চলতি পথে-‘ভয় কি মরণে’ by দীপংকর চন্দ

বরিশাল সদরের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা। অপরিচ্ছন্ন সেই টার্মিনালের কাছেই দেয়ালঘেরা একটি জায়গা। হালকা সবুজ রঙের দেয়ালঘেরা জায়গাটির বহির্ভাগে বেশ কয়েকটি দোকানের সন্নিবেশ। কেন্দ্রভাগে একটি সুউচ্চ প্রবেশ তোরণ। অনলংকৃত সেই তোরণের উপরিভাগে লেখা ‘চারণ কবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত কালী বাড়ী’।


হ্যাঁ, বিকানীর রাজার সহযোগিতায় নথুল্লাবাদে যে কালীবাড়িটি গড়ে তোলেন মুকুন্দ দাস, এটিই সেই কালীবাড়ি। ঐতিহাসিক গুরুত্বে সমৃদ্ধ কালীবাড়িটির প্রবেশ তোরণ অতিক্রম করতে করতে চারণকবি মুকুন্দ দাসের জীবনস্মৃতি রোমন্থন করি আমরা।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গান গেয়ে ঝড় তোলা চারণকবি মুকুন্দ দাসের জন্ম ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বানরি গ্রামে জন্ম হলেও বাবা গুরুদয়াল দের কর্মের সুবাদে শৈশব-পরবর্তী সময় থেকে বরিশালেই বেড়ে ওঠেন তিনি। মুকুন্দ দাসের পিতৃপ্রদত্ত নাম যজ্ঞেশ্বর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য গুরুদয়াল দে বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি করালেন যজ্ঞেশ্বরকে। লেখাপড়ায় অমনোযোগিতার জন্য ১৮৯৩ সালে স্কুল বদলে তাঁকে ভর্তি করা হলো বিএম স্কুলে। কিন্তু স্কুল বদল সত্ত্বেও পাল্টাল না যজ্ঞেশ্বরের লেখাপড়ার পরিস্থিতি। ১৮৯৮ সালে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ গ্রহণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুক্তজীবনে ফিরলেন যজ্ঞেশ্বর। তারপর কিছুদিন দোকানদারি করলেন। অল্প দিনের মধ্যেই দোকানদারি ছেড়ে বীরেশ্বর গুপ্তের ঢপকীর্তনের দলে যোগ দিলেন যজ্ঞেশ্বর। বীরেশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর পর তিনি কীর্তনের নতুন দল গড়লেন। সে সময়ই বৈষ্ণব সন্ন্যাসী অবধূত রামানন্দের কাছে তিনি গ্রহণ করলেন বৈষ্ণব ধর্মমতে দীক্ষা। দীক্ষা গ্রহণের পর পুরোনো নাম বদলে তাঁর নতুন নাম রাখা হলো মুকুন্দ দাস।
১৯০০ সাল। মুকুন্দ দাস কীর্তন গেয়ে যত্সামান্য উপার্জন করতে শুরু করেছেন কেবল; তখনই তাঁর বিয়ের আয়োজন করলেন গুরুদয়াল দে। মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর দিঘিরপাড় গ্রামের রামচরণ দের মেয়ে শতদলবাসিনীর সঙ্গে বিবাহ সুসম্পন্ন হলো তাঁর। শুরু হলো সংসারজীবন। এই সংসারজীবন অনেকটাই পাল্টে দিল মুকুন্দ দাসকে। স্ত্রীর উপস্থিতি, সংসারে সন্তানের আগমন মুকুন্দ দাসের অন্তরে জাগ্রত করল দায়িত্ববোধ। এ সময় বরিশালের বিশিষ্ট মানুষদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটল মুকুন্দ দাসের। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের সান্নিধ্যে এসে দায়িত্ববোধের পাশাপাশি তাঁর অন্তর্জগতে সৃষ্টি হলো দেশাত্মবোধ। দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে একের পর এক গান রচনায় প্রবৃত্ত হলেন মুকুন্দ। গান রচনায় তাঁর সহজাত দক্ষতা দেখে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম মুকুন্দকে ‘চারণকবি’ বিশেষণে ভূষিত করলেন। দেশপ্রেমে আপ্লুত গান ছাড়াও মুকুন্দ দাস সচেষ্ট হলেন ভিন্নধারার যাত্রাপালা পরিবেশনায়। গতানুগতিক কীর্তন পালা পরিবেশনের পরিবর্তে মাতৃপূজা নামে দেশচেতনায় উজ্জীবিত এক পালা রচনা করলেন মুকুন্দ। শুরু হলো পালাটির ব্যতিক্রমী মঞ্চায়ন। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এই পালাটির প্রতি অভূতপূর্ব সাড়া প্রদর্শন করলেন দর্শকেরা। ঠিক সে সময় চলমান বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনেও ভীষণ কার্যকর প্রমাণিত হলো মাতৃপূজা পালাটি। সুতরাং দ্রুতই টনক নড়ল ইংরেজ সরকারের। মাতৃপূজা মঞ্চায়নে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করল ব্রিটিশ রাজ। শুধু তাতেই ক্ষান্ত হলো না শাসকগোষ্ঠী, ১৯০৮ সালে গ্রেপ্তার এবং কয়েক দিনের মধ্যেই কারারুদ্ধ করা হলো মুকুন্দ দাসকে। ১৯১১ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন মুকুন্দ। কিন্তু এরই মধ্যে পত্নীবিয়োগ ঘটে গেছে তাঁর জীবনে। মাতৃহীন দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখলেন মুকুন্দ দাস। অপরিসীম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায়ও তিনি পড়লেন এবার। সামগ্রিক পরিস্থিতি এককথায় অসহনীয়! মৃত্যুসম প্রতিবন্ধকতা যেন তাঁর চারদিকে। কিন্তু ‘ভয় কি মরণে’! ভাবলেন মুকুন্দ দাস এবং ভয়হীনচিত্তে সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়লেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
মুকুন্দ দাস প্রথম জীবনে বৈষ্ণব ধর্মমতে দীক্ষিত হলেও প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত মুকুন্দ দাস ছিলেন পরিপূর্ণভাবে শাক্ত বা কালীর উপাসক। বরিশাল শহরের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের কাছে কাশীপুরে তাই তিনি এই কালীবাড়িটি গড়ে তোলেন। কালীবাড়ির প্রবেশ তোরণ অতিক্রম করতেই মুকুন্দ দাসের আরাধ্য মন্দিরটি দৃষ্টিগোচর হলো আমাদের। টাইলসে বাঁধানো মন্দিরটির গর্ভগৃহের অনুচ্চ বেদিতে দণ্ডায়মান কালীবিগ্রহ। রক্তস্নাত প্রসারিত জিহ্বায়, নরমুণ্ডের মালায় সজ্জিত দেবীর পদতলে শায়িত মহাদেব।
মন্দির চত্বরের বাঁ পাশে চারণকবি মুকুন্দ দাস ছাত্রাবাস। কথা হলো ছাত্রাবাসে বসবাসরত অশোক হাওলাদারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মন্দির প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখলাম আমরা। মন্দির প্রাঙ্গণে ছাত্রাবাস ছাড়াও একটি দাতব্য চিকিত্সালয়, একটি পাঠাগারসহ বেশ কিছু সামাজিক সংগঠনের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল আমাদের। চোখে পড়ল দেয়ালগাত্রে উত্কীর্ণ কিছু ছন্দোবদ্ধ চরণগুচ্ছ। মুকুন্দ দাস রচিত সেই চরণগুচ্ছের একটিতে শুধু চোখই নয়, আটকে গেল আমাদের মনও। কী লেখা সেখানে? ‘রাম রহিম জুদা কর ভাই মনটা খাঁটি রাখো জী, দেশের কথা ভাবো ভাইরে দেশ আমাদের মাতাজী...’ । হ্যাঁ, ভীষণ সত্যি কথা, ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ভুলে দেশের কথা না ভাবলে কোনো দিনই ঘুচবে না আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির দুর্দশা।

No comments

Powered by Blogger.