জনপ্রতিনিধি-পুরুষ সাংসদের ‘দেখে নেওয়া’ by সোহরাব হাসান
বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নেবেন, জানি না। তবে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত।
এত দিন দেখেছি, সাংসদদের হাতে পুলিশ কনস্টেবল লাঞ্ছিত হয়েছেন, থানার ওসি নাজেহাল হয়েছেন। সাংসদেরা ইউএনওর ওপর চড়াও হয়েছেন।
এত দিন দেখেছি, সাংসদদের হাতে পুলিশ কনস্টেবল লাঞ্ছিত হয়েছেন, থানার ওসি নাজেহাল হয়েছেন। সাংসদেরা ইউএনওর ওপর চড়াও হয়েছেন।
প্রকৌশলীকে মারধর করেছেন। প্রজাতন্ত্রের নিরীহ কর্মচারী বলে হয়তো তাঁরা সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করেছেন। না করেই বা উপায় কী? মহা ক্ষমতাধর জনপ্রতিনিধির সঙ্গে বেয়াদবির শাস্তি নির্ঘাত অনন্তকালের জন্য ওএসডি অথবা অবিলম্বে খাগড়াছড়ির মশকসংকুল প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি।
কক্সবাজারের এক স্বনামখ্যাত সাংসদ আছেন, যাঁর হাত থেকে প্রকৌশলী থেকে শুরু করে ইউএনও, প্রবীণ শিক্ষক—কেউ রেহাই পাননি। সব সময়ই নাকি তাঁর হাত নিশপিশ করে। আবার বেকায়দায় পড়লে মাফ চাইতেও কসুর করেন না। এসব খবর দেশবাসীর অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি পাঠকের মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ আকর্ষণের কারণ হলো, সেখানে একজন পুরুষ সাংসদ আরেকজন নারী সাংসদকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন। হুমকিদাতা মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির সাংসদ নাসিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫)। আর যাঁকে হুমকি দিয়েছেন, তিনি হলেন আওয়ামী লীগের সাংসদ সারাহ বেগম কবরী (নারায়ণগঞ্জ-৪)। একেই বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। আমরা এত দিন দেখে এসেছি, বড় শরিকের দাপট বেশি। এখানে ঘটেছে ঠিক উল্টো। ছোট শরিক বড় শরিককে হুমকি দিচ্ছে।
এ কাজটি বিরোধী দল বিএনপির কোনো সাংসদ করলে ক্ষমতাসীনেরা হয়তো বলতেন , সরকারের উন্নয়নকাজে বাধা সৃষ্টি করতে তাঁরা ষড়যন্ত্র করছেন। চক্রান্ত আঁটছেন। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত আছে কি না, সে বিষয়ে তদন্তের জন্য আইজিপি বা র্যাবপ্রধান নির্দেশ দিতেন। কিন্তু হুমকিদাতা যে মহাজোটের শরিক!
বাংলা ভাষায় ‘দেখে নেওয়া’ শব্দটি যতটা নিরীহ মনে হয়, ততটা নিরীহ নয়। সাধারণত এক পাড়ার মাস্তান আরেক পাড়ার মাস্তানকে দেখে নেওয়ার কথা বলে, এলাকায় না আসার হুমকি দেয়। কিন্তু জাতীয় সংসদের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি কী করে সেই কাজ করতে পারেন?
মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক বৈঠক ডেকেছিলেন। সেই বৈঠকে জেলার জনপ্রতিনিধিরা ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তারা ছিলেন। ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধি। সবার উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে জেলা প্রশাসককে তড়িঘড়ি বৈঠক শেষ করতে হয়েছে।
জাতীয় পার্টির সাংসদ নাসিম ওসমান কেন এ হুমকি দিলেন? কবরীর অপরাধ কী? তিনি স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ গোষ্ঠী তাঁর ও তাঁর সমর্থকদের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কবরীর সঙ্গে রাজনীতি করলে তাঁকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং ওই বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে রাজনীতি করলে ভালো মানুষ হয়ে যায়।’ (প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট)
কবরীর বক্তব্যে আপত্তিকর কিছু থাকলে নাসিম ওসমান প্রতিবাদ করতে পারতেন। দলীয় সভায় বিষয়টি তুলে মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের কাছে আপত্তি জানাতে পারতেন। এমনকি জাতীয় সংসদেও তিনি অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার নালিশ জানাতে পারতেন। সে সব না করে একজন সাংসদকে এভাবে তিনি হুমকি দিতে পারেন না। এর মাধ্যমে আইন প্রনেতা নিজের হাতেই আইন হাতে তুলে নিলেন।
আমাদের সমাজে সাধারণত নারীদের উদ্দেশে কথাবার্তা বলার সময় সৌজন্য ও শিষ্টাচার বজায় রাখা হয়। নাসিম ওসমান তাও রাখেননি। পারিবারিক ঝগড়াকে তিনি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে ওঠাতেও দ্বিধা করেননি।
কে কোন পরিবারের বউ না ছেলে হিসেবে সাংসদ হয়েছেন, সেটি আলোচনার বিষয় নয়। জাতীয় সংসদের নির্বাচন পরিবারকেন্দ্রিক হয়না, হয় নির্বাচনী আসনকেন্দ্রিক। নাসিম ওসমানের দাবি, ‘ওসমান পরিবারের বউ হিসেবেই নাকি কবরী সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।’ তাঁর এ যুক্তি মেনে নিলে ওসমান পরিবারের সব বউ জাতীয় সাংসদের সদস্য হতেন। ওসমান পরিবারের বউ কেন, মর্দদেরও যে নির্বাচনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগের কাছে ধরনা দিতে হয়েছে, সে কথাটি নাসিমের না জানান কথা নয়। জনগণ ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি দেখে, শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকারই মহাজোটকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছে। কোনো পরিবারের নামে মানুষ ভোট দেয়নি। নাসিম ওসমান যে পরিবারের কথা বলেছেন, সেই পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতা সত্ত্বেও কবরী নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
আমরা মনে করি, নাসিম ওসমানের এ হুমকি শুধু ব্যক্তির প্রতি নয়—কবরী যে দলের মনোনয়ন নিয়েছেন, সেই আওয়ামী লীগ এবং তার প্রধান শেখ হাসিনার প্রতিও। কেননা তিনিই কবরীকে নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন । কবরীকে নারায়ণগঞ্জ ছাড়া করতে পারলে আওয়ামী লীগ অজনপ্রিয় হবে। লাভবান হবেন নাসিম ওসমান ও তাঁর দল জাতীয় পার্টির। এই লাভ-লোকসানের হিসাবে তাঁর নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আগামী নির্বাচনে কোথায় যান, বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগের জন্য এরশাদ জীবনপাত করার পণ করলেও ওপক্ষের আশ্বাস পেলে আবার যে তিনি দলবদল করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে দুই হাজার একুশ সালের রূপকল্প দেখিয়েছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু কথায় কথায় ‘দেখে নেওয়া’ কিংবা হুমকিদাতাদের নিয়ে যে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাবে না তা হলফ করেই বলা যায়।
একজন নারী সাংসদ যদি নিজের নির্বাচনী এলাকায় নিজেকে নিরাপদ না ভাবতে পারেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে নিরাপদ ভাববে? নিরাপদ থাকবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
কক্সবাজারের এক স্বনামখ্যাত সাংসদ আছেন, যাঁর হাত থেকে প্রকৌশলী থেকে শুরু করে ইউএনও, প্রবীণ শিক্ষক—কেউ রেহাই পাননি। সব সময়ই নাকি তাঁর হাত নিশপিশ করে। আবার বেকায়দায় পড়লে মাফ চাইতেও কসুর করেন না। এসব খবর দেশবাসীর অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি পাঠকের মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ আকর্ষণের কারণ হলো, সেখানে একজন পুরুষ সাংসদ আরেকজন নারী সাংসদকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন। হুমকিদাতা মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির সাংসদ নাসিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫)। আর যাঁকে হুমকি দিয়েছেন, তিনি হলেন আওয়ামী লীগের সাংসদ সারাহ বেগম কবরী (নারায়ণগঞ্জ-৪)। একেই বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। আমরা এত দিন দেখে এসেছি, বড় শরিকের দাপট বেশি। এখানে ঘটেছে ঠিক উল্টো। ছোট শরিক বড় শরিককে হুমকি দিচ্ছে।
এ কাজটি বিরোধী দল বিএনপির কোনো সাংসদ করলে ক্ষমতাসীনেরা হয়তো বলতেন , সরকারের উন্নয়নকাজে বাধা সৃষ্টি করতে তাঁরা ষড়যন্ত্র করছেন। চক্রান্ত আঁটছেন। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত আছে কি না, সে বিষয়ে তদন্তের জন্য আইজিপি বা র্যাবপ্রধান নির্দেশ দিতেন। কিন্তু হুমকিদাতা যে মহাজোটের শরিক!
