প্রশাসন-আমলাতন্ত্র, তোমাকে সালাম! by ফারুক ওয়াসিফ
আমলাতন্ত্র হলো সহজকে কঠিন করে তোলার শিল্প। এটা হলো সেই খেলা, যেখানে সবাইকে গোল হয়ে দাঁড়াতে হয়। খেলার শর্তটাই এমন যে, কিছু করবেন তো ধরা খাবেন। তাই কেউ কিছু করে না, খেলা চলতে থাকে। এর আরেক নাম গোলকধাঁধা। আমাদের দুই প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক এখন সেই গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে বেচঈন।
কানাডা থেকে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে গত বছরটির প্রথম ছয় মাসে তাঁরা ২২টি দেশ পার হতে পারলেও, গত ছয় মাসে ফাইলবন্দী হয়ে আছেন। তাঁরা নিস্তার পেলেও তাঁদের বাহনটি আটক। এক কোটি টাকার মাশুল না হলে সেটি ছাড়া হবে না, অর্থাৎ ছাড়পত্র পাবেন না। বিখ্যাত কৌতুকপ্রতিভা ভানুর একটি কথা মনে পড়ে, এত ঘিরিঙ্গি যদি তাইলে আমি যুদ্ধেই যামু না। দুই বাঙালি পর্যটকেরও দশা তেমনই। হাড়ে হাড়ে তাঁরা বুঝেছেন, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। বিশ্বজয় যেমন-তেমন, বঙ্গদেশ অজেয়ই থাকবে। মোগল-রাজপুতরা এ জন্যই বুঝি বাংলায় আসতে ভয় পেতেন।
প্রবাদ আছে, ‘পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।’ মোগলাই খানার আতিশয্য সবার জন্য নাকি সুখকর হতো না। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের বিষয়েও তেমন করে বলা যায়, ‘পড়েছ আমলার হাতে, ঘুরতে হবে পাকে পাকে।’ আমলাতন্ত্রের অলিগলি-সুড়ঙ্গপথে ঘুরতে ঘুরতে দুই পর্যটকের গতি দুর্গতির দশা পেয়েছে। ভাগ্যিস, বিশ্বখ্যাত রোমাঞ্চ কাহিনির জনক জুল ভার্ন তাঁর আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ-এর নায়ককে কলকাতা ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেও বাংলাদেশে ঢোকাননি! ঢুকলে আশি দিনে বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন ধরা খাওয়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল। সত্যি, আমাদের আমলাতন্ত্রের ফাইল-সেনাপতিরা অতি পরাক্রমশালী! অথচ রাষ্ট্র-সরকার তাঁরাই চালান, সামনে থাকেন রাজনীতিবিদেরা। রাজনীতিবিদদের অপকর্মের তবু কিছু শাস্তি তবু, অন্তত জনতার ধিক্কার তাদের শুনতে হয়। কিন্তু যাদের বাস মগডালে, তাঁদের ধরবে কে? বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র বিচারের ঊর্ধ্বে। রাজা যায় রানি আসে, কিন্তু তাঁরা থেকে যান বহাল তবিয়তে।
কানাডাপ্রবাসী একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার সালাউদ্দিন ৫৭ বছর বয়সী এক উদ্যমী মানুষ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেক কানাডীয় নাগরিক স্যাল বয়কে সঙ্গে নিয়ে তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন। তাঁদের বাহন ‘পরিবেশ বাঁচাও, বিশ্ব বাঁচাও, পরিবার বাঁচাও, স্বাস্থ্য বাঁচাও’ স্লোগান লেখা নিজস্ব একটি গাড়ি। গত বছরের ২ আগস্ট কানাডা থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তাঁরা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, ভারতসহ ২২টি দেশ পেরিয়ে গত মে মাসে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। সঙ্গের গাড়িটিকে পাকিস্তান থেকে জাহাজে করে পাঠানো হয় বাংলাদেশে। গাড়িটি পৌঁছায় ঠিকই, কিন্তু সেটিকে ছাড়ানো আর হয় না। গাড়ির পিছু পিছু ছুটতে গিয়ে তাঁদের এখন ‘আমলাতান্ত্রিক বিশ্ব’ নামে আরেক ‘বিশ্ব’ দর্শন করতে হচ্ছে। এই বিশ্বে কোনো সম্রাট নেই, সবাই রাজা। কে দেবে সিদ্ধান্ত? ইনি ওনাকে দেখান, উনি তেনার কথা বলেন। গোলকধাঁধা ঘুরতে থাকে।
দুই পর্যটকের আরেক ‘বিশ্বভ্রমণ’ শুরু হয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। বাণিজ্য, শুল্ক, বন্দর কর্তৃপক্ষ, এনবিআরসহ যত মন্ত্রণালয়ের যত কর্মকর্তার দরবারে তাঁদের দৌড়াতে হয়েছে, তত দূর দৌড়ালে সম্ভবত আরও কয়েকটি দেশ অতিক্রম করা যেত। ২২টি দেশের কেউ বলল না, কিন্তু বাংলাদেশের ‘নীতিবাগীশ’ আমলাতন্ত্র প্রশ্ন তুলল—কাগজ কই, অনুমতি কই, ট্যাক্স কই ইত্যাদি। দশচক্রে ভগবান নাকি ভূত হয়ে যান, আর বিশ্বভ্রমণের নায়ক সালাউদ্দিন আমলাতন্ত্রের পাকেচক্রে ঘুরে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বেরিয়ে এলেন ‘আইন ভঙ্গকারী’ হিসেবে। গাড়ি পেতে এখন তাঁদের সরকারের কোষাগারে এক কোটি টাকা ঢালতে হবে।
এই টাকা তাঁরা কোথায় পাবেন বা এ রকম ভোগান্তিরই বা কী মানে? পর্যটকের গাড়ির মাশুল আবার কী? এনবিআরের এক কর্মকর্তা জোশের বশে অবিস্মরণীয় উত্তর দিয়েছেন, ‘অন্য দেশ যা করে করুক, এ দেশে কোনো ধানাইপানাই নেই।’ এমন দেশপ্রেম, এমন আইনের প্রতি নিষ্ঠা দেখলে ধন্যি ধন্যি করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দেশের বাস্তবতা বলে, ধন্য আশা কুহকিনী! এমনই নিষ্ঠাবান আমলাতন্ত্র থাকলে সোনার বাংলা কবে কায়েম হয়ে যেত! তা যে হয়নি, তার দায় নিশ্চয়ই দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ এবং ফাঁকিবাজ জনগণের, আমলাতন্ত্র সম্পূর্ণ মাসুম বান্দা। একজন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা অভিযাত্রীকে যাঁরা নাকে দড়ি দিয়ে ছয় মাস ঘোরাতে পেরেছেন, তাঁরা ‘ধানাইপানাই’ কর্মের তুখোড় ধোনকার ছাড়া আর কী? দক্ষতা ও নিষ্ঠার এই বলিহারি বাড়াবাড়ি দেখে, এদেশীয় আমলাতন্ত্রের গোড়াপত্তনকারী ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরাও লজ্জা পেত। বলত, এতটুকু চাইনি বৎসে, চেয়েছিলাম আরও কিছু কম!
চেক সাহিত্যিক ফ্রানজ কাফকা লিখেছিলেন, প্রতিটি বিপ্লবই একসময় উবে যায়, কিন্তু পেছনে রেখে যায় একদলা আঠালো পদার্থ; নতুন এক আমলাতন্ত্র। ব্রিটিশ শাসন ছিল প্রতিবিপ্লব। তাদের তৈরি আমলাতন্ত্রের নিয়ত ছিল পাবলিককে বশে রাখা, সেবা করা নয়। আমাদের আমলাতন্ত্র তারই উত্তরাধিকার। স্বাধীনতার পরে সেই উত্তরাধিকার ত্যাগ না করে বরং আরও পাকাপোক্তই করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র দেশপ্রেমিক আমলাকে অচিরেই কোণঠাসা করে ফেলে। ফল, যেই লাউ সেই কদু; কুমড়োপটাশ বললেও কম বলা হয় না।
মানুষের উদ্যম ও শুভস্বপ্নকে ব্যর্থ করে দেওয়ার যে দক্ষতা বাংলাদেশের অনেক কর্তাব্যক্তির আছে, সেটা সত্যিই জাতীয় ‘গর্বের’ বিষয়। সমাজের অনেক মানুষের অনেক ভালো উদ্যোগ, অনেক সৃষ্টিশীলতা অঙ্কুরেই দম হারায় এঁদের কারণেই। ক্ষমতাবানদের সহযোগিতা চাই না, অন্তত তাঁরা বাধা না দিন। এই কাজে আমলাতন্ত্রও বিশিষ্ট। কার্ল মার্ক্স আমলাদের বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, নিজেদের নাককেই তাঁরা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেই অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাঁদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ।
সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের হাতিয়ার হলো আমলাতন্ত্র। অনেক সময় তারাই সরকারের মস্তিষ্ক হিসেবেও কাজ করে। দুর্নীতি, অনিয়ম, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি, দলবাজিসহ বহু ক্ষেত্রে এই হাতিয়ারের মোক্ষম ব্যবহার দেখা যায়। বিদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি ও লেনাদেনার বেলাতেও তাদেরই হিসাব-নিকাশ, কৌশল ইত্যাদিতে পটুতা দেখানোর কথা। কিন্তু যাদের অনেকেই নিজেদের স্বার্থকেই জাতীয় স্বার্থ মনে করে, জাতীয় স্বার্থ তো তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার বাজি। সেই বাজিতে তারা জিতলে দেশ জেতে না, আর দেশের জয় মানে তাদের হার।
গতিশীল দেশ থেকে আসা একজন প্রবাসী বাঙালি পর্যটকের এই দুর্গতিকে স্ট্যান্ডার্ড ধরলে বাংলাদেশের অগণিত দরিদ্র-সাধারণ কৃষক-মজুরের প্রতি এই আমলাতন্ত্রের আচরণকে কী বলব? কী বলব, প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি তাদের আচরণকে? এক কথায় জবাব হবে, ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এই মানসিকতা মানুষকে একটি সংখ্যা বা ফাইল ভাবে, জীবন ভাবে না। আমলাতন্ত্র নিজেকে অদৃশ্য রাখে, আর সামনে আনে আইন-বিধি-নিষেধ। সাধারণ মানুষের নিজেকে আড়াল করার কোনো উপায় নেই। ইনভিজিবল ম্যান ছবির সেই অদৃশ্য মানুষটি নিজের চামড়াকে অদৃশ্য করতে জানলেও রক্তকে লুকাতে পারে না। আহত হলে চামড়া ফুঁড়ে সেই রক্ত বেরোলে সে ধরা পড়ে যায়। একইভাবে অদৃশ্য আমলাতন্ত্রের চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, জনগণের দুঃখ-কষ্টের প্রকাশের ভেতর দিয়ে। আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার খুঁটি আদালত ও প্রশাসন তথা কোর্টকাচারি থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তরগুলোর ইট-কাঠ-বারান্দা তার সাক্ষী। কত রকমের সংস্কারের রমরমা দেশে, কিন্তু এর কি কোনো সংস্কার হবে না?
সব পথ যেখানে থেমে যায়, দুর্গতির সেই আমলাতন্ত্র, তোমাকে সালাম।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
প্রবাদ আছে, ‘পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।’ মোগলাই খানার আতিশয্য সবার জন্য নাকি সুখকর হতো না। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের বিষয়েও তেমন করে বলা যায়, ‘পড়েছ আমলার হাতে, ঘুরতে হবে পাকে পাকে।’ আমলাতন্ত্রের অলিগলি-সুড়ঙ্গপথে ঘুরতে ঘুরতে দুই পর্যটকের গতি দুর্গতির দশা পেয়েছে। ভাগ্যিস, বিশ্বখ্যাত রোমাঞ্চ কাহিনির জনক জুল ভার্ন তাঁর আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ-এর নায়ককে কলকাতা ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেও বাংলাদেশে ঢোকাননি! ঢুকলে আশি দিনে বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন ধরা খাওয়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল। সত্যি, আমাদের আমলাতন্ত্রের ফাইল-সেনাপতিরা অতি পরাক্রমশালী! অথচ রাষ্ট্র-সরকার তাঁরাই চালান, সামনে থাকেন রাজনীতিবিদেরা। রাজনীতিবিদদের অপকর্মের তবু কিছু শাস্তি তবু, অন্তত জনতার ধিক্কার তাদের শুনতে হয়। কিন্তু যাদের বাস মগডালে, তাঁদের ধরবে কে? বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র বিচারের ঊর্ধ্বে। রাজা যায় রানি আসে, কিন্তু তাঁরা থেকে যান বহাল তবিয়তে।
