গন্তব্য ঢাকা-‘গ্রামে চলে যেতে খুব মন টানছে’ by শর্মিলা সিনড্রেলা
মেলায় বেড়াতে যাওয়া বা যাত্রা দেখে রাতে ঘরে ফেরার আনন্দই অন্য রকম। ভরা পুকুরে দিনরাত লাফালাফি-ঝাঁপিঝাঁপি করার সুখ হূদয় ছোঁয়া। মা হালিমা বেগম ও বাবা আলাউদ্দিন মল্লিকের বড় ছেলে শরাফ মল্লিকের দিন ভালোই কাটছিল।
‘কিন্তু পাশ দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীটা একবার উন্মাদ হয়ে উঠল। হঠাৎ নদীর পাড় ভেঙে যেতে লাগল।’ অগত্যা গ্রাম ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু করল নদীর গর্ভে। কী আর করা। নদীর অতলে বিলীন হয়ে যাওয়ার আগেই তাঁদের পরিবার চলে এল ঢাকায়। সে আজ ৫০ বছর আগের কথা।
বয়স তখন শরাফ মল্লিকের ১২ কি ১৩ বছর। গ্রামে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তাঁদের ছিল না। কিন্তু তার পরও মন মেতে থাকত সদানন্দে। শরীয়তপুরের জাজিরার সেনেরচর মল্লিকান্দি তাঁদের গ্রাম। শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ। তাই ‘মল্লিকান্দি খুব ভালো লাগত’ শরাফ মল্লিকের। জন্ম থেকেই বাবার পায়ের সমস্যা ছিল। কোনো কাজ করতে পারতেন না তিনি। শরাফ মল্লিক থেমে থেমে বলছিলেন, ‘পরিবারের কাছে বাবা ছিলেন অভিশাপস্বরূপ। জায়গা-জমি কম ছিল। আর যা ছিল সেটুকুও বিভিন্ন সময় একটু একটু করে কারও কাছে বন্ধক রেখে টাকা ধার নিতেন বাবা।’ কিন্তু সেই টাকা শোধ করে জমি আর ফিরিয়ে নেওয়া হতো না তাঁর। তবুও স্বপ্ন ছিল পরিবারের সবার, বিপদ কেটে যাবে। সুখ-শান্তির দেখা মিলবে। কিন্তু সেই যে ‘সর্বনাশা পদ্মা তছনছ করে দিল সব স্বপ্ন।’
ঢাকায় যখন আসেন, তখন শরাফ মল্লিকেরা দুই ভাই। তাঁদের একমাত্র বোন প্রমতি। পরে ঢাকায় এসে বাবা-মায়ের পরিবারে এসেছে আরও দুই ভাই। অভাবের সংসারে তত দিনে কষ্ট আরও বেড়েছে।
‘নিজে যখন একটু সেয়ানা (যুবক) হয়েছি, তখন বুঝতে পারলাম মা-বাবার কষ্ট। ছোটবেলা থেকে নানা ধরনের কাজ করেছি। অনেক রকমের কাজই তো করেছি। কখনো কুলিগিরি করেছি। কারখানায় কাজ করেছি। আবার রিকশাও চালিয়েছি, রিকশার মিস্ত্রির কাজও করেছি। তখন রিকশা কিনেছিলাম তিনটা। তার মধ্যে দুইটা চুরি হয়ে যায়। ছোট ভাইয়ের বউ মোর্শেদার পরামর্শে হুটকির (শুঁটকি) ব্যবসা শুরু করলাম।’
আপন সংসারে শরাফ মল্লিকের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বন্ধক রাখা এবং নদীতে ভেসে যাওয়ার পরও তাঁদের কিছুটা জমি ছিল। ‘ছোট ছেলেটাকে বাহরাইনে পাঠাতে সেটুকুও বিক্রি করে ফেলেছি।’ এক ছেলে দর্জির দোকান, আরেকজন বাচ্চাদের বিছানা বানানোর কারখানায় কাজ করে। মেয়েটি সবার ছোট। মেয়েকে নিয়ে শরাফ মল্লিক বলছিলেন, ‘ও এবার এইচএসসি পাস করল। মেয়ের তো ইচ্ছা ভার্সিটিতে পড়ার। জানি না সে স্বপ্ন তাঁর পূরণ হবে কি না। সে সামর্থ্যও তো আমার নেই। আমি নিজে পড়ালেখা জানি না। ছোট ভাই নুরুলকে মাস্টার রেখে রেখে বর্ণ পরিচয় শিখিয়েছি। আমার ছেলেরা তো কেউই বেশি পড়াশোনা করেনি। এখন মেয়েটা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, তবেই আমি অনেক খুশি।’
আজিমপুরে ছাপরা মসজিদ। মসজিদের সামনের রাস্তায় সকাল সাতটা থেকে বেলা দেড়টা, আবার আসরের নামাজের পর থেকে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত শুঁটকি নিয়ে বসে থাকেন শরাফ মল্লিক। দিন শেষে দেখা যায় লাভ হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। ‘১৯৭৩-এর শেষ দিকে আমার বিয়ে হয়। জাজিরার ফিরোজার সাথে।’ শরাফ মল্লিকের কণ্ঠে কিছুটা কষ্টের সুর, ‘সাত মাস হলো সবাইকে ফেলে চিরতরে চলে গেছে ও (ফিরোজা বেগম)।’ ছেলেরা এখন আর কেউই তাঁর সঙ্গে থাকে না। সবাই আপন আপন কাজে ব্যস্ত। আর শরাফ মল্লিক থাকেন মেয়েকে নিয়ে।
বয়সের ঘর থেকে কেটে গেছে ষাটেরও বেশি বছর। গ্রামের স্মৃতিগুলো আজও শরাফ মল্লিকের প্রায় মনে পড়ে, ‘যদি ফিরোজা বেঁচে থাকত, তবে আর থাকতাম না ঢাকায়। দুজনে চলে যেতাম গ্রামে।’ জীবনের শেষ বিকেলে এসে এভাবে একা হয়ে যাওয়ার কষ্টটা সত্যিই সীমাহীন। বৃদ্ধ শরাফ মল্লিকের স্বপ্ন, ‘এখন শুধু মেয়েটাকে নিয়েই চিন্তা করি। ওকে যদি একটা ভালো কারও হাতে তুলে দিতে পারতাম। গ্রামে চলে যেতে খুব মন টানছে, কিন্তু একা একা সেখানে কীভাবে থাকব?’
No comments