মওলানা ভাসানী ও কাগমারী সম্মেলন by মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের
উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন, এর মধ্যে একটি
ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছেÑ ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলন।
রাজনৈতিক
অস্থিরতার মধ্যে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের
কাউন্সিল অধিবেশনে বলা হয়েছিলÑ ‘… সরকার পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি,
বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে,
যেসব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক
স্বাধীনতা ুণœ হইয়াছে।’ ’৫৬ সালের ১৯-২০ মে দলের কাউন্সিল অধিবেশনেও বলা
হয়, ‘কোনো বৈদেশিক শক্তির লেজুড়’ হিসেবে না থেকে পাকিস্তান সরকারের উচিত
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। এই প্রস্তাব নেয়ায় মওলানা
ভাসানী হন অনেক প্রবীণ নেতার বিরাগভাজন। পূর্ববাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক
স্বায়ত্তশাসন এবং সব সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি
গ্রহণ, এই দু’টি বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপসপ্রবণ ও নমনীয়। মওলানা
ভাসানী ছিলেন অনড় ও আপসহীন। যখন এ নিয়ে মতবিরোধ চরমে, তখন মওলানা ভাসানী
দলীয় প্রধান হিসেবে কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন ১৯৫৭ সালের ৭-৮
ফেব্রুয়ারি। তখন তারই প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও প্রদেশে
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে কাগমারী সম্মেলনের
ঘোষণা সরকারে নিদারুণ উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। কাগমারী সম্মেলন তথা
বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্মেলনে রূপ নেয়।
এরপর স্বল্প সময়ের মধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন দল
ন্যাপ এবং প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ থেকে সোহরাওয়ার্দীর অপসারণ এবং ১৯৫৬
সালের সংবিধান বাতিল ও সামরিক শাসন জারির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে।
১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি জনসাধারণের প্রতি এক আবেদনে মওলানা ভাসানী বলেন : ‘এ দেশে শুধু মন্ত্রী, মেম্বার, সরকারি কর্মচারীদের নহে, এ দেশ অগণিত জনসাধারণের দেশ। যাহারা এ দেশ পরিচালনা করেন, তাহারা শতকরা ৯৫ জন গরিব চাষি, মজুর, কামার, কুমার প্রভৃতি শ্রেণীর জনসাধারণের টাকা দিয়েই চলে। …পূর্ববাংলার বাঁচার দাবি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের দাবি এবং ২১ দফার বাকি ১৪ দফা দাবি পূরণের জন্য বিচ্ছিন্ন জনশক্তিকে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তুমুল আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হবে।
৩ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আরেকটি প্রচারপত্রে বলেন : * সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক, * ঐতিহাসিক ২১ দফা আদায়ের ডাক, * চাষি-মজুর, কামার-কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সব শ্রেণীর মিলনের ডাক, * পূর্ববাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ডাক, * ২১ দফার পূর্ণ রূপায়ণের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। ইহা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তির মহান সনদ।
কাগমারী সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খানসহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রায় সব মন্ত্রীই যোগ দিয়েছিলেন। টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তায় ৫১টি তোরণ নির্মিত হয়েছিল, আবার সেই তোরণগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: থেকে শুরু করে ইসলামি ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নামে। এভাবে ৫১টি তোরণের নামকরণ করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সর্বশেষ তোরণটি ছিল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামে।
সম্মেলনে অংশ নিতে মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রনায়কদের। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের, চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্নো, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা। সম্মেলনে ভাসানী তার ভাষণের শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে তাঁর সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ওই ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতাদের মতে, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প’। মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বক্তব্য রেখেছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপরও দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, “পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্য নীতি পালিত না হইলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলিবে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে।” ৮ ফেব্রুয়ারি মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. কাজী মোতাহের হোসেন।
সম্মেলনের সময় মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল কাগমারী সড়কের নাম দিয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা সড়ক। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর কঠোর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও বটে, বিব্রত হন। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে তিনি মওলানা ভাসানীর সমর্থনে বিবৃতিও প্রদান করেন, কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোললেন। অথচ সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে সলিমুল্লাহ হলে সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে। এ নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারিও হয়। আদর্শগত কারণে আওয়ামী লীগের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল।
সম্মেলনের পর ২৬ মার্চ মওলানা ভাসানী একটি প্রচারপত্র বিলি করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লীগ কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আবেদন’Ñ ভাই সব, উভয় পাকিস্তানের সংহতি ও মিলন নির্ভর করে একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনদানের ওপর। এটা ব্যতীত সাড়ে চার কোটি বাঙালির মুক্তি অসম্ভব। ‘…গদির মোহে মুসলিম লীগের সহিত হাত মিলাইয়া সাড়ে চার কোটি বাঙালিকে চিরকালের জন্য কৃতদাস বানাইতে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিসর্জন দিয়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পাস করিয়া ছিল, তাহারাই পুনরায় সাম্রাজ্যবাদী ও কোটিপতি শোষকদের সহিত হাত মিলাইয়া আমার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিবৃতি, পোস্টার, বিজ্ঞাপন ছড়াইয়া সারাদেশময় মিথ্যা প্রচার শুরু করিয়াছে। এসব কুচক্রীকে দেশবাসী ভালো করিয়াই চেনে। তাহারাই গত ৯ বছর ধরিয়া পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে।’
