স্মরণ ॥ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ by আরিফ নজরুল
বাহান্নর কৃষ্ণচূড়া দিনে কুমড়ো ফুলের
চেতনায় সমগ্র বাংলাদেশকে ছাপিয়ে যে চোখ আন্তর্জাতিক চোখ হয়ে উঠেছে, তার
আক্ষরিক মালিক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।
কেন না তিনি কথা
বলেন স্বপ্ন লোকের রং মিশিয়ে, মাটি ও মানুষের মমতায়, শেকড় সন্ধানী চেতনায়।
ধান নদী খালের চন্দ্রদ্বীপ থেকে বেড়ে ওঠা এই স্বচ্ছস্বর প্রকৃত অর্থেই
মানবতার মুক্তির স্বরে পরিণত হয়েছে শেষ পর্যন্ত। কর্মকর্তার চেয়ে কর্মী
কর্তার যে চেহারা দেখেছি সাতনরী হারের প্রতিটি আলোর দানায় তা কখনও রং কখনও
সুরের ব্যঞ্জনায় উচ্ছলিত হয়ে উঠেছে কমলের চোখের মতো। এভাবে উঠতে উঠতে
কিংবদন্তির কথা বলেছেন তিনি। সহিষ্ণু প্রতীৰায় থেকে থেকে কবি বৃষ্টি ও
সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা করে সময়কে চিত্রিত করেছেন একাগ্রচিত্তে।
সময়ের প্রয়োজনীয় বাণীকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন একজন সফল রাষ্ট্রদূতের
কারিশমায়। আবার কেন্দ্রীভূতও হয়েছেন খাঁচার ভেতর অচিন পাখির বিমুগ্ধ
বিস্ময়ে। ফুলে ফুলে ছড়িয়ে থাকা মধুকে তিনি মাধুরী মিশিয়ে চিনিয়েছেন দেশ
থেকে দেশান্তরে।
কবি, সাহিত্যিক, সিভিল সার্ভেন্ট, কূটনীতিক এবং একসময়ের মন্ত্রী আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে। তাঁর ডাক নাম ছিল সেন্টু। বাবা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন ময়মনসিংহের জেলা জজ। সেখানেই কাটে সেন্টুর শৈশব। আব্দুল জব্বার খান জাতীয় পরিষদের স্পীকারও ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ওবায়দু্ল্লাহ সম্পন্ন করেন মাধ্যমিক শিক্ষা। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে। তারপর ইংরেজী সাহিত্যে বিএ অনার্স এবং ১৯৫৩ সালে সম্পন্ন করেন মাস্টার্স ডিগ্রী। সফল ফলাফলের কৃতিত্বে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে। তারপর ১৯৫৭ সালে তিনি যোগদান করেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। হয়ে ওঠেন ডাকসাইটে সরকারী আমলা। সিভিল সার্ভিসে তিনি দারুণ সফলতার স্বাক্ষর রাখেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের পর বেশ ক'টি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবেও কাজ করেন। অবসরের পর ১৯৮২ সালে কৃষি ও পানিসম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে সরকার তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন। জাতীয় ক্ষেত্রে নিযুক্ত হন জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের উপমহাপরিচালক এবং পরে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি এফএও -এর চাকরি থেকে অবসর নেন।
পেশাজীবনে এতগুলো সফলতার পাশাপাশি যে পরিচয়টি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকে করেছে স্বকীয়, খ্যাতিমান এবং পৌঁছে দিয়েছে দেশের মানুষের কাছে, সেটি হচ্ছে তিনি একজন কবি। বাংলাদেশের মানুষ আলাদা করে দেখেছে তাঁকে এবং তাঁর মর্মস্পর্শী সহজবোধ্য বিশুদ্ধ মৌলিক কবিতাকে। তিনি ছিলেন একজন আধুনিক কবি। তিনি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে একসঙ্গে সম্মিলিত করেছিলেন তাঁর কবিতায় এবং এই কবিতার মধ্যে জাগ্রত করেছিলেন তাঁর স্বপ্নকে। এজন্যই কর্মস্থলের বাইরের বিশাল জগতে অভিনন্দিত হয়েছিলেন তিনি বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে। আধুনিক কবিতায় তিনি এনেছিলেন সহজবোধ্য একটি নির্মল কাঠামো। করেছিলেন কৃষিভিত্তিক সভ্যতাকে উজ্জীবিত। একদিকে তাঁর ছড়া, অন্যদিকে কবিতা দুটোতেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। তবে তাঁর লিরিকধর্মী হৃদয়ছোঁয়া কবিতা পাঠককে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। আবেগ এবং অর্থবোধ দুটোকেই সন্নিবেশ করেছিলেন সমানভাবে। আর এজন্যই তাঁর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত 'কোন এক মাকে' আজও পাঠকের মুখে মুখে ফেরে। উচ্চারিত হয় নানাভাবে নানা আসরে। মোটকথা আবু জাফর ওবায়দু্ল্লাহ কবিতা লিখেছিলেন সাধারণ মানুষের ভাষায়।
