তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের পরীক্ষা by মুন্সেফ মারজুকি
মার্কিন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা আলভিন টোফলার বলতেন, যখন একটি সমাজ উন্নয়নের নির্দিষ্ট পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে তখন গণতন্ত্র কেবল নৈতিক নয়,কৌশলগত প্রয়োজনে পরিণত হয়।
এই নিয়মবিধি আরব বিশ্বে প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন করা যায়নি। উপনিবেশবাদের
কারণে শিল্পায়ন ব্যর্থ হয় এবং আধুনিকায়নের উন্মেষ ঘটে। গণতন্ত্রের
ঢেউয়ে ল্যাটিন আমেরিকা এবং পূর্ব ইউরোপে স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে। মনে
হয়, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বর্ণবাদীরা
সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে এ ঘটনার জন্য ভুল কারণকে চিহ্নিত
করে থাকেন।
প্রধানত, বাইরের প্রভাবের কারণে এই বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। সর্বোপরি, ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলের দ্বন্দ্ব এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন দেয়ার কারণে এই বাধার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে এই সরকারগুলো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এবং তেলের প্রাপ্তির সুযোগ প্রদানের শর্তে পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষার ম্যান্ডেট পায়। এসব প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আরবের সমাজগুলো গত ৫০ বছরে আরো বেশি জটিল হয়ে গেছে। এমনকি পশ্চিমারা স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন দেয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্রের পথের সব বাধা দূর হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে সারা আরববিশ্বে বিভিন্ন আকারে এবং বিভিন্ন গতিতে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া চলছে। ক্ষমতা দখলের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সিরিয়ায় দুঃখজনকভাবে জীবন উৎসর্গ করে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া চলছে। তিউনিসিয়া ও মিসরে বাইরের সামান্য সহায়তায় এবং লিবিয়ায় সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া চলছে।
অবশ্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন পথে হলেও আগামী ১০ বছরের মধ্যে আরবের সব স্বৈরশাসকের পতন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয়ে আরবের সমাজগুলো অস্থিতিশীল পর্যায়ে গিয়ে পড়বে এবং তখন সমাজে হিংস্রতা ও সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাবে।
বহু বছর ধরে এ ধরনের অবস্থান অব্যাহত থাকবে। কয়েকটি দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেসব দেশে অন্য ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকার ফিরে আসতে পারে। অন্য দেশগুলোতে গণতন্ত্র অগ্রসর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে। ওই সব দেশকে অবশ্যই দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আসতে হবে। তাদের বর্তমান আরব সমাজের দুটো উপাদানের মধ্যে প্রথমত মীমাংসা ও সমঝোতার রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে এবং তা মেনে চলতে হবে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রক্ষণশীল এবং সেকুলার। এখন প্রধানত ইসলামপন্থীদের ‘রক্ষণশীল’ বলা হয়ে থাকে। আর সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিরাট অংশই হচ্ছে পশ্চিমাপন্থী, আধুনিক।
বর্তমানে গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজেদের সেকুলার ও আধুনিক হিসেবে উপস্থাপন করছে। সেকুলাররা হচ্ছেÑ তাদের ভাষায় লিবারেল বা উদারপন্থী, সাবেক সোস্যালিস্ট বা সমাজতন্ত্রী, সাবেক জাতীয়তাবাদী এবং প্যান-আরব জাতীয়তাবাদী।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক। এটা হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান ও সংগ্রামের ভিত্তিতে এমন একটি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা, যা অবশ্যই সংহতিভিত্তিক এবং চরম মুক্তবাজারের উদার মডেল হবে না। যা থেকে কেবল পশ্চিমাপন্থী এলিটরা সুবিধা পাবে বা উপকৃত হবে। এই দুটি চ্যালেঞ্জ জয়ের জন্য বর্তমানে তিউনিসিয়া হচ্ছে আরব বসন্তের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম। অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে যেকোনো দেশ আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে থাকে। তিউনিসিয়ার জনগণ ইতোমধ্যেই একটি সরকার গঠন করেছে। তারা মডারেট সেকুলার এবং মডারেট ইসলামপন্থীদের সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশটিতে ব্যাপক সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে।
তিউনিসিয়ার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা খুবই কঠিন। কারণ দেশটির জনগণের কম সুবিধাপ্রাপ্ত অংশের আশাবাদ অত্যন্ত উচ্চÑ কিন্তু তাদের সম্পদ সীমিত। যত তাড়াতাড়ি ভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান আইনে পরিণত এবং চলতি বছরের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিউনিসিয়া এই দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।
তিউনিসিয়ায় শিক্ষিত জনশক্তি, মানবসম্পদ (গুণগত এবং শ্রমশক্তির প্রাপ্যতার ভিত্তিতে) বহু আঞ্চলিক উদ্যোক্তাÑ যারা বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সহায়তা ও বন্ধুত্বের মতো অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। দেশটি তেমন কোনো শত্রু নেই বাইরের এবং সেখানে সত্যিকার অর্থে সালাফিপন্থীদেরও ব্যাপক উপস্থিতি নেই, যেটা এখন হয়তো দেশটির স্থিতিশীলতার বদলে ভাবমর্যাদার জন্য ক্ষতিকর হতো। তিউনিসিয়া হচ্ছে গণতন্ত্রের জন্য একটি সত্যিকারের পরীক্ষাগার। তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের পরীক্ষা সফল হলে গোটা আরব বিশ্বে এর একটা অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমানে তিউনিসিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ ‘আমাদের মাত্র দু’টি সুযোগ রয়েছেÑ সফল হতে হবে অথবা সাফল্য লাভ করতে হবে।
