যুগের বাণী-বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি-মাসে বিবেকী ভাবনা by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
লেখাটি লিখছি পহেলা ফেব্রুয়ারি। সকালে পড়ার টেবিলে বসে ডেস্ক ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়তেই মনে হলো তারিখটি এবং মনের পটে ভেসে উঠল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই আন্দোলনের ছবি। আমি তখন ঢাকা কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র। থাকি আরমানিটোলার 'বান্ধব কুটির' ছাত্রাবাসে।
ওই আন্দোলনের অবশ্যম্ভাবী ও অমোঘ পর্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছে। অতঃপর একঝাঁক প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খেতে লাগল_মুক্তিযুদ্ধের ফলস্বরূপ যে বাংলদেশ, সেটা কোথায়? এই সরল প্রশ্নটির পিছু পিছু একটি জটিল প্রশ্ন এসে হাজির হলো_মুক্তিযুদ্ধের ফলস্বরূপ যে বাংলাদেশটি তার চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কী? তখনই এ নির্ভেজাল সত্যটি মেনে নিতে হলো বাংলাদেশ একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্র, যার সীমানায় বাঁধা পড়েছে বাঙালি ও আদিবাসী এবং এসব কোটি নরনারী-শিশুর দেহ-মন মিলিয়েই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির সত্তা। অথচ এই নির্ভেজাল মহাসত্যটি আমাদের ভাবনায় কেন ধরা পড়ে না?
জে এম রবার্টস তাঁর লেখা 'হিস্টরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড' বইটি শেষ করেছেন যে প্যারাগ্রাফটি দিয়ে তার অনূদিত উদ্ধৃতি এই : 'বিশ্ব ইতিহাসের পাঠকদের অনেকের কাছে ইতিহাসের ঘটনাগুলো হতাশাব্যঞ্জক মনে হতে পারে, তথাপি অনিশ্চয়তার কারণে এমনটি কিংবা অমনটি ধারণা করার জোরালো কোনো হেতু নেই। এটা অবশ্য সত্য যে অনেক বেশি সম্ভাবনার কথা ভেবেই তারা হতাশ। একজন ইতিহাসবিদ হওয়ার বাড়তি সুবিধা এই যে কোনো সমস্যার পরিণতি যা হোক না কেন তিনি কম অবাক হন। কারণ তার কাছে দুটি সর্বজনীন সত্য প্রকাশমান। একটি হচ্ছে, ঘটনাগুলোর অনেক বেশি পরিবর্তন ঘটে ও সেগুলো দ্রুত হয়, যা ধারণাতীত। অন্যটি হচ্ছে, ঘটনাগুলোর অনেক কম পরিবর্তন ঘটে ও সেগুলো ধীরে হয়_সেটাও ধারণাতীত। ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক, যা ঘটে সেটা সবাইকে অবাক করে।'
ইতিপূর্বে বলেছি, বাংলা ভাষা আন্দোলনের অবশ্যম্ভাবী কিংবা বলা যায় চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, সেটা যদিও ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে আদিবাসীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সেই যুদ্ধে লাখ লাখ শহীদ ও নির্যাতিতের মধ্যে আদিবাসীও ছিল, যার একটাই কারণ, বাংলাদেশের প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসা। যখন কেউ বুঝতে পারেন এটিই তাঁর মনের মতো জায়গা, তখনই এটা হয় তাঁর স্বদেশ। এই খাল-বিল-নদী-মাঠ-বন-পাহাড়-সাগর তখনই হয়ে যায় তাঁর_এগুলোর একটি কণারও মালিক না হয়ে। ধানের ক্ষেতে এভাবেই বাতাস খেলে যায়, অন্য কোনোভাবেই নয় কিংবা শর্ষের ক্ষেতে এভাবেই হলুদ রঙের নাচন খেলে যায়, অন্য কোনোভাবেই নয় কিংবা পাহাড়ে এভাবেই পশুপাখি-মানুষ মিলেমিশে বেড়ে ওঠে, সে জন্য কিংবা আকাশে মেঘের যে খেলা দেখে অভ্যস্ত, বোধ হয় তারই জন্য। এ রকম হাজার হাজার কারণ থাকতে পারে, যার তালিকা দিতে পারা যাবে না, যার সব বিষয়ে আমরা সচেতনও নই, অথচ তার প্রভাব আমাদের রক্তে বংশপরম্পরায় মিশে আছে। এই যে বোধ, এটা কোনো রাজনীতির প্রভাব দিয়ে গড়া নয়, এটা ব্যক্তিবোধ, যা দিয়ে আমরা দেশকে ভালোবাসি।
মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ-ফেরদৌসীর লেখা 'মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও চা-জনগোষ্ঠী' বইটি থেকে সাহায্য নিয়ে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার কথা লিখছি আমার আজকের লেখাটির মুখবন্ধ হিসেবে। ১৯৭১ সালে পরিমল দ্রং এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে তুরা শহরে ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। অতঃপর ১১ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হন এবং নাগলা ব্রিজ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। ফিরতি পথে তিনি শত্রু বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং কয়েক দিন নির্যাতন করে ফুলপুর থানার কংস নদের তীরে এনে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর স্কুলের শহীদ মিনারটি শহীদ পরিমল দ্রংয়ের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে এবং হালুয়াঘাট মধ্যবাজারে তাঁর নামে একটি মার্কেটের নামকরণ হয়েছে। গারো নারী ভেরোনিকা সিমসাং স্থানীয় মিশন হাসপাতালের নার্স ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ফিল্ড হাসপাতালে যোগ দেন এবং নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে জামালপুর এলাকায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
শম্ভু সিং চা শ্রমিকের পুত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল বিশ কিংবা বাইশ। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে পরপর কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। একদিন মুক্তিসেনারা পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি বালিশিরা ভ্যালি ক্লাব আক্রমণ করেন। এই দলে শম্ভু সিং ছিলেন। তাঁরা এতটা এগিয়ে যান যে সংঘর্ষ হাতাহাতি পর্যায়ে পেঁৗছায় এবং শম্ভু সিং ধরা পড়েন। অতঃপর শুরু হয় নির্যাতন। তাঁর শরীরের একটা অংশ কেটে আলাদা করা হয়। এভাবে তিনি শহীদ হন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার ধলাই চা বাগানের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবময় ঘটনা। এ যুদ্ধেই বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান শহীদ হন। টিলার গা-ঘেঁষা শত্রু বাহিনীর বাংকারের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য না জানায় সেখানে যুদ্ধরত ভারতীয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ বাহিনীকে বাংকারে অবস্থান নির্দেশের উদ্দেশ্যে গুরুনাভর কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে গোপনে বাংকারের কাছে গিয়ে সংকেত দিতে থাকেন। কিন্তু তাঁর দেওয়া সংকেত যৌথ বাহিনীর সেনারা বুঝতে না পারায় তিনি উপায়ান্তর না দেখে বাংকারের ওপর উঠে চিৎকার করে ওঠেন। ঠিক তখনই শত্রুর গুলিতে তাঁর বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যু সার্থক হয়। ধলাই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ঘটে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে রোধ করার জন্য পাঁচ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা জাউয়া সেতু উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কাকন বিবি (খাসিয়া আদিবাসী) গভীর রাতে জেলেনি ছদ্মবেশে কলার ভেলায় মাইন ও গোলাবারুদ নিয়ে সেতুর কাছে পেঁৗছেন ও মুক্তিবাহিনী জাউয়া সেতু উড়িয়ে দেয়।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত মুখবন্ধ থেকে বোধ করি আমরা এ সিদ্ধান্তগুলোতে সহজেই আসতে পারি, যদিও রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই এই দাবি ও আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সংঘটন, তবুও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক কাঠামোতে বাঁধা আদিবাসীও ইতিহাসের সরল নিয়মে মুুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, যার কারণ বাঙালি ও আদিবাসী উভয়েরই বাংলাদেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং কেন এই অগাধ ভালোবাসা তার উৎসকথাও ইতিপূর্বে বলেছি। এ ভালোবাসার কোনো কমবেশি ছিল না। তাই মুক্তিযুদ্ধে একজন বাঙালি যেমন অকাতরে জীবন দিয়েছিলেন, তেমনি একজন আদিবাসীও মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে তাঁর জীবন দিয়েছিলেন। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি, আমাদের সবার বোধে থাকতে হবে, এটা একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্র, যার ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়েছে বাঙালি এবং কমপক্ষে ১৯টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যাদের প্রত্যেকের আছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও দার্শনিক মূল্যবোধ।
শীতার্ত হলে গরম কম্বলটি গায়ে দিতে মনে পড়ে অনেকের কথা, যাদের শীতবস্ত্র নেই কিংবা ক্ষুধার্ত হয়ে খাবার মুখে দিলে মনে পড়ে ক্ষুধার্তদের কথা। এটাকে আমি বলব প্রকৃত অর্থে বিবেকের দংশন। একজন পণ্ডিতের উক্তি, আমাদের বিবেক হচ্ছে ত্রিকোণ পাথরের মতো। খোঁচা খেতে খেতে কোণ তিনটি মসৃণ হয়ে গেলে বিবেকের দংশন আমরা আর অনুভব করি না। আমরা কি সে অবস্থায় পেঁৗছে গেছি? ভাষা আন্দোলনের মাসে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে আমরা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে ছুটে যাই, সেখানে প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান উপভোগ করি। বইমেলায় বই কিনে নতুন মলাটের ঘ্রাণ নিই, বাড়িতে ফিরে বইগুলো পড়ি, সযতনে তাকে তুলে রাখি, তখন কেন আমাদের মনে হয় না তেমন একটি আদিবাসী একাডেমীর প্রয়োজনীয়তা; যেখানে আদিবাসীর ভাষা ও সংস্কৃতিগুলোর চর্চা হবে, বিকশিত হবে।
আজ যেমন আদিবাসীরা বাংলা একাডেমীর বইমেলায় ঘুরে বেড়ায়, বাঙালিদের আনন্দের ভাগ নেয়, তেমনি আনন্দে বাঙালিরা আদিবাসী একাডেমী প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াবে, আদিবাসীর ভাষা-সংস্কৃতির পরিচয় পাবে। বাঙালি আর আদিবাসী মিলেমিশে বাংলাদেশে একটি মহাজাতির জন্ম হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ,
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
জে এম রবার্টস তাঁর লেখা 'হিস্টরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড' বইটি শেষ করেছেন যে প্যারাগ্রাফটি দিয়ে তার অনূদিত উদ্ধৃতি এই : 'বিশ্ব ইতিহাসের পাঠকদের অনেকের কাছে ইতিহাসের ঘটনাগুলো হতাশাব্যঞ্জক মনে হতে পারে, তথাপি অনিশ্চয়তার কারণে এমনটি কিংবা অমনটি ধারণা করার জোরালো কোনো হেতু নেই। এটা অবশ্য সত্য যে অনেক বেশি সম্ভাবনার কথা ভেবেই তারা হতাশ। একজন ইতিহাসবিদ হওয়ার বাড়তি সুবিধা এই যে কোনো সমস্যার পরিণতি যা হোক না কেন তিনি কম অবাক হন। কারণ তার কাছে দুটি সর্বজনীন সত্য প্রকাশমান। একটি হচ্ছে, ঘটনাগুলোর অনেক বেশি পরিবর্তন ঘটে ও সেগুলো দ্রুত হয়, যা ধারণাতীত। অন্যটি হচ্ছে, ঘটনাগুলোর অনেক কম পরিবর্তন ঘটে ও সেগুলো ধীরে হয়_সেটাও ধারণাতীত। ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক, যা ঘটে সেটা সবাইকে অবাক করে।'