পরিপূর্ণ মৌলিক ধারার কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি' তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল জনপ্রিয়তার শিখরে। এই কবিতায় তিনি আমাদের অতীত ইতিহাস এবং বর্তমানের একটি সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন। এদেশের মানুষের অতীত কষ্ট এবং নির্যাতনের বিমূর্ত চিত্র তিনি তাঁর এই কবিতায় অত্যন্ত সফলভাবে তুলে ধরেছিলেন। আধুনিককালের এই কবির কবিতা পাঠক ছাড়াও সবশ্রেণীর মানুষের মুখে উচ্চারিত হতে দেখা গেছে। ভাষা আন্দোলনে যাওয়া সন্তানের অপেক্ষায় থাকা মাকে নিয়ে তাঁর কবিতা 'কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা' কবিতাটি খুবই জনপ্রিয়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সাত নরী হার, কখনো রং কখনো সুর, কমলের চোখ, কিংবদন্তীর কথা বলছি, সহিষ্ণু প্রতীৰা, বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা, আমার সময়, আমার সকল কথা, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, নির্বাচিত কবিতা, মসৃণ কৃষ্ণগোলাপ। ইংরেজী ভাষায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, Yollow Sands Hills, China Through China, Rural Development, Problems and Prospects, Creative Development, Food and Faith.
আবু জাফর ওবায়দু্ল্লাহ এশিয়ার কৃষি সংস্কার ও সম্প্রসারণে রেখেছিলেন বিশেষ অবদান। তিনি ছিলেন পদাবলী কবি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠান ১৯৮০ সালে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করেছিল। কবিতা লেখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও একুশে পদক লাভ করেন।
সম্মাননা : ফেলো, সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ফেলো, ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টার (Poet in Residence) হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের ১৯ মার্চ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ চির বিদায় নিয়ে নিজেই হয়ে গেছেন কিংবদন্তী।
লেখক : কবি
কবি, সাহিত্যিক, সিভিল সার্ভেন্ট, কূটনীতিক এবং একসময়ের মন্ত্রী আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে। তাঁর ডাক নাম ছিল সেন্টু। বাবা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন ময়মনসিংহের জেলা জজ। সেখানেই কাটে সেন্টুর শৈশব। আব্দুল জব্বার খান জাতীয় পরিষদের স্পীকারও ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ওবায়দু্ল্লাহ সম্পন্ন করেন মাধ্যমিক শিক্ষা। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে। তারপর ইংরেজী সাহিত্যে বিএ অনার্স এবং ১৯৫৩ সালে সম্পন্ন করেন মাস্টার্স ডিগ্রী। সফল ফলাফলের কৃতিত্বে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে। তারপর ১৯৫৭ সালে তিনি যোগদান করেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। হয়ে ওঠেন ডাকসাইটে সরকারী আমলা। সিভিল সার্ভিসে তিনি দারুণ সফলতার স্বাক্ষর রাখেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের পর বেশ ক'টি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবেও কাজ করেন। অবসরের পর ১৯৮২ সালে কৃষি ও পানিসম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে সরকার তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন। জাতীয় ক্ষেত্রে নিযুক্ত হন জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের উপমহাপরিচালক এবং পরে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি এফএও -এর চাকরি থেকে অবসর নেন।
