১৯৭১ ॥ চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ যুদ্ধ by সামসুদ্দিন আহম্মদ
ওই সময় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাঙালী
সৈনিকদের উদ্ধারের জন্য ক্যান্টেনমেন্ট আক্রমণ করলে এত রক্তয় হতো না। রাত
দুটোর পরে মেজর জিয়া তাদের সিইও কর্নেল জানজুয়া ও কিছু পাকিস্তানী সেনা
অফিসারকে বন্দী করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে পটিয়ার দিকে
চলে গেলেন।
২৬ মার্চ সকালে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ
বেতারের নিরাপত্তা ও ঘোষণা দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে বিনীত অনুরোধ
জানান। সেই থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণভার ইপিআর সদস্যরা
গ্রহণ করে।এদিকে ডা. জাফর ও ডা. মান্নান জিয়ার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। ৮ম
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোন হদিস না পেয়ে সকাল বেলা ক্যাপ্টেন রফিকের সদর
দফতর রেলওয়ে হিলে গিয়ে (সিআরবি) তার সাথে যোগাযোগ করেন। ক্যাপ্টেন রফিক
ইপিআরদের নিয়ে রাত থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন রফিক
মেজর জিয়ার ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে খুঁজে বের করার জন্য জাফর ভাইকে
অনুরোধ করেন। ডা. জাফর সকাল ৯টায় আমাকে নিয়ে পটিয়ার দিকে রওনা হন। আমরা
কালুরঘাট ব্রিজ পার হয়ে কধুরখীল পৌঁছাই। সেখানে ডা. মান্নানের দেখা পাই।
সেখানে গিয়ে শুনলাম জিয়া পটিয়ার দিকে অবস্থান করছেন। জাফর ভাইকে নিয়ে আমরা
তার কাছে গেলাম। সেখানে মেজর জিয়া, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান,
ক্যাপ্টেন ওয়ালী, লেফটেন্যান্ট মাহফুজ, লেফটেন্যান্ট শমসের মুবিনকে দেখতে
পাই। তাদেরকে চট্টগ্রাম শহরে যুদ্ধ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। মেজর জিয়া
বলেন, আমরা আগে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি পরে বিবেচনা করা হবে। ২৬ তারিখে
মেজর জিয়া ও মেজর শওকত কক্সবাজার চলে গেলেন।
এদিকে ক্যাপ্টেন রফিক ইপিআরদের নিয়ে শহরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এমএ হান্নান ও জাফর ভাইকে জানান, বাঙালীরা যে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তা যেন বেতারে প্রচার করা হয়। তখন হান্নান ভাই বললেন, আপনি রেডিওতে আসেন। বাঙালী সৈন্যরা যে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে দেশবাসী তা জানে। ক্যাপ্টেন রফিক হান্নান ভাইকে অনুরোধ করলেন, আমার চেয়ে মেজর জিয়া সিনিয়র তাকে দিয়ে ঘোষণাটি পাঠ করান। হান্নান ভাই চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে হান্নান ভাইকে বাধ্য করে দুপুর আড়াইটার দিকে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় বেতার ঘোষণা দেয়ার জন্য। প্রথমে এম.এ. হান্নান সাহেব স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে বাঙালী ভাইদের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাক সেনাদের মোকাবেলা করার জন্য আবেদন জানান। তারপর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান, এম.এ. হান্নানের ঘোষণা একটু পর পরই প্রচার করা হতে থাকে।
