গদ্যকার্টুন-ইহারা একে অপরকে ছুড়িয়া নিচে ফেলে কেন? by আনিসুল হক
সোনার ছেলেদের কী হইল, উহারা একযোগে উপরতলা হইতে একে অপরকে নিচে ছুড়িয়া ফেলিতে আরম্ভ করিয়াছে কেন? দোতলা হইতে ফেলিতেছে, তেতলা হইতে ফেলিতেছে, চারতলা হইতে ফেলিতেছে। উহারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলিয়াছে হালি ধরিয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলিয়াছে একজনকে।
ঘটনা কী? অন্য সব অস্ত্র ব্যবহার কি সম্পন্ন হইয়াছে—ভোজালি-চাপাতি-রামদা-ক্ষুরে কোপানো, পোচ মারা, ঢুকাইয়া দেওয়া, ছ্যাদা করা, হাতুড়ি দিয়া থেঁতলা করা, ড্রিল মেশিন দিয়া ফুটা করা, পিস্তল-বন্দুক-কাটা রাইফেল দিয়া মাথার খুলি কিংবা ঘিলু উড়ানো—এইসব ক্রীড়া-কৌতুক কি এখন পুরাতন হইয়া গিয়াছে? ওই সবে আর আনন্দ নাই? এখন তাহারা নূতন খেলা আরম্ভ করিয়াছে। ছাত্রাবাসের উপর হইতে নিচে ফেলিয়া দেওয়া।
খেলা হিসাবে তাহা মন্দ নহে। প্রথমে বেদম বেধড়ক প্রহার, তাহার পর চ্যাংদোলা করিয়া রেলিং পার করাইয়া শূন্যে নিক্ষেপ। হয়তো উহারা উপর দিকেই মহাশূন্য পানেই নিক্ষেপ করে, কিন্তু সব দোষ বেচারা নিউটনের, তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করিয়া আপেলসমেত সমস্ত ফল ও মানবশরীরকে বিপদে ফেলিয়াছেন, উপরের দিকে ছুড়িলেও তাহারা নিম্নদিকে ধাবিত হয় আর এই পৃথিবীর মায়ার টানে ভূতলেই আছাড় খাইয়া পড়ে।
নিউটন এই অন্যায়টা কেন করিলেন? তিনি কি জানেন না সোনার ছেলেরা সরকারি ছাত্রসংগঠনে যোগ দেয় একতলা দোতলা করিয়া বহু উপরে উঠিবে বলিয়া, নিচে নামিবার জন্য নহে। কাজেই যখন একই সংগঠনের সভাপতির গ্রুপ তাহার প্রিয় সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপ করিবার কারণে স্নেহবশত তাহাকে উপরে ছুড়িয়া মারে, তখন সে তাহাকে আসলে আরও উপরেই তুলিতে চায়, কিন্তু সে যদি নিচে পড়িয়া যায়, পড়িয়া যদি তাহার মাথা ভাঙে, হাত-পা গুঁড়া হয়, বুকের পাঁজরের সব কটা হাড় মটাৎ করিয়া উঠে, তবে সেই দায়িত্ব তো সভাপতির নহে, সাধারণ সম্পাদকেরও নহে, তাহাদের অনুগত কর্মীদলেরও নহে।
এই রূপ আর কোথায় আছে? রুয়ান্ডায়? কোনো ঘন জঙ্গলে যাহারা এখনো লজ্জা ঢাকিবার জন্য পরিধানে কোনো আবরণ দিবারও প্রয়োজন মনে করে না, তাহারাও কি এইরূপ ছোড়াছুড়ি কখনো করিয়াছে? কেহ কখনো শুনিয়াছে? উহারা নগ্ন থাকে, নগ্নতাকে তাহাদের লজ্জা নাই। আমরা কাপড় পরিধান করি, আমাদের লজ্জা বড় বেশি, কারণ আমরা সভ্য। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বানাইয়াছি সভ্যতার আলোকে নিজেকে আর জগৎকে আলোকিত করিব বলিয়া। আমাদের রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রনীতি আছে, আইনকানুন আছে, আমাদের মহামতি সরকার আছে, সরকারি সংগঠন আছে। তাহাদের ছাত্রসংগঠন আছে, তাহারা সকলে বস্ত্র পরিধান করে; শোনা যায়, বিদ্যুৎ বাতি ইত্যাদিও তাহারা কখনো কখনো ব্যবহার করে, এবং তাহারা নিজেদের সহপাঠীদের, নিজের মতের লোকদিগের মধ্যে সর্বদাই দ্বিধা-ত্রিধা বিভক্তি ঘটায়, এবং অতঃপর পুস্তক রাখিয়া, কলম ফেলিয়া, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি প্রাচীন ধারণাকে ফুৎকারে উড়াইয়া দিয়া একে অপরকে প্রথমে আচ্ছামতো ধোলাই দেয় এবং সর্বশেষে দোতলা তেতলা চারতলা হইতে নিচে ফেলিয়া দেয়। ইহাকেই বলে সভ্যতা, ইহাকেই বলে গণতন্ত্র, ইহাকেই বলে বিদ্যাপীঠ, ইহাকেই বলে আইনের শাসন।
ধন্য ধন্য। সরকারি ছাত্রসংগঠন যদি উপরে উঠিবার সিঁড়ি বা মই সরবরাহ করিয়া থাকে, তাহা হইলে নিচে নামিবার পতনযজ্ঞও তো তাহাদিগকেই সম্পন্ন করিতে হইবে।
দুষ্ট লোকেরা নানা কথা বলে। কোটি টাকার টেন্ডার-বাণিজ্য, সিট-ব্যবসায়, চাঁদাবাজি ইত্যাদির দখল নাকি এইসব ভারোত্তোলন ও অধঃপাতনের পশ্চাতে নিহিত। দুষ্ট লোকদের কথায় আমরা কান দিব না।
আসলে সোনার বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা কোনো বিষয়েই সোনার মেডেল বিশ্বদরবার হইতে আনিতে পারে নাই, তাই তাহারা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাইয়া দেশের গৌরব সারা পৃথিবীবাসীর কর্ণকুহরের মধ্য দিয়া মর্মে পৌঁছাইতে চাহিতেছে যে, দেখো, পৃথিবীতে এমন দেশও আছে, যেই দেশে এক দল শিক্ষার্থী আরেক দল শিক্ষার্থীকে যথাসম্ভব উচ্চ ভবনে তুলিয়া শূন্যে ছুড়িয়া মারে? তোমরা কি কেহ এই রূপ অভিনব ভাবনা ভাবিতে পারিবে?
তবে, খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই উচ্চাঙ্গের ক্রীড়াকৌতুকটিকে কোনো কোনো অভাজন উদ্বেগজনক, কলঙ্কজনক, সুতরাং প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য বলিয়া জ্ঞান করিতেছেন। তাহারা নাকি অত্যন্ত জ্ঞানী ও উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক। তাহারা নাকি ১১ পিপা নস্যি নাকে দিয়া সারা দিন ভাবিয়া এই উপায় বাহির করিয়াছেন যে, এই নিম্নপাতন মহামারির কারণ হইল ছাত্রাবাসগুলিকে বহুতল হিসাবে নির্মাণ করা, কাজেই তাহাদের সুপারিশ হইল, বাংলাদেশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আর বহুতল ভবন থাকিতে পারিবে না এবং কোনো সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকিবে না। দোতলা তিনতলা চারতলায় উঠিতে না পারিলে উহারা পরস্পরকে নিচে ঠেলিয়া বা ছুড়িয়া দিবে কী প্রকারে?
