কলা চুরির জন্য ফাঁসি! by মাসুম খলিলী

বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে একটি প্রবচন বেশ শোনা যায়। সেটি হলো কলা চুরির জন্য ফাঁসি হয় না। এর গভীর একটি তাৎপর্য আছে।
সে তাৎপর্য হলোÑ প্রত্যেক অপরাধের একটি মাত্রা আছে, আর শাস্তি হবে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী। বাংলাদেশের সর্বশেষ সংশোধনীর পর সংবিধানের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে কলা চুরির জন্য ফাঁসির মতো দণ্ডের বিধান খোদ শাসনতন্ত্রেই করা আছেÑ এমন মত নানা আলোচনায় উঠে আসছে। বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীতে এমন কোনো দেশের সংবিধান নেই যেটি প্রণয়নের সময় যে রকম ছিল তেমনটি অবিকল এখনো আছে। সংশোধন সবচেয়ে কঠিন বলা হয় আমেরিকান সংবিধানকে। সেটিও ১৭৯১ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯২ সালের ৭ মে পর্যন্ত দুই শ’ বছরে ২৭ দফা সংশোধন হয়েছে। বাংলাদেশের ৪০ বছর সময়ে সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৫ বার। সংশোধনের সুযোগ শাসনতন্ত্রে এ কারণে রাখা হয় যে, মানুষের প্রণীত কোনো কিছুই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত হয় না। বাংলাদেশের গণপরিষদ সদস্যরা যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে দশম ভাগের পুরোটা হলো সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত। সংশোধনের এ বিধানেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, সময়ের সাথে সাথে অনেক বিধান পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে পরিবর্তনের প্রয়োজন উপলব্ধি করা হয়। সে সমালোচনা যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মধ্যে পড়ে তাহলে কেউ আর সংবিধান নিয়ে কথা বলবে না। বাংলাদেশের সংবিধানের সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৭(১) অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। ৭(১) অনুচ্ছেদে সংবিধান ‘বাতিল’ ‘স্থগিতকরণ’ এর উদ্যোগ বা ষড়যন্ত্র করলে কিংবা সংবিধানের কোন বিধানের প্রতি আস্থা বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করার উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে সর্বোচ্চ দণ্ড দেয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের আর কোথায়ও এভাবে কোনো অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়ার বিধানের কথা উল্লেখ নেই। দণ্ডবিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি যেখানে মৃত্যুদণ্ড তা খোদ সংবিধানে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে শাসনতন্ত্রের প্রতি আস্থা বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করার দায়ে। সংবিধানের পরিবর্তনযোগ্যতার স্বীকৃতি যেখানে খোদ সংবিধানেই রাখা হয়েছে, সেখানে সংবিধান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ থাকবে নাÑ তা একেবারেই পরস্পরবিরোধী। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা এই আজগুবি ধরনের বিধান পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে পাওয়া যায় না। যদিও এ বিধান এখনো কারো ওপর প্রয়োগ করা হয়নি।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে অনেক রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক দল নিজস্ব আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতি করছে। বাংলাদেশের বর্তমান যে মূলনীতি আছে এগুলোর ব্যাপারেও একেক দলের একেক মত রয়েছে। সংবিধানে যে সমাজতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগই সে সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমকে সমর্থন করে না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রতি কোনো ইসলামি দলেরই আস্থা নেই। আবার সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের শুরুতে যে বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করে। এর  বাইরেও সংবিধানে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা থাকা উচিত নয় বলে অনেকে মনে করেন। কারোএই সমালোচনাকে কেউ সংবিধানের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির প্রয়াস বলে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের এবং বিচার করে শাস্তি দেয়া হলে এর পরিণতি কী দাঁড়াবে? বাস্তবে দেখা গেছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর মহাজোট সরকারের অংশীদাররাই এই সংশোধনীর কিছু বিষয়ের ব্যাপারে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন।

অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, ৫ম, ৭ম ও ত্রয়োদশ সংশোধনীসংক্রান্ত রায়ের ব্যাপারে সরকার নিজস্ব করণীয় নির্ধারণে পরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। এতে নানা ধরনের ত্রুটিযুক্ত বিধান সন্নিবেশ হয়ে গেছে সংশোধনীতে। আর একই সাথে সংবিধান সংশোধনের একটি উপায় হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে উচ্চতর আদালতের রায়কে। অথচ বাংলাদেশের অষ্টম সংশোধনী রায়ের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ‘মিনার্ভা মিলস লি বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’র মামলায় ৪২তম সংশোধনীর একটি অনুচ্ছেদ বাতিলের যে রায়ের (এআইআর-১৯৮০ সুপ্রিম কোর্ট) রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়েছিল, সে রায় এখনো ভারতীয় লোকসভা গ্রহণ করেনি। বাতিল ঘোষিত সংশোধনীর সেই অনুচ্ছেদটি এখনো ভারতীয় সংবিধানের অংশ হয়ে আছে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ব্যাপারে এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যে মনে হয়েছিল এখানকার সরকারও একই লাইনেই যাচ্ছে। সৈয়দ আশরাফ তখন বলেছিলেন, সংবিধান সংশোধনের কাজ আদালতকে দিলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে একবার সংবিধানের সংস্করণ প্রকাশ এবং পরে আবার পঞ্চদশ সংশোধনীতে কোর্টের রায়ের অনেক অনুচ্ছেদ হুবহু তুলে দেয়ায় সংসদ সংবিধানের সংশোধনীসংক্রান্ত রায়কে কোন মাত্রায় গ্রহণ করেছে এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।

এ ছাড়া আদালতের রায়ে জিয়া ও এরশাদ আমলের বাতিল হওয়া ১৭২টি অধ্যাদেশের (সামরিক ফরমান) বৈধতা দিতে গিয়ে গত ২১ জানুয়ারি দু’টি পৃথক অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। কোনো অধ্যাদেশ আইনে পরিণত হতে পারে কেবলমাত্র সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নতুন অধ্যাদেশ জারি করে বাতিল হওয়া অধ্যাদেশের বৈধতা দিতে গিয়ে সংবিধানের ৯৩ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হয়েছে। আদালতের সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার স্বীকার করতে গিয়ে এর বাইরে আরো নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ সংসদকে কোনো নির্দেশ দিতে পারে না। আদালত নিজের মতো করে সংবিধান সংশোধনী বাতিল করার ফলে সৃষ্ট শূন্যতা ও অচলাবস্থা নিরসনে বেশ কিছু বিষয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এটাকে অনেকে ব্যাখ্যা করছেন সংসদের ওপর উচ্চতর আদালতের পরোক্ষ নির্দেশনা হিসেবে। এই এখতিয়ার ভারতের সংসদ কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি হয়নি। এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের একটি বিরাট প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে।

সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে আইন বিভাগের ওপর যেমন বিচার বিভাগের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে দেখা যায় তেমনিভাবে বিচার বিভাগের ওপর সংসদের নিয়ন্ত্রণের একটি প্রচেষ্টাও সক্রিয় দেখা যায়। পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণের আগে এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর সাথে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের মন্তব্য-পাল্টামন্তব্য নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচার করা জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করবেন এমন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়। মূলত, সংসদীয় সার্বভৌমত্বের প্রাচীন ধারণা থেকে এ প্রস্তাবনার উৎপত্তি। অবশ্য এটি ঠিক যে কোনো কোনো দেশে সাংবিধানিকভাবেই বিচারকদের অভিশংসনের মতা আইনসভার কাছে ন্যস্ত। বাংলাদেশের মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে এ দায়িত্ব সংসদের কাছে ন্যস্ত করা হয়। তাতে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের পাস করা প্রস্তাবে প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের বিধান ছিল। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ মতা দেয়া হয় নিরঙ্কুশভাবে প্রেসিডেন্টকে। আবার পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিধানে আমূল পরিবর্তন আসে। এতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি ও অপর দু’জন প্রবীণ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতামত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অযোগ্যতা ও নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারবেন। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে ১৯৭২ সালের বিধানের পরিবর্তে ৫ম সংশোধনীর বিধানটি রেখে দেয়া হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতেও অনেকটা সেই বিধানটি রেখে দেয়া হয়। এ সংশোধনী যখন সংসদে বিবেচনার জন্য উঠে তখন আইন সভা ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক পাকিস্তানের মতো সংঘাতপ্রবণ হলে মূল সংবিধানের বিধানটিই হয়তো ফিরিয়ে আনা হতে পারত। বিচারপতি-স্পিকার বিতর্কের সময় এই মনোভাবের প্রতিফলন সরকারি জোটের সংসদ সদস্যেদের কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। রাষ্ট্রের কাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা যে গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক হয় এ বিষয়ে কেউ এখন আর বিতর্ক করে না। এ কারণে রাষ্ট্রের প্রধান বিভাগগুলোর মধ্যে অবশ্যই বিদ্যমান ভারসাম্য বজায় রাখা ভালো।

সংবিধানের সংশোধনযোগ্যতা আরেকটি ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক বিধানগুলো সংশোধন করা যাবে না মর্মে অনুচ্ছেদ (৭খ) সংযোজন করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, ‘১৪২ অনুচ্ছেদে যাই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম ক ভাগের বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ  ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সংযোজন পরিবর্তন প্রতিস্থাপন রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধন অযোগ্য হইবে।’  এই অপরিবর্তনযোগ্য অংশের মধ্যে সংবিধানের প্রায় এক তৃতীয়াংশই পড়ে যায়। এর মধ্যে রাষ্ট্রধর্ম, জাতীয় সঙ্গীত, জাতির পিতা, নাগরিকত্ব, সংবিধানের বিরুদ্ধে কথা বললে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি, জাতীয় মূলনীতি, জরুরি অবস্থা ইত্যাদি রয়েছে। এর বাইরে আলাদাভাবে বলা হয়েছে মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলির কথা।

আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, এই অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে সংবিধানের উল্লেখিত অংশ কোনো দিন পরিবর্তন করা যাবে না। ঠিক এর পাল্টা মত প্রকাশ করেছেন বিরোধী দলের আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এই অনুচ্ছেদ রেখে পরিবর্তন হয়তো করা যাবে না। তাই আগে পরিবর্তন না করার অনুচ্ছেদটি বাতিল করা হলে পরে অন্য অংশে পরিবর্তন আনতে আর কোন বাধা থাকবে না।

সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য নিয়েও বিতর্কের অন্ত নেই। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর রায়ে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সংবিধান হলো এককেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। সুতরাং হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীয়করণের বিষয়টি সংবিধানের এককেন্দ্রিকতার পরিপন্থী বিধায় বাতিলযোগ্য। বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে পুরো পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী কিছু মার্জনাসাপেক্ষে বাতিল করা হয়। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো আসলে কী তার কোনো সংজ্ঞায়ন বা চিহ্নিতকরণ সংবিধান বা আইনের কোথায়ও নেই। আদালতের বিচারকেরা তাদের নিজস্ব বিবেচনা মতো এর ব্যাখ্যা দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন। সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী অনুচ্ছেদগুলোর বিপরীত কোনো আইন না করার কথা নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় এর মধ্যে মূলনীতিসহ মূল সংবিধানের আরো অনেক কিছুই বিবেচনায় আনা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র এখন এক ধরনের মৃত আদর্শ। রাশিয়ায়ও এখন সমাজতন্ত্র নেই। চীনে সমাজতন্ত্র থাকলেও এর মূল বৈশিষ্ট্য পাল্টে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগকে সেখানে এখন ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সমাজতন্ত্রের লাশ মূলনীতি হিসাবে আজীবন বয়ে বেড়ানোর বক্তব্য অনেকে মেনে নেবেন না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল আদর্শ ছিল গণতন্ত্র। সেটিকে মৌলিক আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হলে এর পরিপন্থী কোনো বিধান সংবিধানে সন্নিবেশ করা সম্ভব নয়। অথচ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল গঠনের বিধানকে সংবিধান পরিপন্থী বা বাতিল ঘোষণা করা হয়নি কোনো রায়ে। কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন, চতুর্থ সংশোধনীকে কেউ তো চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেনি। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হকের বেঞ্চ যে মামলার জের ধরে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন সেটি ছিল একটি সিনেমা হলের মালিকানা দাবির। এতে পঞ্চম সংশোধনীর প্রাসঙ্গিকতা কিছুটা আসে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সময়ের সরকারের সব ঘোষণা বৈধ বলে গণ্য হবে এবং আদালতে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা যাবে না মর্মে উল্লেখিত বিষয়টি। সিনেমা হলের মালিকানার জের ধরে পঞ্চম সংশোধনী এলে চতুর্থ সংশোধনী প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যেতে পারত। কিন্তু সেটি না আসায় এবং সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ে পঞ্চম সংশোধনীর সাথে দ্বাদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ায় এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে সংবিধানে। এতে এখন দেশে যে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চলছে সেটিই অবৈধ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আরেকটি সংশোধনী এনে এ বিষয়গুলো নিষ্পত্তি না হলে বড় ধরনের সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে দেশে।