এম.এ. হান্নান, ডা. জাফর ও ডা. মান্নান কক্সবাজার থেকে জিয়ার আগমনের অপোয় থাকেন। ২৭ মার্চ দুপুর ১টার মধ্যে মেজর জিয়া কক্সবাজার থেকে ফেরত আসেন। মেজর জিয়া পটিয়া থেকে সরে এসে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে বোয়ালখালীর গোমদণ্ডি। স্কুলে তার সদর দফতর স্থাপন করেন। ওখান থেকে জিয়াকে ডা. জাফর ও মির্জা মনসুর রেডিওতে নিয়ে আসেন। ওইদিন সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণায় সংগ্রামরত সাধারণ মানুষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এতে আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়ার কাছে আপত্তি জানান। তারপরে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুরোধে একে খান সাহেবের নিজ হাতের লেখা ও সংশোধিত ভাষণ নিয়ে আসেন মির্জা মনসুর সাহেব। পরে মেজর জিয়া এই লিখিত ভাষণটি বেতারে পাঠ করেন। 'জাতির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প থেকে আমি মেজর জিয়া বলছি। আমাদের গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সাথে আছেন।' এই ভাষণটি কালুরঘাট বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার প্রচার করা হতে থাকে। এ সময় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন মির্জা মনসুর, ডা. মান্নান, ডা. জাফরসহ আরও অনেক। পরে লেফটেন্যান্ট শমসের মুবিন বেতার থেকে জনতার কাছে বারবার আহ্বান জানিয়েছিলেন, আপনারা মেজর জিয়ার ভাষণ শোনেন।
বেতার ভাষণের পর যুদ্ধের গুরুত্ব বেড়ে যায়। সৈনিক, ছাত্র, জনতা, সবাই অসীম সাহসী হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ রাতে কয়েকজন বাঙালী অফিসার ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রাণে বেঁচে পালিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া অন্যতম। শহরে ইপিআর সদস্যরা যুদ্ধরত অবস্থায় আছেন। এদিকে প্রবর্তক হিলে ইপিআর ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পাক সেনাদের মোকাবেলা করার জন্য বসে আছে। পাকিস্তানী সেনারা ক্যান্টনমেন্টে সব শেষ করে শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা ষোলশহর রেলগেটের অল্প দূরে অবস্থান নিয়েছে। এদিকে ক্যাপ্টেন রফিকের বার্তা পেয়ে সীমান্তের ইপিআর সদস্যরা শহরের দিকে মার্চ করেছে। টেকনাফ, কক্সবাজার, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটির ইপিআর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কাপ্তাই থেকে ক্যাপ্টেন হারুন তার সিপাহীদের নিয়ে শহরে ঢুকে পড়লেন। ২৬ তারিখ সকাল থেকে একটি হেলিকপ্টার চট্টগ্রাম শহরের উপর দিয়ে টহল দিতে থাকে। একটু পর পর পার্ক নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ 'বাবর' থেকে শহরের দিকে শেল নিপে করা হচ্ছে। চট্টগ্রামবাসীদের একটি আতঙ্কিত অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে গুজব রটে গেল কুমিল্লা থেকে এক বিরাট বহর নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে পাকিস্তানী বাহিনী। ক্যাপ্টেন রফিক একদল ইপিআর সেনাকে কুমিরার পাহাড়ে পাঠিয়ে দিলেন। রাতে ইপিআর সেনাদের এ্যাম্বুসে অনেক পাকসেনা মারা পড়ল, বাকিরা দিশেহারা হয়ে পালাতে শুরু করল। প্রচুর যানবাহন ধ্বংস হলো। ২৬ তারিখ রাতে কুমিরায় এই ভয়াবহ যুদ্ধে পাকসেনাদের কমান্ডিং অফিসার ভয়ে আত্মগোপন করেছিল। কুমিরার এই যুদ্ধে পাকসেনাদের পক্ষে একজন ব্রিগেডিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা কোনদিন আশা করেনি যুদ্ধের শুরুতেই বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে এ রকম বিরাট বিপর্যয় ঘটবে, এত ক্ষয়ক্ষতিও তারা আশা করেনি। ইপিআরদের অল্প য়তি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে 'কুমিরার যুদ্ধ' ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
২৫ মার্চ রাত থেকেই চট্টগ্রাম নগরীতে ইপিআর সদস্যরা যে যুদ্ধ শুরু করে তাতে কোন বাঙালী সেনা অংশগ্রহণ করেনি। এদিকে নৌবাহিনীর ঘাঁটি টাইগার পাস থেকে নৌসেনারা আক্রমণ শুরু করে। পাকসেনা ও নৌবাহিনীর প্রতিটি আক্রমণের বিরুদ্ধে ইপিআর সৈনিকেরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদিকে নৌসেনারা ক্যাপ্টেন রফিকের সদর দফতর রেলওয়ে হিলে অনবরত গোলাবর্ষণ করে। বাধ্য হয়ে তিনি রেলওয়ে হিল ত্যাগ করেন। নৌসেনারা বিহারী ও অবাঙালীদের সহায়তায় রাতের বেলায় দলবেঁধে ইস্পাহানি বিল্ডিং, সার্কিট হাউস, আসকার দীঘির পাড় ও ইস্পাহানি বাংলোতে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানী নৌসেনারা রোগীর কথা বলে মেডিক্যাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ দখল করে।
চট্টগ্রামবাসী ভেবেছিল বাঙালী সৈনিকেরা ইপিআরদের সাথে যুদ্ধ করে শহরবাসীকে রা করবে। কিন্তু শহর রা তো দূরের কথা, সীমান্ত থেকে আগত ইপিআরদের মেজর জিয়া কালুরঘাটে আটকে রাখেন। চট্টগ্রামবাসীদের জন্য আরেকটি অসুবিধা হলো কলোনি ছাড়া পুরো চট্টগ্রাম শহরেই অবাঙালীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাকিস্তানী ছাড়াও বিহারী, মোহাজের, শিয়া, মেমনরা শহরে বসবাসরত ছিল। এ ছাড়াও টেরিবাজার, খাতুনগঞ্জ, রহমতগঞ্জ, কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশ, চকবাজার, বাকলিয়া, মুরাদপুর, অক্সিজেন, নাসিরাবাদ, সোসাইটি, আতুরার ডিপো, পশ্চিম নাসিরাবাদ ও শহরের দক্ষিণ দিকে কদমতুলি, মোঘলটুলি, পাঠানটুলি, পাহাড়তলি, ঝাউতলা, আমবাগান ও আগ্রাবাদ রেলওয়ে কলোনিগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবাঙালীরা বসবাস করত। এর বাইরে চট্টেশ্বরী রোডে কাবুলীওয়ালা ও পাঠানদের বৃহত্তম ঘাঁটি ছিল। এদের প্রত্য ও পরো সহায়তায় পাকিস্তানী সৈন্যরা অতি দ্রুত চট্টগ্রাম শহর দখল করে নেয়।
২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন রফিক দু'দিক থেকে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। একটি গ্রুপকে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। আর তিনি নিজে বায়েজিদ বোস্তামি রোড দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া সীমান্ত থেকে আগত সব ইপিআর সৈনিকদের কালুরঘাটে আটকে রাখায় তার পক্ষে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হলো না। ক্যাপ্টেন রফিক ডা. জাফরের মাধ্যমে পুনরায় জিয়ার কাছে অনুরোধ করেন ইপিআর সৈন্যদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। পরে এম.এ. হান্নান কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে গোমদণ্ডি স্কুলে যান। তারা মেজর জিয়া ও মেজর শওকতকে অনুরোধ করেন আর বিলম্ব না করে শহরে ইপিআরদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য।
এদিকে চট্টগ্রাম শহর প্রায় জনমানবহীন হয়ে পড়লো। ২৮ মার্চ ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে সামরিক ও বেসামরিক জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, সবাই যেন লালদীঘির ময়দানে এসে জমায়েত হন। পরে রাজনীতিবিদদের নির্দেশে সে ঘোষণা বাতিল করা হয়। এদিকে দামপাড়া পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। আমার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম বেতারে অবস্থানরত বাঙালী সৈনিকদের খাদ্য সরবরাহ করা। লেফটেন্যান্ট মাহফুজ আমাকে আগে থেকে চিনত। সে সুবাদে মেজর জিয়া মাহফুজকে বলল, তাদের পরিবারকে নাসিরাবাদ বাসা থেকে উদ্ধার করার জন্য। জিয়ার চাচা শ্বশুর দেলোয়ার হোসেন সাহেবের বাসা চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চিম পাশে পৌঁছে দিতে হবে তার পরিবারের সদস্যদেরকে। আমি দেলোয়ার সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে তাকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে গমন করি। একটি এ্যাম্বুলেন্স অনেক কষ্ট করে যোগাড় করে সেই এ্যাম্বুলেন্স সাথে নিয়ে জিয়ার বাসায় পৌঁছি ওই বাংলোতে না পেয়ে আমরা পাশে একটি বিদেশী লোকের বাসা থেকে রাত নয়টার দিকের জিয়ার পরিবারকে উদ্ধার করি। বাসায় পাহারারত সৈনিকদের নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে নামিয়ে আমরা দেলোয়ার সাহেবের বাসার দিকে রওনা দেই। পথে আমরা দুর্ঘটনার শিকার হই ওলিখাঁ মসজিদ থেকে রাসত্মায় যাওয়ার পথে সংগ্রামী জনতার রোষের মুখে পড়ি। তারা সবাইকে অবাঙালী মনে করছে চকবাজারের লীগ স্টরের সামনে (বর্তমান গুলজার সিনেমা হলের সামনে) সেখান থেকে বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক দানুর সহায়তায় রা পায়। জিয়ার পরিবারে সাথে যারা ছিল কর্নেল হোসেন সাহেবের স্ত্রী ও এক ছেলে লে. মাহফুজির স্ত্রী ও আট মাসের ছেলে ছিল। জিয়ার স্ত্রী ও দুই ছেলেকে আমি ষোলশহরের বাসা থেকে দেলোয়ার সাহেবের বাসায় পৌঁছে দেই। দ্বিতীয় দায়িত্বটি ছিল বেতারে পাহারারত সৈনিকদের ঠিকমতো খাবার সরবরাহ করা। এখানে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা পাহারারত ছিল। (চলবে)
এদিকে ক্যাপ্টেন রফিক ইপিআরদের নিয়ে শহরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এমএ হান্নান ও জাফর ভাইকে জানান, বাঙালীরা যে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তা যেন বেতারে প্রচার করা হয়। তখন হান্নান ভাই বললেন, আপনি রেডিওতে আসেন। বাঙালী সৈন্যরা যে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে দেশবাসী তা জানে। ক্যাপ্টেন রফিক হান্নান ভাইকে অনুরোধ করলেন, আমার চেয়ে মেজর জিয়া সিনিয়র তাকে দিয়ে ঘোষণাটি পাঠ করান। হান্নান ভাই চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে হান্নান ভাইকে বাধ্য করে দুপুর আড়াইটার দিকে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় বেতার ঘোষণা দেয়ার জন্য। প্রথমে এম.এ. হান্নান সাহেব স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে বাঙালী ভাইদের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাক সেনাদের মোকাবেলা করার জন্য আবেদন জানান। তারপর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান, এম.এ. হান্নানের ঘোষণা একটু পর পরই প্রচার করা হতে থাকে।
এম.এ. হান্নান, ডা. জাফর ও ডা. মান্নান কক্সবাজার থেকে জিয়ার আগমনের অপোয় থাকেন। ২৭ মার্চ দুপুর ১টার মধ্যে মেজর জিয়া কক্সবাজার থেকে ফেরত আসেন। মেজর জিয়া পটিয়া থেকে সরে এসে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে বোয়ালখালীর গোমদণ্ডি। স্কুলে তার সদর দফতর স্থাপন করেন। ওখান থেকে জিয়াকে ডা. জাফর ও মির্জা মনসুর রেডিওতে নিয়ে আসেন। ওইদিন সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণায় সংগ্রামরত সাধারণ মানুষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এতে আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়ার কাছে আপত্তি জানান। তারপরে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুরোধে একে খান সাহেবের নিজ হাতের লেখা ও সংশোধিত ভাষণ নিয়ে আসেন মির্জা মনসুর সাহেব। পরে মেজর জিয়া এই লিখিত ভাষণটি বেতারে পাঠ করেন। 'জাতির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প থেকে আমি মেজর জিয়া বলছি। আমাদের গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সাথে আছেন।' এই ভাষণটি কালুরঘাট বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার প্রচার করা হতে থাকে। এ সময় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন মির্জা মনসুর, ডা. মান্নান, ডা. জাফরসহ আরও অনেক। পরে লেফটেন্যান্ট শমসের মুবিন বেতার থেকে জনতার কাছে বারবার আহ্বান জানিয়েছিলেন, আপনারা মেজর জিয়ার ভাষণ শোনেন।
বেতার ভাষণের পর যুদ্ধের গুরুত্ব বেড়ে যায়। সৈনিক, ছাত্র, জনতা, সবাই অসীম সাহসী হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ রাতে কয়েকজন বাঙালী অফিসার ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রাণে বেঁচে পালিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া অন্যতম। শহরে ইপিআর সদস্যরা যুদ্ধরত অবস্থায় আছেন। এদিকে প্রবর্তক হিলে ইপিআর ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পাক সেনাদের মোকাবেলা করার জন্য বসে আছে। পাকিস্তানী সেনারা ক্যান্টনমেন্টে সব শেষ করে শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা ষোলশহর রেলগেটের অল্প দূরে অবস্থান নিয়েছে। এদিকে ক্যাপ্টেন রফিকের বার্তা পেয়ে সীমান্তের ইপিআর সদস্যরা শহরের দিকে মার্চ করেছে। টেকনাফ, কক্সবাজার, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটির ইপিআর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কাপ্তাই থেকে ক্যাপ্টেন হারুন তার সিপাহীদের নিয়ে শহরে ঢুকে পড়লেন। ২৬ তারিখ সকাল থেকে একটি হেলিকপ্টার চট্টগ্রাম শহরের উপর দিয়ে টহল দিতে থাকে। একটু পর পর পার্ক নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ 'বাবর' থেকে শহরের দিকে শেল নিপে করা হচ্ছে। চট্টগ্রামবাসীদের একটি আতঙ্কিত অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে গুজব রটে গেল কুমিল্লা থেকে এক বিরাট বহর নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে পাকিস্তানী বাহিনী। ক্যাপ্টেন রফিক একদল ইপিআর সেনাকে কুমিরার পাহাড়ে পাঠিয়ে দিলেন। রাতে ইপিআর সেনাদের এ্যাম্বুসে অনেক পাকসেনা মারা পড়ল, বাকিরা দিশেহারা হয়ে পালাতে শুরু করল। প্রচুর যানবাহন ধ্বংস হলো। ২৬ তারিখ রাতে কুমিরায় এই ভয়াবহ যুদ্ধে পাকসেনাদের কমান্ডিং অফিসার ভয়ে আত্মগোপন করেছিল। কুমিরার এই যুদ্ধে পাকসেনাদের পক্ষে একজন ব্রিগেডিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা কোনদিন আশা করেনি যুদ্ধের শুরুতেই বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে এ রকম বিরাট বিপর্যয় ঘটবে, এত ক্ষয়ক্ষতিও তারা আশা করেনি। ইপিআরদের অল্প য়তি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে 'কুমিরার যুদ্ধ' ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
২৫ মার্চ রাত থেকেই চট্টগ্রাম নগরীতে ইপিআর সদস্যরা যে যুদ্ধ শুরু করে তাতে কোন বাঙালী সেনা অংশগ্রহণ করেনি। এদিকে নৌবাহিনীর ঘাঁটি টাইগার পাস থেকে নৌসেনারা আক্রমণ শুরু করে। পাকসেনা ও নৌবাহিনীর প্রতিটি আক্রমণের বিরুদ্ধে ইপিআর সৈনিকেরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদিকে নৌসেনারা ক্যাপ্টেন রফিকের সদর দফতর রেলওয়ে হিলে অনবরত গোলাবর্ষণ করে। বাধ্য হয়ে তিনি রেলওয়ে হিল ত্যাগ করেন। নৌসেনারা বিহারী ও অবাঙালীদের সহায়তায় রাতের বেলায় দলবেঁধে ইস্পাহানি বিল্ডিং, সার্কিট হাউস, আসকার দীঘির পাড় ও ইস্পাহানি বাংলোতে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানী নৌসেনারা রোগীর কথা বলে মেডিক্যাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ দখল করে।
চট্টগ্রামবাসী ভেবেছিল বাঙালী সৈনিকেরা ইপিআরদের সাথে যুদ্ধ করে শহরবাসীকে রা করবে। কিন্তু শহর রা তো দূরের কথা, সীমান্ত থেকে আগত ইপিআরদের মেজর জিয়া কালুরঘাটে আটকে রাখেন। চট্টগ্রামবাসীদের জন্য আরেকটি অসুবিধা হলো কলোনি ছাড়া পুরো চট্টগ্রাম শহরেই অবাঙালীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাকিস্তানী ছাড়াও বিহারী, মোহাজের, শিয়া, মেমনরা শহরে বসবাসরত ছিল। এ ছাড়াও টেরিবাজার, খাতুনগঞ্জ, রহমতগঞ্জ, কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশ, চকবাজার, বাকলিয়া, মুরাদপুর, অক্সিজেন, নাসিরাবাদ, সোসাইটি, আতুরার ডিপো, পশ্চিম নাসিরাবাদ ও শহরের দক্ষিণ দিকে কদমতুলি, মোঘলটুলি, পাঠানটুলি, পাহাড়তলি, ঝাউতলা, আমবাগান ও আগ্রাবাদ রেলওয়ে কলোনিগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবাঙালীরা বসবাস করত। এর বাইরে চট্টেশ্বরী রোডে কাবুলীওয়ালা ও পাঠানদের বৃহত্তম ঘাঁটি ছিল। এদের প্রত্য ও পরো সহায়তায় পাকিস্তানী সৈন্যরা অতি দ্রুত চট্টগ্রাম শহর দখল করে নেয়।
