চারুশিল্প-মেঘ বৃষ্টি জল by মোবাশ্বির আলম মজুমদার
পাহাড়, মেঘ আর সবুজের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে শিল্পী হারিয়ে যান প্রকৃতির রঙে। বাংলার ষড়ঋতুর রঙের বৈভবে শিল্পীর ক্যানভাস সেজে ওঠে। প্রাচ্যশিল্পে জলরঙের সর্বাধিক ব্যবহার ও চর্চায় শিল্পী দক্ষ হয়ে ওঠেন। শিল্পী সোহাগ পারভেজ বাস্তবধর্মী নিসর্গচিত্রে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তাঁর দ্বিতীয় প্রদর্শনী ‘পাহাড়িয়া পথে’র ছবিতে।
এবারের প্রদর্শনীতে বিষয় হিসেবে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়, নদী আর চাকমা, মুরং, ত্রিপুরা, খাসিয়া, বম জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন ও প্রতিকৃতি এঁকেছেন। তবে শিল্পী ওই পাহাড়-নদীর সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত করেছেন, সেটি হলো কালবৈশাখী—কালবৈশাখী ঝড়। প্রদর্শনীর মোট ৭৪টি কাজের মধ্যে ১৩টি ছবি ঝড় নিয়ে আঁকা। ১৫ জুন গ্যালারি কায়ায় শুরু হয়েছে শিল্পী সোহাগ পারভেজের ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ শিরোনামের চতুর্থ একক প্রদর্শনী। প্রদর্শিত ছবিগুলোর মাধ্যম জলরং ও অ্যাক্রিলিক; এর আগে শিল্পীর আয়োজিত প্রদর্শনী ছিল শুধু জলরঙের ছবি। জলরঙে আঁকা ছবিতে শিল্পী তাঁর আঁকার দক্ষতা দেখিয়েছেন। এবারে তাঁর কাজে বাড়তি যোগ হয়েছে অ্যাক্রিলিক মাধ্যম। জলরঙের ধোঁয়া পদ্ধতিতে অ্যাক্রিলিক রং প্রয়োগ করেছেন ছবিতে। ১৩টি ছবির বিষয়ে ঝড়ের মুহূর্ত, রাতের আকাশ আর নদী তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে শিল্পীর বক্তব্য হলো, ‘বৈশাখের ঝড়ে যেমন বেদনা থাকে, তেমনি আবার গতিও থাকে। প্রকৃতির এ দুটো রূপই আমাকে মুগ্ধ করে। আর রাত মানে শুধু গাঢ় অন্ধকার বা কালো রঙে ঢাকা আকাশ নয়, রাতের আকাশে থাকে নদীর নীল, লাল, উজ্জ্বল হলুদ, বার্ন্ট সিয়েনা।’
এবারের প্রদর্শনীতে শিল্পী প্রকৃতির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রূপ আর রাতের রং প্রকাশ করেছেন নিজস্ব অঙ্কনরীতিতে। সোহাগের ক্যানভাসের বিষয় উপস্থাপনায় আলোছায়া ও ছন্দের দিকে লক্ষ রেখে চিত্রতলের রচনায় স্থান বিভাজন ও পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাস্তবধর্মী চিত্ররচনার যে মৌলিক অধ্যায়, সেটি তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন।
বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য এলাকা। এখানে জীবনের বৈচিত্র্য যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ছয় ঋতুতে প্রকৃতির রংও দ্রুত বদলায়, শিল্পী তাঁর ছবিতে এই পরিবর্তন ধরতে চেয়েছেন। যে কারণে শিল্পী পার্বত্য অঞ্চলের রঙের প্রাচুর্য দেখতে দীর্ঘ ছয় বছর ওই অঞ্চলে যাতায়াত করেছেন। গ্রীষ্মে পাহাড় রেঙে ওঠে গাঢ় সবুজে, শরতে আকাশে থাকে মেঘের ভেলা, বর্ষায় পাহাড়িয়া সবুজ মেতে ওঠে উৎসবে, শীতে পাহাড় ঢেকে থাকে মায়াবী কুয়াশায়। সূর্যের আলোর সঙ্গে পাহাড় আর আকাশ তখন রেঙে ওঠে অপরূপ আলোয়। রঙের এই বিপুল প্রাচুর্য বাংলার অন্য কোনো অঞ্চলে খুঁজে পান না শিল্পী। তিনি মনে করেন, এটিই প্রকৃত সবুজের ভূমি।
নৈসর্গিক দৃশ্যে শিল্পী নদী ও নৌকাকে প্রধান করে দেখেছেন। সাঙ্গু নদী সিরিজের কাজে দুই পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা নদীর বুকে নৌকার সারি। পাহাড় এঁকেছেন সবুজের নানা স্তরে। সোহাগের জলরঙে আঁকা ছবিতে কখনো কখনো প্রচলিত পদ্ধতিতে আঁকার প্রবণতাও দেখা যায়। কোনো কোনো নিসর্গচিত্রে কালোর স্থূল বহিঃরেখার ব্যবহার ছবির মৌলিক শিল্পগুণ ব্যাহত করেছে মনে হয়। তবে এটা শিল্পীর নিজস্ব ভঙ্গি বা কৌশলও হতে পারে।
বাস্তবধর্মী চিত্রে পরিপ্রেক্ষিত রঙের প্রয়োগে গতির সঞ্চার, চিত্রতলের সুব্যবস্থাপনা শিল্পীর কাজগুলোকে শক্তি জুগিয়েছে।
‘কালবৈশাখী ঝড়’ সিরিজের কাজগুলোতে আকাশের গাঢ় কালোর মধ্যে ফুঁসে ওঠা মেঘের ঝলকানি দারুণ এক চিত্রকল্পের ইঙ্গিত দেয়। ঝড়ে বাতাস, সবুজ গাছ আর নদীর অস্থির অবস্থা বেশ বাস্তবসম্মতভাবে নির্মাণ করেছেন বলা যায়।
এ ছাড়া জুমচাষ, সাঙ্গু নদী, বাড়ি ফেরা, রাতের শীতলক্ষ্যা, রাতের নদী—এসব কাজে রঙের ক্ষেত্রে অতিবাস্তবতার পাশাপাশি অঙ্কন কৌশলে বিন্দু ও গতিময় রেখার ব্যবহারে অন্যান্য বাস্তবধর্মী ছবির চেয়ে কিছুটা আলাদা মনে হয়েছে। আকাশের নীলের সঙ্গে মিশে যাওয়া দূরের গাছগাছালি গাঢ় নীল রং ধারণ করে যেন আকাশেরই অংশ হয়ে গেছে কোনো কোনো ছবিতে। শিল্পীর এ প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য কাজ ঝড় সিরিজ, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এর সঙ্গে নদীর রূপ নির্মাণের বিষয়টিও দর্শকদের মুগ্ধ করবে। রাতের শীতলক্ষ্যা-১, ২ ছবিতে গাঢ় কালো আকাশের বুক চিরে উজ্জ্বল আলো এসে নদীর জলে ছায়া পড়েছে, রাতের নিস্তব্ধ ঘুমন্ত নদীতে নিঝুম, একাকী নৌকা আর জলজ উদ্ভিদ—সব মিলিয়ে রাতের নদীর অদ্ভুত আলো-ছায়াময় একচিত্রকল্প তিনি এঁকেছেন। আবার সূর্য ডোবার সময় নদীতে যেমন হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখা যায়, সেই অসাধারণ দৃশ্য এঁকেছেন তিনি ‘সন্ধ্যার নদী’ ছবিতে। ‘নিঝুম দ্বীপ’ রোদ উজ্জ্বল পুরোনো ঢাকা, মেঘে ভরা এসব ছবিতেও সোহাগ বাস্তব রীতির আশ্রয়ে ফর্ম ভেঙে নিজস্ব শৈলীতে আঁকার চেষ্টা করেছেন। অপার সৌন্দর্যের খোঁজে বাংলায় রঙের প্রাচুর্যের সন্ধানে সোহাগ পারভেজের পথচলা, ভবিষ্যতে অনিন্দ্য-সুন্দর এক বাংলাদেশকে দেখতে পারব তাঁর কাজে, আশা রাখি। প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৬ জুন।
সোহাগ পারভেজ: জন্ম ১৯৮১। ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে বিএফএ ও ২০১২ সালে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনটি একক প্রদর্শনী ছাড়াও ২৪টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নেন। বর্তমানে তিনি শিল্পী। স্বাধীনভাবে শুধু ছবি আঁকাআঁকি নিয়েই আছেন।
এবারের প্রদর্শনীতে শিল্পী প্রকৃতির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রূপ আর রাতের রং প্রকাশ করেছেন নিজস্ব অঙ্কনরীতিতে। সোহাগের ক্যানভাসের বিষয় উপস্থাপনায় আলোছায়া ও ছন্দের দিকে লক্ষ রেখে চিত্রতলের রচনায় স্থান বিভাজন ও পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাস্তবধর্মী চিত্ররচনার যে মৌলিক অধ্যায়, সেটি তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন।
বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য এলাকা। এখানে জীবনের বৈচিত্র্য যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ছয় ঋতুতে প্রকৃতির রংও দ্রুত বদলায়, শিল্পী তাঁর ছবিতে এই পরিবর্তন ধরতে চেয়েছেন। যে কারণে শিল্পী পার্বত্য অঞ্চলের রঙের প্রাচুর্য দেখতে দীর্ঘ ছয় বছর ওই অঞ্চলে যাতায়াত করেছেন। গ্রীষ্মে পাহাড় রেঙে ওঠে গাঢ় সবুজে, শরতে আকাশে থাকে মেঘের ভেলা, বর্ষায় পাহাড়িয়া সবুজ মেতে ওঠে উৎসবে, শীতে পাহাড় ঢেকে থাকে মায়াবী কুয়াশায়। সূর্যের আলোর সঙ্গে পাহাড় আর আকাশ তখন রেঙে ওঠে অপরূপ আলোয়। রঙের এই বিপুল প্রাচুর্য বাংলার অন্য কোনো অঞ্চলে খুঁজে পান না শিল্পী। তিনি মনে করেন, এটিই প্রকৃত সবুজের ভূমি।
নৈসর্গিক দৃশ্যে শিল্পী নদী ও নৌকাকে প্রধান করে দেখেছেন। সাঙ্গু নদী সিরিজের কাজে দুই পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা নদীর বুকে নৌকার সারি। পাহাড় এঁকেছেন সবুজের নানা স্তরে। সোহাগের জলরঙে আঁকা ছবিতে কখনো কখনো প্রচলিত পদ্ধতিতে আঁকার প্রবণতাও দেখা যায়। কোনো কোনো নিসর্গচিত্রে কালোর স্থূল বহিঃরেখার ব্যবহার ছবির মৌলিক শিল্পগুণ ব্যাহত করেছে মনে হয়। তবে এটা শিল্পীর নিজস্ব ভঙ্গি বা কৌশলও হতে পারে।
বাস্তবধর্মী চিত্রে পরিপ্রেক্ষিত রঙের প্রয়োগে গতির সঞ্চার, চিত্রতলের সুব্যবস্থাপনা শিল্পীর কাজগুলোকে শক্তি জুগিয়েছে।
‘কালবৈশাখী ঝড়’ সিরিজের কাজগুলোতে আকাশের গাঢ় কালোর মধ্যে ফুঁসে ওঠা মেঘের ঝলকানি দারুণ এক চিত্রকল্পের ইঙ্গিত দেয়। ঝড়ে বাতাস, সবুজ গাছ আর নদীর অস্থির অবস্থা বেশ বাস্তবসম্মতভাবে নির্মাণ করেছেন বলা যায়।
এ ছাড়া জুমচাষ, সাঙ্গু নদী, বাড়ি ফেরা, রাতের শীতলক্ষ্যা, রাতের নদী—এসব কাজে রঙের ক্ষেত্রে অতিবাস্তবতার পাশাপাশি অঙ্কন কৌশলে বিন্দু ও গতিময় রেখার ব্যবহারে অন্যান্য বাস্তবধর্মী ছবির চেয়ে কিছুটা আলাদা মনে হয়েছে। আকাশের নীলের সঙ্গে মিশে যাওয়া দূরের গাছগাছালি গাঢ় নীল রং ধারণ করে যেন আকাশেরই অংশ হয়ে গেছে কোনো কোনো ছবিতে। শিল্পীর এ প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য কাজ ঝড় সিরিজ, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এর সঙ্গে নদীর রূপ নির্মাণের বিষয়টিও দর্শকদের মুগ্ধ করবে। রাতের শীতলক্ষ্যা-১, ২ ছবিতে গাঢ় কালো আকাশের বুক চিরে উজ্জ্বল আলো এসে নদীর জলে ছায়া পড়েছে, রাতের নিস্তব্ধ ঘুমন্ত নদীতে নিঝুম, একাকী নৌকা আর জলজ উদ্ভিদ—সব মিলিয়ে রাতের নদীর অদ্ভুত আলো-ছায়াময় একচিত্রকল্প তিনি এঁকেছেন। আবার সূর্য ডোবার সময় নদীতে যেমন হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখা যায়, সেই অসাধারণ দৃশ্য এঁকেছেন তিনি ‘সন্ধ্যার নদী’ ছবিতে। ‘নিঝুম দ্বীপ’ রোদ উজ্জ্বল পুরোনো ঢাকা, মেঘে ভরা এসব ছবিতেও সোহাগ বাস্তব রীতির আশ্রয়ে ফর্ম ভেঙে নিজস্ব শৈলীতে আঁকার চেষ্টা করেছেন। অপার সৌন্দর্যের খোঁজে বাংলায় রঙের প্রাচুর্যের সন্ধানে সোহাগ পারভেজের পথচলা, ভবিষ্যতে অনিন্দ্য-সুন্দর এক বাংলাদেশকে দেখতে পারব তাঁর কাজে, আশা রাখি। প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৬ জুন।
সোহাগ পারভেজ: জন্ম ১৯৮১। ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে বিএফএ ও ২০১২ সালে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনটি একক প্রদর্শনী ছাড়াও ২৪টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নেন। বর্তমানে তিনি শিল্পী। স্বাধীনভাবে শুধু ছবি আঁকাআঁকি নিয়েই আছেন।
No comments