কোনো আইন বা বিধানের সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ায় বিষয়ে অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আসছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য পঞ্চম সংশোধনীতে এ বিচার করা যাবে না বলে যে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে, সেটিকে দীর্ঘ দিন সাংবিধানিক বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সংবিধানের এ বিধান বাতিল না করে বিচারটি করা যাবে কি না এই আইনি প্রশ্ন এলে দেশের দুই খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ মত দেন সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অংশটি সংশোধন করতে হবে। অন্য দিকে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দায়মুক্তি রদ করে একটি আইনই বিচারের জন্য যথেষ্ট বলে মত দেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক। শেষ পর্যন্ত শেষোক্ত মত গ্রহণ করে সংসদে দায়মুক্তি রদ আইন পাস করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারসম্পন্ন করা হয়। সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ আইনে অভিযুক্তদের মৌলিক অধিকার রহিত থাকা সংক্রান্ত ধারাকে সংরক্ষণ দেয়া হয়। ২০১০ সালে এ আইনের সংশোধনী এনে সেটাকে সংরক্ষণের আওতায় ফেলা হচ্ছে। এই বিধানকে চ্যালেঞ্জ করে সংসদে রিট করা হলে সেটি শুনতেই রাজি হননি হাইকোর্টের একাধিক বেঞ্চ। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ৩৫(১) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে তাও এ ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে, ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংবিধানে বলবৎ ছিল এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষীসাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ সংগঠনকালে বলবৎ সেই আইন বলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না।’ অথচ ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আইন এবং এর পরবর্তী সংশোধনীতে এমন বিধান রয়েছে যা ১৯৭১ সালে অপরাধ সংগঠনের সময় ছিল না। এসব বিষয় এ কারণে হচ্ছে যে, আইনি বিষয়ের ওপর প্রচারণা ও আবেগ বেশি প্রাধান্য বিস্তার করছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার জন্য এটি মোটেই সুখকর কিছু নয়। গণপিটুনিতে হত্যার বেশির ভাগ ঘটনায় নির্দোষ মানুষ এর শিকার হয়। আইনের প্রয়োগের ওপর আবেগ ও প্রচারণা স্থান পেলেও একই ঘটনা ঘটে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, পঞ্চদশ সংশোধনী-উত্তর যে সংবিধান রয়েছে তাতে এত অসঙ্গতি ও পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে যে, বর্তমান সরকারের মেয়াদে না হলেও এক সময় এর একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা দাবি উঠবে। কোনো দেশের শাসনতন্ত্রই রাজনৈতিক ভাবাদর্শ থেকে মুক্ত থাকে না। সেই ভাবাদর্শ হয় দেশটির উন্মেষকাল বা স্বাধীনতা লাভকালীন সময়ের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনে ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দলীয় আদর্শকে সংবিধানে সন্নিবেশিত করে জাতীয় আদর্শের মর্যাদা দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় আদালতের রায়েও একই ধরনের প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এটি শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য মঙ্গলকর হয় না।

mrkmmb@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.