু হু করে উঠেছিল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেছি, জীবনানন্দ দাশের কবিতার সেই অমোঘ কথাগুলো, 'আবার আসিব ফিরে ... এই বাংলায় ...।'
সাতক্ষীরা ছিল ৯ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত। এখানেই আমি খবর সংগ্রহের জন্য ঘুরতে ঘুরতে বালিয়াডাঙ্গার বিলের তীরে এসে উপস্থিত হই। আমার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও)। তিনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন না। আমিও জানতাম না তাঁর কথা। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, তিনি ওই ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর মাহবুবের অধীনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই আমাকে বললেন, এক প্রচণ্ড যুদ্ধের শেষে মাহবুব যখন একটু মাথা উঁচু করেছে, শত্রুপক্ষের একটা গুলি তার বুকের একপাশ দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাঁরা সবাই চেষ্টা করেন পরনের কাপড় ইত্যাদি দিয়ে সেই রক্ত ঠেকানোর। কিন্তু রক্ত যেন বাঁধ মানছিল না। যুদ্ধ আরো তীব্র হলো। হঠাৎ একসময় দেখা গেল, আহত মাহবুব তাঁদের পাশে নেই। মাহবুব তখন লক্ষ করেছিল, তাঁর শুশ্রূষা করতে গিয়ে তাঁর সহযোদ্ধাদের মনোযোগ যুদ্ধ থেকে সরে যাচ্ছিল। সে জন্য তিনি বাংকার থেকে কোনোমতে ওপরে উঠে গড়িয়ে গড়িয়ে বালিয়াডাঙ্গার বিলের মধ্যে পড়ে যান। তখন বেশ হাওয়া ছিল সেই এলাকায়। মাহবুব শুরুতে পা দিয়ে পানিতে সাঁতরানোর চেষ্টা করেন, তারপর কোনো একসময় অত্যধিক রক্তক্ষরণের জন্য এবং ক্লান্তিতে তাঁর তন্দ্রা এসে যায়। সে অবস্থায় কতক্ষণ তিনি পানিতে ভেসে ছিলেন, জানেন না। তাঁর ভাগ্য ভালো যে ওই সময় বাতাসের ধাক্কায় তাঁর ভাসমান দেহ আস্তে আস্তে অনেক দূরে গিয়ে কোনো একটি ডাঙ্গায় থিতু হয়। তাঁর তন্দ্রা যখন ভাঙে, তখন রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক দিন। পাশের গ্রামের লোকজন তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বালিয়াডাঙ্গা বিলের কোনো এক তীরে আধমরা অবস্থায় শুয়ে আছেন। অধিক রক্তক্ষরণের জন্য তাঁর সারা দেহ ফ্যাকাসে। ওই গ্রামবাসীই তাঁকে কাছের মুক্তিবাহিনীর ছাউনিতে নিয়ে যায়। সেখানে নানা রকম শুশ্রূষা দেওয়ার পর মাহবুব বেঁচে ওঠে।
আমার যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা ছিল এ ধরনের সংবাদ সম্পর্কে জানা। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমি আমার বরাদ্দকৃত কাজ নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে সব খবর লিখে রাখতে পারিনি। না হলে কেবল এই অবিস্মরণীয় ঘটনাগুলো নিয়েই একটি গ্রন্থ রচনা করা যেত।
'স্যার, চলেন যাওয়া যাক।' ভাবনার কোন অতলে তলিয়ে গিয়েছিলাম জানি না। অকস্মাৎ আমার পাশে দাঁড়ানো জেসিওর এ কথায় মোহভঙ্গ হলো। তাকিয়ে দেখলাম পশ্চিম দিকে সূর্য অস্তগামী। আকাশ একেবারে লাল হয়ে এসেছে। আমি তাঁর দিকে ফিরে বললাম, 'চলুন, ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া যাক।'
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সাতক্ষীরা ছিল ৯ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত। এখানেই আমি খবর সংগ্রহের জন্য ঘুরতে ঘুরতে বালিয়াডাঙ্গার বিলের তীরে এসে উপস্থিত হই। আমার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও)। তিনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন না। আমিও জানতাম না তাঁর কথা। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, তিনি ওই ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর মাহবুবের অধীনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই আমাকে বললেন, এক প্রচণ্ড যুদ্ধের শেষে মাহবুব যখন একটু মাথা উঁচু করেছে, শত্রুপক্ষের একটা গুলি তার বুকের একপাশ দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাঁরা সবাই চেষ্টা করেন পরনের কাপড় ইত্যাদি দিয়ে সেই রক্ত ঠেকানোর। কিন্তু রক্ত যেন বাঁধ মানছিল না। যুদ্ধ আরো তীব্র হলো। হঠাৎ একসময় দেখা গেল, আহত মাহবুব তাঁদের পাশে নেই। মাহবুব তখন লক্ষ করেছিল, তাঁর শুশ্রূষা করতে গিয়ে তাঁর সহযোদ্ধাদের মনোযোগ যুদ্ধ থেকে সরে যাচ্ছিল। সে জন্য তিনি বাংকার থেকে কোনোমতে ওপরে উঠে গড়িয়ে গড়িয়ে বালিয়াডাঙ্গার বিলের মধ্যে পড়ে যান। তখন বেশ হাওয়া ছিল সেই এলাকায়। মাহবুব শুরুতে পা দিয়ে পানিতে সাঁতরানোর চেষ্টা করেন, তারপর কোনো একসময় অত্যধিক রক্তক্ষরণের জন্য এবং ক্লান্তিতে তাঁর তন্দ্রা এসে যায়। সে অবস্থায় কতক্ষণ তিনি পানিতে ভেসে ছিলেন, জানেন না। তাঁর ভাগ্য ভালো যে ওই সময় বাতাসের ধাক্কায় তাঁর ভাসমান দেহ আস্তে আস্তে অনেক দূরে গিয়ে কোনো একটি ডাঙ্গায় থিতু হয়। তাঁর তন্দ্রা যখন ভাঙে, তখন রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক দিন। পাশের গ্রামের লোকজন তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বালিয়াডাঙ্গা বিলের কোনো এক তীরে আধমরা অবস্থায় শুয়ে আছেন। অধিক রক্তক্ষরণের জন্য তাঁর সারা দেহ ফ্যাকাসে। ওই গ্রামবাসীই তাঁকে কাছের মুক্তিবাহিনীর ছাউনিতে নিয়ে যায়। সেখানে নানা রকম শুশ্রূষা দেওয়ার পর মাহবুব বেঁচে ওঠে।
আমার যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা ছিল এ ধরনের সংবাদ সম্পর্কে জানা। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমি আমার বরাদ্দকৃত কাজ নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে সব খবর লিখে রাখতে পারিনি। না হলে কেবল এই অবিস্মরণীয় ঘটনাগুলো নিয়েই একটি গ্রন্থ রচনা করা যেত।
'স্যার, চলেন যাওয়া যাক।' ভাবনার কোন অতলে তলিয়ে গিয়েছিলাম জানি না। অকস্মাৎ আমার পাশে দাঁড়ানো জেসিওর এ কথায় মোহভঙ্গ হলো। তাকিয়ে দেখলাম পশ্চিম দিকে সূর্য অস্তগামী। আকাশ একেবারে লাল হয়ে এসেছে। আমি তাঁর দিকে ফিরে বললাম, 'চলুন, ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া যাক।'
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments