নিঝুম দ্বীপের কান্না-২-মৃত্যুমুখে ৫০ হাজার হরিণ by নওশাদ জামিলনিঝুম দ্বীপের কান্না-২-মৃত্যুমুখে ৫০ হাজার হরিণ by নওশাদ জামিল

মেঘনার বুক থেকে ভেসে আসা হাওয়ার তোড়ে নুয়ে পড়েছিল কয়েকটি কেওড়াগাছ। ডাল-পাতাসহ গাছগুলো পেয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ে হরিণগুলো। প্রথমে আসে দু-একটি হরিণ, এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে। জঙ্গল থেকে হরিণগুলো বের হয়ে জমা হয় ওই কেওড়াগাছ ঘিরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ন্যাড়া হয়ে গেল গাছগুলো।


এভাবে কেওড়াপাতা পেলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে হরিণ। খাদ্যের জন্য এরা হন্যে হয়ে ঘোরে বনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে অভয়ারণ্যখ্যাত হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের প্রায় ৫০ হাজার হরিণ এখন মৃত্যুমুখে।
শুধু খাদ্য নয়, মিঠা পানির তীব্র সংকটও রয়েছে এখানে। ফলে খাদ্য ও মিঠা পানির জন্য হরিণ ছুটছে লোকালয়ে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে হরিণ ধরে পাচার করছে স্থানীয় অধিবাসী ও জলদস্যুরা।
হরিণের খাদ্য লতা-পাতা ও মিঠা পানি। নিঝুম দ্বীপে এখন এসবেরই ভয়াবহ সংকট। দ্বীপের চারদিকেই পানি। তবে তা লবণাক্ত। বনের ভেতরে ছোট-বড় অনেক খাল-নালা আছে। সেখানেও জোয়ারের সঙ্গে ঢুকছে লবণ পানি। ফলে তীব্র দাবদাহের এ মৌসুমে খাদ্য ও মিঠা পানির সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়েছে হরিণগুলো।
নিঝুম দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, হরিণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, মিঠা পানিও নেই। প্রাণ বাঁচাতে হরিণগুলো ছুটছে লোকালয়ে। পানি খেতে এসে প্রতিদিনই ধরা পড়ছে হরিণ। গত এক সপ্তাহে শতাধিক হরিণ লোকালয়ে এসে ধরা পড়েছে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান।
হরিণের খাদ্য ও মিঠা পানি সংকটের কথা স্বীকার করেন নিঝুম দ্বীপের বন বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা জাবের হোসেন। তিনি জানান, হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখানে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, অধিক হারে বসতি নির্মাণ ও বন উজাড় হওয়ার কারণে হরিণের খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া বনের পুকুর ও নালা ভরাটের ফলে মিঠা পানির তীব্র আকাল দেখা গেছে।
দ্বীপের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে, বনের বড় কেওড়া গাছগুলো কোনো রকমে বেঁচে আছে। ছোট কেওড়া, গেওয়া আর বাড়তে পারছে না। হরিণের দল সেগুলোকে বনসাই বানিয়ে দিয়েছে। নতুন চারাগাছ গজাতেই পারছে না, মুড়ে খেয়ে ফেলছে হরিণে। এ অবস্থায় তলার গাছপালা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত পর্যটন সম্ভাবনাময় উপদ্বীপের নাম নিঝুম দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে ওঠা এ দ্বীপে ১৯৭৩ সালে জনবসতি শুরু হয়। কেওড়া, গেওয়া ও বাইনগাছ বেষ্টিত এ দ্বীপে হরিণের উপস্থিতি ১৯৭৮ সাল থেকে। বর্তমানে ৩০ হাজার মানুষের সঙ্গে বসবাস করছে প্রায় ৫০ হাজার হরিণ।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নিঝুম দ্বীপের একটি মা হরিণ বছরে দুবার কমপক্ষে দুটি করে মোট চারটি বাচ্চা দেয়। আর নিঝুম দ্বীপে এখন প্রায় ১৫ হাজারের মতো মা হরিণ রয়েছে। এ হিসাবে প্রতিবছর ৬০ হাজারের মতো বাচ্চা জন্মানোর কথা। এর এক-তৃতীয়াংশ বেঁচে থাকলেও বছরে বৃদ্ধি পায় ২০ হাজার হরিণ। নিঝুম দ্বীপে বর্তমানে হরিণের প্রকৃত সংখ্যা বন বিভাগের জানা না থাকলেও এলাকাবাসীর মতে এ সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি।
নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহেরাজ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, এ দ্বীপের বনাঞ্চল, কাজিরবাজার, ঢালচর, চরকমলা, চরইউনুস ও চর আফতাবের বনাঞ্চল মিলিয়ে হরিণের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হবে। কিন্তু নিঝুম দ্বীপের বন বিভাগের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে জানান, নিঝুম দ্বীপের হরিণের সংখ্যা ৪০ হাজার হতে পারে। তবে প্রত্যেকে জানিয়েছেন, প্রতিবছর বাড়ছে হরিণ। হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপে হরিণের বিচরণক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে দেখা দিচ্ছে খাদ্য ও পানির সংকট।
হরিণ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন মাত্র সাত-আটজন প্রহরী। এ অবস্থায় স্থানীয় বন বিভাগ কিছু হরিণ অন্য বনে স্থানান্তরের চিন্তা করছে বলে জানান বন কর্মকর্তা জাবের হোসেন।
এদিকে লবণাক্ত পানিতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেক হরিণ। তবে দ্বীপের এসব হরিণের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বন বিভাগের কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই, নেই কোনো পশু হাসপাতালও। হাতিয়ার ওছখালীতে এনে এসব হরিণের চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে। দুর্যোগের সময় হরিণের আশ্রয় নেওয়ার মতো মাটির কোনো উঁচু কেল্লার ব্যবস্থাও নেই দ্বীপে। বিগত সময়ে বহু দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার হরিণ পানিতে ভেসে গেছে বলে বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
মানচিত্রে দেখতে চোখের মতো মনে হয় হাতিয়াকে। আর এ চোখ থেকে ঝরে পড়া একফোঁটা অশ্রু যেন নিঝুম দ্বীপ। বনের ভেতর মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, হরিণের আর্তনাদ। হয়তো খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে হরিণের সুন্দর চোখ থেকে ঝরছে অশ্রুবিন্দু। কিন্তু কেউ তার খোঁজ রাখে না।

No comments

Powered by Blogger.