খোলা চোখে-ওবামা এবার কী করবেন? by হাসান ফেরদৌস
‘শেলাকিং’ শব্দটির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। প্রেসিডেন্ট ওবামার বদৌলতে এবার হয়েছে। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে আচ্ছা মারের পর হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী, সে কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ওবামা বলেন, এই পরাজয় ডেমোক্র্যাটদের জন্য ‘শেলাকিং’। সে কথা শুনে ঘরভর্তি লোক হেসে ওঠেন।
তাঁদের সঙ্গে ওবামাও হাসলেন, তবে তাকে হাসি না বলে কান্না ঢাকার চেষ্টা বলাই অধিক সংগত হবে।
অভিধান হাতড়ে জানলাম, ‘শেলাকিং’ শব্দটির দুটি অর্থ—চূড়ান্ত পরাজয় ও বেধড়ক মার। ওবামা সম্ভবত উভয় অর্থেই শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন। এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা যে হারবে, সে কথা আমাদের জানা ছিল, কিন্তু তাই বলে এমন গো-হারা, তা বোধহয় ভাবিনি। প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটরা খুইয়েছে কম করে হলেও ৭৭টি আসন। কম করে বলছি এই কারণে যে, এখনো কয়েকটি আসনের চূড়ান্ত ফল ঘোষিত হয়নি। গত সত্তর বছরের ইতিহাসে এমন বিপুল ব্যবধানে প্রতিনিধি পরিষদে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়নি। ক্ষমতার হাতবদলের ফলে স্পিকারের দায়িত্ব পেতে চলেছেন জন বেইনার, যাঁকে ওবামা নির্বাচনের আগে নাম ধরে ‘শত্রু’ বলেছিলেন। অন্যদিকে সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা তাদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারলেও ছয় বা তার চেয়ে বেশি সদস্য তারা হারিয়েছে। যদি সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে রিপাবলিকানরা সিনেটও কবজা করতে পারত। মিচ ম্যাকনেল, অল্পের জন্য সিনেটে যাঁর নেতা হওয়া হলো না, সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামা বা তাঁর কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা তিনি করবেন না। তাঁরা যদি রিপাবলিকান এজেন্ডায় সমর্থন করেন, শুধু তাহলেই কথা এগোবে, অন্যথায় নয়।
মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হেরে থাকে, এ কোনো নতুন কথা নয়। দেশ যেমনই চলুক, দেশের মানুষ কখনোই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় না। মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোট থেকে বোঝা যায়, তাদের অসন্তোষের বা রুদ্ররোষের মাত্রা কী। নির্বাচনী গণতন্ত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’। সেই রুদ্ররোষেরই শিকার ডেমোক্র্যাটরা। লক্ষ করে থাকবেন, আমি বরাবরই ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়ের কথা বলেছি, রিপাবলিকানদের জয়ের কথা বলিনি একবারও। বস্তুত এবারে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছে—ডেমোক্র্যাটরা হেরেছে, আর তার ফায়দা পেয়েছে রিপাবলিকান পার্টি। দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি এখনো সম্মানিত নয়, তাদের গণসমর্থন ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় এখনো কম। তার পরও যে তাদের জয় হয়েছে, তার কারণ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ সমর্থন করে এমন ভোটাররা এবার হয় ভোট দিতে যাননি, বা গেলেও নিজ দলের পক্ষে ভোট দেননি। ২০০৮ সালে ওবামা ও তাঁর দল জিতেছিল মূলত তরুণ, সংখ্যালঘু ও স্বতন্ত্র ভোটারদের সমর্থনে। এবারের নির্বাচনে এই তিন ধরনের ভোটারই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ২০০৮ সালের তুলনায় এবার ভোট দিতে যাননি এমন লোকের সংখ্যা সাড়ে চার কোটি, তাঁদের অধিকাংশই সাবেক ওবামা-ভোটার।
কিন্তু কেন?