লেখকঃ তিউনিসিয়া প্রজাতন্ত্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। সাবেক স্বৈরশাসক জেইন আল আবেদিন বেন আলির সরকারের সময়ের একজন ভিন্নমতাবলম্বী।
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
প্রধানত, বাইরের প্রভাবের কারণে এই বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। সর্বোপরি, ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলের দ্বন্দ্ব এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন দেয়ার কারণে এই বাধার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে এই সরকারগুলো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এবং তেলের প্রাপ্তির সুযোগ প্রদানের শর্তে পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষার ম্যান্ডেট পায়। এসব প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আরবের সমাজগুলো গত ৫০ বছরে আরো বেশি জটিল হয়ে গেছে। এমনকি পশ্চিমারা স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন দেয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্রের পথের সব বাধা দূর হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে সারা আরববিশ্বে বিভিন্ন আকারে এবং বিভিন্ন গতিতে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া চলছে। ক্ষমতা দখলের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সিরিয়ায় দুঃখজনকভাবে জীবন উৎসর্গ করে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া চলছে। তিউনিসিয়া ও মিসরে বাইরের সামান্য সহায়তায় এবং লিবিয়ায় সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া চলছে।
অবশ্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন পথে হলেও আগামী ১০ বছরের মধ্যে আরবের সব স্বৈরশাসকের পতন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয়ে আরবের সমাজগুলো অস্থিতিশীল পর্যায়ে গিয়ে পড়বে এবং তখন সমাজে হিংস্রতা ও সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাবে।
বহু বছর ধরে এ ধরনের অবস্থান অব্যাহত থাকবে। কয়েকটি দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেসব দেশে অন্য ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকার ফিরে আসতে পারে। অন্য দেশগুলোতে গণতন্ত্র অগ্রসর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে। ওই সব দেশকে অবশ্যই দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আসতে হবে। তাদের বর্তমান আরব সমাজের দুটো উপাদানের মধ্যে প্রথমত মীমাংসা ও সমঝোতার রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে এবং তা মেনে চলতে হবে। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রক্ষণশীল এবং সেকুলার। এখন প্রধানত ইসলামপন্থীদের ‘রক্ষণশীল’ বলা হয়ে থাকে। আর সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিরাট অংশই হচ্ছে পশ্চিমাপন্থী, আধুনিক।
বর্তমানে গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজেদের সেকুলার ও আধুনিক হিসেবে উপস্থাপন করছে। সেকুলাররা হচ্ছেÑ তাদের ভাষায় লিবারেল বা উদারপন্থী, সাবেক সোস্যালিস্ট বা সমাজতন্ত্রী, সাবেক জাতীয়তাবাদী এবং প্যান-আরব জাতীয়তাবাদী।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক। এটা হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান ও সংগ্রামের ভিত্তিতে এমন একটি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা, যা অবশ্যই সংহতিভিত্তিক এবং চরম মুক্তবাজারের উদার মডেল হবে না। যা থেকে কেবল পশ্চিমাপন্থী এলিটরা সুবিধা পাবে বা উপকৃত হবে। এই দুটি চ্যালেঞ্জ জয়ের জন্য বর্তমানে তিউনিসিয়া হচ্ছে আরব বসন্তের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম। অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে যেকোনো দেশ আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে থাকে। তিউনিসিয়ার জনগণ ইতোমধ্যেই একটি সরকার গঠন করেছে। তারা মডারেট সেকুলার এবং মডারেট ইসলামপন্থীদের সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশটিতে ব্যাপক সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে।
তিউনিসিয়ার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা খুবই কঠিন। কারণ দেশটির জনগণের কম সুবিধাপ্রাপ্ত অংশের আশাবাদ অত্যন্ত উচ্চÑ কিন্তু তাদের সম্পদ সীমিত। যত তাড়াতাড়ি ভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান আইনে পরিণত এবং চলতি বছরের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিউনিসিয়া এই দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।
তিউনিসিয়ায় শিক্ষিত জনশক্তি, মানবসম্পদ (গুণগত এবং শ্রমশক্তির প্রাপ্যতার ভিত্তিতে) বহু আঞ্চলিক উদ্যোক্তাÑ যারা বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সহায়তা ও বন্ধুত্বের মতো অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। দেশটি তেমন কোনো শত্রু নেই বাইরের এবং সেখানে সত্যিকার অর্থে সালাফিপন্থীদেরও ব্যাপক উপস্থিতি নেই, যেটা এখন হয়তো দেশটির স্থিতিশীলতার বদলে ভাবমর্যাদার জন্য ক্ষতিকর হতো। তিউনিসিয়া হচ্ছে গণতন্ত্রের জন্য একটি সত্যিকারের পরীক্ষাগার। তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের পরীক্ষা সফল হলে গোটা আরব বিশ্বে এর একটা অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমানে তিউনিসিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ ‘আমাদের মাত্র দু’টি সুযোগ রয়েছেÑ সফল হতে হবে অথবা সাফল্য লাভ করতে হবে।
লেখকঃ তিউনিসিয়া প্রজাতন্ত্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। সাবেক স্বৈরশাসক জেইন আল আবেদিন বেন আলির সরকারের সময়ের একজন ভিন্নমতাবলম্বী।
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
No comments