চারদিক-দুঃসময়ে এক দুর্গম মরুর কান্ডারি by বিপ্লব বালা

এক কি দুই দশক আগেও ছিল জেলা শহরে শহরে সংস্কৃতির একেক দুর্গ। কবিতা-আবৃত্তি-গান-নাটকের নানা দল। আবার তারা সবাই মিলে হয় জোট, ফেডারেশন, সমন্বয় পরিষদ। আশির দশকে তার সর্বোচ্চ প্রকাশ-বিকাশ ঘটে। নব্বইয়ের দশক থেকেই শুরু হয় তার নিম্নগতি। দলীয় সরকারের সুযোগ-সুবিধার মৌচাকে নেতৃস্থানীয়দের চাটাচাটি।


আবার মাঝেমধ্যে নামকাওয়াস্তে সংস্কৃতিচর্চা, আন্দোলন। তবে আগের সেই চারিত্র আর ফেরে না। অথচ বায়ান্ন থেকেই তো সংস্কৃতির নানা কাজেই হয় বাংলাদেশের গোড়াপত্তন। যাতে কিনা চাষ হয় মনের জমিনে। তার ওপরই তো ফসল ফলায় রাজনীতি। চিরকাল এই তো হয়। তবে বাংলাদেশে চলে যেন একফসলি জমির পত্তন, ফলন আর তারপরে আবার পড়ে থাকে যেন এক বিরানভূমি।
আবারও একদিন সময় আসে। নতুন করে চাষাবাদে হাত লাগায়। তাতে করে স্থায়ী কোনো ধারাপাত যেন তার ঘটে না। স্বাধীনতার পরে এক নাটক ছাড়া সংস্কৃতিশিল্পের আর কিছু তেমন বেগ পায় না। বাঙালি তো এক নাটুকে জাতি। জোরেশোরে নতুন নাটকের পত্তন ঘটায় সে নতুন দেশ নতুন সমাজ গড়ার দিবাস্বপ্নে। আর সেই সুযোগেও আসে যেন পঁচাত্তর। এত দিনের যত স্বপ্ন-সাধ-অর্জন লন্ডভন্ড সব।
ঊনসত্তরে আন্দোলনের সময়ই ফরিদপুরে গড়ে ওঠে ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থা। ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রাজ্জাক, আহম্মদ আলী মুন্সী, আ ন ম আবদুস সোবহান, আজম আমীর আলী, এম এ সামাদ প্রমুখ প্রধান উদেযাগী। আরও নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে শহরজুড়ে জাগিয়ে রাখেন তাঁরা বাংলা কবিতা গানের আসর। রাজনীতির কৃতার্থ দোহারকি যেন ধরেন তাঁরা। কত যে কবিতা-ছড়া লেখা আর পড়া হয়। গণসংগীতের জোয়ার জাগে। অথচ স্বাধীনতার পরে সেসব হয়ে দাঁড়ায় অভ্যস্ত প্রথানুগ দিবস পালন মাত্র। সবার মন যে তখন উড়ু উড়ু। কোথায় যে কে ঘুরে বেড়ায় লাভের গুড়ের কোন আশে কে জানে। চলছে তখন একদিকে এহেন চাটার গোষ্ঠীর রমরমা আর অন্যদিকে পরাজিত শেয়ালের নানা দলে ঢুকে যত ফন্দি-ফিকিরের তাল। সবাই মিলেই তারা ঘটায় যেন পঁচাত্তর। নইলে সাধ্য কী জনা কয়েক খুনির! এ বুঝি সত্যিই আমাদের সমবেত জাতীয় পাপাচরণ—‘এ আমার এ তোমার পাপ।’
তার পরে ঘটে সে উলটপুরাণ। গর্ত থেকে উঠে আসে পলাতক যত শেয়াল-শকুন আর নেকড়ের পাল। একই সঙ্গে গর্তে ঢোকে, পোড়া মুখ লুকায়, থোতা মুখ ভোঁতা যত গোহারা হারুয়া বাঙালি পুঙ্গব—তারাই নাকি একদিন স্বাধীন করেছিল দেশ!