প্রথম ও প্রধান কারণ অর্থনীতি। আমেরিকার অর্থনীতি এখন হাঁটুভাঙা দ-এর মতো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, হাতে একখানা লাঠি। ওই লাঠিখানা টেনে নিলে, অর্থাৎ সরকারি নগদ সাহায্য বাদ দিলে সে নির্ঘাত মুখ থুবড়ে পড়বে। দেশের প্রতি ১০ জনের একজন যদি কর্মহীন হয়, তাহলে কমবেশি সবাই তার কুফল ভোগ করতে বাধ্য। অর্থনীতির এই অবস্থার জন্য যদিও দোষ ওবামার নয়, তবু সবাই বলছে, অর্থনীতিকে সচল করতে যা যা করা দরকার, ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা তা করেনি। ২৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ‘স্টিমুলাস’ হিসেবে ঢালা হয়েছে বটে, কিন্তু এর কোনোটাই স্থায়ী চাকরি সৃষ্টির কাজে বিনিয়োগ করা হয়নি। এই করেছি, সেই করেছি বললে কী হবে, ফলে তো তার পরিচয় নেই।
ওবামাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট সবাই। ডান, বাম ও মাঝের এক ক্রমবর্ধমান অংশ বলছে, ওবামার অনুসৃত নীতির ফলে দেশ কাদা মাড়িয়ে উঠতে পারছে না। রক্ষণশীল রিপাবলিকান ও স্বতন্ত্র নাগরিকদের অধিকাংশই মনে করে, ওবামা প্রশাসন সরকারের আয়তন বাড়িয়েছে, লাগামছাড়া খরচ করছে এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো শুরু করেছে। মন্দাবস্থা ঠেকানোর নামে এই সরকার যে দেদার টাকা ঢালছে, তার ফলে মাথাপিছু ঋণ ও বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে, দেশের মানুষের প্রকৃত আয়ও কমে আসছে। এমন চলতে থাকলে খুব শিগগির আমেরিকা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে পরিণত হবে। স্বাস্থ্যবিমার নামে যে আইন পাস হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, প্রতিটি নাগরিককে স্বাস্থ্যবিমা কিনতে হবে, না হলে অর্থদণ্ড। ফলে নাগরিক জীবনে সরকারের ভূমিকা বিস্তৃত হবে, যা তাদের মোটেই কাম্য নয়। বহিরাগতদের ভিড়ে দেশ উপচে পড়ছে, অথচ ওবামা প্রশাসন এ নিয়ে কিছুই করছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যকে সমর্থন না জানালে চাকরি সৃষ্টি হবে না, অথচ ওবামা তাদের জন্য নতুন কর রেয়াতিতে আগ্রহী নন। এসব অসন্তোষকে ঘিরে গড়ে উঠেছে তথাকথিত টি-পার্টি আন্দোলন (টিইএ পার্টি—যারা বলছে, ট্যাক্স এনাফ অলরেডি।) ওবামার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ তুলেছেন এই আন্দোলনের সমর্থকেরাই। প্রধানত শ্বেতকায়, চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষদের নিয়ে গঠিত এই আন্দোলন শ্বেত আধিপত্য হারানোর সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন। আর সে জন্য তাদের সবচেয়ে বেশি রাগ বারাক হোসেন ওবামা নামের এই কালো মানুষটির ওপর।
অন্যদিকে উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটরা ওবামাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধিতে নয়, উল্টো সরকার যথেষ্ট করছে না বলে। স্টিমুলাসের নামে যে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা পরিমাণে এত অল্প যে, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত হয়নি। যে স্বাস্থ্যবিমা হয়েছে, তাও খুব দুর্বল। এতে একটি ‘পাবলিক অপশন’ অর্থাৎ গ্রেট ব্রিটেনের মতো সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে অধিকাংশ ডেমোক্র্যাট, অথচ সে প্রশ্নে রিপাবলিকানদের সঙ্গে যথেষ্ট দৃঢ়তার সঙ্গে দরকষাকষি করেননি ওবামা। ওয়াল স্ট্রিট অর্থাৎ আমেরিকান ব্যাংক ও অর্থব্যবস্থা সংস্কারের নামে একটি আইন হয়েছে বটে, কিন্তু সে আইনে না আছে নখ, না আছে দাঁত। জলবায়ুর উষ্ণতা উদারনৈতিকদের জন্য একটি অগ্রাধিকার, অথচ ওবামা প্রশাসন এ নিয়ে যুদ্ধে নামার আগেই হার মেনে বসে আছে। সমকামীদের সমানাধিকার নিয়েও ওবামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা ছাড়া এ নিয়ে কিছুই করেননি।
ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের বিপক্ষে এবার এক বড় অস্ত্র ছিল টাকার খেলা। এ বছর সুপ্রিম কোর্টের নেওয়া এক সিদ্ধান্তের ফলে দেশি বা বিদেশি যেকোনো করপোরেশন যত খুশি অর্থ নির্বাচনী প্রচারণায় ঢালতে পারে, এ জন্য তাদের নামধামও প্রকাশ করতে হবে না। ওয়াল স্ট্রিট নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ওবামা, তা ব্যাংক বা করপোরেশনগুলোর ভালো লাগেনি। ফলে হাতের মুঠি খুলে তারা রিপাবলিকানদের পক্ষে চাঁদা দিয়েছে।
রিপাবলিকানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজের চেষ্টাতেও হাত পুড়িয়েছেন ওবামা। রিপাবলিকানদের দলে টানতে গিয়ে নিজ দলের ‘কোর’ সমর্থকদের হারিয়েছেন তিনি। এই ব্যর্থতা ওবামার নিজের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি আশ্চর্য দক্ষতায় নিজের সমর্থনে এক বিশাল ‘কোয়ালিশন’ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। নতুন তথ্যপ্রযুক্তি, বিশেষত ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ ও যুবকদের নিজ ছাতার নিচে এনেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সে জোট তিনি ধরে রাখতে পারেননি। এমনকি মহিলারা, যাঁরা বরাবরই ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক, এবার তাঁরাও ওবামাকে ছেড়ে গেছেন। তাঁদের ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিকভাবে তাঁকে যতটা যুক্ত থাকা দরকার ছিল, ওবামা বা তাঁর দল তা থাকেনি।
মজার ব্যাপার হলো, গত দুই বছরে ওবামা যে একেবারে কিছুই করেননি, তা নয়। বস্তুত কোনো কোনো ভাষ্যকারের বিবেচনায়, ওবামা ও ডেমোক্রেটিক নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস মাত্র দুই বছরে যা করেছে, অনেক প্রেসিডেন্ট তাঁর পুরো মেয়াদেও তা করতে সক্ষম হননি। স্বাস্থ্যবিমা আইনের কথাই ধরুন। একটা অর্থপূর্ণ স্বাস্থ্যবিমার জন্য কার্যত ৭০ বছর ধরে চেষ্টা চলছে। বিপক্ষ দলের প্রতিরোধের মুখে কোনো প্রেসিডেন্টই এগোতে পারেননি। উদারনৈতিকেরা যা যা চেয়েছিলেন, এই আইনে হয়তো তার সব অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কিন্তু তার পরও যা হয়েছে, তাও খুব কম নয়। প্রায় চার কোটি অতিরিক্ত মানুষ এর ফলে এই প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আসবে। ২৬ বছর বয়সের কম, এমন সন্তানেরা বাবা-মায়ের বিমার আওতায় সুবিধা ভোগ করবেন। পুরোনো অসুখ, এই যুক্তিতে এখন থেকে কারও স্বাস্থ্যবিমা বাতিল করা যাবে না।
অর্থ খাতে নতুন নিয়ন্ত্রণ অবস্থার আরোপ ওবামার আরেক উল্লেখযোগ্য অর্জন। অর্থবাজারের ওপর, বিশেষ করে গৃহঋণ খাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়াই এবারের মন্দাবস্থার কারণ। রিগান থেকে জর্জ বুশ গত ৩০ বছরে ‘ডি রেগুলেশন’-এর নামে যে অপকর্ম করেছেন, ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা তাতে রাশ টেনে ধরেছেন। তাঁরা নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন, ভোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন আইন বানিয়েছেন, অর্থ সংস্থাগুলোর ওপর নজরদারির ব্যবস্থা করেছেন। যেমন—এখন থেকে ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো চাইলেই যখন-তখন সুদের হার বাড়াতে পারবে না বা নতুন কোনো সার্ভিস চার্জ আরোপ করতে পারবে না। ভোক্তা বাজার নিয়ন্ত্রণ ও তার ওপর খবরদারির জন্য একটি নতুন ফেডারেল এজেন্সিও গঠিত হয়েছে। হতে পারে, উদারনৈতিকেরা যা যা চেয়েছিল, যেমন যেমন চেয়েছিল এসব আইনে তার সবকিছু নেই। কিন্তু তার পরও অর্থ ও ঋণবাজার নিয়ন্ত্রণে এবং ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় ওবামা ও ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, তা মানতেই হবে।
একই কথা বলা যায় অর্থনীতি প্রশ্নে। ব্যাংক ও অর্থ সংস্থার আশু বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারি অর্থের জোগান দিয়ে যে ত্বরিত ব্যবস্থা ওবামা নেন, তাতে কমবেশি কাজ হয়েছে। সে ব্যবস্থা না নিলে আমেরিকা, আমেরিকা কেন, পুরো বিশ্ব অর্থনীতিই দীর্ঘমেয়াদি মন্দাবস্থার কবলে পড়ত। ওবামা প্রশাসন হস্তক্ষেপ না করলে আমেরিকার মোটর কোম্পানিগুলোরও লালবাতি জ্বলা নিশ্চিত ছিল। শুধু সেসব কোম্পানিই দেউলিয়া হতো না, সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মার্কিনের চাকরি যেত, সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পেনশন। স্টিমুলাসের ফলে কম করে হলেও ৩০ লাখ লোকের অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। সমস্যা হলো, ওবামা বা তাঁর দল কেউই এসব পদক্ষেপের সুফল স্পষ্টভাবে দেশের মানুষকে বুঝিয়ে বলতে পারেনি। ওবামা প্রশাসন যে এ দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য আয়কর রেয়াতির ব্যবস্থা করেছে, সে কথাটা পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ জানে না। ব্যাংকগুলো কোটি কোটি ডলার ধার দেওয়ায় রক্ষণশীলেরা ক্ষিপ্ত হয়েছেন, অথচ এর ফলে ব্যাংকি সেক্টর শুধু যে টিকে গেল, তা-ই নয়, ধার নেওয়া টাকা সুদে-আসলে ইতিমধ্যে ফেরতও দিয়ে দিয়েছে। একজন ভাষ্যকার পরিহাস করে বলেছেন, ওবামা পুঁজিবাদের পতন ঠেকিয়েছেন বটে, কিন্তু নিজের বা নিজ দলের ভরাডুবি ঠেকাতে পারলেন না।
আগামী দুই বছর ওবামার জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে। রিপাবলিকানরা রক্তের স্বাদ পেয়েছে, ওবামাকে ছিঁড়ে খুবলে না শেষ করা পর্যন্ত তারা থামবে না। সিনেটে রিপাবলিকানদের এক নম্বর নেতা মিচ ম্যাকনেল জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে জেতা ঠেকানো হলো তাঁদের এক নম্বর লক্ষ্য। ফলে এ কথা নিশ্চিত যে, কংগ্রেসের ভেতর রিপাবলিকানদের তরফ থেকে কোনো সহযোগিতা তিনি পাবেন না। তার মানে সেখানে কোনো অর্থপূর্ণ কাজই হবে না। এদিকে ওবামার নিজের দলের ভেতরেও অন্তঃকলহ শুরু হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবির জন্য তাঁদের কেউ কেউ প্রেসিডেন্টের নাম ধরেই অভিযোগ করা শুরু করেছেন। তাঁদের দাবি, দলের নেতা হলেও দলকে সংগঠিত করতে পারেননি ওবামা। পরিকল্পিত নির্বাচনী অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারেননি তিনি। কোন আসন ধরে রাখা যাবে, কোনটা যাবে না—সে হিসাবে তাঁদের মস্ত ভুল ছিল। যেখানে ওবামার সমর্থন ছিল জরুরি, সেখানে সময়মতো সাহায্য দিতে পারেননি তিনি। যেমন— পেনসিলভানিয়ার কংগ্রেসওম্যান ক্যাথি ডালকেম্পার নিজের জন্য বিপজ্জনক জেনেও ওবামার স্বাস্থ্যবিমার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ওবামা তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় একবারের জন্য আসেননি। ডালকেম্পার যথারীতি নির্বাচনে হেরেছেন। কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সঙ্গেও তাঁর বনিবনা হয়নি। তাঁদের কথা শুনে কখনো কখনো এমন মনে হয়েছে, এই দুজন বুঝি দুই ভিন্ন ভিন্ন দলের।
এককথায় কোনো ভুল নেই, আগামী দুই বছর ওবামাকে আগুনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। রিপাবলিকান নেতৃত্ব গোড়া থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা ওবামার কোনো ব্যাপারেই সমর্থন জোগাবে না। তাদের এই নীতি সফল হয়েছে। আগামী বছর নতুন জন গণনার ভিত্তিতে নির্বাচনের জেলাওয়ারি তালিকা তৈরি হবে। সে তালিকা তৈরির দায়িত্বে থাকবেন অঙ্গরাজ্যগুলোর গভর্নররা। মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর দেশের অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে এখন রিপাবলিকানদের আধিপত্য। তাঁরা ভোটের নতুন যে ছক কাটবেন, তার ফলে কম করে হলেও ১০টি আসন ডেমোক্র্যাটদের হাতছাড়া হবে। অন্য কথায়, আগামী নির্বাচনের আগেই ডজন খানেক আসন খুইয়ে বসে আছেন ওবামা ও তাঁর দল।
