একা! by সুভাষ সাহা

'আসছি একা, যাব একা' কথনে মরমি গানের সুরে ক্ষণিকের জন্য হলেও উদাস হয় অতি-ব্যস্ত সংসারী মানুষের মন।শরীরী মানব তখন মনের ডানায় চড়ে অশরীরী পরাবাস্তবে নিজের ঠিকানা খুঁজে হয়রান হয়। কারণ সেখানে সে একেবারেই নিঃসঙ্গ। একাকিত্বের রূপ বিভিন্ন বয়সের মানুষের জীবনে ভিন্ন ভিন্নরূপে হাজির হয়।


এখন যেমন বলা হচ্ছে, ফেসবুক তরুণ প্রজন্মকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে বাস্তবে গল্পগুজব বা হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটানোর চেয়ে 'ভার্চুয়াল রিয়ালিটি' বা ফেসবুক ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মানুষের সঙ্গে কল্পিত বাস্তবে সংযোগ গড়ে তোলা ও ভাব বিনিময়ের আকাঙ্ক্ষা ব্যাপক হচ্ছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুতন্ত্রের গবেষকরা একটি সমীক্ষায় দেখেছেন, যারা নিজেদের নিঃসঙ্গ ভাবছেন, তারাই ফেসবুক ও কম্পিউটারের মাধ্যমে কথাবার্তা, খেলা-বিনোদনের নানা ওয়েবসাইটে বেশি সময় কাটান। সমীক্ষায় দাবি করা হয়, ফেসবুক নতুন বন্ধু লাভের সুযোগ দেওয়ার ধারণাটা ভুল। প্রধানত পরিচিত লোকদের সঙ্গেই ফেসবুকে আলাপ চলে। তাই ফেসবুক মানুষের নিঃসঙ্গতাকে আরও দীর্ঘায়িত ও তীব্র করছে কি-না এমন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সমীক্ষার ফাইন্ডিংসকে অগ্রাহ্য না করেও বলা যায়, পুঁজিবাদী ভোগবাদী সমাজ যখন মানব মনের সুকোমল বৃত্তিগুলোকেও বাণিজ্যের বাজারী উপকরণ করে তুলেছে, তখন সনাতনী পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক দায়বদ্ধতাও আপনাআপনি অন্তর্হিত হয়। এর ফলে মানুষ সামাজিক জীব এই ধারণাটাই সারশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ তার কর্মস্থল ও ঘরের বাইরে তাকানোরও প্রয়োজন অনুভব করে না অনেক সময়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার সময় এ কারণেই উপর-নিচ ও পাশের অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারাও তার খবর রাখেন না। সবাই এই মধ্যবিত্ত সমাজে 'আপনারে লয়ে' ব্যস্ত। মানুষকে শুধু অর্থ-বিত্ত, স্ট্যাটাস অর্জনের দিকে তীব্রগতিতে ধাবিত করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এই একাকিত্ববোধ সৃষ্টির জন্য পুঁজিবাদ দায়ী। পুঁজিবাদই পরিবার ছোট করে আনার মাধ্যমে প্রবীণদের সংসার থেকে বিতাড়নের বন্দোবস্ত করেছে। ফলে সৃষ্টি হয় আরেক মানবিক সমস্যার। দেখা যায়, যেখানে আর্থিক সঙ্গতির কোনো ঘাটতি নেই সেখানেও একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা দু'দণ্ড কথা বলার পর্যন্ত লোক খুঁজে পান না।
আসলে ফেসবুক, টুইটার বা ইন্টারনেট মানুষকে নিঃসঙ্গ করে দেয় না। বরং পুঁজিবাদ সৃষ্ট নিঃসঙ্গতাকে ভার্চুয়াল সামাজিক নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে কিছুটা হলেও দূর করতে সহায়তা করে। পৃথিবীর এক কোণে পড়ে থাকা মানুষটির কাছে হাত বাড়ালেই গোটা বিশ্বকে এনে দেয়।
প্রধানত পরিচিতজনদের সঙ্গে ফেসবুক, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও আলাপ চললেও এর মাধ্যমে এমন অনেক অপরিচিত লোকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়, যা অতীতে মানুষ কল্পনাও করতে পারত না। সারাবিশ্বে আজ যে মানুষের বিভিন্ন অধিকার দাবিতে আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সেটা ফেসবুক, টুইটার, ইন্টারনেটের কল্যাণেই। এভাবে আধুনিক বৃহত্তর বিশ্ব সমাজের ভবিষ্যৎ আভাস কি আমরা দেখতে পাই না! এখন হয়তো একটি সমীক্ষা ফেসবুক, ইন্টারনেটকে মানুষের নিঃসঙ্গতাকে দীর্ঘায়িত করার দোষে দুষ্ট জ্ঞান করছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরেক সমীক্ষায় আমরা দেখব, এই সামাজিক ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমগুলো মানুষের নিঃসঙ্গতাকে দীর্ঘায়িত করে না, এগুলো ভবিষ্যৎ বিশ্ব মানব সমাজের বার্তাবাহক।
আমরা মনে করি কেন যে, আদি থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের অনুভব একই রূপ আছে বা থাকবে! আদতে মানুষের মনে ঈশ্বর ছাড়া ধ্রুব বলে কি কিছু আছে এই চরাচরে? সবকিছুই কি পরিবর্তিত হচ্ছে না? ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ কি বিবর্তনের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে না? এই পরিবর্তনের পথে মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ার উপায় ফেসবুক, টুইটার, ইন্টারনেট। আগামী দিনে নতুন কোনো উপায়ের সঙ্গে মানুষই মানুষকে পরিচিত করাবে।
পুঁজিবাদ মানুষের মনের সুকোমল বৃত্তিগুলোকেও যেভাবে বাণিজ্যিক উপকরণ বানিয়ে ব্যক্তিমানুষকে সমাজ বিচ্ছিন্ন করে বাণিজ্যিক উপকরণে পরিণত করছে তার থেকে পরিত্রাণের উপায়ও মানুষকেই সন্ধান করতে হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.