ইতিপূর্বে বলেছি, বাংলা ভাষা আন্দোলনের অবশ্যম্ভাবী কিংবা বলা যায় চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, সেটা যদিও ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে আদিবাসীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সেই যুদ্ধে লাখ লাখ শহীদ ও নির্যাতিতের মধ্যে আদিবাসীও ছিল, যার একটাই কারণ, বাংলাদেশের প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসা। যখন কেউ বুঝতে পারেন এটিই তাঁর মনের মতো জায়গা, তখনই এটা হয় তাঁর স্বদেশ। এই খাল-বিল-নদী-মাঠ-বন-পাহাড়-সাগর তখনই হয়ে যায় তাঁর_এগুলোর একটি কণারও মালিক না হয়ে। ধানের ক্ষেতে এভাবেই বাতাস খেলে যায়, অন্য কোনোভাবেই নয় কিংবা শর্ষের ক্ষেতে এভাবেই হলুদ রঙের নাচন খেলে যায়, অন্য কোনোভাবেই নয় কিংবা পাহাড়ে এভাবেই পশুপাখি-মানুষ মিলেমিশে বেড়ে ওঠে, সে জন্য কিংবা আকাশে মেঘের যে খেলা দেখে অভ্যস্ত, বোধ হয় তারই জন্য। এ রকম হাজার হাজার কারণ থাকতে পারে, যার তালিকা দিতে পারা যাবে না, যার সব বিষয়ে আমরা সচেতনও নই, অথচ তার প্রভাব আমাদের রক্তে বংশপরম্পরায় মিশে আছে। এই যে বোধ, এটা কোনো রাজনীতির প্রভাব দিয়ে গড়া নয়, এটা ব্যক্তিবোধ, যা দিয়ে আমরা দেশকে ভালোবাসি।
মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ-ফেরদৌসীর লেখা 'মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও চা-জনগোষ্ঠী' বইটি থেকে সাহায্য নিয়ে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার কথা লিখছি আমার আজকের লেখাটির মুখবন্ধ হিসেবে। ১৯৭১ সালে পরিমল দ্রং এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে তুরা শহরে ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। অতঃপর ১১ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হন এবং নাগলা ব্রিজ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। ফিরতি পথে তিনি শত্রু বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং কয়েক দিন নির্যাতন করে ফুলপুর থানার কংস নদের তীরে এনে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর স্কুলের শহীদ মিনারটি শহীদ পরিমল দ্রংয়ের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে এবং হালুয়াঘাট মধ্যবাজারে তাঁর নামে একটি মার্কেটের নামকরণ হয়েছে। গারো নারী ভেরোনিকা সিমসাং স্থানীয় মিশন হাসপাতালের নার্স ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ফিল্ড হাসপাতালে যোগ দেন এবং নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে জামালপুর এলাকায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
শম্ভু সিং চা শ্রমিকের পুত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল বিশ কিংবা বাইশ। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে পরপর কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। একদিন মুক্তিসেনারা পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি বালিশিরা ভ্যালি ক্লাব আক্রমণ করেন। এই দলে শম্ভু সিং ছিলেন। তাঁরা এতটা এগিয়ে যান যে সংঘর্ষ হাতাহাতি পর্যায়ে পেঁৗছায় এবং শম্ভু সিং ধরা পড়েন। অতঃপর শুরু হয় নির্যাতন। তাঁর শরীরের একটা অংশ কেটে আলাদা করা হয়। এভাবে তিনি শহীদ হন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার ধলাই চা বাগানের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবময় ঘটনা। এ যুদ্ধেই বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান শহীদ হন। টিলার গা-ঘেঁষা শত্রু বাহিনীর বাংকারের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য না জানায় সেখানে যুদ্ধরত ভারতীয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ বাহিনীকে বাংকারে অবস্থান নির্দেশের উদ্দেশ্যে গুরুনাভর কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে গোপনে বাংকারের কাছে গিয়ে সংকেত দিতে থাকেন। কিন্তু তাঁর দেওয়া সংকেত যৌথ বাহিনীর সেনারা বুঝতে না পারায় তিনি উপায়ান্তর না দেখে বাংকারের ওপর উঠে চিৎকার করে ওঠেন। ঠিক তখনই শত্রুর গুলিতে তাঁর বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যু সার্থক হয়। ধলাই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ঘটে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে রোধ করার জন্য পাঁচ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা জাউয়া সেতু উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কাকন বিবি (খাসিয়া আদিবাসী) গভীর রাতে জেলেনি ছদ্মবেশে কলার ভেলায় মাইন ও গোলাবারুদ নিয়ে সেতুর কাছে পেঁৗছেন ও মুক্তিবাহিনী জাউয়া সেতু উড়িয়ে দেয়।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত মুখবন্ধ থেকে বোধ করি আমরা এ সিদ্ধান্তগুলোতে সহজেই আসতে পারি, যদিও রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই এই দাবি ও আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সংঘটন, তবুও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক কাঠামোতে বাঁধা আদিবাসীও ইতিহাসের সরল নিয়মে মুুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, যার কারণ বাঙালি ও আদিবাসী উভয়েরই বাংলাদেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং কেন এই অগাধ ভালোবাসা তার উৎসকথাও ইতিপূর্বে বলেছি। এ ভালোবাসার কোনো কমবেশি ছিল না। তাই মুক্তিযুদ্ধে একজন বাঙালি যেমন অকাতরে জীবন দিয়েছিলেন, তেমনি একজন আদিবাসীও মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে তাঁর জীবন দিয়েছিলেন। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি, আমাদের সবার বোধে থাকতে হবে, এটা একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্র, যার ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়েছে বাঙালি এবং কমপক্ষে ১৯টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যাদের প্রত্যেকের আছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও দার্শনিক মূল্যবোধ।
শীতার্ত হলে গরম কম্বলটি গায়ে দিতে মনে পড়ে অনেকের কথা, যাদের শীতবস্ত্র নেই কিংবা ক্ষুধার্ত হয়ে খাবার মুখে দিলে মনে পড়ে ক্ষুধার্তদের কথা। এটাকে আমি বলব প্রকৃত অর্থে বিবেকের দংশন। একজন পণ্ডিতের উক্তি, আমাদের বিবেক হচ্ছে ত্রিকোণ পাথরের মতো। খোঁচা খেতে খেতে কোণ তিনটি মসৃণ হয়ে গেলে বিবেকের দংশন আমরা আর অনুভব করি না। আমরা কি সে অবস্থায় পেঁৗছে গেছি? ভাষা আন্দোলনের মাসে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে আমরা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে ছুটে যাই, সেখানে প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান উপভোগ করি। বইমেলায় বই কিনে নতুন মলাটের ঘ্রাণ নিই, বাড়িতে ফিরে বইগুলো পড়ি, সযতনে তাকে তুলে রাখি, তখন কেন আমাদের মনে হয় না তেমন একটি আদিবাসী একাডেমীর প্রয়োজনীয়তা; যেখানে আদিবাসীর ভাষা ও সংস্কৃতিগুলোর চর্চা হবে, বিকশিত হবে।
আজ যেমন আদিবাসীরা বাংলা একাডেমীর বইমেলায় ঘুরে বেড়ায়, বাঙালিদের আনন্দের ভাগ নেয়, তেমনি আনন্দে বাঙালিরা আদিবাসী একাডেমী প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াবে, আদিবাসীর ভাষা-সংস্কৃতির পরিচয় পাবে। বাঙালি আর আদিবাসী মিলেমিশে বাংলাদেশে একটি মহাজাতির জন্ম হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ,
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
No comments