বীর মুক্তিযোদ্ধা ওডারল্যান্ড ও যতীন মোদী by এসকে মজিদ মুকুল
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী
একাত্তরের মহান জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশী সাংবাদিক লেখক,
শিল্পী, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে
তালিকাভুক্তি ও সম্মাননা দেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
এ
সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে এ দেশ, এ জাতি বিশ্বে আরেকবার নতুনভাবে প্রশংসিত
হবে। এই যথার্থ ঘোষণাটি আমাকে আজকের এই লেখাটি তুলে ধরতে খুব বেশি
অনুপ্রাণিত করছে। বিষয়ভিত্তিক দেখার আগে নিজের তৃপ্তির জন্য উল্লেখ করছি
যে, সংরক্ষণের সুযোগ-সুবিধা নেই প্রায় পরিবেশের একজন কারণে (কারও কাছে
থাকতে পারে বা আছে) কেউ চ্যালেঞ্জ করলে হয়ত এ মুহূর্তে প্রমাণ উপস্থাপন করা
সম্ভব নাও হতে পারে। তার পরও সত্য যে, দেশের অবহেলিত উত্তর জনপদের
সমস্যাবহুল গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রকাশিত
গণপ্রহরীসহ একাধিক পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার লিখেছিলাম। বিশেষত
মিত্রবাহিনীসহ অন্য বিদেশীদের আত্মবলিদানকারীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান
প্রদর্শনে স্মৃতিফলক স্থাপন ও তাঁদের তালিকা জাতির সামনে তুলে ধরতে সরকারের
প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। সিদ্ধান্তটি কার্যকর করতে এখনই কাজ শুরু হোক।
গর্বিত জাতি হিসেবে গর্ব করেই বলছি, বাংলাদেশী বাঙালীরা যেহেতু অকৃতজ্ঞ নয়, সেহেতু আমাদের মহান জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনীর ভূমিকা পালন করতে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। সেই সাথে যে সকল স্বাধীনতাকামী, মুক্তিকামী বিশ্ববাসী এবং দেশ নানাভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমার আলোচ্য বিষয়ে আমারই স্মরণীয়দের মধ্যে অন্যতম অস্ট্রেলিয়ার বীর সন্তান আমাদের দেশে প্রবাসী জীবনে থেকে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ কৃতিত্বের জন্য অস্ট্রেলিয়ার ওলন্দাজ নাগরিক বীর মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়ম এএস ওডারল্যান্ড 'বীরপ্রতীক' খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। অপরজন ভারতের গুজরাটের ড. যতীন মোদি নিজ মেধা দিয়ে বুঝতে পারেন, বাংলাদেশের বীর জনগণের কাঙিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত অনির্ধারিত সময় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজন। ড. যতীন যুদ্ধে অংশ নিলে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা পালন করা হবে। আর অর্থ দিলে অনেকে যুদ্ধ করতে পারবেন। অর্থে অস্ত্র, খাদ্য ও ঔষুধপত্র ক্রয় করে যেমনি যুদ্ধ করতে পারবেন, তেমনি আহত অনেককে অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা নিয়ে জীবন রৰা করতে পারবেন। তাই অর্থ সংগ্রহকারী মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা পালন করে প্রশংসিত হন। তিনি নিজেও এজন্য গর্ব করেন। এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা ওডারল্যান্ড ও যতীন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হোক এবং সম্মাননা পাক_ এটা আমার একান্ত কাম্য।
পরিবেশ বিপর্যয়, নির্গমনের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে সময়ে-অসময়ে বন্যা, খরা, ঝড়-বৃষ্টি হওয়ার দিক পরিবর্তন হলেও আমাদের দেশে এখনও প্রচলিত 'মর্নিং শোজ দ্যা ডে।' এ বাস্তবতা আমরা দেখতে পারি প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ওডারল্যান্ডের ক্ষেত্রে। ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে জন্মগ্রহণকারী ওডারল্যান্ডের মৃত্যুকাল ২০০১ সালের ১৮ মে পর্যন্ত দীর্ঘ ৮৪ বছর বয়সের সময়কাল পর্যালোচনা করে আমরা যদি বলি, তিনি আজন্ম দেশ ও মানবপ্রেমী ছিলেন, তাহলে তা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। মতাদর্শগত ক্ষেত্রে কারও সাথে পার্থক্য থাকলেও বর্তমান বিশ্ব ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে ভিন্নমতাবলম্বীরাও (যদি থাকেন) আমাদের সাথে একমত হবেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাটা সু কোম্পানিতে জুতা পালিশকারক পদে চাকরিতে যোগ দেন। চাকরির পদ বলে দেয়, শ্রেণীগতভাবে তিনি নিম্নশ্রেণীর। অর্থাৎ সাধারণ পরিবারের। তা যা-ই হোক, তাঁর দেশ ও মানবপ্রেম দু'বছরের বেশি বাটার মতো বিশাল আন্তর্জাতিক সু কোম্পানি তাঁকে চাকরিতে ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৩৬ সালে তাঁর দেশের জাতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করে রয়্যাল সিগন্যাল কোরে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সার্জেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কমান্ডো হিসেবে বিশ্বযুদ্ধেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধ শেষে তিনি পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি দেশ গড়ার কাজে ভূমিকা পালন করতে থাকেন। ১৯৭০ সালে ৫৩ বছর বয়সে বাটা সু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ঢাকায় কোম্পানির দফতরে যোগদান করেন। শুরু হয় বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর প্রবাস জীবন যাপনের পালা। আমরা কিন্তু উইলিয়াম এএস ওডারল্যান্ড সম্পর্কে তাঁর অতীত জীবন থেকে নিশ্চিত হয়েছি, যে মানুষ দেশ ও মানবপ্রেমে জীবন-মরণের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তিনি দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সচেতন। তিনি কর্তব্যে অবহেলাও করতে পারেন না। ওডারল্যান্ড প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বছর না পেরোতেই পদোন্নতি পেয়ে কোম্পানির ম্যানেজার পদে অধিষ্ঠিত হন। এমন সময় আমাদের জাতীয় জীবনে আগত একাত্তর। মুক্তিপাগল মানুষের মুক্তির নেশায় দেশ উত্তাল। দেশ ও মানবপ্রেমে উজ্জীবিত ওডারল্যান্ড ইউরোপে যে যৌবন কাটিয়ে এসেছেন, আমাদের দেশের বাস্তবতায় তাঁর হৃদয়ে আবার যুদ্ধ দোলা দিতে থাকে। অভিজ্ঞতার ভাস্কর প্রাক্তন গেরিলা কমান্ডো অর্ধ শতাধিক বছর বয়সের এই সৈনিক নতুন এক যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে ফিরে পান যৌবন। প্রাক্তন গেরিলা যোদ্ধার বয়স্ক মাথায় নতুন গেরিলা যুদ্ধ ও কায়দার ফন্দি মাথায় আসে। সে মতে বিদেশী হিসেবে পাকিস্তানী সেনা কর্তাদের সাথে মেশা, সেনা সদরে যাতায়াত এবং তাদের কোন কোন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার তাঁর সে সুযোগ ছিল। সেই সুযোগকে তিনি প্রথম কৌশল হিসেবে কাজে লাগান। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরিকল্পনা ও নানা তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেই সাথে জীবনে অর্জিত-সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে ও দূরদর্শিতায় দায়িত্ব ও কর্তব্য কাজে লাগাতে বেশি বেশি তৎপর হতে থাকেন। শুধু তথ্য প্রেরণ নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য ও অর্থসহ সম্ভাব্য সকল প্রকার সহায়তা দিতে থাকেন। পাশাপাশি তিনি বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন গণহত্যার বিষয় বিশ্ববাসীকে জানানো প্রয়োজন। প্রয়োজনবোধ করার সাথে সাথে ভূমিকা পালন শুরু। ওডারল্যান্ড এসব করেও যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তাই তাঁর হৃদয়ে সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে আবারও জীবন-মরণের যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। নিজের টঙ্গীর বাটা সু কোম্পানির অভ্যন্তরে এবং আরও কিছু গোপনীয় জায়গায় ২নং সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনায় গেরিলা শাখার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ একের পর এক আক্রমণে সফলতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বিজয়ের পথে এগিয়ে চলে। পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দালালরা ত্রিশ লাখ বীর শহীদের রক্ত নিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। হিংস্র নরঘাতকরা মা-বোনের সম্ভ্রমও লুণ্ঠন করে। তাতে এক মুহূর্তের জন্যও যুদ্ধ থেমে থাকে না। অবশেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়াম এএস ওডারল্যান্ডের বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে সরকার 'বীরপ্রতীক' রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করে। এই বীর যোদ্ধা মৃত্যুকালে স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাসহ স্বজনদের তাঁর আদর্শ অনুকরণ-অনুসরণের শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
