ওবামা ও ভারত-কাশ্মীরের অসন্তোষের ফল by অরুন্ধতী রায়
১৯৪৭ সাল থেকে কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিন-তিনবার যুদ্ধ বেধেছিল। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, কাশ্মীরের স্বশাসনের সংগ্রামের একটা মীমাংসা করা তাঁর ‘সংকটময় দায়িত্বগুলোর’ একটি।
তাঁর এই মন্তব্য ভারতে ক্ষোভের সঙ্গে গৃহীত হয়েছিল। তার পর থেকেই ওবামা এ বিষয়ে মোটামুটি মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন।
কিন্তু গত সোমবার তিনি ভারতের মেহমান হিসেবে এসে, নিমন্ত্রণকারীদের দারুণ খুশি করে গেছেন। তিনি বলেছেন, কাশ্মীর বিষয়ে আমেরিকা হস্তক্ষেপ তো করবেই না, উপরন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আসন পাওয়ার ব্যাপারে আমেরিকা ভারতের মদদ পাবে। সন্ত্রাসবাদের হুমকির বিষয়ে কথার তুবড়ি ফোটালেও কাশ্মীরে ভারতের মানবাধিকার দলন নিয়ে তিনি কিচ্ছুটি বলেননি। ওবামা আবারও কাশ্মীর বিষয়ে অবস্থান বদলাবেন কি না, তা নির্ভর করবে কয়েকটি ঘটনার ওপর: আফিগানিস্তানের যুদ্ধের কী হাল হয়, পাকিস্তানের কতটা সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের দরকার হয় এবং এই শীতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিমানবহর কেনে কি না। (৫.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বোয়িং সি-১৭, গ্লোবমাস্টার ৩ নামক বিমানসহ বিপুল সামরিক ব্যবসাই ওবামাকে নীরব রেখেছে।) কিন্তু ওবামার নীরবতা বা হস্তক্ষেপ কোনোটাই কাশ্মীরের জনগণকে তাদের একমাত্র অস্ত্র হাতের পাথর ত্যাগ করাবে না।
১০ দিন আগেও আমি কাশ্মীরে ছিলাম। পাকিস্তান সীমান্তের সেই অপরূপ উপত্যকায় জন্ম নিয়েছিল তিনটি মহান সভ্যতা: ইসলামি, হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা। ইতিহাস আর কিংবদন্তি এখানে একাকার। অনেকেরই বিশ্বাস যিশুখ্রিষ্ট এখানেই দেহান্তরিত হয়েছেন। অনেকের বিশ্বাস, মুসা নবী এখানেই তাঁর হারিয়ে যাওয়া গোত্রকে খুঁজতে এসেছিলেন। হজরতবাল দরগায় জিয়ারত করেন লাখ লাখ মানুষ; বছরের কয়েকটি দিন এখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি পবিত্র চুল ভক্তদের প্রদর্শন করা হয়।
সেই কাশ্মীর এখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা জঙ্গি ইসলাম, এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকা পড়েছে। বলা বাহুল্য, এই জাতীয়তাবাদ দিনকে দিন উগ্র ও ‘হিন্দুয়ানি’ হয়ে উঠছে। কাশ্মীর এখন হয়ে উঠেছে পরমাণু যুদ্ধের জ্বালামুখ। দেশটি অধিকার করে রেখেছে পাঁচ লাখ ভারতীয় সেনা এবং এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে সেনাঘন সামরিকায়িত এলাকা।
আমার গন্তব্য ছিল দক্ষিণের এক চিলতে এক শহর—আপেলের শহর সোপিয়ান। কাশ্মীরের রাজধানী আর সোপিয়ানের মাঝখানের মহাসড়ক তখন উত্তেজনায় কাঁপছিল। মহাসড়কজুড়ে তখন সেনাদের টহল। আঙুরবাগিচায়, মাঠে, ছাদের ওপর, ছোট ছোট বাজারের চত্বরে, সবখানেই সেনা মোতায়েন করা আছে। মাসের পর মাস কারফিউ জারি থাকা সত্ত্বেও আবার পথে নেমেছে ‘আজাদি আজাদি’ বলে চিৎকার করা ‘পাথর-যোদ্ধার দল’। তাদের অনুপ্রেরণা ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা (গণ-অভ্যুত্থান)। মহাসড়কের অনেক জায়গাই সেই সব পাথর দিয়ে এমনই ভরা যে, সাধারণ গাড়ির পক্ষে সেগুলোর ওপর দিয়ে চলা কঠিন।
কপাল ভালো যে আমার সঙ্গীরা গ্রামের ভেতর দিয়ে বিকল্প পথ-ঘাটের খোঁজ জানত। ‘শর্টকাটের’ বদলে সেটা ছিল ‘লংকাট’। এই দীর্ঘ পথেই তাদের কাছ থেকে এ বছরের গণজাগরণের গল্প শোনার সুযোগ পেলাম। সবচেয়ে ছোটটি নিতান্তই বালক। সে আমাকে বলল, পাথর ছোড়ার জন্য তাদের তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ তাদের তিনজনেরই আঙুলের নখ উপড়ে ফেলে—দুই হাতের কোনো নখই তারা বাদ রাখেনি।
লাগাতার তিন বছর ধরে কাশ্মীরিরা রাস্তায় আছে, প্রতিবাদে আছে। তাদের ভাষায় ভারতের নৃশংস দখলদারির বিরুদ্ধে তারা লড়ছে। অন্যদিকে, ২০ বছর আগে পাকিস্তানের মদদে ভারতের বিরুদ্ধে যে জঙ্গি আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা এখন স্তিমিত হওয়ার পথে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতে, এখন কাশ্মীর উপত্যকায় মোটের ওপর ৫০০ জঙ্গিও নেই। এই যুদ্ধে ৭০ হাজার কাশ্মীরি নিহত আর নির্যাতনে পঙ্গু হয়েছে লাখ লাখ। হাজার হাজার মানুষ ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে। দুই লাখের মতো কাশ্মীরি হিন্দুকে চলে যেতে হয়েছে। যদিও জঙ্গিরা প্রায় বিলীন, তবু ভারতীয় সেনাদের সংখ্যা রয়ে গেছে আগের মতোই। কিন্তু ভারতের এই সামরিক আধিপত্যকে রাজনৈতিক বিজয় বলে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। সাধারণ মানুষের অস্ত্র বলতে সেই আদিম পাথর, কিন্তু ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি তাদের ক্রোধ বিপুল। তরুণদের গোটা একটি প্রজন্ম, যারা বেড়ে উঠেছে কাঁটাতার, তল্লাশি চৌকি, বাঙ্কার, সেনাছাউনি এবং নির্যাতনকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে, যাদের শৈশব কেটেছে ‘ধর ও মার’ নামের সামরিক অভিযান দেখতে দেখতে, যাদের কল্পনাজুড়ে আছে গোয়েন্দা টিকটিকি, পুলিশের চর, ‘অচেনা বন্দুকবাজ’, সামরিক গোয়েন্দাদের কার্যকলাপ আর নির্বাচন লুট; সেই সব তরুণ আজ ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে, এমনকি তারা ভয় পেতেও ভুলে গেছে। পাগলের মতো দুঃসাহস বুকে নিয়ে কাশ্মীরি তরুণেরা সশস্ত্র সেনাদের মোকাবিলা করে নিজেদের রাস্তাঘাটের দখল নিয়ে নিয়েছে।
গত এপ্রিলে সেনাবাহিনী তিনটি বেসামরিক তরুণকে গুলি করে হত্যা করে তাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এর পর থেকে মুখোশ পরা পাথর-যোদ্ধারা, যাদের বেশির ভাগই ছাত্র, কাশ্মীরের জীবনকে থমকে দিয়েছে। ভারত সরকার গুলি, কারফিউ ও বিধিনিষেধ দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। মাত্র গত কয়েক মাসে নিহত হয়েছে ১১১ জন, এদের বেশির ভাগই কিশোর বয়সী। আহত তিন হাজার, গ্রেপ্তার এক হাজার। কিন্তু এখনো তারা বেপরোয়া, তারা তরুণ এবং তাদের পাথর আপসহীন। দৃশ্যত তাদের কোনো দল নেই, নেই কোনো নেতা। তারাই তাদের প্রতিনিধি। দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী হঠাৎ হতবাক হয়ে দেখল তারা ব্যর্থ হচ্ছে। ভারত সরকারও বেচায়েন হয়ে সমঝোতা করার জন্য কাউকে তারা পাচ্ছে না, জানেও না কার সঙ্গে তাদের আলোচনা করতে হবে। অন্যদিকে অনেক ভারতীয় ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, দশকের পর দশক তাদের মিথ্যা শেখানো হয়েছে। কাশ্মীর বিষয়ে ভারতীয়দের যে কঠিন একতা ছিল, হঠাৎ তাতে এক চিলতে ফাটল দেখা দিল।
সোপিয়ান যাত্রার সকালে আমি কিছুটা মুশকিলেই পড়ে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন আগে, দিল্লির এক আলোচনা সভায় আমি বলি, কাশ্মীর এক বিতর্কিত এলাকা এবং ভারত সরকারের দাবি মোতাবেক বলা যাবে না যে কাশ্মীর ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য’ অংশ। খ্যাপাটে রাজনীতিবিদেরা এবং টেলিভিশনের উপস্থাপকেরা দাবি করলেন, উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তৎক্ষণাৎ আমাকে আটক করা হোক। ওদিকে সরকার ‘নরম’ ভূমিকা নিচ্ছে এই ভয়ে উল্টো হুমকি দেওয়া শুরু করে পরিস্থিতিকে আরও তাতিয়ে দিল। দিনের পর দিন, খবরের গরম সময়ে (প্রাইম-টাইম নিউজ) টেলিভিশনে আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলা হলো, সন্ত্রাসী বুদ্ধিজীবী ডাকা হলো এবং আরও কিছু বলা হলো, যা কেবল ‘অবাধ্য’ নারীদের জন্যই বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু সোপিয়ানের রাস্তায় গাড়িতে বসে, সেই খুদে বন্ধুদের কথা শুনতে শুনতে আমি টের পেলাম, দিল্লির ওই বক্তব্যের জন্য আমি মোটেই অনুতপ্ত নই।
আমরা যাচ্ছিলাম শাকিল আহমেদের বাড়িতে। গতকাল তিনি দীর্ঘ পথ পেরিয়ে শ্রীনগরে এসেছিলেন আমাকে তাঁদের শহরে নিয়ে যেতে। তাঁর অনুরোধের জরুরত উপেক্ষা করা আমার জন্য কঠিন ছিল। শাকিলের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ২০০৯ সালের জুন মাসে। এর কয়েক সপ্তাহ আগে, তাঁর ২২ বছর বয়সী স্ত্রী নিলুফার এবং ১৭ বছরের বোন আয়েশার লাশ পাওয়া গিয়েছিল তাঁদের বাড়ির কিছুটা দূরে একটা নালার মধ্যে, সেনা ও পুলিশ ক্যাম্পের মাঝখানের চরম প্রহরাধীন এলাকায়। ময়নাতদন্তে জানা যায়, তাদের ধর্ষণের পর খুন করা হয়। কিন্তু সরকারের চাপে এই প্রতিবেদন গায়েব করে সাজানো হয় মিথ্যা গল্প। প্রতিবাদে ৪৭ দিন ধরে শহরবাসী শহরটি বন্ধ করে রেখেছে। গোটা এলাকা শোকে, দুঃখে, রাগে কাঁপছে। অথচ এত দিনেও খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। কাশ্মীরিদের ওপর চালানো বিভীষিকা এবং তাদের জোরালো প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে আছে এ রকম অজস্র ঘটনা, এরকম অনেক সোপিয়ান।
সময়টা ছিল আপেলের মৌসুম। বাড়ির সামনের বাগিচায় নারী-পুরুষেরা আপেল তোলায় ব্যস্ত। তাদের শিশুদের মুখগুলোও আপেলের মতো এতই রক্তিম সুন্দর যে, আপেল বলে ভুল করে কেউ হয়তো তাদের ঝুড়িতে রেখে দিতে পারে। রাস্তার পাশে আমাদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল অনেক মানুষ।
শাকিলদের বাড়ির পাশেই নিলুফার আর আয়েশার কবর। পুলিশ শাকিলকে হুমকি দিয়ে গেছে। সেখানে আমাদের ঘিরে অজস্র ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ নরনারী দাঁড়িয়ে ছিল। একটা প্রদীপ ঘিরে আমরা বসেছিলাম। সবাই বুক উজাড় করে বলতে লাগল ভয়াবহ সব গল্প। এসব নারী এমন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে, যেখানে সাধারণ মানুষের চেয়ে সেনাদের সংখ্যাই বেশি। শাকিলের ছোট্ট বাচ্চাটি এর কোল ওর কোলে ঘুরছিল। ওর দিকে তাকিয়ে শাকিল বললেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই সে-ও জানবে, ওর মায়ের সঙ্গে কী করা হয়েছিল!’
আমরা সেখান থেকে চলে এলাম। বুঝে এলাম, ভারতের কাছ থেকে কখনো কোনো ‘ইনসাফ’ তারা পাবে—এই আশা তারা হারিয়ে ফেলেছে। এখন তাদের একটাই বিশ্বাস, একটাই আশা; তার নাম ‘আজাদি’।
শ্রীনগর থেকে এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করে জানালেন, ‘পুলিশ তোমাকে গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট টাইপ করছে, আজ রাতেই তোমাকে ধরা হবে।’ আমরা নীরবে চলতে থাকলাম। আমাদের গাড়ি চলা শুরু করার পরপরই আরেকটি গাড়ি আমাদের ছাড়িয়ে গেল। গাড়িভর্তি একদল মানুষ হাত নেড়ে আমাদের থামতে বলছিল। আমরা থামলাম, ভয়ে জমে গিয়েছিলাম। মুখে দাড়ি নীল চোখের একজন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, তাঁর নাম আবদুল হাই, তিনি নিহত নিলুফারের বাবা। ‘আমার বাগিচার আপেল না নিয়ে আপনাকে যেতে দেব না’—এই বলে তিনি দুই বাক্স আপেল গাড়িতে তুলে দিলেন। জীর্ণ আলখাল্লার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি ডিম বের করে আনলেন লোকটি। এরপর, এক হাত দিয়ে আমার হাত টেনে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে ডিমটি তালুতে রেখে আমার আঙুলগুলো দিয়ে ঢেকে দিলেন। টের পেলাম, ডিমটা তখনো উষ্ণ।
ভারতের জাতীয়তাবাদীরা এবং তাঁদের সরকার বিশ্বাস করতে চায়, মার্কিন বিমান আর হুমকি-ধমকির মিশেল দিয়ে তাঁরা ভারতের শৌর্যবীর্যকে অটুট করে তুলবেন। কিন্তু একটি উষ্ণ সেদ্ধ ডিমের শক্তি কত, তা তাঁদের এখনো জানতে বাকি রয়ে গেছে।
দি নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় ঔপন্যাসিক এবং লেখক ও অধিকারকর্মী।
কিন্তু গত সোমবার তিনি ভারতের মেহমান হিসেবে এসে, নিমন্ত্রণকারীদের দারুণ খুশি করে গেছেন। তিনি বলেছেন, কাশ্মীর বিষয়ে আমেরিকা হস্তক্ষেপ তো করবেই না, উপরন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আসন পাওয়ার ব্যাপারে আমেরিকা ভারতের মদদ পাবে। সন্ত্রাসবাদের হুমকির বিষয়ে কথার তুবড়ি ফোটালেও কাশ্মীরে ভারতের মানবাধিকার দলন নিয়ে তিনি কিচ্ছুটি বলেননি। ওবামা আবারও কাশ্মীর বিষয়ে অবস্থান বদলাবেন কি না, তা নির্ভর করবে কয়েকটি ঘটনার ওপর: আফিগানিস্তানের যুদ্ধের কী হাল হয়, পাকিস্তানের কতটা সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের দরকার হয় এবং এই শীতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিমানবহর কেনে কি না। (৫.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বোয়িং সি-১৭, গ্লোবমাস্টার ৩ নামক বিমানসহ বিপুল সামরিক ব্যবসাই ওবামাকে নীরব রেখেছে।) কিন্তু ওবামার নীরবতা বা হস্তক্ষেপ কোনোটাই কাশ্মীরের জনগণকে তাদের একমাত্র অস্ত্র হাতের পাথর ত্যাগ করাবে না।
১০ দিন আগেও আমি কাশ্মীরে ছিলাম। পাকিস্তান সীমান্তের সেই অপরূপ উপত্যকায় জন্ম নিয়েছিল তিনটি মহান সভ্যতা: ইসলামি, হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা। ইতিহাস আর কিংবদন্তি এখানে একাকার। অনেকেরই বিশ্বাস যিশুখ্রিষ্ট এখানেই দেহান্তরিত হয়েছেন। অনেকের বিশ্বাস, মুসা নবী এখানেই তাঁর হারিয়ে যাওয়া গোত্রকে খুঁজতে এসেছিলেন। হজরতবাল দরগায় জিয়ারত করেন লাখ লাখ মানুষ; বছরের কয়েকটি দিন এখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি পবিত্র চুল ভক্তদের প্রদর্শন করা হয়।
সেই কাশ্মীর এখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা জঙ্গি ইসলাম, এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকা পড়েছে। বলা বাহুল্য, এই জাতীয়তাবাদ দিনকে দিন উগ্র ও ‘হিন্দুয়ানি’ হয়ে উঠছে। কাশ্মীর এখন হয়ে উঠেছে পরমাণু যুদ্ধের জ্বালামুখ। দেশটি অধিকার করে রেখেছে পাঁচ লাখ ভারতীয় সেনা এবং এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে সেনাঘন সামরিকায়িত এলাকা।
আমার গন্তব্য ছিল দক্ষিণের এক চিলতে এক শহর—আপেলের শহর সোপিয়ান। কাশ্মীরের রাজধানী আর সোপিয়ানের মাঝখানের মহাসড়ক তখন উত্তেজনায় কাঁপছিল। মহাসড়কজুড়ে তখন সেনাদের টহল। আঙুরবাগিচায়, মাঠে, ছাদের ওপর, ছোট ছোট বাজারের চত্বরে, সবখানেই সেনা মোতায়েন করা আছে। মাসের পর মাস কারফিউ জারি থাকা সত্ত্বেও আবার পথে নেমেছে ‘আজাদি আজাদি’ বলে চিৎকার করা ‘পাথর-যোদ্ধার দল’। তাদের অনুপ্রেরণা ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা (গণ-অভ্যুত্থান)। মহাসড়কের অনেক জায়গাই সেই সব পাথর দিয়ে এমনই ভরা যে, সাধারণ গাড়ির পক্ষে সেগুলোর ওপর দিয়ে চলা কঠিন।
কপাল ভালো যে আমার সঙ্গীরা গ্রামের ভেতর দিয়ে বিকল্প পথ-ঘাটের খোঁজ জানত। ‘শর্টকাটের’ বদলে সেটা ছিল ‘লংকাট’। এই দীর্ঘ পথেই তাদের কাছ থেকে এ বছরের গণজাগরণের গল্প শোনার সুযোগ পেলাম। সবচেয়ে ছোটটি নিতান্তই বালক। সে আমাকে বলল, পাথর ছোড়ার জন্য তাদের তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ তাদের তিনজনেরই আঙুলের নখ উপড়ে ফেলে—দুই হাতের কোনো নখই তারা বাদ রাখেনি।
লাগাতার তিন বছর ধরে কাশ্মীরিরা রাস্তায় আছে, প্রতিবাদে আছে। তাদের ভাষায় ভারতের নৃশংস দখলদারির বিরুদ্ধে তারা লড়ছে। অন্যদিকে, ২০ বছর আগে পাকিস্তানের মদদে ভারতের বিরুদ্ধে যে জঙ্গি আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা এখন স্তিমিত হওয়ার পথে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতে, এখন কাশ্মীর উপত্যকায় মোটের ওপর ৫০০ জঙ্গিও নেই। এই যুদ্ধে ৭০ হাজার কাশ্মীরি নিহত আর নির্যাতনে পঙ্গু হয়েছে লাখ লাখ। হাজার হাজার মানুষ ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে। দুই লাখের মতো কাশ্মীরি হিন্দুকে চলে যেতে হয়েছে। যদিও জঙ্গিরা প্রায় বিলীন, তবু ভারতীয় সেনাদের সংখ্যা রয়ে গেছে আগের মতোই। কিন্তু ভারতের এই সামরিক আধিপত্যকে রাজনৈতিক বিজয় বলে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। সাধারণ মানুষের অস্ত্র বলতে সেই আদিম পাথর, কিন্তু ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি তাদের ক্রোধ বিপুল। তরুণদের গোটা একটি প্রজন্ম, যারা বেড়ে উঠেছে কাঁটাতার, তল্লাশি চৌকি, বাঙ্কার, সেনাছাউনি এবং নির্যাতনকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে, যাদের শৈশব কেটেছে ‘ধর ও মার’ নামের সামরিক অভিযান দেখতে দেখতে, যাদের কল্পনাজুড়ে আছে গোয়েন্দা টিকটিকি, পুলিশের চর, ‘অচেনা বন্দুকবাজ’, সামরিক গোয়েন্দাদের কার্যকলাপ আর নির্বাচন লুট; সেই সব তরুণ আজ ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে, এমনকি তারা ভয় পেতেও ভুলে গেছে। পাগলের মতো দুঃসাহস বুকে নিয়ে কাশ্মীরি তরুণেরা সশস্ত্র সেনাদের মোকাবিলা করে নিজেদের রাস্তাঘাটের দখল নিয়ে নিয়েছে।
গত এপ্রিলে সেনাবাহিনী তিনটি বেসামরিক তরুণকে গুলি করে হত্যা করে তাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এর পর থেকে মুখোশ পরা পাথর-যোদ্ধারা, যাদের বেশির ভাগই ছাত্র, কাশ্মীরের জীবনকে থমকে দিয়েছে। ভারত সরকার গুলি, কারফিউ ও বিধিনিষেধ দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। মাত্র গত কয়েক মাসে নিহত হয়েছে ১১১ জন, এদের বেশির ভাগই কিশোর বয়সী। আহত তিন হাজার, গ্রেপ্তার এক হাজার। কিন্তু এখনো তারা বেপরোয়া, তারা তরুণ এবং তাদের পাথর আপসহীন। দৃশ্যত তাদের কোনো দল নেই, নেই কোনো নেতা। তারাই তাদের প্রতিনিধি। দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী হঠাৎ হতবাক হয়ে দেখল তারা ব্যর্থ হচ্ছে। ভারত সরকারও বেচায়েন হয়ে সমঝোতা করার জন্য কাউকে তারা পাচ্ছে না, জানেও না কার সঙ্গে তাদের আলোচনা করতে হবে। অন্যদিকে অনেক ভারতীয় ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, দশকের পর দশক তাদের মিথ্যা শেখানো হয়েছে। কাশ্মীর বিষয়ে ভারতীয়দের যে কঠিন একতা ছিল, হঠাৎ তাতে এক চিলতে ফাটল দেখা দিল।
সোপিয়ান যাত্রার সকালে আমি কিছুটা মুশকিলেই পড়ে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন আগে, দিল্লির এক আলোচনা সভায় আমি বলি, কাশ্মীর এক বিতর্কিত এলাকা এবং ভারত সরকারের দাবি মোতাবেক বলা যাবে না যে কাশ্মীর ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য’ অংশ। খ্যাপাটে রাজনীতিবিদেরা এবং টেলিভিশনের উপস্থাপকেরা দাবি করলেন, উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তৎক্ষণাৎ আমাকে আটক করা হোক। ওদিকে সরকার ‘নরম’ ভূমিকা নিচ্ছে এই ভয়ে উল্টো হুমকি দেওয়া শুরু করে পরিস্থিতিকে আরও তাতিয়ে দিল। দিনের পর দিন, খবরের গরম সময়ে (প্রাইম-টাইম নিউজ) টেলিভিশনে আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলা হলো, সন্ত্রাসী বুদ্ধিজীবী ডাকা হলো এবং আরও কিছু বলা হলো, যা কেবল ‘অবাধ্য’ নারীদের জন্যই বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু সোপিয়ানের রাস্তায় গাড়িতে বসে, সেই খুদে বন্ধুদের কথা শুনতে শুনতে আমি টের পেলাম, দিল্লির ওই বক্তব্যের জন্য আমি মোটেই অনুতপ্ত নই।
আমরা যাচ্ছিলাম শাকিল আহমেদের বাড়িতে। গতকাল তিনি দীর্ঘ পথ পেরিয়ে শ্রীনগরে এসেছিলেন আমাকে তাঁদের শহরে নিয়ে যেতে। তাঁর অনুরোধের জরুরত উপেক্ষা করা আমার জন্য কঠিন ছিল। শাকিলের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ২০০৯ সালের জুন মাসে। এর কয়েক সপ্তাহ আগে, তাঁর ২২ বছর বয়সী স্ত্রী নিলুফার এবং ১৭ বছরের বোন আয়েশার লাশ পাওয়া গিয়েছিল তাঁদের বাড়ির কিছুটা দূরে একটা নালার মধ্যে, সেনা ও পুলিশ ক্যাম্পের মাঝখানের চরম প্রহরাধীন এলাকায়। ময়নাতদন্তে জানা যায়, তাদের ধর্ষণের পর খুন করা হয়। কিন্তু সরকারের চাপে এই প্রতিবেদন গায়েব করে সাজানো হয় মিথ্যা গল্প। প্রতিবাদে ৪৭ দিন ধরে শহরবাসী শহরটি বন্ধ করে রেখেছে। গোটা এলাকা শোকে, দুঃখে, রাগে কাঁপছে। অথচ এত দিনেও খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। কাশ্মীরিদের ওপর চালানো বিভীষিকা এবং তাদের জোরালো প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে আছে এ রকম অজস্র ঘটনা, এরকম অনেক সোপিয়ান।
সময়টা ছিল আপেলের মৌসুম। বাড়ির সামনের বাগিচায় নারী-পুরুষেরা আপেল তোলায় ব্যস্ত। তাদের শিশুদের মুখগুলোও আপেলের মতো এতই রক্তিম সুন্দর যে, আপেল বলে ভুল করে কেউ হয়তো তাদের ঝুড়িতে রেখে দিতে পারে। রাস্তার পাশে আমাদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল অনেক মানুষ।
শাকিলদের বাড়ির পাশেই নিলুফার আর আয়েশার কবর। পুলিশ শাকিলকে হুমকি দিয়ে গেছে। সেখানে আমাদের ঘিরে অজস্র ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ নরনারী দাঁড়িয়ে ছিল। একটা প্রদীপ ঘিরে আমরা বসেছিলাম। সবাই বুক উজাড় করে বলতে লাগল ভয়াবহ সব গল্প। এসব নারী এমন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে, যেখানে সাধারণ মানুষের চেয়ে সেনাদের সংখ্যাই বেশি। শাকিলের ছোট্ট বাচ্চাটি এর কোল ওর কোলে ঘুরছিল। ওর দিকে তাকিয়ে শাকিল বললেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই সে-ও জানবে, ওর মায়ের সঙ্গে কী করা হয়েছিল!’
আমরা সেখান থেকে চলে এলাম। বুঝে এলাম, ভারতের কাছ থেকে কখনো কোনো ‘ইনসাফ’ তারা পাবে—এই আশা তারা হারিয়ে ফেলেছে। এখন তাদের একটাই বিশ্বাস, একটাই আশা; তার নাম ‘আজাদি’।
শ্রীনগর থেকে এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করে জানালেন, ‘পুলিশ তোমাকে গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট টাইপ করছে, আজ রাতেই তোমাকে ধরা হবে।’ আমরা নীরবে চলতে থাকলাম। আমাদের গাড়ি চলা শুরু করার পরপরই আরেকটি গাড়ি আমাদের ছাড়িয়ে গেল। গাড়িভর্তি একদল মানুষ হাত নেড়ে আমাদের থামতে বলছিল। আমরা থামলাম, ভয়ে জমে গিয়েছিলাম। মুখে দাড়ি নীল চোখের একজন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, তাঁর নাম আবদুল হাই, তিনি নিহত নিলুফারের বাবা। ‘আমার বাগিচার আপেল না নিয়ে আপনাকে যেতে দেব না’—এই বলে তিনি দুই বাক্স আপেল গাড়িতে তুলে দিলেন। জীর্ণ আলখাল্লার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি ডিম বের করে আনলেন লোকটি। এরপর, এক হাত দিয়ে আমার হাত টেনে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে ডিমটি তালুতে রেখে আমার আঙুলগুলো দিয়ে ঢেকে দিলেন। টের পেলাম, ডিমটা তখনো উষ্ণ।
ভারতের জাতীয়তাবাদীরা এবং তাঁদের সরকার বিশ্বাস করতে চায়, মার্কিন বিমান আর হুমকি-ধমকির মিশেল দিয়ে তাঁরা ভারতের শৌর্যবীর্যকে অটুট করে তুলবেন। কিন্তু একটি উষ্ণ সেদ্ধ ডিমের শক্তি কত, তা তাঁদের এখনো জানতে বাকি রয়ে গেছে।
দি নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় ঔপন্যাসিক এবং লেখক ও অধিকারকর্মী।
No comments