কানাডাপ্রবাসী একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার সালাউদ্দিন ৫৭ বছর বয়সী এক উদ্যমী মানুষ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেক কানাডীয় নাগরিক স্যাল বয়কে সঙ্গে নিয়ে তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন। তাঁদের বাহন ‘পরিবেশ বাঁচাও, বিশ্ব বাঁচাও, পরিবার বাঁচাও, স্বাস্থ্য বাঁচাও’ স্লোগান লেখা নিজস্ব একটি গাড়ি। গত বছরের ২ আগস্ট কানাডা থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তাঁরা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, ভারতসহ ২২টি দেশ পেরিয়ে গত মে মাসে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। সঙ্গের গাড়িটিকে পাকিস্তান থেকে জাহাজে করে পাঠানো হয় বাংলাদেশে। গাড়িটি পৌঁছায় ঠিকই, কিন্তু সেটিকে ছাড়ানো আর হয় না। গাড়ির পিছু পিছু ছুটতে গিয়ে তাঁদের এখন ‘আমলাতান্ত্রিক বিশ্ব’ নামে আরেক ‘বিশ্ব’ দর্শন করতে হচ্ছে। এই বিশ্বে কোনো সম্রাট নেই, সবাই রাজা। কে দেবে সিদ্ধান্ত? ইনি ওনাকে দেখান, উনি তেনার কথা বলেন। গোলকধাঁধা ঘুরতে থাকে।
দুই পর্যটকের আরেক ‘বিশ্বভ্রমণ’ শুরু হয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। বাণিজ্য, শুল্ক, বন্দর কর্তৃপক্ষ, এনবিআরসহ যত মন্ত্রণালয়ের যত কর্মকর্তার দরবারে তাঁদের দৌড়াতে হয়েছে, তত দূর দৌড়ালে সম্ভবত আরও কয়েকটি দেশ অতিক্রম করা যেত। ২২টি দেশের কেউ বলল না, কিন্তু বাংলাদেশের ‘নীতিবাগীশ’ আমলাতন্ত্র প্রশ্ন তুলল—কাগজ কই, অনুমতি কই, ট্যাক্স কই ইত্যাদি। দশচক্রে ভগবান নাকি ভূত হয়ে যান, আর বিশ্বভ্রমণের নায়ক সালাউদ্দিন আমলাতন্ত্রের পাকেচক্রে ঘুরে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বেরিয়ে এলেন ‘আইন ভঙ্গকারী’ হিসেবে। গাড়ি পেতে এখন তাঁদের সরকারের কোষাগারে এক কোটি টাকা ঢালতে হবে।
এই টাকা তাঁরা কোথায় পাবেন বা এ রকম ভোগান্তিরই বা কী মানে? পর্যটকের গাড়ির মাশুল আবার কী? এনবিআরের এক কর্মকর্তা জোশের বশে অবিস্মরণীয় উত্তর দিয়েছেন, ‘অন্য দেশ যা করে করুক, এ দেশে কোনো ধানাইপানাই নেই।’ এমন দেশপ্রেম, এমন আইনের প্রতি নিষ্ঠা দেখলে ধন্যি ধন্যি করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দেশের বাস্তবতা বলে, ধন্য আশা কুহকিনী! এমনই নিষ্ঠাবান আমলাতন্ত্র থাকলে সোনার বাংলা কবে কায়েম হয়ে যেত! তা যে হয়নি, তার দায় নিশ্চয়ই দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ এবং ফাঁকিবাজ জনগণের, আমলাতন্ত্র সম্পূর্ণ মাসুম বান্দা। একজন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা অভিযাত্রীকে যাঁরা নাকে দড়ি দিয়ে ছয় মাস ঘোরাতে পেরেছেন, তাঁরা ‘ধানাইপানাই’ কর্মের তুখোড় ধোনকার ছাড়া আর কী? দক্ষতা ও নিষ্ঠার এই বলিহারি বাড়াবাড়ি দেখে, এদেশীয় আমলাতন্ত্রের গোড়াপত্তনকারী ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরাও লজ্জা পেত। বলত, এতটুকু চাইনি বৎসে, চেয়েছিলাম আরও কিছু কম!
চেক সাহিত্যিক ফ্রানজ কাফকা লিখেছিলেন, প্রতিটি বিপ্লবই একসময় উবে যায়, কিন্তু পেছনে রেখে যায় একদলা আঠালো পদার্থ; নতুন এক আমলাতন্ত্র। ব্রিটিশ শাসন ছিল প্রতিবিপ্লব। তাদের তৈরি আমলাতন্ত্রের নিয়ত ছিল পাবলিককে বশে রাখা, সেবা করা নয়। আমাদের আমলাতন্ত্র তারই উত্তরাধিকার। স্বাধীনতার পরে সেই উত্তরাধিকার ত্যাগ না করে বরং আরও পাকাপোক্তই করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র দেশপ্রেমিক আমলাকে অচিরেই কোণঠাসা করে ফেলে। ফল, যেই লাউ সেই কদু; কুমড়োপটাশ বললেও কম বলা হয় না।
মানুষের উদ্যম ও শুভস্বপ্নকে ব্যর্থ করে দেওয়ার যে দক্ষতা বাংলাদেশের অনেক কর্তাব্যক্তির আছে, সেটা সত্যিই জাতীয় ‘গর্বের’ বিষয়। সমাজের অনেক মানুষের অনেক ভালো উদ্যোগ, অনেক সৃষ্টিশীলতা অঙ্কুরেই দম হারায় এঁদের কারণেই। ক্ষমতাবানদের সহযোগিতা চাই না, অন্তত তাঁরা বাধা না দিন। এই কাজে আমলাতন্ত্রও বিশিষ্ট। কার্ল মার্ক্স আমলাদের বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, নিজেদের নাককেই তাঁরা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেই অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাঁদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ।
সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের হাতিয়ার হলো আমলাতন্ত্র। অনেক সময় তারাই সরকারের মস্তিষ্ক হিসেবেও কাজ করে। দুর্নীতি, অনিয়ম, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি, দলবাজিসহ বহু ক্ষেত্রে এই হাতিয়ারের মোক্ষম ব্যবহার দেখা যায়। বিদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি ও লেনাদেনার বেলাতেও তাদেরই হিসাব-নিকাশ, কৌশল ইত্যাদিতে পটুতা দেখানোর কথা। কিন্তু যাদের অনেকেই নিজেদের স্বার্থকেই জাতীয় স্বার্থ মনে করে, জাতীয় স্বার্থ তো তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার বাজি। সেই বাজিতে তারা জিতলে দেশ জেতে না, আর দেশের জয় মানে তাদের হার।
গতিশীল দেশ থেকে আসা একজন প্রবাসী বাঙালি পর্যটকের এই দুর্গতিকে স্ট্যান্ডার্ড ধরলে বাংলাদেশের অগণিত দরিদ্র-সাধারণ কৃষক-মজুরের প্রতি এই আমলাতন্ত্রের আচরণকে কী বলব? কী বলব, প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি তাদের আচরণকে? এক কথায় জবাব হবে, ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এই মানসিকতা মানুষকে একটি সংখ্যা বা ফাইল ভাবে, জীবন ভাবে না। আমলাতন্ত্র নিজেকে অদৃশ্য রাখে, আর সামনে আনে আইন-বিধি-নিষেধ। সাধারণ মানুষের নিজেকে আড়াল করার কোনো উপায় নেই। ইনভিজিবল ম্যান ছবির সেই অদৃশ্য মানুষটি নিজের চামড়াকে অদৃশ্য করতে জানলেও রক্তকে লুকাতে পারে না। আহত হলে চামড়া ফুঁড়ে সেই রক্ত বেরোলে সে ধরা পড়ে যায়। একইভাবে অদৃশ্য আমলাতন্ত্রের চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, জনগণের দুঃখ-কষ্টের প্রকাশের ভেতর দিয়ে। আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার খুঁটি আদালত ও প্রশাসন তথা কোর্টকাচারি থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তরগুলোর ইট-কাঠ-বারান্দা তার সাক্ষী। কত রকমের সংস্কারের রমরমা দেশে, কিন্তু এর কি কোনো সংস্কার হবে না?
সব পথ যেখানে থেমে যায়, দুর্গতির সেই আমলাতন্ত্র, তোমাকে সালাম।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments