সংকটের বড় উৎস বৈদেশিক খাত by মনজুর আহমেদ

আড়াই বছর আগের কথা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ প্রথমবারের মতো এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ঘটা করে তা উদ্যাপন করেছিল শেরাটন হোটেলে (বর্তমানে রূপসী বাংলা)। ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো গিয়ে পৌঁছে এক হাজার তিন কোটি ডলারে।


কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই চাপের মুখে পড়ে যায় রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক লেনদেনে পিছিয়ে পড়ে দেশ। প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমতে থাকে। প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স) দিয়েও এটা আর সামাল দেওয়া যায়নি। দেশ বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবেও পিছিয়ে পড়ে।
দেশে স্বীকার না করলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পেতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই এক চিঠিতে ১৮ মাস ধরে চলতে থাকা চাপের কথা বলেন। তার পরও আরও দুই মাস পার হয়েছে। অর্থনীতিতে এই যে সংকট-চাপ, তা উৎসারিত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে পিছিয়ে পড়ার কারণে।
আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি অন্যান্য বছরের চেয়ে গত দুই বছর একটু বেশি দ্রুত আগালেও বড় সংকট তৈরি হয় সরকার বিদেশ থেকে কোনো মূলধনি আয় আনতে না পারায়। জাতীয় বাজেটে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে যে অর্থ পাওয়ার আশা সরকার করেছিল, তা মেলেনি। কিন্তু প্রকল্পগুলোকে এগিয়ে নিয়েছে সরকার। মূলত ব্যাংক থেকে টাকা ধার করেই সরকার প্রকল্পের অর্থ জোগান দিয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা একদিকে যেমন আসেনি, অন্যদিকে ব্যাংক থেকে ধার করে সেই টাকায় সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে ব্যয় করেছে। এতে দুইভাবেই অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়ে।
বাজেটে বড় আশা থাকলেও বছরের পর বছর ধরে বৈদেশিক সাহায্যের অধিকাংশই অব্যবহূত থেকে গেছে। সক্ষমতার অভাব ও দুর্নীতির কারণে সেই অর্থ আনতে পারেনি সরকার। যেমন, পদ্মা সেতুর অর্থায়নে টাকা বিশ্বব্যাংক থেকে পাওয়া যায়নি। সরকার এখন বলছে, মালয়েশিয়ার কাছ থেকে অর্থ এনে নাকি পদ্মা সেতু গড়া হবে। কিন্তু, বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা এবং এখন পর্যন্ত যে আলোচনা রয়েছে তাতে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে ঋণ করলে সেই টাকার সুদের হারে বিরাট ব্যবধান থাকবে।
অব্যবহূত বৈদেশিক সাহায্য: আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন বছরে বৈদেশিক সাহায্যের অব্যবহারের নতুন নজির তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত হিসাবে পাইপলাইনে পড়ে রয়েছে এক হাজার ৬৬১ কোটি (১৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন) ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
সরকার নিজেই এ অর্থ ছাড় না করতে পারার কারণ বের করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে: ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প, কাগজপত্র যথাযথ তৈরি করতে ব্যর্থতা, জমি অধিগ্রহণ করতে না পারা, কাগজপত্র তৈরিতে ধীরগতি ইত্যাদি। আর উন্নয়ন-সহযোগীদের দিক থেকে অর্থ ছাড় না করার ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ ও পরামর্শক নিয়োগে ধীরগতি।
সাধারণভাবে প্রতিবছর পাইপলাইনে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলার আটকে পড়ে। কিন্তু, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে পাইপলাইনে জমতে থাকা অর্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে। চলতি বছরে এর পরিমাণ বেড়ে এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। দেশের বৈদেশিক লেনদেন যখন তীব্র চাপের মধ্যে, সরকারকে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে অর্থের জন্য ধরনা দিতে হচ্ছে, ঠিক এই সময়ে এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাইপলাইনে অব্যবহূত অবস্থায় পড়ে আছে।
লেনদেনের ভারসাম্য: চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে পণ্যবাণিজ্যে ঘাটতি সাড়ে ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর সেবা খাতের বাণিজ্য বিবেচনায় নিলে এই ঘাটতি সাড়ে ৮০০ কোটি ডলারের ওপরে। তবে বাণিজ্য ঘাটতিজনিত চাপ থাকার পরও জুলাই-মার্চ সময়ে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উদ্বৃত্তাবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নয় মাসে এই উদ্বৃত্ত হয়েছে ৪৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তার মানে হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এ সময়কালে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়কালে যেখানে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৫৭ কোটি ১০ লাখ ডলার, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এই বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, এবার বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার তুলনায় বাইরে বেশি চলে গেছে।
লেনদেনের ভারসাম্যে আরও দেখা যায়, জুলাই-মার্চ সময়ে আর্থিক হিসাবে ১২২ কোটি ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে লেনদেনের ভারসাম্যে ৪১ কোটি ৯০ লাখ ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫২ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
আইএমএফের পরের কিস্তি: সরকার আইএমএফকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ঋণ সাহায্য এনেছে। আগামী তিন বছরে সমান সাত কিস্তিতে আইএমএফের ঋণের পুরো অর্থ ছাড় করার কথা। এই ঋণের অর্থ ছাড় করাতে সরকারকে অনেক কঠিন শর্ত পালন করতে হবে। সংস্থার ওয়েবসাইটে ঋণ অনুমোদনের তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি ঋণ পেতে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে লেখা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আগ্রহপত্র, অর্থনৈতিক ও আর্থিক নীতিগুলোর স্মারক এবং কারিগরি সমঝোতা স্মারকসংবলিত একটি দলিল প্রকাশ করেছে। এই দলিলে সারের দাম বাড়ানোর অঙ্গীকার রয়েছে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বর নাগাদ জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কমাতে এ সময়ের মধ্যে একটি স্বয়ংক্রিয় ফর্মুলায় যাওয়ার কথা বলেছে সরকার।
পরিচালনা পর্ষদের সভার পর আইএমএফের ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্বে থাকা উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নায়োকি শিনোহারা বলেন, জ্বালানি তেলের দাম ও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারের সংকুলানমুখী মুদ্রানীতির কারণে ২০১০ সালের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর চাপ অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে ঋণ পাওয়ার তিন বছরে সরকারকে দেশের আর্থিক খাতে গতিশীলতা আনা, সম্পদের সংগ্রহ বাড়ানো, সামাজিক ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ঘাটতি কমিয়ে আনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, রপ্তানিমুখী বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য চারটি খাতে সংস্কার চালাতে হবে। এই চারটি খাত হলো: আর্থিক নীতি, মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার, আর্থিক খাত ও বিনিয়োগ খাত।
এসব কাজ শেষ করে ঋণের বাকি কিস্তিগুলো ছাড় করা নিয়ে এখনই সরকারের ভেতরে-বাইরে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.