চারদিক-‘গীতাঞ্জলি’র এক শ বছর by এম এম খালেকুজ্জামান

‘...লেখকের চেয়ে বড় কোনো দেবতা নেই। তাঁরা কাঁপিয়ে দেন সমস্ত সত্তার মূল...’—মহৎ কোনো সাহিত্য-সৃষ্টিকে ভার্জিনিয়া উলফের অরল্যান্ড যেভাবে দেখতেন, যেভাবে বিস্মিত হতে ভালোবাসতেন, সেভাবেই বাসেন বিশ্বের তাবৎ সাহিত্যমোদীরাও। রবীন্দ্রসৃষ্ট গীতাঞ্জলি তেমনি এক বিস্ময় সৃষ্টিকারী কবিতাগুচ্ছ, যাতে বিস্ময়াভিভূত ইউরোপীয় সাহিত্যানুরাগী মহল।


কেবল ইউরোপীয় গোষ্ঠী নয়, প্রকৃত সাহিত্যমোদী মানুষমাত্রই রবীন্দ্রসৃষ্টির স্বাদে আপ্লুত হন, তা যেখানেই তাঁর জন্মভূমি হোক না কেন। গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। এ বছর এই রচনার শতবর্ষপূর্তি।
গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। সে বছরের ১৩ নভেম্বর এ সংবাদে উল্লসিত হয়ে ওঠে ভারতবাসী। শুধু নোবেল প্রাপ্তিই নয়, এই সাহিত্য সৃষ্টির কল্যাণে তৎকালীন পরাধীন ভারতের অজ্ঞাত একটি প্রাদেশিক ভাষা বাংলা বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি পেয়েছিল। অধ্যাত্ম চিন্তা ও ঈশ্বরপ্রেমের ভাবধারার সংশ্লেষে ১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত বইটি রচনা করেন কবিগুরু। এটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে (৩১ শ্রাবণ, ১৩১৭ বঙ্গাব্দ)।
১৯১২ সালে বিলেত ভ্রমণে যান কবি। সঙ্গে নেন নিজের অনুবাদ করা গীতাঞ্জলি ও সমসাময়িক আরও কিছু কাব্যের অনুবাদ। লন্ডনে বন্ধু-শিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টেইনের হাতে তুলে দেন এই সম্ভার। পরে ব্রাদার জেমস ও ব্রিটিশ কবি জো উইন্টার আরও কিছু অনুবাদ করেন। এরপর সে সময়কার বিখ্যাত আইরিশ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের ভূমিকাসহ লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে ১৯১২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয় Gitanjali: Song Offerings। এই সংস্করণের মুদ্রণসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত শ। পরে ম্যাকমিলান কোম্পানি এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে একযোগে লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে।
বাংলা মূল গীতাঞ্জলি আর ইংরেজি গীতাঞ্জলির (সং অফারিংস) পার্থক্য হচ্ছে, মূল কাব্যগ্রন্থে কাব্যসংখ্যা ১৫৭ আর ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে রয়েছে মোট ১০৩টি কাব্য অনুবাদ। এর মধ্যে ৫৩টি নেওয়া হয়েছে বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে। বাকি ৫০টি খেয়া, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, কল্পনা, গীতমাল্য, গীতালি, স্মরণ, শিশু প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে নেওয়া। অচলায়তন নাটকের একটি গানও তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কাব্যানুরাগী মহলের বিপুল ভালোবাসা পেয়ে যায় এই গ্রন্থ। ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর তারিখে নোবেল ঘোষণার আগেই ১০টি সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। একে একে ইউরোপের নানা ভাষায় অনূদিত হতে থাকে গীতাঞ্জলির ইংরেজি ভাষ্য।
জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার ঠিক আগের সময়কার একটি চমকপ্রদ ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। ব্রিটিশ প্রকাশক ম্যাকমিলান অনুবাদকর্মটি হস্তান্তর করেন স্বনামধন্য জার্মান প্রকাশক কুর্ট উলভকে। কিন্তু তাঁর সহকারী ‘প্রকাশযোগ্য নয়’ বলে বাতিল করে লন্ডনে ফেরত পাঠাতে পোস্টাফিসে পাঠিয়ে দেন। কাকতালীয়ভাবে সেদিনই রেডিও ঘোষণায় জানা গেল গীতাঞ্জলি তথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তির খবর। লিপজিগের (Leipzig) প্রকাণ্ড পোস্টাফিসের ওয়্যার হাউস থেকে প্রাণপণ চেষ্টায় কুর্ট ওলভ উদ্ধার করেন মহার্ঘ্য গীতাঞ্জলি। আর প্রকাশের পরে কুড়িয়ে নেন যথেষ্ট অর্থ ও খ্যাতি।
প্রাচ্যদেশীয় ভাবনা, কল্পনা ও মানস সঞ্জাত গীতাঞ্জলি যখন প্রতীচ্যে আবির্ভূত হলো, তখন ইউরোপজুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা বেজে উঠেছে। যুবকেরা প্রস্তুতি নিচ্ছে যুদ্ধে যাওয়ার। মূলত পুরো জনপদ তখন দ্বন্দ্বমুখর। দ্বন্দ্বপ্রাবল্যে মুখর ইউরোপীয় সমাজকে গীতাঞ্জলির প্রভাব বিস্তারকারী একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। সুজান এইচ ওয়েন নামের এক ইংরেজ ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে বলেন, তাঁর ছেলে উইলফ্রেড ওয়েন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে যাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথ রচিত কাব্য থেকে পঙিক্ত উদ্ধৃত করে বিদায় নেন, যা ছিল—‘...When I go from hence let this be my parting word, that what I have seen is unsurpassable, (যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই/যা দেখেছি যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই)’।
গীতাঞ্জলি যেন এক বৈচিত্র্যের আধার। এতে আছে ঈশ্বরবোধের প্রেরণা, উপনিষদের ব্রহ্মবাদ, বৈষ্ণব পদাবলির মিনতি, বাউলিয়ানার মরমি ও সহজিয়া ধারা। প্রাচ্যদেশীয় শুভবোধের বার্তাবহনকারী এক ললিত কাব্যকৃতি।
সুইডিশ লেখক ভার্নার ভন হেইডেনস্টাম গীতাঞ্জলিকে কেন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত, তার ব্যাখ্যায় লেখেন, ‘গ্যেটের অন্যান্য লেখার সঙ্গে পরিচিতি না থাকলেও তাঁর নির্বাচিত কিছু কবিতা পড়েই গ্যেটের বিশালত্ব মেনে নেওয়া যায়। সেভাবে এই গ্রীষ্মে আমাদের হাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে যে কবিতা পৌঁছেছে, সেগুলো সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি—এই লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ এক কবিকে আমরা জানতে পেরেছি। তীব্র অনুভূতি নিয়ে কবিতাগুলো পাঠ করেছি এবং বলতে পারি বেশ কয়েক দশকের মধ্যে কাব্য সাহিত্যে এগুলোর তুল্য কিছু পাইনি। কবিতাগুলোর সঙ্গে যে সময় কাটিয়েছি, তা আমার কাছে বিশেষ মূল্যবান। যেন আমি স্বচ্ছ ও ঝরঝরে এক ঝরনার জল পান করার সুযোগ পেয়েছি।...’
গীতাঞ্জলির শতবর্ষপূর্তিতে বিশ্বকবির প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.