কাগমারী সম্মেলনের পরই আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তিনি পদত্যাগ করেন মেহনতি জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ২৫ জুলাই রূপমহল সিনেমা হলে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিÑ ন্যাপ।
কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমেই স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন তা আজো স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগায়। মওলানা ভাসানীর যে সম্মান প্রাপ্য ছিল স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও তাকে সে সম্মান ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বাংলাদেশ ন্যাপ
১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি জনসাধারণের প্রতি এক আবেদনে মওলানা ভাসানী বলেন : ‘এ দেশে শুধু মন্ত্রী, মেম্বার, সরকারি কর্মচারীদের নহে, এ দেশ অগণিত জনসাধারণের দেশ। যাহারা এ দেশ পরিচালনা করেন, তাহারা শতকরা ৯৫ জন গরিব চাষি, মজুর, কামার, কুমার প্রভৃতি শ্রেণীর জনসাধারণের টাকা দিয়েই চলে। …পূর্ববাংলার বাঁচার দাবি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের দাবি এবং ২১ দফার বাকি ১৪ দফা দাবি পূরণের জন্য বিচ্ছিন্ন জনশক্তিকে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তুমুল আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হবে।
৩ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আরেকটি প্রচারপত্রে বলেন : * সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক, * ঐতিহাসিক ২১ দফা আদায়ের ডাক, * চাষি-মজুর, কামার-কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সব শ্রেণীর মিলনের ডাক, * পূর্ববাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ডাক, * ২১ দফার পূর্ণ রূপায়ণের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। ইহা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তির মহান সনদ।
কাগমারী সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খানসহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রায় সব মন্ত্রীই যোগ দিয়েছিলেন। টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তায় ৫১টি তোরণ নির্মিত হয়েছিল, আবার সেই তোরণগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: থেকে শুরু করে ইসলামি ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নামে। এভাবে ৫১টি তোরণের নামকরণ করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সর্বশেষ তোরণটি ছিল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামে।
সম্মেলনে অংশ নিতে মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রনায়কদের। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের, চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্নো, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা। সম্মেলনে ভাসানী তার ভাষণের শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে তাঁর সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ওই ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতাদের মতে, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প’। মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বক্তব্য রেখেছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপরও দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, “পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্য নীতি পালিত না হইলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলিবে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে।” ৮ ফেব্রুয়ারি মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. কাজী মোতাহের হোসেন।
সম্মেলনের সময় মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল কাগমারী সড়কের নাম দিয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা সড়ক। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর কঠোর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও বটে, বিব্রত হন। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে তিনি মওলানা ভাসানীর সমর্থনে বিবৃতিও প্রদান করেন, কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোললেন। অথচ সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে সলিমুল্লাহ হলে সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে। এ নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারিও হয়। আদর্শগত কারণে আওয়ামী লীগের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল।
সম্মেলনের পর ২৬ মার্চ মওলানা ভাসানী একটি প্রচারপত্র বিলি করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লীগ কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আবেদন’Ñ ভাই সব, উভয় পাকিস্তানের সংহতি ও মিলন নির্ভর করে একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনদানের ওপর। এটা ব্যতীত সাড়ে চার কোটি বাঙালির মুক্তি অসম্ভব। ‘…গদির মোহে মুসলিম লীগের সহিত হাত মিলাইয়া সাড়ে চার কোটি বাঙালিকে চিরকালের জন্য কৃতদাস বানাইতে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিসর্জন দিয়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পাস করিয়া ছিল, তাহারাই পুনরায় সাম্রাজ্যবাদী ও কোটিপতি শোষকদের সহিত হাত মিলাইয়া আমার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিবৃতি, পোস্টার, বিজ্ঞাপন ছড়াইয়া সারাদেশময় মিথ্যা প্রচার শুরু করিয়াছে। এসব কুচক্রীকে দেশবাসী ভালো করিয়াই চেনে। তাহারাই গত ৯ বছর ধরিয়া পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে।’
কাগমারী সম্মেলনের পরই আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তিনি পদত্যাগ করেন মেহনতি জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ২৫ জুলাই রূপমহল সিনেমা হলে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিÑ ন্যাপ।
কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমেই স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন তা আজো স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগায়। মওলানা ভাসানীর যে সম্মান প্রাপ্য ছিল স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও তাকে সে সম্মান ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বাংলাদেশ ন্যাপ
No comments