কী করবেন ওবামা? কোথায় হাত বাড়াবেন সমর্থনের জন্য? এর উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে এটুকু বলা যায়, তাঁর চলার রাস্তায় এখন কোনো শুকনো বাসি ফুলও আর অবশিষ্ট নেই। সেখানে কেবলই কাঁটা।
নিউইয়র্ক, ৯ নভেম্বর ২০১০
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
অভিধান হাতড়ে জানলাম, ‘শেলাকিং’ শব্দটির দুটি অর্থ—চূড়ান্ত পরাজয় ও বেধড়ক মার। ওবামা সম্ভবত উভয় অর্থেই শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন। এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা যে হারবে, সে কথা আমাদের জানা ছিল, কিন্তু তাই বলে এমন গো-হারা, তা বোধহয় ভাবিনি। প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটরা খুইয়েছে কম করে হলেও ৭৭টি আসন। কম করে বলছি এই কারণে যে, এখনো কয়েকটি আসনের চূড়ান্ত ফল ঘোষিত হয়নি। গত সত্তর বছরের ইতিহাসে এমন বিপুল ব্যবধানে প্রতিনিধি পরিষদে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়নি। ক্ষমতার হাতবদলের ফলে স্পিকারের দায়িত্ব পেতে চলেছেন জন বেইনার, যাঁকে ওবামা নির্বাচনের আগে নাম ধরে ‘শত্রু’ বলেছিলেন। অন্যদিকে সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা তাদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারলেও ছয় বা তার চেয়ে বেশি সদস্য তারা হারিয়েছে। যদি সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে রিপাবলিকানরা সিনেটও কবজা করতে পারত। মিচ ম্যাকনেল, অল্পের জন্য সিনেটে যাঁর নেতা হওয়া হলো না, সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামা বা তাঁর কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা তিনি করবেন না। তাঁরা যদি রিপাবলিকান এজেন্ডায় সমর্থন করেন, শুধু তাহলেই কথা এগোবে, অন্যথায় নয়।
মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হেরে থাকে, এ কোনো নতুন কথা নয়। দেশ যেমনই চলুক, দেশের মানুষ কখনোই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় না। মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোট থেকে বোঝা যায়, তাদের অসন্তোষের বা রুদ্ররোষের মাত্রা কী। নির্বাচনী গণতন্ত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’। সেই রুদ্ররোষেরই শিকার ডেমোক্র্যাটরা। লক্ষ করে থাকবেন, আমি বরাবরই ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়ের কথা বলেছি, রিপাবলিকানদের জয়ের কথা বলিনি একবারও। বস্তুত এবারে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছে—ডেমোক্র্যাটরা হেরেছে, আর তার ফায়দা পেয়েছে রিপাবলিকান পার্টি। দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি এখনো সম্মানিত নয়, তাদের গণসমর্থন ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় এখনো কম। তার পরও যে তাদের জয় হয়েছে, তার কারণ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ সমর্থন করে এমন ভোটাররা এবার হয় ভোট দিতে যাননি, বা গেলেও নিজ দলের পক্ষে ভোট দেননি। ২০০৮ সালে ওবামা ও তাঁর দল জিতেছিল মূলত তরুণ, সংখ্যালঘু ও স্বতন্ত্র ভোটারদের সমর্থনে। এবারের নির্বাচনে এই তিন ধরনের ভোটারই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ২০০৮ সালের তুলনায় এবার ভোট দিতে যাননি এমন লোকের সংখ্যা সাড়ে চার কোটি, তাঁদের অধিকাংশই সাবেক ওবামা-ভোটার।
কিন্তু কেন?
প্রথম ও প্রধান কারণ অর্থনীতি। আমেরিকার অর্থনীতি এখন হাঁটুভাঙা দ-এর মতো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, হাতে একখানা লাঠি। ওই লাঠিখানা টেনে নিলে, অর্থাৎ সরকারি নগদ সাহায্য বাদ দিলে সে নির্ঘাত মুখ থুবড়ে পড়বে। দেশের প্রতি ১০ জনের একজন যদি কর্মহীন হয়, তাহলে কমবেশি সবাই তার কুফল ভোগ করতে বাধ্য। অর্থনীতির এই অবস্থার জন্য যদিও দোষ ওবামার নয়, তবু সবাই বলছে, অর্থনীতিকে সচল করতে যা যা করা দরকার, ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা তা করেনি। ২৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ‘স্টিমুলাস’ হিসেবে ঢালা হয়েছে বটে, কিন্তু এর কোনোটাই স্থায়ী চাকরি সৃষ্টির কাজে বিনিয়োগ করা হয়নি। এই করেছি, সেই করেছি বললে কী হবে, ফলে তো তার পরিচয় নেই।
ওবামাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট সবাই। ডান, বাম ও মাঝের এক ক্রমবর্ধমান অংশ বলছে, ওবামার অনুসৃত নীতির ফলে দেশ কাদা মাড়িয়ে উঠতে পারছে না। রক্ষণশীল রিপাবলিকান ও স্বতন্ত্র নাগরিকদের অধিকাংশই মনে করে, ওবামা প্রশাসন সরকারের আয়তন বাড়িয়েছে, লাগামছাড়া খরচ করছে এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো শুরু করেছে। মন্দাবস্থা ঠেকানোর নামে এই সরকার যে দেদার টাকা ঢালছে, তার ফলে মাথাপিছু ঋণ ও বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে, দেশের মানুষের প্রকৃত আয়ও কমে আসছে। এমন চলতে থাকলে খুব শিগগির আমেরিকা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে পরিণত হবে। স্বাস্থ্যবিমার নামে যে আইন পাস হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, প্রতিটি নাগরিককে স্বাস্থ্যবিমা কিনতে হবে, না হলে অর্থদণ্ড। ফলে নাগরিক জীবনে সরকারের ভূমিকা বিস্তৃত হবে, যা তাদের মোটেই কাম্য নয়। বহিরাগতদের ভিড়ে দেশ উপচে পড়ছে, অথচ ওবামা প্রশাসন এ নিয়ে কিছুই করছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যকে সমর্থন না জানালে চাকরি সৃষ্টি হবে না, অথচ ওবামা তাদের জন্য নতুন কর রেয়াতিতে আগ্রহী নন। এসব অসন্তোষকে ঘিরে গড়ে উঠেছে তথাকথিত টি-পার্টি আন্দোলন (টিইএ পার্টি—যারা বলছে, ট্যাক্স এনাফ অলরেডি।) ওবামার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ তুলেছেন এই আন্দোলনের সমর্থকেরাই। প্রধানত শ্বেতকায়, চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষদের নিয়ে গঠিত এই আন্দোলন শ্বেত আধিপত্য হারানোর সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন। আর সে জন্য তাদের সবচেয়ে বেশি রাগ বারাক হোসেন ওবামা নামের এই কালো মানুষটির ওপর।
অন্যদিকে উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটরা ওবামাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধিতে নয়, উল্টো সরকার যথেষ্ট করছে না বলে। স্টিমুলাসের নামে যে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা পরিমাণে এত অল্প যে, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত হয়নি। যে স্বাস্থ্যবিমা হয়েছে, তাও খুব দুর্বল। এতে একটি ‘পাবলিক অপশন’ অর্থাৎ গ্রেট ব্রিটেনের মতো সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে অধিকাংশ ডেমোক্র্যাট, অথচ সে প্রশ্নে রিপাবলিকানদের সঙ্গে যথেষ্ট দৃঢ়তার সঙ্গে দরকষাকষি করেননি ওবামা। ওয়াল স্ট্রিট অর্থাৎ আমেরিকান ব্যাংক ও অর্থব্যবস্থা সংস্কারের নামে একটি আইন হয়েছে বটে, কিন্তু সে আইনে না আছে নখ, না আছে দাঁত। জলবায়ুর উষ্ণতা উদারনৈতিকদের জন্য একটি অগ্রাধিকার, অথচ ওবামা প্রশাসন এ নিয়ে যুদ্ধে নামার আগেই হার মেনে বসে আছে। সমকামীদের সমানাধিকার নিয়েও ওবামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা ছাড়া এ নিয়ে কিছুই করেননি।
ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের বিপক্ষে এবার এক বড় অস্ত্র ছিল টাকার খেলা। এ বছর সুপ্রিম কোর্টের নেওয়া এক সিদ্ধান্তের ফলে দেশি বা বিদেশি যেকোনো করপোরেশন যত খুশি অর্থ নির্বাচনী প্রচারণায় ঢালতে পারে, এ জন্য তাদের নামধামও প্রকাশ করতে হবে না। ওয়াল স্ট্রিট নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ওবামা, তা ব্যাংক বা করপোরেশনগুলোর ভালো লাগেনি। ফলে হাতের মুঠি খুলে তারা রিপাবলিকানদের পক্ষে চাঁদা দিয়েছে।
রিপাবলিকানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজের চেষ্টাতেও হাত পুড়িয়েছেন ওবামা। রিপাবলিকানদের দলে টানতে গিয়ে নিজ দলের ‘কোর’ সমর্থকদের হারিয়েছেন তিনি। এই ব্যর্থতা ওবামার নিজের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি আশ্চর্য দক্ষতায় নিজের সমর্থনে এক বিশাল ‘কোয়ালিশন’ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। নতুন তথ্যপ্রযুক্তি, বিশেষত ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ ও যুবকদের নিজ ছাতার নিচে এনেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সে জোট তিনি ধরে রাখতে পারেননি। এমনকি মহিলারা, যাঁরা বরাবরই ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক, এবার তাঁরাও ওবামাকে ছেড়ে গেছেন। তাঁদের ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিকভাবে তাঁকে যতটা যুক্ত থাকা দরকার ছিল, ওবামা বা তাঁর দল তা থাকেনি।
মজার ব্যাপার হলো, গত দুই বছরে ওবামা যে একেবারে কিছুই করেননি, তা নয়। বস্তুত কোনো কোনো ভাষ্যকারের বিবেচনায়, ওবামা ও ডেমোক্রেটিক নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস মাত্র দুই বছরে যা করেছে, অনেক প্রেসিডেন্ট তাঁর পুরো মেয়াদেও তা করতে সক্ষম হননি। স্বাস্থ্যবিমা আইনের কথাই ধরুন। একটা অর্থপূর্ণ স্বাস্থ্যবিমার জন্য কার্যত ৭০ বছর ধরে চেষ্টা চলছে। বিপক্ষ দলের প্রতিরোধের মুখে কোনো প্রেসিডেন্টই এগোতে পারেননি। উদারনৈতিকেরা যা যা চেয়েছিলেন, এই আইনে হয়তো তার সব অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কিন্তু তার পরও যা হয়েছে, তাও খুব কম নয়। প্রায় চার কোটি অতিরিক্ত মানুষ এর ফলে এই প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আসবে। ২৬ বছর বয়সের কম, এমন সন্তানেরা বাবা-মায়ের বিমার আওতায় সুবিধা ভোগ করবেন। পুরোনো অসুখ, এই যুক্তিতে এখন থেকে কারও স্বাস্থ্যবিমা বাতিল করা যাবে না।
অর্থ খাতে নতুন নিয়ন্ত্রণ অবস্থার আরোপ ওবামার আরেক উল্লেখযোগ্য অর্জন। অর্থবাজারের ওপর, বিশেষ করে গৃহঋণ খাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়াই এবারের মন্দাবস্থার কারণ। রিগান থেকে জর্জ বুশ গত ৩০ বছরে ‘ডি রেগুলেশন’-এর নামে যে অপকর্ম করেছেন, ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা তাতে রাশ টেনে ধরেছেন। তাঁরা নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন, ভোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন আইন বানিয়েছেন, অর্থ সংস্থাগুলোর ওপর নজরদারির ব্যবস্থা করেছেন। যেমন—এখন থেকে ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো চাইলেই যখন-তখন সুদের হার বাড়াতে পারবে না বা নতুন কোনো সার্ভিস চার্জ আরোপ করতে পারবে না। ভোক্তা বাজার নিয়ন্ত্রণ ও তার ওপর খবরদারির জন্য একটি নতুন ফেডারেল এজেন্সিও গঠিত হয়েছে। হতে পারে, উদারনৈতিকেরা যা যা চেয়েছিল, যেমন যেমন চেয়েছিল এসব আইনে তার সবকিছু নেই। কিন্তু তার পরও অর্থ ও ঋণবাজার নিয়ন্ত্রণে এবং ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় ওবামা ও ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, তা মানতেই হবে।
