পুঁজিবাজার : বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব বিভ্রান্তিকর by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

এই আলোচনায় যাওয়ার আগেCapital Market বা পুঁজিবাজারের সংজ্ঞা কী তা জানা প্রয়োজন। অর্থনীতির অভিধান অনুযায়ী Capital Market বলতে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদিLoan capital ছাড়া শেয়ার, ডিবেঞ্চার, বন্ড সব কিছুকে বোঝায়। আর যদি সিকিউরিটিজ মার্কেট বলতে চাই, তাহলে পরিধি সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে।


যেমন শেয়ার, ডিবেঞ্চার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইত্যাদি। এর আবার দুটো ভাগ রয়েছে, যথা প্রাইমারি মার্কেট ও সেকেন্ডারি মার্কেট। প্রাইমারি মার্কেট আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার বা অন্যান্য আর্থিক পত্র ছাড়া হয়। আর সেকেন্ডারি মার্কেট বলতে যেখানে শেয়ার, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয় হয়। একে স্টক এক্সচেঞ্জ বলা হয়। অতএব যেকোনো সংজ্ঞা অনুযায়ী এটি মার্কেট বা বাজার। একে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলাও ভুল। কেননা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মকাণ্ড রয়েছে, যেমন লিজ ফাইন্যান্স কিংবা মার্জিন লোন। স্টক এক্সচেঞ্জের ফ্লোর শেয়ার কেনা-বেচা হয় কিছু নিয়ম-নীতির মাধ্যমে। যেহেতু প্রত্যক্ষ টাকা-পয়সার ব্যাপার, তাই বেশ কড়া নিয়মের মাধ্যমে শেয়ারবাজার পরিচালনা করা হয়ে থাকে। তার পরও তো বাংলাদেশে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে ভয়াবহ শেয়ার কেলেংকারি হলো। বহু বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হলেন। শেয়ারবাজার বা স্টক এক্সচেঞ্জ কোনো পুঁজি সরবরাহ করতে বা কোনো অনুদান দিতে পারে না। এর পক্ষে যে কথাটা বলা চলে, তা হলো শেয়ারবাজার সক্রিয় থাকলে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা আইপিওর মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহে উৎসাহী হবেন। আর স্টক এক্সচেঞ্জের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে প্রাইমারি মার্কেট থেকে। অবশ্য বলা যেতে পারে যে আইপিওতে না গিয়ে কোনো কম্পানি সরাসরি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে পারে। এটা সুস্থ নিয়ম নয়। এমনকি এ ক্ষেত্রেও স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা খুব সীমিত। যে কম্পানি প্রত্যক্ষভাবে তালিকাভুক্ত হবে, তার পরিচালকরা ঠিক করবেন যে কত টাকার শেয়ার বিক্রি করা হবে। আমাদের এখানে গত মহাধসের আগে যে দু-একটি কম্পানি প্রত্যক্ষভাবে তালিকাভুক্ত হয়েছিল, সেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীর অর্থ লুট করে নেওয়া হয়েছে বলে অত্যুক্তি হবে না। আইপিওর মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে যে অর্থ ওঠানো হয়, প্রসপেক্টাসে দেখাতে হয় যে কী উদ্দেশ্যে সেটি ব্যয় করা হবে। হতে পারে সে কম্পানির ঋণ শোধ করা হবে অথবা কম্পানির উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো হবে। এতে কম্পানির মুনাফা বাড়বে যার সুফল ভোগ করবেন কম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা। আর উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে জিডিপি বাড়বে। প্রকৃতপক্ষে দেশের সাধারণ নাগরিকের সঞ্চয়কে জাতীয় উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার একমাত্র রাস্তা হলো আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার, ডিবেঞ্চার বা বন্ড ছাড়া। প্রত্যক্ষ লিস্টিংয়ের মাধ্যমে যাঁরা শেয়ার বিক্রি করেন, তাঁরা কোনো ব্যাখ্যা দেন না যে তাঁরা এ টাকা দিয়ে কী করবেন?