বলিলাম, এ কেমন সমাধান। মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটিয়া ফেলা। বন্ধুবর উত্তর করিলেন, যানজটের জন্য স্কুল বন্ধ করিতে হইল, গ্যাসের জন্য বিদ্যুৎসংকট, বিদ্যুতের জন্য পানিসংকট, পানির জন্য শহরে আরেকটা কানসাট বিস্ফোরণ রোধ করিবার উদ্দেশ্যে এখন সিএনজি স্টেশন এক প্রহরকাল বন্ধ রাখা হইতেছে। অথচ ঢাকার পানিসংকট সমাধানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা ওয়াসার জন্য কতগুলি জেনারেটর কিনিবার টাকা সরকারের গত দেড় বৎসরেও সংস্থান হইল না। ইহার পর বলা হইবে যানজট সমস্যার সমাধান হইল অফিস-আদালত চিরদিনের জন্য বন্ধ রাখা। তো তাহার তুলনায় বহুতলবিশিষ্ট শিক্ষাঙ্গন না রাখা কি সহজ কৌশল নহে?
বন্ধুবরের কথায় সায় না দিয়া পারিলাম না। কারণ আমরা একটি ছয়তলা ভবনের বারান্দায় দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছিলাম।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
খেলা হিসাবে তাহা মন্দ নহে। প্রথমে বেদম বেধড়ক প্রহার, তাহার পর চ্যাংদোলা করিয়া রেলিং পার করাইয়া শূন্যে নিক্ষেপ। হয়তো উহারা উপর দিকেই মহাশূন্য পানেই নিক্ষেপ করে, কিন্তু সব দোষ বেচারা নিউটনের, তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করিয়া আপেলসমেত সমস্ত ফল ও মানবশরীরকে বিপদে ফেলিয়াছেন, উপরের দিকে ছুড়িলেও তাহারা নিম্নদিকে ধাবিত হয় আর এই পৃথিবীর মায়ার টানে ভূতলেই আছাড় খাইয়া পড়ে।
নিউটন এই অন্যায়টা কেন করিলেন? তিনি কি জানেন না সোনার ছেলেরা সরকারি ছাত্রসংগঠনে যোগ দেয় একতলা দোতলা করিয়া বহু উপরে উঠিবে বলিয়া, নিচে নামিবার জন্য নহে। কাজেই যখন একই সংগঠনের সভাপতির গ্রুপ তাহার প্রিয় সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপ করিবার কারণে স্নেহবশত তাহাকে উপরে ছুড়িয়া মারে, তখন সে তাহাকে আসলে আরও উপরেই তুলিতে চায়, কিন্তু সে যদি নিচে পড়িয়া যায়, পড়িয়া যদি তাহার মাথা ভাঙে, হাত-পা গুঁড়া হয়, বুকের পাঁজরের সব কটা হাড় মটাৎ করিয়া উঠে, তবে সেই দায়িত্ব তো সভাপতির নহে, সাধারণ সম্পাদকেরও নহে, তাহাদের অনুগত কর্মীদলেরও নহে।
এই রূপ আর কোথায় আছে? রুয়ান্ডায়? কোনো ঘন জঙ্গলে যাহারা এখনো লজ্জা ঢাকিবার জন্য পরিধানে কোনো আবরণ দিবারও প্রয়োজন মনে করে না, তাহারাও কি এইরূপ ছোড়াছুড়ি কখনো করিয়াছে? কেহ কখনো শুনিয়াছে? উহারা নগ্ন থাকে, নগ্নতাকে তাহাদের লজ্জা নাই। আমরা কাপড় পরিধান করি, আমাদের লজ্জা বড় বেশি, কারণ আমরা সভ্য। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বানাইয়াছি সভ্যতার আলোকে নিজেকে আর জগৎকে আলোকিত করিব বলিয়া। আমাদের রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রনীতি আছে, আইনকানুন আছে, আমাদের মহামতি সরকার আছে, সরকারি সংগঠন আছে। তাহাদের ছাত্রসংগঠন আছে, তাহারা সকলে বস্ত্র পরিধান করে; শোনা যায়, বিদ্যুৎ বাতি ইত্যাদিও তাহারা কখনো কখনো ব্যবহার করে, এবং তাহারা নিজেদের সহপাঠীদের, নিজের মতের লোকদিগের মধ্যে সর্বদাই দ্বিধা-ত্রিধা বিভক্তি ঘটায়, এবং অতঃপর পুস্তক রাখিয়া, কলম ফেলিয়া, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি প্রাচীন ধারণাকে ফুৎকারে উড়াইয়া দিয়া একে অপরকে প্রথমে আচ্ছামতো ধোলাই দেয় এবং সর্বশেষে দোতলা তেতলা চারতলা হইতে নিচে ফেলিয়া দেয়। ইহাকেই বলে সভ্যতা, ইহাকেই বলে গণতন্ত্র, ইহাকেই বলে বিদ্যাপীঠ, ইহাকেই বলে আইনের শাসন।