পেশাজীবনে এতগুলো সফলতার পাশাপাশি যে পরিচয়টি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকে করেছে স্বকীয়, খ্যাতিমান এবং পৌঁছে দিয়েছে দেশের মানুষের কাছে, সেটি হচ্ছে তিনি একজন কবি। বাংলাদেশের মানুষ আলাদা করে দেখেছে তাঁকে এবং তাঁর মর্মস্পর্শী সহজবোধ্য বিশুদ্ধ মৌলিক কবিতাকে। তিনি ছিলেন একজন আধুনিক কবি। তিনি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে একসঙ্গে সম্মিলিত করেছিলেন তাঁর কবিতায় এবং এই কবিতার মধ্যে জাগ্রত করেছিলেন তাঁর স্বপ্নকে। এজন্যই কর্মস্থলের বাইরের বিশাল জগতে অভিনন্দিত হয়েছিলেন তিনি বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে। আধুনিক কবিতায় তিনি এনেছিলেন সহজবোধ্য একটি নির্মল কাঠামো। করেছিলেন কৃষিভিত্তিক সভ্যতাকে উজ্জীবিত। একদিকে তাঁর ছড়া, অন্যদিকে কবিতা দুটোতেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। তবে তাঁর লিরিকধর্মী হৃদয়ছোঁয়া কবিতা পাঠককে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। আবেগ এবং অর্থবোধ দুটোকেই সন্নিবেশ করেছিলেন সমানভাবে। আর এজন্যই তাঁর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত 'কোন এক মাকে' আজও পাঠকের মুখে মুখে ফেরে। উচ্চারিত হয় নানাভাবে নানা আসরে। মোটকথা আবু জাফর ওবায়দু্ল্লাহ কবিতা লিখেছিলেন সাধারণ মানুষের ভাষায়।
পরিপূর্ণ মৌলিক ধারার কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি' তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল জনপ্রিয়তার শিখরে। এই কবিতায় তিনি আমাদের অতীত ইতিহাস এবং বর্তমানের একটি সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন। এদেশের মানুষের অতীত কষ্ট এবং নির্যাতনের বিমূর্ত চিত্র তিনি তাঁর এই কবিতায় অত্যন্ত সফলভাবে তুলে ধরেছিলেন। আধুনিককালের এই কবির কবিতা পাঠক ছাড়াও সবশ্রেণীর মানুষের মুখে উচ্চারিত হতে দেখা গেছে। ভাষা আন্দোলনে যাওয়া সন্তানের অপেক্ষায় থাকা মাকে নিয়ে তাঁর কবিতা 'কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা' কবিতাটি খুবই জনপ্রিয়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সাত নরী হার, কখনো রং কখনো সুর, কমলের চোখ, কিংবদন্তীর কথা বলছি, সহিষ্ণু প্রতীৰা, বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা, আমার সময়, আমার সকল কথা, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, নির্বাচিত কবিতা, মসৃণ কৃষ্ণগোলাপ। ইংরেজী ভাষায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, Yollow Sands Hills, China Through China, Rural Development, Problems and Prospects, Creative Development, Food and Faith.
আবু জাফর ওবায়দু্ল্লাহ এশিয়ার কৃষি সংস্কার ও সম্প্রসারণে রেখেছিলেন বিশেষ অবদান। তিনি ছিলেন পদাবলী কবি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠান ১৯৮০ সালে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করেছিল। কবিতা লেখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও একুশে পদক লাভ করেন।
সম্মাননা : ফেলো, সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ফেলো, ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টার (Poet in Residence) হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের ১৯ মার্চ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ চির বিদায় নিয়ে নিজেই হয়ে গেছেন কিংবদন্তী।
লেখক : কবি
No comments