একই ভাবে স্টক এক্সচেঞ্জে যে লেনদেন, সেটা ক্রেতা-বিক্রেতার নিজস্ব ব্যাপার। তাঁরা তাঁদের অর্থ উৎপাদনের জন্য ব্যয় করবেন, নাকি নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য ব্যয় করবেন সেটা তাঁরা জানেন। অতএব সরকারের বা কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ঋণ দেওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ারবাজারে যে ধস নেমেছিল এবং যাকে The Great crush বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তার অন্যতম কারণ ছিল ফেডারেল রিজার্ভের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক) মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে জনগণের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে আসে। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত মার্কিন কূটনীতিক এবং অর্থনীতিবিদ Mr. Galbraith তাঁর The great crush বইতে লিখেছেন �The funds that the Federal Research made available were either invested in common stock or (and more important) they become available to help finance the purchase of common stocks by others. So provided with funds people rushed into the market.� Mr. Galbraithg আরো বলেছেন, �that people will speculate if only they can get the money to finance it.� স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনকৃত অর্থ কে কিভাবে ব্যয় করেন, তা যখন জানা যায় না, তখন সেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংক অর্থ জোগান দেবে অথবা সরকার অর্থায়নের জন্য তহবিল গঠন করবে কেন? শেয়ার বিনিয়োগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত হয়। সে জন্য মার্চেন্ট ব্যাংক যে মার্জিন লোন দিয়ে থাকে, তা প্রতিদিন অথবা নিদেনপক্ষে সপ্তাহান্তে সমন্বয় করতে হয়।
এবার আমি ২০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি সরকারের কাছে। বলা হয়েছে, এতে পুঁজিবাজারের অস্থিরতা দূর হবে। ব্যাপক অর্থে যদি পুঁজিবাজারকে ধরা হয়, তাহলে অস্থির বা স্থির থাকার প্রশ্ন ওঠে না। আর যদি শুধু স্টক এক্সচেঞ্জকে বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয় যে এ অস্থিরতা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
১৯৯৬ ও ২০১০ সালে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং কারা এ রকম করেছিলেন, সবই তো তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। শেয়ার নিয়ে যেকোনো আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত একটা, আর সেটা হলো যে এ ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। তা না বলে শেয়ার ব্যবসায়ীদের সরকারি উদ্যোগে ঋণ দেওয়া হোক, এটা কোনো সুস্থ অর্থনীতিবিদ বলতে পারেন না। অনেকের হয়তো মনে আছে যে ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেংকারির পর সংসদে এ নিয়ে আলোচনার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়ার প্রতি অশোভন উক্তি করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে আরেক সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে মহামানব বলা হয়েছিল। সেই সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকাকালে (২০০১-২০০৬) শেয়ারবাজার স্বাভাবিক গতিতে চলেছিল। দয়া করে সে সময়ের শেয়ারবাজারের রিপোর্ট দেখাবেন। এতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়নি। তখন জিডিপির বৃদ্ধির হার ঠিক ছিল। তাঁকে কেউ শেয়ারবাজার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে পারেনি। তিনি জানতেন, জাতীয় অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের ভূমিকা কী হতে পারে?
শেয়ারবাজারের বিপর্যয় দেখানোর জন্য মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের ফিগার উল্লেখ করা হয়। যেমন আগের দিনের চেয়ে পরের দিন মার্কেট ক্যাপিটাইলাইজেশনের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা কমে গেল, অমনি পত্রিকায় শিরোনাম হলো শেয়ারবাজার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা উধাও। এখনো তো শেয়ারবাজারের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের পরিমাণ ১৭৫ লাখ কোটি টাকার ওপর। অথচ সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দকৃত ৪৬ হাজার কোটি টাকা (২০১১-১২) জোগাড় করতে পারেনি। ওখান থেকে আনা যায় না। না, তা হয় না, কোনো মার্কেটে ক্যাপিটালাইজেশনের কোনো অন্তর্নির্হিত মূল্য নেই। শেয়ারের দৈনন্দিন মূল্যের গতি বোঝার জন্য এটি নিরূপণ করা হয়, যা মনে মনে কলা খাওয়ার মতো। সমস্যাটা এমনই হয় যখন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে দেশের জিডিপির ৩৪ শতাংশ শেয়ারবাজারে অর্থাৎ মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের পরিমাণ জিডিপির ৩৪ শতাংশের সমান। অথচ ৩৪ কেন ১০০ ভাগ হলে কী এসে যায়?