২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন রফিক দু'দিক থেকে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। একটি গ্রুপকে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। আর তিনি নিজে বায়েজিদ বোস্তামি রোড দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া সীমান্ত থেকে আগত সব ইপিআর সৈনিকদের কালুরঘাটে আটকে রাখায় তার পক্ষে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হলো না। ক্যাপ্টেন রফিক ডা. জাফরের মাধ্যমে পুনরায় জিয়ার কাছে অনুরোধ করেন ইপিআর সৈন্যদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। পরে এম.এ. হান্নান কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে গোমদণ্ডি স্কুলে যান। তারা মেজর জিয়া ও মেজর শওকতকে অনুরোধ করেন আর বিলম্ব না করে শহরে ইপিআরদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য।
এদিকে চট্টগ্রাম শহর প্রায় জনমানবহীন হয়ে পড়লো। ২৮ মার্চ ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে সামরিক ও বেসামরিক জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, সবাই যেন লালদীঘির ময়দানে এসে জমায়েত হন। পরে রাজনীতিবিদদের নির্দেশে সে ঘোষণা বাতিল করা হয়। এদিকে দামপাড়া পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। আমার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম বেতারে অবস্থানরত বাঙালী সৈনিকদের খাদ্য সরবরাহ করা। লেফটেন্যান্ট মাহফুজ আমাকে আগে থেকে চিনত। সে সুবাদে মেজর জিয়া মাহফুজকে বলল, তাদের পরিবারকে নাসিরাবাদ বাসা থেকে উদ্ধার করার জন্য। জিয়ার চাচা শ্বশুর দেলোয়ার হোসেন সাহেবের বাসা চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চিম পাশে পৌঁছে দিতে হবে তার পরিবারের সদস্যদেরকে। আমি দেলোয়ার সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে তাকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে গমন করি। একটি এ্যাম্বুলেন্স অনেক কষ্ট করে যোগাড় করে সেই এ্যাম্বুলেন্স সাথে নিয়ে জিয়ার বাসায় পৌঁছি ওই বাংলোতে না পেয়ে আমরা পাশে একটি বিদেশী লোকের বাসা থেকে রাত নয়টার দিকের জিয়ার পরিবারকে উদ্ধার করি। বাসায় পাহারারত সৈনিকদের নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে নামিয়ে আমরা দেলোয়ার সাহেবের বাসার দিকে রওনা দেই। পথে আমরা দুর্ঘটনার শিকার হই ওলিখাঁ মসজিদ থেকে রাসত্মায় যাওয়ার পথে সংগ্রামী জনতার রোষের মুখে পড়ি। তারা সবাইকে অবাঙালী মনে করছে চকবাজারের লীগ স্টরের সামনে (বর্তমান গুলজার সিনেমা হলের সামনে) সেখান থেকে বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক দানুর সহায়তায় রা পায়। জিয়ার পরিবারে সাথে যারা ছিল কর্নেল হোসেন সাহেবের স্ত্রী ও এক ছেলে লে. মাহফুজির স্ত্রী ও আট মাসের ছেলে ছিল। জিয়ার স্ত্রী ও দুই ছেলেকে আমি ষোলশহরের বাসা থেকে দেলোয়ার সাহেবের বাসায় পৌঁছে দেই। দ্বিতীয় দায়িত্বটি ছিল বেতারে পাহারারত সৈনিকদের ঠিকমতো খাবার সরবরাহ করা। এখানে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা পাহারারত ছিল। (চলবে)
No comments