অপরদিকে ভারতের গুজরাট রাজ্যের রাজধানী আহমেদাবাদবাসী একাত্তরে আহমেদাবাদের মেয়র ড. রাম ভিক্টর মোদীর সাহসী সন্তান যতীন মোদী মুক্তিপাগল বাংলাদেশী বাঙালীদের হৃদয়ে লালিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষার অংশীদার হয়ে ওঠেন। মানসিকভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটা বাংলাদেশের বাঙালীদের মুক্তি অর্জনের, স্বাধীনতা অর্জনের। তাই তিনি প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে পারতেন না বটে। তবে তাঁর মনের আকাঙ্ক্ষা, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও অস্ত্র কিনতে প্রয়োজন অর্থ, খাদ্য, ওষুধ ও বস্ত্রের যোগান দেই তাহলেও তো আমার (ড. যতীন মোদী) কাঙিক্ষত মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলাম। স্বাধীনতাকামী ভারতীয় জাতির একজন হিসেবে স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের বাঙালীদের সাথে অংশ নেয়া তো কর্তব্য।
সত্যিই তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা ও কর্তব্যবোধ গুজরাটের রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভাপতি ড. যতীন মোদী তাঁর নেতৃত্বে 'হেলপ বাংলাদেশ' ব্যানার নিয়ে সহযোগীদের অংশগ্রহণে নিজ হাতে অর্থ সাহায্যের ঝুলি নিয়ে রাজপথে নামেন। সর্বস্তরের মানুষ ড. যতীনের উদ্যোগকে স্বাগত জানান, অভিনন্দিত করেন। যাঁর পক্ষে যা সম্ভব মুক্ত হস্তে তা ড. যতীনদের ঝুলিতে দেন। সে অর্থ, সেসব সামগ্রী ভারতীয় সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেই ড. যতীন মোদী হয়েছেন তাঁর কাঙিক্ষত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা ড. যতীন মোদীর এই মহতী উদ্যোগ আহমেদাবাদ বা গুজরাটেই শুধু নয়, দ্রুত ছড়িয়ে যায় বিশাল ভারতের সর্বত্র। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখেছি, বিশেষত সীমান্তবর্তী ভারতীয় অঞ্চলের বীর জনগণ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে আশ্রয় দিয়েছেন পাকিস্তানী হানাদারদের হিংস্র ছোবল থেকে রক্ষায় উদ্বাস্তু ও নিঃস্ব হয়ে যাঁরা ভারতে গিয়েছিলেন তাঁদের। গোটা ভারতের বীর জনগণের আন্তরিক সমর্থনে ভারতীয় সরকার দ্রুত এগিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় যুদ্ধে অংশ নেয়। সব মিলে বাংলাদেশের শাহাদাতবরণকারী ত্রিশ লাখ বীর শহীদের সাথে ভারতীয় বাহিনীর যাঁরা আত্মবলিদান করেছেন তাঁদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ভারতীয় বীর জনগণের ত্যাগের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে বিজয়ের এই দেশের একজন সন্তান হিসেবে আবারও বলছি, বীর মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়াম এএস ওডারল্যান্ড বীরপ্রতীক ও মুক্তিযোদ্ধা ড. যতীন মোদি লও সালাম।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
গর্বিত জাতি হিসেবে গর্ব করেই বলছি, বাংলাদেশী বাঙালীরা যেহেতু অকৃতজ্ঞ নয়, সেহেতু আমাদের মহান জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনীর ভূমিকা পালন করতে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। সেই সাথে যে সকল স্বাধীনতাকামী, মুক্তিকামী বিশ্ববাসী এবং দেশ নানাভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমার আলোচ্য বিষয়ে আমারই স্মরণীয়দের মধ্যে অন্যতম অস্ট্রেলিয়ার বীর সন্তান আমাদের দেশে প্রবাসী জীবনে থেকে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ কৃতিত্বের জন্য অস্ট্রেলিয়ার ওলন্দাজ নাগরিক বীর মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়ম এএস ওডারল্যান্ড 'বীরপ্রতীক' খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। অপরজন ভারতের গুজরাটের ড. যতীন মোদি নিজ মেধা দিয়ে বুঝতে পারেন, বাংলাদেশের বীর জনগণের কাঙিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত অনির্ধারিত সময় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজন। ড. যতীন যুদ্ধে অংশ নিলে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা পালন করা হবে। আর অর্থ দিলে অনেকে যুদ্ধ করতে পারবেন। অর্থে অস্ত্র, খাদ্য ও ঔষুধপত্র ক্রয় করে যেমনি যুদ্ধ করতে পারবেন, তেমনি আহত অনেককে অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা নিয়ে জীবন রৰা করতে পারবেন। তাই অর্থ সংগ্রহকারী মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা পালন করে প্রশংসিত হন। তিনি নিজেও এজন্য গর্ব করেন। এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা ওডারল্যান্ড ও যতীন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হোক এবং সম্মাননা পাক_ এটা আমার একান্ত কাম্য।