শেয়ারবাজারের বিষয়টা সরকার এবং কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী উল্টোদিক থেকে দেখছেন। বিভিন্নভাবে প্রাথমিক মার্কেটকে সক্রিয় রাখা দরকার। সরকারি, বেসরকারি উভয়পক্ষের লক্ষ্য হতে পারে যে তারা বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা পরিষেবা বা অবকাঠামো উন্নতির জন্য আইপিওর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করবে। এসব বিনিয়োগকারী ব্যক্তিগত প্রয়োজনে শেয়ার বিক্রির জন্য শেয়ারবাজারে যাবেন। আর একদল যাবেন শেয়ার ব্যবসার জন্য। অর্থাৎ তাঁরা কেনা-বেচা করার ফাঁকে দুই পয়সা কামাই করবেন। সরকারের সম্পৃক্ততা এখানে। আইপিওতে শেয়ার ছাড়ার জন্য সরকার কিছু প্রণোদনা দিয়েছে। প্রয়োজনবোধে আরো দিতে পারে। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কিংবা দায়দায়িত্ব বহন করার প্রশ্ন ওঠে না। অথচ কিছু ভুল বক্তব্য এবং বিভ্রান্তিকর আচরণের ফলে এমন একটা বার্তা চলে এলো যেন সরকার এবং স্টক এক্সচেঞ্জ এক হয়ে গেছে। ফলে ধস নামার পর সরকারের কাঁধে সব দোষ চাপানো হলো। কোথায় সরকার বিচারকের আসনে বসবে, তা না হয়ে তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো। পৃথিবীর আর কোথাও এ রকম নজির পাওয়া যাবে না।
বিশদ জানতে পারিনি, তবে পত্রিকা মারফত যা জানলাম, তা হলো ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড হবে; যা দিয়ে পুঁজিবাজারের অস্থিরতা বন্ধ করা যাবে। আবার মনে হচ্ছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের কথা বলা হয়েছে, চলতি বছরের বাজেটে এই খাতে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
পিপিপিতে প্রকল্পওয়ারি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেখানে আইপিওর কথা বলা যেতে পারে। তবে বাধ্য করা যেতে পারে না। আর সরকার যদি তার অংশ পাবলিকের মধ্যে শেয়ার হিসেবে ছাড়ে, সেটা ভিন্ন কথা। সেখানেও পার্টনারের সম্মতির প্রশ্ন ওঠে। মূল বিষয় একজন পার্টনার পাওয়া, শেয়ারবাজার গৌণ। দুটি জিনিস বোধগম্য হচ্ছে না। অনেক জ্ঞানী বলে আসছেন, প্রথম শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া। স্টক এক্সচেঞ্জে যা লেনদেনের রেকর্ড রয়েছে। যিনি কেনাবেচা করে থাকেন না কেন, তিনি তো জেনেশুনে করেছেন। তবে যদি ব্রোকার বা মার্চেন্ট ব্যাংক প্রতারণা করে থাকেও, সে ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যেতে পারে। পাইকারিভাবে যে ক্ষতিপূরণের কথা বলা হচ্ছে, সে টাকা কোথা থেকে আসবে? ব্যক্তিগতভাবে কেউ ব্যবসা করতে গিয়ে লোকসান হলে তার দায়িত্ব কে বহন করবে? তাহলে তো কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্ন সর্বাগ্রে আসে। তাদের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে পণ্যের বাজার মূল্য কম। অবশ্য সব আইটেমে নয়। কিন্তু ধানের মতো প্রধান পণ্যে বহু কৃষক লোকসান গুনেছেন। কৃষকরা কী কঠিন কায়িক পরিশ্রম করে থাকেন, তা সবার জানা। দ্বিতীয়ত, আরেকটি কথা বলা হয় তা হলো তারল্য সংকট। তারল্য সংকট হলে তা ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীর। বেশি মূল্যে শেয়ার কিনতে আসবেন কেন? আর এ রকম অনুৎপাদনশীল খাতে সরকার কিংবা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ দেওয়ার প্রশ্ন আসে না, এ কথা আগেও একবার উল্লেখ করেছি। অতএব সরকারের উদ্যোগে কোনো ফান্ড সৃষ্টি করে তা নানা কৌশলে সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যবসার জন্য বরাদ্দ করার পরামর্শ দেওয়া উচিত নয়।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.