মিডিয়া ভাবনা-চাই সংবাদ জাদুঘর, নিউজিয়াম by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

৪ নভেম্বর প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ‘কাঙালের অমূল্য রতন’ শিরোনামে আশীষ-উর-রহমানের একটি চমৎকার ফিচার পড়েছি। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে প্রকাশিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা (১৮৬৩) পত্রিকার প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রটি সম্পর্কে এই ফিচারে পাঠককে নানা কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য জানিয়েছেন। লেখাটির সঙ্গে ছিল সেই ঐতিহ্যবাহী মুদ্রণযন্ত্রটির ছবি।


বাংলাদেশের গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতেই এই মুদ্রণযন্ত্রটি এখন রয়েছে।
স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজদের প্রজাপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ মানুষের ব্যথাবেদনাকে ভাষা দেওয়ার জন্য কাঙাল হরিনাথ ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন মাসিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা। পরে তা পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক রূপে প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে পত্রিকাটি কলকাতা থেকে মুদ্রিত হলেও ১৮৭৩ সাল থেকে এ মেশিনেই গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা মুদ্রিত হতে থাকে।
সেই ইতিহাসখ্যাত বা ইতিহাসের অংশীদার প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রটি এখনো কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে রয়েছে, এটা আমাদের অশেষ সৌভাগ্য। কাঙাল হরিনাথের আত্মীয়পরম্পরা এই মুদ্রণযন্ত্র এখনো সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন, যা অভাবনীয়। এই পরিবারের সদস্যদের প্রতি ইতিহাসসচেতন ব্যক্তিমাত্রই কৃতজ্ঞ। আশীষ-উর-রহমানকে ধন্যবাদ, তিনি এই মুদ্রণযন্ত্রটির সচিত্র আখ্যান পাঠকদের জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস কম উজ্জ্বল নয়। রঙ্গপুর বার্তাবহ (১৮৪৭) থেকে হালের কালের কণ্ঠ (২০১০)—ইতিহাস কম প্রাচীনও নয়। কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো টিকে রয়েছে সেই প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্র।
আমার প্রস্তাব: এই ইতিহাসখ্যাত মুদ্রণযন্ত্রটি এর বর্তমান মালিককে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে জাতীয় জাদুঘরে রাখার ব্যবস্থা করা হোক। দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার তেমন প্রাচীন ও উজ্জ্বল নিদর্শন জাতীয় জাদুঘরে নেই। এই মুদ্রণযন্ত্রটি যেমন সেই অভাব কিছুটা পূরণ করবে, তেমনি প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রটি হাজার হাজার দর্শকের সামনেও উপস্থাপন করা হবে তার পরিচিতিসমেত। মেশিনের পাশে রাখা যেতে পারে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার একটি কপি ও সম্পাদক হরিনাথ মজুমদারের ছবি।
কাজটি খুব কঠিন হবে না। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী যদি উদ্যোগী হন, এই প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রটি তার গৌরব নিয়ে জাতীয় জাদুঘরে স্থান পেতে পারে। আশা করি কুষ্টিয়াবাসী এ ব্যাপারে অমত করবে না।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ইতিহাস খুবই উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকে এই ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত নয়। অনাগত প্রজন্মও ঠিকভাবে পরিচিত হবে কি না সন্দেহ। সাংবাদিকদের কোনো প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি জাতীয় প্রেসক্লাবও কোনো বরেণ্য সাংবাদিকের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে না। একাত্তরে শহীদ সাংবাদিক ছাড়া অন্য কোনো বরেণ্য সাংবাদিককে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরসূরিরা স্মরণ করেন না।
আমার প্রস্তাব: বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের নির্মীয়মাণ ভবনে আরও দুটি ফ্লোর সংযুক্ত করে একটি নিউজিয়াম (সংবাদ জাদুঘর) প্রতিষ্ঠা করা হোক। পৃথিবীর নানা দেশে এ রকম নিউজিয়াম রয়েছে। এটা অবাস্তব চিন্তা নয়। তথ্য মন্ত্রণালয় আগ্রহী হলে শুধু সংবাদ জাদুঘর নয়, চলচ্চিত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জাদুঘরও প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এফডিসি, জাতীয় বেতার ভবন ও রামপুরার বিটিভি ভবনেই এ রকম জাদুঘর তৈরি করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী মিডিয়া প্রযুক্তি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই বিলীয়মান প্রযুক্তির নানা উপাদান সংরক্ষণ করা দরকার। জাদুঘর ছাড়া এই কাজ আর কে করতে পারে?
এই প্রকল্প পদ্মা সেতুর মতো কোনো মেগা প্রকল্প নয়। প্রথমে ছোট আকারেও শুরু করা যেতে পারে, যদি থাকে সদিচ্ছা। এসব অব্যবসায়ী ও অলাভজনক কাজ অন্য কেউ করতে আগ্রহী হবে না, সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
সংবাদপত্র জগতের বহু কিছু এখন হারিয়ে গেছে। একালের অনেক সাংবাদিক নিউজপ্রিন্ট ও বলপয়েন্ট ব্যবহার করেন না। টাইপরাইটার কী, অনেক নবীন সাংবাদিক চোখেও দেখেননি। প্রেস টেলিগ্রাম কাকে বলে তাও অনেক সাংবাদিক জানেন না। ছাপার কাজে শিসার টাইপও অনেকে দেখেননি। দেখেননি ছাপার ট্রেডল মেশিনও। আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। এখনই এসব বস্তু সংরক্ষণ করা উচিত। এমন একদিন আসতে পারে, যেদিন সংরক্ষণের জন্যও এসব সামগ্রী আর পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে এত বড় মাপের কয়েকজন সাংবাদিক বা সম্পাদক বাংলাদেশে আর কখনো জন্ম নেবেন কি না জানি না। দেশের সাংবাদিকতার যে চিত্র দেখছি, তাতে ভরসা খুব কম।
মওলানা আকরম খাঁ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, মুজীবর রহমান খাঁ, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস এবং তাঁদের মতো মনীষী সাংবাদিকদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র কি এখন পাওয়া যাবে? তাঁদের লেখার কোনো পাণ্ডুলিপি? রেফারেন্স ফাইল? মানিক মিয়ার ব্যবহূত সেই বিখ্যাত ইজিচেয়ারটি?
এখনো উদ্যোগ নিলে হয়তো কিছু স্মারক পাওয়া যেতে পারে। অন্তত সেগুলো তো আমরা নিউজিয়ামে রাখতে পারি। এই উদ্যোগ নিতে দেরি হলে হয়তো কিছুই আর পাওয়া যাবে না।
আমাদের তথ্যমন্ত্রী মিডিয়া জগতেরই লোক। তিনি কি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.