বাংলা ভাষায় ‘দেখে নেওয়া’ শব্দটি যতটা নিরীহ মনে হয়, ততটা নিরীহ নয়। সাধারণত এক পাড়ার মাস্তান আরেক পাড়ার মাস্তানকে দেখে নেওয়ার কথা বলে, এলাকায় না আসার হুমকি দেয়। কিন্তু জাতীয় সংসদের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি কী করে সেই কাজ করতে পারেন?
মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক বৈঠক ডেকেছিলেন। সেই বৈঠকে জেলার জনপ্রতিনিধিরা ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তারা ছিলেন। ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধি। সবার উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে জেলা প্রশাসককে তড়িঘড়ি বৈঠক শেষ করতে হয়েছে।
জাতীয় পার্টির সাংসদ নাসিম ওসমান কেন এ হুমকি দিলেন? কবরীর অপরাধ কী? তিনি স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ গোষ্ঠী তাঁর ও তাঁর সমর্থকদের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কবরীর সঙ্গে রাজনীতি করলে তাঁকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং ওই বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে রাজনীতি করলে ভালো মানুষ হয়ে যায়।’ (প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট)
কবরীর বক্তব্যে আপত্তিকর কিছু থাকলে নাসিম ওসমান প্রতিবাদ করতে পারতেন। দলীয় সভায় বিষয়টি তুলে মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের কাছে আপত্তি জানাতে পারতেন। এমনকি জাতীয় সংসদেও তিনি অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার নালিশ জানাতে পারতেন। সে সব না করে একজন সাংসদকে এভাবে তিনি হুমকি দিতে পারেন না। এর মাধ্যমে আইন প্রনেতা নিজের হাতেই আইন হাতে তুলে নিলেন।
আমাদের সমাজে সাধারণত নারীদের উদ্দেশে কথাবার্তা বলার সময় সৌজন্য ও শিষ্টাচার বজায় রাখা হয়। নাসিম ওসমান তাও রাখেননি। পারিবারিক ঝগড়াকে তিনি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে ওঠাতেও দ্বিধা করেননি।
কে কোন পরিবারের বউ না ছেলে হিসেবে সাংসদ হয়েছেন, সেটি আলোচনার বিষয় নয়। জাতীয় সংসদের নির্বাচন পরিবারকেন্দ্রিক হয়না, হয় নির্বাচনী আসনকেন্দ্রিক। নাসিম ওসমানের দাবি, ‘ওসমান পরিবারের বউ হিসেবেই নাকি কবরী সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।’ তাঁর এ যুক্তি মেনে নিলে ওসমান পরিবারের সব বউ জাতীয় সাংসদের সদস্য হতেন। ওসমান পরিবারের বউ কেন, মর্দদেরও যে নির্বাচনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগের কাছে ধরনা দিতে হয়েছে, সে কথাটি নাসিমের না জানান কথা নয়। জনগণ ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি দেখে, শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকারই মহাজোটকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছে। কোনো পরিবারের নামে মানুষ ভোট দেয়নি। নাসিম ওসমান যে পরিবারের কথা বলেছেন, সেই পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতা সত্ত্বেও কবরী নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
আমরা মনে করি, নাসিম ওসমানের এ হুমকি শুধু ব্যক্তির প্রতি নয়—কবরী যে দলের মনোনয়ন নিয়েছেন, সেই আওয়ামী লীগ এবং তার প্রধান শেখ হাসিনার প্রতিও। কেননা তিনিই কবরীকে নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন । কবরীকে নারায়ণগঞ্জ ছাড়া করতে পারলে আওয়ামী লীগ অজনপ্রিয় হবে। লাভবান হবেন নাসিম ওসমান ও তাঁর দল জাতীয় পার্টির। এই লাভ-লোকসানের হিসাবে তাঁর নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আগামী নির্বাচনে কোথায় যান, বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগের জন্য এরশাদ জীবনপাত করার পণ করলেও ওপক্ষের আশ্বাস পেলে আবার যে তিনি দলবদল করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে দুই হাজার একুশ সালের রূপকল্প দেখিয়েছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু কথায় কথায় ‘দেখে নেওয়া’ কিংবা হুমকিদাতাদের নিয়ে যে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাবে না তা হলফ করেই বলা যায়।
একজন নারী সাংসদ যদি নিজের নির্বাচনী এলাকায় নিজেকে নিরাপদ না ভাবতে পারেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে নিরাপদ ভাববে? নিরাপদ থাকবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments