রাজনীতি-সংলাপ হচ্ছে, সংলাপ হচ্ছে না! by মাহমুদুর রহমান মান্না
দিন দশেক আগে এক ব্যবসায়ী নেতার বাড়িতে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কথায় কথায় তিনি বললেন, এই কয়েক দিন আগেও যে মনে হচ্ছিল বিএনপি আসুক আর নাই আসুক আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবেই, তার পরিবর্তন হয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন বিএনপিকেও নির্বাচনে আনতে চায়।
আমি খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলাম। এবার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই বিএনপির ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কঠোর মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছিল। বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে উচ্ছেদ থেকে শুরু করে ৩৩ জন নেতার গ্রেপ্তার পর্যন্ত সেই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পাচ্ছিল। ইতিমধ্যে বেগম জিয়ার দুই পুত্রসন্তানের ব্যাপারেও কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে সরকার। আমি কিছু বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগে সেখানে উপস্থিত আরেকজন ব্যবসায়ী বললেন, এটা যদি হয় তাহলে ধরে নিতে হবে আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যাচ্ছে এবং সেটা মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন শেখ হাসিনা।
এই ব্যবসায়ীও আওয়ামী লীগ করেন। এবং তিনি একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সেগুলো দেখে তাঁর এই ধারণা হয়েছে যে মোটামুটি সৎ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ তাতে হেরে যাবে। আমি সেই বিতর্কের মধ্যে গেলাম না। একটু ঘুরিয়ে সেই প্রেসিডিয়াম সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বক্তব্য কতখানি নির্ভরযোগ্য। কতখানি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তা পাওয়া?
তিনি হাসলেন, বেশ প্রত্যয়ী হাসি। বললেন, আমাকে তো কেউ আর এভাবে বলেনি, অঙ্গভঙ্গি থেকে বুঝে নিয়েছি।
পাঠক, তত দিনে হিলারি-প্রণবসহ তিন নেতা বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। কথায় কথায় সে প্রসঙ্গ এসে গেল, আমাদের দেশে রাজনীতিতে, ক্ষমতার পরিবর্তনে এদের ভূমিকা কতটুকু? যেভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর ওখানে কিছু না খেয়ে একেবারে খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে এক ঘণ্টা ধরে গল্প করলেন এবং পাটিশাপটা খেলেন তা কি কোনো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে? এই যে সাড়ে তিন বছর ধরে সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেল তার কি কোনো মূল্য নেই মার্কিন প্রশাসনের কাছে? এক ইউনূস ইস্যুতে আমেরিকা কি তাদের আন্তর্জাতিক নীতি বদলে ফেলবে? আর ভারত সরকার বিশেষত কংগ্রেস আওয়ামী লীগের বন্ধু। তাদের বাদ দিয়ে মার্কিনিরা এখানে নতুন নীতি নেবে।
এসব কথাও আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু প্রেসিডিয়াম সদস্যের ওই একই কথা। আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করতে যাচ্ছে না। আমরা তিনজন তার কথায় একমত হইনি। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা একা একাই সে রকম নির্বাচন করে ফেলতে পারবেন এবং সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে সে রকম কথা বলিনি আমরা। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে কোনো নমনীয়তা দেখা যাবে সে রকম বিশ্বাস করতে পারিনি।
দুই.
এই লেখা শুরু করতে গিয়ে সেসব কথা মনে পড়ল। বিদেশি মেহমানরা বলেছিলেন দেশ গণতন্ত্রের পথে চলতে গেলে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের মধ্যে সংলাপ করতে হবে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই কথাবার্তা বলে নিষ্পত্তি করতে হবে। তখন দৃশ্যত কেউ গুরুত্ব দেয়নি সেসব কথায়। সরকারি দল তো দেশে যে কোনো রাজনৈতিক সংকট আছে তাই-ই মনে করে না। তবে কিসের কথা। তিন টার্ম আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া চলছিল না, তা তিন বছর আগে দানবে পরিণত হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই দানবকে হত্যা করা হয়েছে। এখন যে সরকার আছে তা নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়ে যাবে। সমস্যা কী? এই তিন বছরে এই সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে তা তো খুবই সুষ্ঠু হয়েছে। অতএব, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
এ রকমই যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ বলছিল, কথাবার্তা যদি কিছু বলার থাকে তাহলে সংসদে এসে বলুক বিএনপি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা নেই। ওটা মারা গেছে। বেশ ভাব নিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপি প্রতিবাদ করছিল, আন্দোলনের কর্মসূচি দিচ্ছিল, কয়েকটা হরতালও করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ পাত্তা দিচ্ছিল না। আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগ হলো আন্দোলনের গাছ, আর বিএনপি আন্দোলনের ডালপালা। ওরা আবার কী আন্দোলন করবে।
কিন্তু হালে আওয়ামী লীগের এই হাবভাবে একটু টান পড়েছে। খোদ সাধারণ সম্পাদক সংলাপের আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দিযেছেন, হয় সংলাপ, না হয় গৃহযুদ্ধ। দুই-একটি জাতীয় দৈনিক ঠিকই মন্তব্য করেছে আওয়ামী লীগে বরফ ভাঙতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য আগের মতোই বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। কিন্তু মানুষ ভাবছে, ওই সব বক্তৃতা করতে হয়। তাঁর অনুমতির বাইরে কি দলের সাধারণ সম্পাদক কথা বলেছেন?
মাত্র ১৫ দিন আগেও আমি এ রকম পরিস্থিতি ভাবিনি। কিন্তু এখন আমি ভাবছি, প্রেসিডিয়ামের সেই সদস্য ঠিক কথা বলেছিলেন। একটা কিছু হয়েছে জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে, যাতে কোনো দলের পক্ষে সংলাপকে অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপির তো সংলাপকে অস্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। কারণ, তাদের মাথায় ঢুকে গেছে যেকোনোভাবেই নির্বাচন হলে তারা জিতবে।
তিন.
তাহলে কি সংলাপ হবে? হলে কী হবে? আমাদের এই দেশে সংলাপের সাফল্যের ইতিহাস তো নেই। এ রকম সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আব্দুল জলিল-মান্নান ভূঁইয়ার সংলাপের ঘটনা তো সে দিনের। এবারও সংলাপ শুরুর আগে দল দুটি বাহানা কিন্তু ছাড়ছে না। আওয়ামী লীগ বলছে, সংলাপ হতে পারে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা নয়। বিএনপি বেশ ঠান্ডা খেলছে। বাজারে রটে ছিল সরকারের চাপ বিএনপি সহ্য করতে পারবে না, দলটি ভাঙবে। কিন্তু সেটা সত্যে পরিণত হয়নি। বিএনপি বরং বলছে তারা এ রকম পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় না, যাতে অন্য কেউ সুযোগ নিতে পারে। বেশ মজার ব্যাপার। সুযোগ পেলে এরা কেউ-ই ভালোমানুষি দেখাতে ছাড়ে না। কিন্তু বাস্তবে তারা কতখানি ভালো মানুষ তা নিয়ে মানুষের সন্দেহ রয়েই গেছে। আমি কেবল বলছিলাম, বিএনপি আওয়ামী লীগের ওই বাহানার জবাব দিয়েছে বেশ বুদ্ধি করে। তারা বলেছে যে নামেই ডাকা হোক তাদের আপত্তি নেই। কেবল একটি শর্ত, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারবে না।
একভাবে বলা যায়, সংলাপ শুরু হয়ে গেছে এবং তা বেশ খানিকটা অগ্রগতিও লাভ করেছে। আওয়ামী মহল থেকে কথা হয়েছে অনির্বাচিত সরকার থাকতে পারবে না। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছে, উভয় জোট থেকে সমানসংখ্যক সংসদ সদস্য নিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যায় কি না। প্রশ্ন হলো সেই সংসদ সদস্যরাই কি তখন নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন। একবার নির্বাচিত হলে তো আজীবনের জন্য নির্বাচিত হয়ে যান না। অতএব, এমপিদের রাখলেই সেটি নির্বাচিত সরকার হয়ে গেল এ রকম কোনো কথা নয়।
আমি বলছি না আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু হয়েছে। কিন্তু এ কথা সত্যি, সমাজের মধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গত সংলাপে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি আব্দুল জলিলও বলেছেন আওয়ামী লীগের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যাবে। তাঁর মানে কী দাঁড়াচ্ছে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বড় বড় নেতা বর্তমান পরিস্থিতি ও সমাধান নিয়ে কথাবার্তা বলছেন, তাঁদের মত প্রকাশ করছেন। মূল দুই নেত্রীও কথা বলছেন। তার মানে সংলাপ চলছে। কিন্তু একটি জাতীয় দৈনিক ভালো শিরোনাম করেছে, ‘সংলাপ মুখেই, উদ্যোগ নেই’।
চার.
এ কথা বলা যায় যে সংলাপ চলছে এবং মূল দুই নেত্রী সেই সংলাপে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিক নয়। আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরুর আগে প্রস্তুতি চলছে। এই কয় দিন আগে অনুষ্ঠিত জব্বারের বলী খেলা অনুষ্ঠিত হলো। বলীদের একজন আরেকজনকে আক্রমণের আগে চারদিকে হেঁটে বেড়ায়, উরু থাবড়ায়, হাঁকডাক মারে। সংলাপও অনেকটা সে রকম। উভয় পক্ষ যখন মনে করবে যে জেতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তখন খেলাটা শুরু হবে।
ইতিমধ্যে দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান এবং বিএনপির ৩৩ জন নেতার গ্রেপ্তার নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা অবশ্যই উদ্বেগজনক ছিল। রাত ১২টায় শিক্ষার্থীদের এ-লেভেল পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছে, শুক্রবার ছুটির দিনে স্কুল খোলা রাখতে হয়েছিল। এ পরিস্থিতি জনগণকে উদ্বিগ্ন করবেই। কী কারণে জানি না, বিএনপি আপাতত আন্দোলনে ক্ষ্যামা দিয়েছে। কিন্তু তারা এ ঘোষণাও দিয়েছে যে পূর্বঘোষিত আলটিমেটাম অনুযায়ী, ১০ জুনের মধ্যে সরকারপক্ষ কার্যকর উদ্যোগ না নিলে তারা আবার আন্দোলন শুরু করবে।
সাংবাদিক, সমাজকর্মী, নাগরিকদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে বেশি। আমি বলেছি এ উদ্বেগ স্বাভাবিক। কিন্তু আমি এও বলছি, এই উদ্বেগের কারণে দুই নেত্রী তড়িঘড়ি করে সংলাপে বসবেন না। এর চেয়ে বেশি উদ্বেগ জনগণ, বিশেষ করে অভিভাবকের চোখেমুখে আমি সম্প্রতি দেখেছি। এই উদ্বেগের ছাপ যে দুই নেত্রীর চোখেমুখেও পড়ে তা কখনো মনে হয়নি। যদি হতো তবে তাঁরা তো স্ব-উদ্যোগে একটা কিছু করতেন। নেতা জনগণকে নেতৃত্ব দেন, নাকি জনগণ নেতাকে পরিচালনা করেন? আমাদের দেশে তো সব কিছু উল্টা বইছে। আগে রাজনৈতিক দলের মধ্যে কর্মীরা ছিল দলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান সম্পদ। এখন কর্মীরা সব কামলা হয়ে গেছে। নেতা খুশি না থাকলে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। দ্বিদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা ছিল নিজেদের কাজে-গুণে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জনের প্রতিযোগিতা। এখন নেতা আগে দলকে জয় করেন, দলের ওপর তাঁর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং অতপর জনগণের ওপর খবরদারি করেন। আগে প্রতিযোগিতা ছিল ওই দলের চেয়ে আমার দল কত ভালো, আর এখন জনগণকে ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমাদের চেয়ে ওরা কত খারাপ। এ জন্যই জনগণের তোয়াক্কা করার আর কোনো দরকার পড়ছে না।
কেউ কেউ আছেন যাঁরা মনে করেন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসাতে হবে। তাঁরা ভুলের স্বর্গে বাস করেন। এখন বরং কাজ হলো জনগণকে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝানো। তাদের সংঘবদ্ধ করা। জনগণের পক্ষ থেকে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। তাদের বলা, দেখো তোমরা দুটি দল আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু তোমাদের গণতান্ত্রিক হতে হবে। যুক্তি মানতে হবে, জেদ করলে চলবে না। আমরা তোমাদেরই সঙ্গে আছি। কিন্তু তোমরা যদি মনে করো, তোমরাই সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, তাহলে তোমরা ভুল করছ। আমরা অর্থাৎ জনগণই সব ক্ষমতার মালিক, আমাদের সঙ্গে চালাকি করে, আমাদের উপেক্ষা করে, অবজ্ঞা করে যদি আমাদের কষ্ট দিতে চাও, তাহলে আমরা আমাদের কথা ভাবব, তোমাদের কথা ভাবব না।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
এই ব্যবসায়ীও আওয়ামী লীগ করেন। এবং তিনি একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সেগুলো দেখে তাঁর এই ধারণা হয়েছে যে মোটামুটি সৎ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ তাতে হেরে যাবে। আমি সেই বিতর্কের মধ্যে গেলাম না। একটু ঘুরিয়ে সেই প্রেসিডিয়াম সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বক্তব্য কতখানি নির্ভরযোগ্য। কতখানি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তা পাওয়া?