ধন্য ধন্য। সরকারি ছাত্রসংগঠন যদি উপরে উঠিবার সিঁড়ি বা মই সরবরাহ করিয়া থাকে, তাহা হইলে নিচে নামিবার পতনযজ্ঞও তো তাহাদিগকেই সম্পন্ন করিতে হইবে।
দুষ্ট লোকেরা নানা কথা বলে। কোটি টাকার টেন্ডার-বাণিজ্য, সিট-ব্যবসায়, চাঁদাবাজি ইত্যাদির দখল নাকি এইসব ভারোত্তোলন ও অধঃপাতনের পশ্চাতে নিহিত। দুষ্ট লোকদের কথায় আমরা কান দিব না।
আসলে সোনার বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা কোনো বিষয়েই সোনার মেডেল বিশ্বদরবার হইতে আনিতে পারে নাই, তাই তাহারা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাইয়া দেশের গৌরব সারা পৃথিবীবাসীর কর্ণকুহরের মধ্য দিয়া মর্মে পৌঁছাইতে চাহিতেছে যে, দেখো, পৃথিবীতে এমন দেশও আছে, যেই দেশে এক দল শিক্ষার্থী আরেক দল শিক্ষার্থীকে যথাসম্ভব উচ্চ ভবনে তুলিয়া শূন্যে ছুড়িয়া মারে? তোমরা কি কেহ এই রূপ অভিনব ভাবনা ভাবিতে পারিবে?
তবে, খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই উচ্চাঙ্গের ক্রীড়াকৌতুকটিকে কোনো কোনো অভাজন উদ্বেগজনক, কলঙ্কজনক, সুতরাং প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য বলিয়া জ্ঞান করিতেছেন। তাহারা নাকি অত্যন্ত জ্ঞানী ও উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক। তাহারা নাকি ১১ পিপা নস্যি নাকে দিয়া সারা দিন ভাবিয়া এই উপায় বাহির করিয়াছেন যে, এই নিম্নপাতন মহামারির কারণ হইল ছাত্রাবাসগুলিকে বহুতল হিসাবে নির্মাণ করা, কাজেই তাহাদের সুপারিশ হইল, বাংলাদেশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আর বহুতল ভবন থাকিতে পারিবে না এবং কোনো সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকিবে না। দোতলা তিনতলা চারতলায় উঠিতে না পারিলে উহারা পরস্পরকে নিচে ঠেলিয়া বা ছুড়িয়া দিবে কী প্রকারে?
বলিলাম, এ কেমন সমাধান। মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটিয়া ফেলা। বন্ধুবর উত্তর করিলেন, যানজটের জন্য স্কুল বন্ধ করিতে হইল, গ্যাসের জন্য বিদ্যুৎসংকট, বিদ্যুতের জন্য পানিসংকট, পানির জন্য শহরে আরেকটা কানসাট বিস্ফোরণ রোধ করিবার উদ্দেশ্যে এখন সিএনজি স্টেশন এক প্রহরকাল বন্ধ রাখা হইতেছে। অথচ ঢাকার পানিসংকট সমাধানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা ওয়াসার জন্য কতগুলি জেনারেটর কিনিবার টাকা সরকারের গত দেড় বৎসরেও সংস্থান হইল না। ইহার পর বলা হইবে যানজট সমস্যার সমাধান হইল অফিস-আদালত চিরদিনের জন্য বন্ধ রাখা। তো তাহার তুলনায় বহুতলবিশিষ্ট শিক্ষাঙ্গন না রাখা কি সহজ কৌশল নহে?
বন্ধুবরের কথায় সায় না দিয়া পারিলাম না। কারণ আমরা একটি ছয়তলা ভবনের বারান্দায় দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছিলাম।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments