ধর্ম-মাহে রমজান প্রশিক্ষণ লাভের মাস by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজান হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও প্রশিক্ষণ লাভের মাস। পার্থিব জগতে শিক্ষকতাসহ দুনিয়ার সব কাজে যেমন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনে যেমন জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন আছে এবং কর্মক্ষেত্রে যেমন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা হয়, তেমনি মুসলিম জাতির প্রশিক্ষণের মাস পবিত্র রমজান।


পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় বান্দাদের বছরের পূর্ববর্তী ১১ মাসের কৃত দোষ-অপরাধ চিহ্নিত করে মার্জনা করার জন্য এবং ১১ মাস আল্লাহর নির্দেশিত বিধি-বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসনের ওপর ঈমানি শক্তি ও মনোবল নিয়ে অবিচল থাকার জন্য এ মহান মাস প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। কেননা দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ তাআলা চান না যে তাঁর প্রিয় বান্দারা গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে দোজখের কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হোক। তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ রমজান মাসে উপস্থিত (জীবিত) থাকে, তারই রোজা পালন করা কর্তব্য।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
প্রশিক্ষণকালে আত্মসংশোধন ও নতুন জ্ঞান অর্জনে একজন মানুষ যতটুকু সচেতন থাকে, অন্য সময় ততটুকু থাকে না। আই মানবজীবনে প্রশিক্ষণ লাভের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। রমজান মাস হলো নৈতিক অগ্রগতির প্রশিক্ষণের মাস। এ মাসে সিয়াম সাধনা হলো প্রশিক্ষণ কোর্স। সারা দিনের উপবাস প্রশিক্ষণ কোর্সের অতি ক্ষুদ্র অঙ্গ। কোনো প্রশিক্ষণ কোর্সে গেলে নিবন্ধন করতে হয়। সারা দিন না খেয়ে থাকাও তেমনি সিয়াম সাধনার নিবন্ধন। কোনো ব্যক্তি যদি প্রশিক্ষণ কোর্সেও নিবন্ধন করে আর কোনো কাজকর্ম না করে, তবে যেমন প্রশিক্ষণ থেকে কোনো উপকারই হয় না, তেমনি উপবাস করলেই রোজা পুরো হলো না। বরং উল্টো ফল হওয়ার আশঙ্কা আছে। আল্লাহ তাআলা বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভের জন্য মাহে রমজানকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করেছেন। প্রথম পর্ব হলো রহমত; অর্থাৎ যেসব মানুষ আগে থেকেই তওবা, ইস্তেগফার, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে মহৎ জীবন লাভ করে পুণ্যবান হতে সক্ষম হয়। রমজান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা যখন মহান আল্লাহর অন্যান্য ফরজ, ওয়াজিব আদায় করার পাশাপাশি রোজা, তারাবি ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে তখন তাদের ওপর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে করুণার ঝরনাধারা বর্ষিত হতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্ব হলো মাগফিরাত; অর্থাৎ যারা মাহে রমজান আসার আগে তওবা, ইস্তেগফার করে নিজেদের পাপ মোচন করতে সক্ষম হয়নি, তারাও যখন পবিত্র রমজানের মর্যাদা রক্ষাকল্পে যাবতীয় শরিয়ত-পরিপন্থী গর্হিত কাজকর্ম পরিহার এবং রমজানের প্রথম থেকে তওবার মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করে, রোজা রাখে, নামাজ আদায় করে, তখন দয়াময় আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি ক্ষমা-পরবশ হয়ে মাহে রমজানের দ্বিতীয়াংশে তার মাগফিরাত ঘোষণা করেন।
আর তৃতীয় পর্ব হলো নাজাত; অর্থাৎ যারা প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমেও ক্ষমা লাভ করতে পারেনি; এতদসত্ত্বেও তারা যখন নিরাশ না হয়ে আল্লাহ তাআলার ওপর পরিপূর্ণ ঈমানে অবিচল থেকে মাহে রমজানের শেষাংশ পর্যন্ত তওবা, ইস্তেগফার ও ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকে তখন মহান আল্লাহ গুনাহগারদের দোজখের প্রজ্বলিত অগ্নি ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে পরিত্রাণ করে দেন।
সিয়াম সাধনার মাহে রমজানের রোজা এমন মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য—এ ষড়রিপুর তাড়না অবদমিত করে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংযম, সহানুভূতি, সাম্য ও যাবতীয় সৎ মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে পারে। সিয়াম সাধনা বা রোজা আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র উন্নয়নের এক বিশেষ প্রক্রিয়া। যেকোনো মানবিক প্রক্রিয়ায় উন্নতি করতে হলে যথেষ্ট মানসিক কসরত করতে হয়। শরীরকে বেশি মজবুত করতে হলে ব্যায়াম করতে হয়। তেমনি চারিত্রিক উন্নয়ন ও মানসিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন মানসচর্চা ও মানসিক সাধনা। এ সাধনায় শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহারের চেয়ে মনের গতি-প্রকৃতি, কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বই অনেক বেশি। এভাবে রোজাদারকে প্রকৃত সত্যিকারের আদর্শ মানুষ হতে হবে। রমজান মাসের প্রশিক্ষণই মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করে। সে নিজেকে চিনতে শিখে এবং আল্লাহকেও চিনতে পারে। সে নিজেকে সর্বদা পবিত্র রাখে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘যে নিজেকে পবিত্র করবে, সেই সফলকাম হবে। আর যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে সে ব্যর্থ হবে।’ (সূরা আশ-শামস, আয়াত: ৯-১০)
ইসলামি বিধান অনুযায়ী সিয়াম বা রোজা শুধু উপবাসের নামান্তর নয়, বরং এটি এক ধরনের কঠোর নিয়মতান্ত্রিক কঠোর সাধনা। মাহে রমজান হলো মুমিনের জন্য একটি প্রশিক্ষণ লাভের মাস। এ পবিত্র মাসে প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সচেতনভাবে কাটাতে হবে। রোজাদারদের পরকালীন জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। সদাচরণ, মহৎ ও সত্য-সুন্দর জীবনযাপনের শপথ নিতে হবে। শুধু এক বার নয়, এক দিন নয়, দু-চার দিন বা দশ-বারো দিনের ব্যাপার নয় এবং ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি ও ইচ্ছামতো রোজাব্রত পালন করলে চলে না। একাধারে পূর্ণ মাস ৩০ দিন। একবার দুজন লোক জোহর কিংবা আসরের নামাজ পড়ল। তারা দুজনই রোজা পালনকারী ছিল। নবী করিম (সা.) যখন নামাজ শেষ করলেন তখন ওই দুজনকে বললেন, ‘তোমরা পুনরায় অজু কর ও নামাজ আবার পড় এবং রোজা এখনো চালিয়ে যাও। কিন্তু অন্য দিনে এ রোজা দুটি কাজা করে দিও।’ তাঁরা বললেন, ‘কেন হে আল্লাহর রাসুল?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা অমুকের গিবত ও নিন্দা করেছ (তাই এ শাস্তি)।’ (বায়হাকি, মিশকাত)
রোজার মাধ্যমে একজন রোজাদার ব্যক্তি তার সকল কামনা-বাসনা ও কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। পূর্ণ একটি মাস রোজা পালন করে সবাইকে খুব সতর্কতার সঙ্গে নানা প্রকার বদঅভ্যাস যা কিছু মানুষের মধ্যে নিহিত আছে, সবকিছু থেকে বিরত থাকার কঠোর সংযমের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এমনিভাবে এক মাস নিবিড় প্রশিক্ষণের সুফল বাকি ১১ মাস একজন রোজাদার ভোগ করতে থাকেন।

ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.