তিনি হাসলেন, বেশ প্রত্যয়ী হাসি। বললেন, আমাকে তো কেউ আর এভাবে বলেনি, অঙ্গভঙ্গি থেকে বুঝে নিয়েছি।
পাঠক, তত দিনে হিলারি-প্রণবসহ তিন নেতা বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। কথায় কথায় সে প্রসঙ্গ এসে গেল, আমাদের দেশে রাজনীতিতে, ক্ষমতার পরিবর্তনে এদের ভূমিকা কতটুকু? যেভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর ওখানে কিছু না খেয়ে একেবারে খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে এক ঘণ্টা ধরে গল্প করলেন এবং পাটিশাপটা খেলেন তা কি কোনো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে? এই যে সাড়ে তিন বছর ধরে সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেল তার কি কোনো মূল্য নেই মার্কিন প্রশাসনের কাছে? এক ইউনূস ইস্যুতে আমেরিকা কি তাদের আন্তর্জাতিক নীতি বদলে ফেলবে? আর ভারত সরকার বিশেষত কংগ্রেস আওয়ামী লীগের বন্ধু। তাদের বাদ দিয়ে মার্কিনিরা এখানে নতুন নীতি নেবে।
এসব কথাও আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু প্রেসিডিয়াম সদস্যের ওই একই কথা। আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করতে যাচ্ছে না। আমরা তিনজন তার কথায় একমত হইনি। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা একা একাই সে রকম নির্বাচন করে ফেলতে পারবেন এবং সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে সে রকম কথা বলিনি আমরা। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে কোনো নমনীয়তা দেখা যাবে সে রকম বিশ্বাস করতে পারিনি।
দুই.
এই লেখা শুরু করতে গিয়ে সেসব কথা মনে পড়ল। বিদেশি মেহমানরা বলেছিলেন দেশ গণতন্ত্রের পথে চলতে গেলে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের মধ্যে সংলাপ করতে হবে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই কথাবার্তা বলে নিষ্পত্তি করতে হবে। তখন দৃশ্যত কেউ গুরুত্ব দেয়নি সেসব কথায়। সরকারি দল তো দেশে যে কোনো রাজনৈতিক সংকট আছে তাই-ই মনে করে না। তবে কিসের কথা। তিন টার্ম আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া চলছিল না, তা তিন বছর আগে দানবে পরিণত হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই দানবকে হত্যা করা হয়েছে। এখন যে সরকার আছে তা নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়ে যাবে। সমস্যা কী? এই তিন বছরে এই সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে তা তো খুবই সুষ্ঠু হয়েছে। অতএব, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
এ রকমই যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ বলছিল, কথাবার্তা যদি কিছু বলার থাকে তাহলে সংসদে এসে বলুক বিএনপি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা নেই। ওটা মারা গেছে। বেশ ভাব নিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপি প্রতিবাদ করছিল, আন্দোলনের কর্মসূচি দিচ্ছিল, কয়েকটা হরতালও করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ পাত্তা দিচ্ছিল না। আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগ হলো আন্দোলনের গাছ, আর বিএনপি আন্দোলনের ডালপালা। ওরা আবার কী আন্দোলন করবে।
কিন্তু হালে আওয়ামী লীগের এই হাবভাবে একটু টান পড়েছে। খোদ সাধারণ সম্পাদক সংলাপের আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দিযেছেন, হয় সংলাপ, না হয় গৃহযুদ্ধ। দুই-একটি জাতীয় দৈনিক ঠিকই মন্তব্য করেছে আওয়ামী লীগে বরফ ভাঙতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য আগের মতোই বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। কিন্তু মানুষ ভাবছে, ওই সব বক্তৃতা করতে হয়। তাঁর অনুমতির বাইরে কি দলের সাধারণ সম্পাদক কথা বলেছেন?
মাত্র ১৫ দিন আগেও আমি এ রকম পরিস্থিতি ভাবিনি। কিন্তু এখন আমি ভাবছি, প্রেসিডিয়ামের সেই সদস্য ঠিক কথা বলেছিলেন। একটা কিছু হয়েছে জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে, যাতে কোনো দলের পক্ষে সংলাপকে অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপির তো সংলাপকে অস্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। কারণ, তাদের মাথায় ঢুকে গেছে যেকোনোভাবেই নির্বাচন হলে তারা জিতবে।
তিন.
তাহলে কি সংলাপ হবে? হলে কী হবে? আমাদের এই দেশে সংলাপের সাফল্যের ইতিহাস তো নেই। এ রকম সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আব্দুল জলিল-মান্নান ভূঁইয়ার সংলাপের ঘটনা তো সে দিনের। এবারও সংলাপ শুরুর আগে দল দুটি বাহানা কিন্তু ছাড়ছে না। আওয়ামী লীগ বলছে, সংলাপ হতে পারে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা নয়। বিএনপি বেশ ঠান্ডা খেলছে। বাজারে রটে ছিল সরকারের চাপ বিএনপি সহ্য করতে পারবে না, দলটি ভাঙবে। কিন্তু সেটা সত্যে পরিণত হয়নি। বিএনপি বরং বলছে তারা এ রকম পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় না, যাতে অন্য কেউ সুযোগ নিতে পারে। বেশ মজার ব্যাপার। সুযোগ পেলে এরা কেউ-ই ভালোমানুষি দেখাতে ছাড়ে না। কিন্তু বাস্তবে তারা কতখানি ভালো মানুষ তা নিয়ে মানুষের সন্দেহ রয়েই গেছে। আমি কেবল বলছিলাম, বিএনপি আওয়ামী লীগের ওই বাহানার জবাব দিয়েছে বেশ বুদ্ধি করে। তারা বলেছে যে নামেই ডাকা হোক তাদের আপত্তি নেই। কেবল একটি শর্ত, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারবে না।
একভাবে বলা যায়, সংলাপ শুরু হয়ে গেছে এবং তা বেশ খানিকটা অগ্রগতিও লাভ করেছে। আওয়ামী মহল থেকে কথা হয়েছে অনির্বাচিত সরকার থাকতে পারবে না। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছে, উভয় জোট থেকে সমানসংখ্যক সংসদ সদস্য নিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যায় কি না। প্রশ্ন হলো সেই সংসদ সদস্যরাই কি তখন নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন। একবার নির্বাচিত হলে তো আজীবনের জন্য নির্বাচিত হয়ে যান না। অতএব, এমপিদের রাখলেই সেটি নির্বাচিত সরকার হয়ে গেল এ রকম কোনো কথা নয়।
আমি বলছি না আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু হয়েছে। কিন্তু এ কথা সত্যি, সমাজের মধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গত সংলাপে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি আব্দুল জলিলও বলেছেন আওয়ামী লীগের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে যাবে। তাঁর মানে কী দাঁড়াচ্ছে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বড় বড় নেতা বর্তমান পরিস্থিতি ও সমাধান নিয়ে কথাবার্তা বলছেন, তাঁদের মত প্রকাশ করছেন। মূল দুই নেত্রীও কথা বলছেন। তার মানে সংলাপ চলছে। কিন্তু একটি জাতীয় দৈনিক ভালো শিরোনাম করেছে, ‘সংলাপ মুখেই, উদ্যোগ নেই’।
চার.
এ কথা বলা যায় যে সংলাপ চলছে এবং মূল দুই নেত্রী সেই সংলাপে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিক নয়। আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরুর আগে প্রস্তুতি চলছে। এই কয় দিন আগে অনুষ্ঠিত জব্বারের বলী খেলা অনুষ্ঠিত হলো। বলীদের একজন আরেকজনকে আক্রমণের আগে চারদিকে হেঁটে বেড়ায়, উরু থাবড়ায়, হাঁকডাক মারে। সংলাপও অনেকটা সে রকম। উভয় পক্ষ যখন মনে করবে যে জেতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তখন খেলাটা শুরু হবে।
ইতিমধ্যে দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান এবং বিএনপির ৩৩ জন নেতার গ্রেপ্তার নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা অবশ্যই উদ্বেগজনক ছিল। রাত ১২টায় শিক্ষার্থীদের এ-লেভেল পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছে, শুক্রবার ছুটির দিনে স্কুল খোলা রাখতে হয়েছিল। এ পরিস্থিতি জনগণকে উদ্বিগ্ন করবেই। কী কারণে জানি না, বিএনপি আপাতত আন্দোলনে ক্ষ্যামা দিয়েছে। কিন্তু তারা এ ঘোষণাও দিয়েছে যে পূর্বঘোষিত আলটিমেটাম অনুযায়ী, ১০ জুনের মধ্যে সরকারপক্ষ কার্যকর উদ্যোগ না নিলে তারা আবার আন্দোলন শুরু করবে।
সাংবাদিক, সমাজকর্মী, নাগরিকদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে বেশি। আমি বলেছি এ উদ্বেগ স্বাভাবিক। কিন্তু আমি এও বলছি, এই উদ্বেগের কারণে দুই নেত্রী তড়িঘড়ি করে সংলাপে বসবেন না। এর চেয়ে বেশি উদ্বেগ জনগণ, বিশেষ করে অভিভাবকের চোখেমুখে আমি সম্প্রতি দেখেছি। এই উদ্বেগের ছাপ যে দুই নেত্রীর চোখেমুখেও পড়ে তা কখনো মনে হয়নি। যদি হতো তবে তাঁরা তো স্ব-উদ্যোগে একটা কিছু করতেন। নেতা জনগণকে নেতৃত্ব দেন, নাকি জনগণ নেতাকে পরিচালনা করেন? আমাদের দেশে তো সব কিছু উল্টা বইছে। আগে রাজনৈতিক দলের মধ্যে কর্মীরা ছিল দলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান সম্পদ। এখন কর্মীরা সব কামলা হয়ে গেছে। নেতা খুশি না থাকলে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। দ্বিদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা ছিল নিজেদের কাজে-গুণে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জনের প্রতিযোগিতা। এখন নেতা আগে দলকে জয় করেন, দলের ওপর তাঁর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং অতপর জনগণের ওপর খবরদারি করেন। আগে প্রতিযোগিতা ছিল ওই দলের চেয়ে আমার দল কত ভালো, আর এখন জনগণকে ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমাদের চেয়ে ওরা কত খারাপ। এ জন্যই জনগণের তোয়াক্কা করার আর কোনো দরকার পড়ছে না।
কেউ কেউ আছেন যাঁরা মনে করেন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসাতে হবে। তাঁরা ভুলের স্বর্গে বাস করেন। এখন বরং কাজ হলো জনগণকে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝানো। তাদের সংঘবদ্ধ করা। জনগণের পক্ষ থেকে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। তাদের বলা, দেখো তোমরা দুটি দল আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু তোমাদের গণতান্ত্রিক হতে হবে। যুক্তি মানতে হবে, জেদ করলে চলবে না। আমরা তোমাদেরই সঙ্গে আছি। কিন্তু তোমরা যদি মনে করো, তোমরাই সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, তাহলে তোমরা ভুল করছ। আমরা অর্থাৎ জনগণই সব ক্ষমতার মালিক, আমাদের সঙ্গে চালাকি করে, আমাদের উপেক্ষা করে, অবজ্ঞা করে যদি আমাদের কষ্ট দিতে চাও, তাহলে আমরা আমাদের কথা ভাবব, তোমাদের কথা ভাবব না।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
No comments