পরিবেশ বিপর্যয়, নির্গমনের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে সময়ে-অসময়ে বন্যা, খরা, ঝড়-বৃষ্টি হওয়ার দিক পরিবর্তন হলেও আমাদের দেশে এখনও প্রচলিত 'মর্নিং শোজ দ্যা ডে।' এ বাস্তবতা আমরা দেখতে পারি প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ওডারল্যান্ডের ক্ষেত্রে। ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে জন্মগ্রহণকারী ওডারল্যান্ডের মৃত্যুকাল ২০০১ সালের ১৮ মে পর্যন্ত দীর্ঘ ৮৪ বছর বয়সের সময়কাল পর্যালোচনা করে আমরা যদি বলি, তিনি আজন্ম দেশ ও মানবপ্রেমী ছিলেন, তাহলে তা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। মতাদর্শগত ক্ষেত্রে কারও সাথে পার্থক্য থাকলেও বর্তমান বিশ্ব ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে ভিন্নমতাবলম্বীরাও (যদি থাকেন) আমাদের সাথে একমত হবেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাটা সু কোম্পানিতে জুতা পালিশকারক পদে চাকরিতে যোগ দেন। চাকরির পদ বলে দেয়, শ্রেণীগতভাবে তিনি নিম্নশ্রেণীর। অর্থাৎ সাধারণ পরিবারের। তা যা-ই হোক, তাঁর দেশ ও মানবপ্রেম দু'বছরের বেশি বাটার মতো বিশাল আন্তর্জাতিক সু কোম্পানি তাঁকে চাকরিতে ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৩৬ সালে তাঁর দেশের জাতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করে রয়্যাল সিগন্যাল কোরে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সার্জেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কমান্ডো হিসেবে বিশ্বযুদ্ধেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধ শেষে তিনি পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি দেশ গড়ার কাজে ভূমিকা পালন করতে থাকেন। ১৯৭০ সালে ৫৩ বছর বয়সে বাটা সু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ঢাকায় কোম্পানির দফতরে যোগদান করেন। শুরু হয় বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর প্রবাস জীবন যাপনের পালা। আমরা কিন্তু উইলিয়াম এএস ওডারল্যান্ড সম্পর্কে তাঁর অতীত জীবন থেকে নিশ্চিত হয়েছি, যে মানুষ দেশ ও মানবপ্রেমে জীবন-মরণের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তিনি দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সচেতন। তিনি কর্তব্যে অবহেলাও করতে পারেন না। ওডারল্যান্ড প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বছর না পেরোতেই পদোন্নতি পেয়ে কোম্পানির ম্যানেজার পদে অধিষ্ঠিত হন। এমন সময় আমাদের জাতীয় জীবনে আগত একাত্তর। মুক্তিপাগল মানুষের মুক্তির নেশায় দেশ উত্তাল। দেশ ও মানবপ্রেমে উজ্জীবিত ওডারল্যান্ড ইউরোপে যে যৌবন কাটিয়ে এসেছেন, আমাদের দেশের বাস্তবতায় তাঁর হৃদয়ে আবার যুদ্ধ দোলা দিতে থাকে। অভিজ্ঞতার ভাস্কর প্রাক্তন গেরিলা কমান্ডো অর্ধ শতাধিক বছর বয়সের এই সৈনিক নতুন এক যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে ফিরে পান যৌবন। প্রাক্তন গেরিলা যোদ্ধার বয়স্ক মাথায় নতুন গেরিলা যুদ্ধ ও কায়দার ফন্দি মাথায় আসে। সে মতে বিদেশী হিসেবে পাকিস্তানী সেনা কর্তাদের সাথে মেশা, সেনা সদরে যাতায়াত এবং তাদের কোন কোন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার তাঁর সে সুযোগ ছিল। সেই সুযোগকে তিনি প্রথম কৌশল হিসেবে কাজে লাগান। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরিকল্পনা ও নানা তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেই সাথে জীবনে অর্জিত-সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে ও দূরদর্শিতায় দায়িত্ব ও কর্তব্য কাজে লাগাতে বেশি বেশি তৎপর হতে থাকেন। শুধু তথ্য প্রেরণ নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য ও অর্থসহ সম্ভাব্য সকল প্রকার সহায়তা দিতে থাকেন। পাশাপাশি তিনি বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন গণহত্যার বিষয় বিশ্ববাসীকে জানানো প্রয়োজন। প্রয়োজনবোধ করার সাথে সাথে ভূমিকা পালন শুরু। ওডারল্যান্ড এসব করেও যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তাই তাঁর হৃদয়ে সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে আবারও জীবন-মরণের যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। নিজের টঙ্গীর বাটা সু কোম্পানির অভ্যন্তরে এবং আরও কিছু গোপনীয় জায়গায় ২নং সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনায় গেরিলা শাখার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ একের পর এক আক্রমণে সফলতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বিজয়ের পথে এগিয়ে চলে। পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দালালরা ত্রিশ লাখ বীর শহীদের রক্ত নিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। হিংস্র নরঘাতকরা মা-বোনের সম্ভ্রমও লুণ্ঠন করে। তাতে এক মুহূর্তের জন্যও যুদ্ধ থেমে থাকে না। অবশেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়াম এএস ওডারল্যান্ডের বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে সরকার 'বীরপ্রতীক' রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করে। এই বীর যোদ্ধা মৃত্যুকালে স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাসহ স্বজনদের তাঁর আদর্শ অনুকরণ-অনুসরণের শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
অপরদিকে ভারতের গুজরাট রাজ্যের রাজধানী আহমেদাবাদবাসী একাত্তরে আহমেদাবাদের মেয়র ড. রাম ভিক্টর মোদীর সাহসী সন্তান যতীন মোদী মুক্তিপাগল বাংলাদেশী বাঙালীদের হৃদয়ে লালিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষার অংশীদার হয়ে ওঠেন। মানসিকভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটা বাংলাদেশের বাঙালীদের মুক্তি অর্জনের, স্বাধীনতা অর্জনের। তাই তিনি প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে পারতেন না বটে। তবে তাঁর মনের আকাঙ্ক্ষা, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও অস্ত্র কিনতে প্রয়োজন অর্থ, খাদ্য, ওষুধ ও বস্ত্রের যোগান দেই তাহলেও তো আমার (ড. যতীন মোদী) কাঙিক্ষত মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলাম। স্বাধীনতাকামী ভারতীয় জাতির একজন হিসেবে স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের বাঙালীদের সাথে অংশ নেয়া তো কর্তব্য।
সত্যিই তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা ও কর্তব্যবোধ গুজরাটের রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভাপতি ড. যতীন মোদী তাঁর নেতৃত্বে 'হেলপ বাংলাদেশ' ব্যানার নিয়ে সহযোগীদের অংশগ্রহণে নিজ হাতে অর্থ সাহায্যের ঝুলি নিয়ে রাজপথে নামেন। সর্বস্তরের মানুষ ড. যতীনের উদ্যোগকে স্বাগত জানান, অভিনন্দিত করেন। যাঁর পক্ষে যা সম্ভব মুক্ত হস্তে তা ড. যতীনদের ঝুলিতে দেন। সে অর্থ, সেসব সামগ্রী ভারতীয় সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেই ড. যতীন মোদী হয়েছেন তাঁর কাঙিক্ষত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা ড. যতীন মোদীর এই মহতী উদ্যোগ আহমেদাবাদ বা গুজরাটেই শুধু নয়, দ্রুত ছড়িয়ে যায় বিশাল ভারতের সর্বত্র। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখেছি, বিশেষত সীমান্তবর্তী ভারতীয় অঞ্চলের বীর জনগণ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে আশ্রয় দিয়েছেন পাকিস্তানী হানাদারদের হিংস্র ছোবল থেকে রক্ষায় উদ্বাস্তু ও নিঃস্ব হয়ে যাঁরা ভারতে গিয়েছিলেন তাঁদের। গোটা ভারতের বীর জনগণের আন্তরিক সমর্থনে ভারতীয় সরকার দ্রুত এগিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় যুদ্ধে অংশ নেয়। সব মিলে বাংলাদেশের শাহাদাতবরণকারী ত্রিশ লাখ বীর শহীদের সাথে ভারতীয় বাহিনীর যাঁরা আত্মবলিদান করেছেন তাঁদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ভারতীয় বীর জনগণের ত্যাগের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে বিজয়ের এই দেশের একজন সন্তান হিসেবে আবারও বলছি, বীর মুক্তিযোদ্ধা উইলিয়াম এএস ওডারল্যান্ড বীরপ্রতীক ও মুক্তিযোদ্ধা ড. যতীন মোদি লও সালাম।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
No comments