এহেন মুখ থুবড়ে পড়া দুঃসময়ে ফরিদপুরে দেখা মেলে এক গোঁয়ার গোবিন্দের। বেসরকারি কলেজশিক্ষক মুহম্মদ আজিজুল হক খান। ১৯৭৭ সালে ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থায় নানামতের নেতৃত্ব সরিয়ে নবীন একদল যুবা তাঁরই হাতে পরায় রাখি। আর তাঁর হাতে হাত রেখে শুরু হয় সন্ধান জিয়নকাঠির। হাল ধরেন তিনি ফরিদপুরে—বাংলা ও বাঙালির প্রাণভোমরার পুনরুজ্জীবনের, কঠিন প্রাণপণ ব্রতে। বাংলা কি বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে আনে, তখন এমন বুকের পাটা নেই তো কোনো মর্দেরই। তখন আমাদের এই গোঁয়ার গোবিন্দই বাঙালের রোখে সভাপতিত্ব করে চলে বঙ্গবন্ধু নামকীর্তনের যত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সভায়। ১৯৭৫ সালেই প্রবর্তন করা হয় ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’; যার মর্যাদা দাঁড়ায়, বলতে গেলে বাংলা একাডেমী পুরস্কারের পরেই। সেই উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলন যেন সোনারকাঠির ছোঁয়ায় প্রাণ ফেরায় মুমূর্ষু নগর-সংস্কৃতির। তারপর একদিন হবুচন্দ্র রাজা এরশাদ বঙ্গভূমির নামে ফরিদপুরেও দাঙ্গা বাধাতে চাইলে পথে নামে সংস্থা ‘জাগো বাঙালি আবার জাগো, দাঁড়াও রুখিয়া’। ঢাকা থেকে ওয়াহিদুল হক আসেন এক প্রতিবাদ সভায়। আর এক সেমিনারে আসেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। যুক্তি-বিদ্রূপের তীক্ষ শরে তাঁরা স্বৈরাচারীর ভণ্ডামি প্রকাশ্য করে তোলেন। সেসব সভার সভাপতি দাড়িমুখের ঠোঁটকাটা এই বাঙালি মর্দই। সেই উতুঙ্গ সময়ে ফরিদপুরের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতির দায়িত্বও বর্তায় তাঁর কাঁধে। রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতির পদেও নিযুক্ত হন তিনি। সংস্থাকে কেন্দ্র করে চালিত হয় এসব সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থা সংস্কৃতির দুর্ভেদ্য এক দুর্গ, কেল্লা হয়ে ওঠে।
আর দেশের ভাগ্য যতই ফেরে, ততই যেন নিভে আসে জ্বলন্ত সে অগ্নিশিখা। তারপর একদিন ক্ষমতার ছলে বলে তাঁকেই করা হয় সংস্থাছাড়া। নিন্দা-কুত্সার বান ডাকে। সংগত অতিমানেই বুঝি তিনিও হারিয়ে ফেলেন আগ্রহ। আর তার ফল কী ফলে? কী দশা আজ হয় ক্রমে সংস্থার?
ঢাকার বারডেম হাসপাতালে কঠিন রোগশয্যায় শায়িত আজ ফরিদপুরের একদা সংস্কৃতি-অধিনায়ক মুহম্মদ আজিজুল হক খান। তাঁকে প্রাপ্য কোনো সম্মাননায় বরণ করার মুখও যেন নেই আজ কোনো প্রতিষ্ঠানের। জীবন্মৃত নাকি আধমরা সারা দেশের তাবৎ সংগঠন আজ। তবুও একদিন ফিরবে নাকি চেতন-হুঁশ, সংবিৎ ফিরে পাবে যেদিন জাতি, সেদিন তাঁর মতো যত কান্ডারি নায়কগণে ডেকে ডেকে সে বরণ করবে নতমস্তক দুর্মর মানব মর্যাদায়।
তবু মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ—আমরা রাবীন্দ্রিক যে।

No comments

Powered by Blogger.