চারদিক-পাহাড়ের কোলে পাহাড়ি বাজার by মৃত্যুঞ্জয় রায়

মেঘের কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। বৃষ্টিও কোনো আহ্বান শোনে না। চারাতলায় আমনের কচি চারা দিনে দিনে ডাগর হয়ে উঠছে। নরম নতুন মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে বেড়ে ওঠার জন্য ওরা বড় উদ্গ্রীব। কিন্তু শ্রাবণেই শ্রাবণধারা নেই, জুতসই করে মাটি ভিজছে না। আকাশের সব মেঘ যেন নেমে এসেছে কৃষকের মনের ভেতর।


এ রকম কয়েক দিন বৃষ্টি না হলে হয়তো বৃষ্টির জল গড়াবে কৃষকের চোখ দিয়ে। আবার কী অদ্ভুত ব্যাপার, ওই দূর পাহাড়ের মাথায় ঘোলাটে আকাশ, ধোঁয়াশা। বোধ হয় ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু খাগড়াছড়ির এই আকাশ রৌদ্রলীন।
হোটেল শৈল সুবর্ণার ছাদে বসে কাছে-দূরের সুউচ্চ আলুটিলা পাহাড়কে দেখছি আর ওর নীলাভ সবুজ রূপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। পাহাড়ের মাথায় চলছে রৌদ্র-ছায়ার খেলা। বর্ষার নতুন জল পেয়ে আহ্ কী সবুজ আর মায়াময় আলুটিলা! ধীরে ধীরে পাহাড় এসে খানিকটা সমতল হয়েছে, আর সেই সমতল গিরিতলেই গড়ে উঠেছে খাগড়াছড়ি শহরটা। আলুটিলার মাথায় উঠলে এই শহরটা পুরোপুরিই দেখা যায়। ওপর থেকে দেখা যায় নতুন আমনের খেত অথবা রোয়া লাগানোর অপেক্ষায় থাকা জমি, জমির বুক চিরে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা চেঙ্গি নদী। টিলার গা বেয়ে নেমে চলা জুমের ধানখেত। আসার পথে গাড়ি থামিয়ে আলুটিলা থেকে পাখির চোখে সেসব দেখে এসেছি। এখন হোটেলের ছাদে বসে উল্টো দেখছি আলুটিলাকে। আলুটিলার কোলজুড়ে নানা রকম ফসলের মেলা, আখখেত, করাতকল, গাছগাছালি আর গ্রামের ঘরবাড়ি, নদীরেখা, সেতু, বাজার—সবই ওপর থেকে দেখাচ্ছে চমৎকার। এসব ছাড়িয় বাজারের মধ্য দিয়ে একটা ইটের রাস্তা একটু এঁকেবেঁকে চলে গেছে আলুটিলার দিকে।
বাজারটাকে সবাই বলে নিচাবাজার আর রাস্তাটাকে বলে গঞ্জপাড়া রোড। কেননা, রাস্তাটা ওই গঞ্জপাড়া গ্রামেই গেছে। এরপর জিরো পয়েন্ট। সেখান থেকে আলুটিলা মহালছড়ি বা অন্য কোনোখানে যাওয়ার মহাসড়ক। সকালবেলাতেই বাজার বেশ জমে উঠেছে। আদিবাসী কৃষক-কিষানিরা নানা রকম পণ্য নিয়ে ওই রাস্তা বেয়ে আসছেন। কিছু চিনি, কিছু চিনি না। অতএব আর বসে থাকা হলো না। নেমে এলাম নিচাবাজারে।
খাগড়াছড়ির মূল বাজার থেকে এই বাজারটা একটু নিচুতে। পাহাড়ের ঢালটা ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে আরও নিচে নেমে চেঙ্গি নদীতে গিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে। হয়তো সে জন্যই নামটা নিচাবাজার। বাজারে রাস্তার দুই পাশে যথারীতি সারবাঁধা মুদি দোকান, চায়ের দোকান। পুব দিকে কাঁচাবাজার। সেখানে পাহাড়ি-বাঙালিরা মিলেমিশে নানা রকম পণ্যের দোকান নিয়ে বসেছে। বিশেষ করে বর্ষাকালীন শাকসবজিতে সকালের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। পাহাড়ি-বাঙালিরা সেসব জিনিস কিনছেও মিলেমিশে। তবে দেশের আর দশটা বাজার থেকে আলুটিলার কোলে এই পাহাড়ি বাজারটা কিসে যেন একটু আলাদা ঠেকছে। আরও নিচে ত্রিপুরা আর মারমা আদিবাসী মেয়েরা নানা রকম পাহাড়ি বনজ সবজি আর জুমের ফসল নিয়ে বসেছে।
সে জন্যই কি? হয়তো বা। কেননা, আমরা সমতলের লোক খনগোলা চিনি না। হয়তো পাইন্যাগোলাও চিনি না। একজন ক্রেতা অরুণ ত্রিপুরা সেটা কিনতে কিনতে বললেন, ‘দাদা, এর মতো উপকারী সবজি আর নেই। জন্ডিস সারাতে এটা মহা ওস্তাদ। সিদ্ধ করে নরম করার পর চেঁছে ওর ছাল তুলে ফেলে শুঁটকি দিয়ে আমরা রেঁধে খাই, কেউ কেউ সবজির মতো ওটা রান্না করেও খায়।’ সত্যিই তাই। এক হাত লম্বা আর চার আঙুল চওড়া শিম আমি কখনো দেখিনি। এত বড় শিমের গাছটা না জানি কত বড়! হাতে ধরে দেখলাম, তখনো নরম তকতকে, পীতাভ বর্ণ। বাত্তি হলে শক্ত হয়ে যায়। তখন তা খাওয়া যায় না। এক ধরনের ওল উঠেছে, যার পাঁচ-সাতটা মুখ। জুমে, পাহাড়ের ঢালে, বাড়ির আঙিনায় হয়। ওটা ওলই। তবে কেউ কেউ বলে সাতমুখী। বিক্রেতা ভোলার চরফ্যাশনের লাল মিয়া বললেন, ‘আমাদের দেশে এর নাম বাঘতাড়ালি। প্রায় ২০ বছর ধরে এই বাজারে সবজি বেচছি। তখন থেকেই এই সময়ে এ ধরনের ওলকচু বেচে আসছি। কিছুদিন পর বড় বড় ছড়ার মুখীকচু উঠবে। ওসব রামগড়ের নাকাপা আর জালিয়াপাড়ায় খুব হয়।’ পাইতু মারমা আর মণিকা ত্রিপুরাসহ আরও ১০-১২ জন বিক্রি করতে বসেছেন জুমের মারফা, বরবটি, বিলাতি ধনিয়া, কলার মোচা, খনাগোলা, ঢ্যাঁড়স, কচি ভুট্টার মোচা, মরিচ, ধনেপাতা, করলা শাক, করলা, কাঁকরোল ইত্যাদি। কলাবাগানে বাড়ি আবদুল আজিজের। তিনি বিক্রি করছেন এক থেকে সোয়া ফুট লম্বা বিশাল বিশাল শসা। এগুলোও কি জুমে হয়? তিনি মাথা নাড়লেন, ‘না, ওগুলো হাইব্রিড শসা। আসে বান্দরবান থেকে।’
বাজার থেকে আলুটিলার টানে হাঁটতে শুরু করলাম বাজার ছাড়িয়ে সামনের দিকে। মেহেদীবাগ পেরিয়ে চেঙ্গি সেতুর কাছে পৌঁছাতেই চা-দোকানি আজিজ ভাই বললেন, হেঁটে কি আর আলুটিলায় যেতে পারবেন? জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত টমটমে যেতে পারবেন। সেখান থেকে চান্দের গাড়ি বা বাস ধরে আলুটিলায় যেতে পারবেন। তবে এসব ভেজাল পথে না গিয়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে সোজা বাসে যাওয়াই ভালো। কথা বলতে বলতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। মনে মনে খুশি হয়ে বললাম, জয় হোক কৃষকের।

No comments

Powered by Blogger.