মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-মুজাহিদের বিচার শুরু

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারাবন্দি জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যা, ফরিদপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর গণহত্যা, একাধিক হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, দেশান্তরে বাধ্য করাসহ সাতটি অভিযোগে গতকাল বৃহস্পতিবার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।


তাঁর বিরুদ্ধে আগামী ১৯ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। এ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মুজাহিদের বিচার শুরু হলো।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে গতকাল এই আদেশ দেন।
এদিকে জামায়াতের আরেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর অসুস্থতার কথা তুলে যেকোনো শর্তে জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়। এই আবেদনের ওপর গতকাল শুনানি হয়েছে। আগামী ২৪ জুন আদেশ দেবেন বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১। এই ট্রাইব্যুনালেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপির বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ তাঁর অসমাপ্ত জবানবন্দি দেওয়া শেষ করেন। তিনি জবানবন্দিতে তাঁর বাবার প্রকৃত হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করেন।
এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিএনপির নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে দেওয়া আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর ২৪ জুন শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্থপতি বললেন মুজাহিদ
গতকাল সকালে ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার আগে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন খারিজ করেন। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা নতুন একটি অভিযোগ ও সাতজন সাক্ষী অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন মঞ্জুর করেন। এ বিষয়ে আদেশে বলা হয়, ফরমাল চার্জ আমলে নেওয়ার পরও রাষ্ট্রপক্ষের আনা নতুন অভিযোগে মুজাহিদ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
এরপর একে একে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, শহীদ-জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনসহ একাধিক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা, ফরিদপুর এবং ঢাকায় একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা-নির্যাতনসহ সাতটি অভিযোগ উত্থাপন করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর মুজাহিদের কাছে তিনি দোষী না নির্দোষ তা জানতে চান। জবাবে মুজাহিদ বলেন, 'আল্লাহকে হাজির-নাজির রেখে বলছি, আমি ১০০ ভাগ নির্দোষ। আজকের এ অবস্থানের কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।' তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার পর আমি কোনো দিন পলাতক ছিলাম না। আমার নামে কোনো মামলা বা জিডি ছিল না। রাজনৈতিক কারণেই এ মামলা দেওয়া হয়েছে।'
অভিযোগ গঠনের পর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট সাতটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যেসব বুদ্ধিজীবীর খোঁজ পাওয়া যায়নি, তাঁদের লাশ মোহাম্মদপুর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া গেছে। তখন আলী আহসান মুজাহিদের নেতৃত্বে অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগের প্রথমে বলা হয়, ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে ৫, চামেলীবাগের বাসা থেকে মুখোশধারীরা অপহরণ করে। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাঁর লাশও পাওয়া যায়নি। ছাত্রসংঘের প্রভাবশালী নেতা ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে হত্যার জন্য মুজাহিদকে দায়ী করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময় ফরিদপুরে হিন্দু অধ্যুষিত বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গি গ্রামে হামলা চালিয়ে ৫০-৬০ জন হিন্দুকে হত্যা, তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার সঙ্গে মুজাহিদ জড়িত।
তৃতীয় অভিযোগ, জুনের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের রণজিৎ নাথকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।
চতুর্থ অভিযোগ, একই বছরের ২৬ জুলাই ফরিদপুরে মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ পাখিকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
পঞ্চম অভিযোগ, ১৩ আগস্ট রাতে ঢাকার নাখালপাড়া পুরাতন এমপি হোস্টেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে যান মতিউর রহমান নিজামী ও মুজাহিদ। তাঁরা সেখানে বলেন, রাষ্ট্রপতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে পারেন। এর আগেই আলতাফ মাহমুদ, রুমী, জালাল, বদিসহ আটকদের হত্যা করতে হবে। এরপর তাঁদের হত্যা করা হয়।
ষষ্ঠ অভিযোগ, ঢাকার মোহাম্মদপুর শরীরচর্চা ইনস্টিটিউটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পে আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়মিত যাতায়াত করতেন মুজাহিদ। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হত্যা, নির্যাতন চালানোর পরিকল্পনা করতেন। এরই অংশ হিসেবে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর অনেককে হত্যা করা হয়। পরে তাদের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।
সপ্তম অভিযোগ, ফরিদপুরের খলিলপুর কমিউনিটি সেন্টারে রাজাকারদের সঙ্গে বৈঠক করে বকচর গ্রামে হামলা চালানো হয়। সেখানে বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেন, সত্যরঞ্জন, জগবন্ধুসহ অনেককে হত্যা করা হয়। সেখানে একজন নারীকে নির্যাতন করা হয়। অনিল সাহার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
গত ২৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর গত ১০ মে মুজাহিদের মামলা সেখানে স্থানান্তর করা হয়। মুজাহিদের বিরুদ্ধে মোট ১০৯ পৃষ্ঠার ৩৪টি বিভিন্ন ঘটনাসহ ছয় হাজার ৬৮০ পৃষ্ঠার নথিপত্রের ভিত্তিতে অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন।
২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক দেখানো হয়।
অভিযোগ গঠনের পর ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে মুজাহিদ কথা বলেন। তিন কারণে এ মামলা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, 'দল হিসেবে জামায়াতের জনপ্রিয়তা, বিদেশি ষড়যন্ত্র ও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী জোট গঠনের কারণেই আজকের এ মামলা।' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্থপতি অভিহিত করে মুজাহিদ বলেন, 'তাঁর পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের কারণে পিন্ডির হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু তিনি দেশকে দিলি্লর হাতে যেতে দেননি। সেই থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বিভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।'
প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহের জবানবন্দি সমাপ্ত
এদিকে গতকাল অসমাপ্ত জবানবন্দিতে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ বলেন, '১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল ভারতের রামগড়ে ড. আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি আমাদের বাড়ির খবর জানতে চান। আমি বলি, ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়ি এসে বাবাকে হত্যা করেছে। একই কথা অনেককেই বলেছি। আমি বাবাকে হত্যার প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করতে চাই। আমি আমার বাবার প্রকৃত হত্যাকারীর শাস্তি চাই।'
প্রফুল্ল রঞ্জনের জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী তাঁকে জেরা করেন। এ জেরা অব্যাহত রয়েছে। আগামী রবিবার আবার জেরা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.