একই কথা বলা যায় অর্থনীতি প্রশ্নে। ব্যাংক ও অর্থ সংস্থার আশু বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারি অর্থের জোগান দিয়ে যে ত্বরিত ব্যবস্থা ওবামা নেন, তাতে কমবেশি কাজ হয়েছে। সে ব্যবস্থা না নিলে আমেরিকা, আমেরিকা কেন, পুরো বিশ্ব অর্থনীতিই দীর্ঘমেয়াদি মন্দাবস্থার কবলে পড়ত। ওবামা প্রশাসন হস্তক্ষেপ না করলে আমেরিকার মোটর কোম্পানিগুলোরও লালবাতি জ্বলা নিশ্চিত ছিল। শুধু সেসব কোম্পানিই দেউলিয়া হতো না, সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মার্কিনের চাকরি যেত, সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পেনশন। স্টিমুলাসের ফলে কম করে হলেও ৩০ লাখ লোকের অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। সমস্যা হলো, ওবামা বা তাঁর দল কেউই এসব পদক্ষেপের সুফল স্পষ্টভাবে দেশের মানুষকে বুঝিয়ে বলতে পারেনি। ওবামা প্রশাসন যে এ দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য আয়কর রেয়াতির ব্যবস্থা করেছে, সে কথাটা পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ জানে না। ব্যাংকগুলো কোটি কোটি ডলার ধার দেওয়ায় রক্ষণশীলেরা ক্ষিপ্ত হয়েছেন, অথচ এর ফলে ব্যাংকি সেক্টর শুধু যে টিকে গেল, তা-ই নয়, ধার নেওয়া টাকা সুদে-আসলে ইতিমধ্যে ফেরতও দিয়ে দিয়েছে। একজন ভাষ্যকার পরিহাস করে বলেছেন, ওবামা পুঁজিবাদের পতন ঠেকিয়েছেন বটে, কিন্তু নিজের বা নিজ দলের ভরাডুবি ঠেকাতে পারলেন না।
আগামী দুই বছর ওবামার জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে। রিপাবলিকানরা রক্তের স্বাদ পেয়েছে, ওবামাকে ছিঁড়ে খুবলে না শেষ করা পর্যন্ত তারা থামবে না। সিনেটে রিপাবলিকানদের এক নম্বর নেতা মিচ ম্যাকনেল জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে জেতা ঠেকানো হলো তাঁদের এক নম্বর লক্ষ্য। ফলে এ কথা নিশ্চিত যে, কংগ্রেসের ভেতর রিপাবলিকানদের তরফ থেকে কোনো সহযোগিতা তিনি পাবেন না। তার মানে সেখানে কোনো অর্থপূর্ণ কাজই হবে না। এদিকে ওবামার নিজের দলের ভেতরেও অন্তঃকলহ শুরু হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবির জন্য তাঁদের কেউ কেউ প্রেসিডেন্টের নাম ধরেই অভিযোগ করা শুরু করেছেন। তাঁদের দাবি, দলের নেতা হলেও দলকে সংগঠিত করতে পারেননি ওবামা। পরিকল্পিত নির্বাচনী অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারেননি তিনি। কোন আসন ধরে রাখা যাবে, কোনটা যাবে না—সে হিসাবে তাঁদের মস্ত ভুল ছিল। যেখানে ওবামার সমর্থন ছিল জরুরি, সেখানে সময়মতো সাহায্য দিতে পারেননি তিনি। যেমন— পেনসিলভানিয়ার কংগ্রেসওম্যান ক্যাথি ডালকেম্পার নিজের জন্য বিপজ্জনক জেনেও ওবামার স্বাস্থ্যবিমার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ওবামা তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় একবারের জন্য আসেননি। ডালকেম্পার যথারীতি নির্বাচনে হেরেছেন। কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সঙ্গেও তাঁর বনিবনা হয়নি। তাঁদের কথা শুনে কখনো কখনো এমন মনে হয়েছে, এই দুজন বুঝি দুই ভিন্ন ভিন্ন দলের।
এককথায় কোনো ভুল নেই, আগামী দুই বছর ওবামাকে আগুনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। রিপাবলিকান নেতৃত্ব গোড়া থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা ওবামার কোনো ব্যাপারেই সমর্থন জোগাবে না। তাদের এই নীতি সফল হয়েছে। আগামী বছর নতুন জন গণনার ভিত্তিতে নির্বাচনের জেলাওয়ারি তালিকা তৈরি হবে। সে তালিকা তৈরির দায়িত্বে থাকবেন অঙ্গরাজ্যগুলোর গভর্নররা। মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর দেশের অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে এখন রিপাবলিকানদের আধিপত্য। তাঁরা ভোটের নতুন যে ছক কাটবেন, তার ফলে কম করে হলেও ১০টি আসন ডেমোক্র্যাটদের হাতছাড়া হবে। অন্য কথায়, আগামী নির্বাচনের আগেই ডজন খানেক আসন খুইয়ে বসে আছেন ওবামা ও তাঁর দল।
কী করবেন ওবামা? কোথায় হাত বাড়াবেন সমর্থনের জন্য? এর উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে এটুকু বলা যায়, তাঁর চলার রাস্তায় এখন কোনো শুকনো বাসি ফুলও আর অবশিষ্ট নেই। সেখানে কেবলই কাঁটা।
নিউইয়র্ক, ৯ নভেম্বর ২০১০
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments