বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪১৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা সফল যোদ্ধা ক্ষিপ্রগতিতে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলের (চার্লি [সি] কোম্পানি) নেতৃত্বে মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া।

তাঁদের লক্ষ্য, কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাহবাজপুর সেতু অনতিবিলম্বে দখল করা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত সরাইল উপজেলার পূর্বদিকে শাহবাজপুর।
মুক্তিযোদ্ধা সব মিলে এক ব্যাটালিয়ন শক্তি। অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও সেনাপ্রধান)। অগ্রাভিযানে মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া তাঁর দল নিয়ে একদম সামনে। তাঁদের অনুসরণ করছে আরও দুটি দল—আলফা ও ডেলটা কোম্পানি। দুই দলের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বিদ্যমান।
এই অভিযানে আছেন ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান) নিজেও। তাঁর সঙ্গে আছে ক্ষুদ্র একটি দল। তিনি যখন শাহবাজপুরের অদূরে ইসলামপুরে পৌঁছালেন, তখন একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। হঠাৎ সেখানে হাজির হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটি মিলিটারি ট্রাক। তাতে ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ১৫-১৬ জন সেনা।
মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া তখন তাঁর দল নিয়ে কিছুটা সামনে। ইসলামপুরে পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি ছিল একেবারে আশাতীত। কারণ, একদম পেছনে আরেকটি দল (ব্রাভো [বি] কোম্পানি) নিয়ে ছিলেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া (পরে মেজর জেনারেল)। তাঁদের ওপর দায়িত্ব, শত্রু পাকিস্তানি সেনারা যেন পেছন থেকে অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ না করতে পারে।
কে এম সফিউল্লাহ তাৎক্ষণিক পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা হাত উঁচু করে ট্রাক থেকে নেমেই গুলি শুরু করে। এক পাকিস্তানি সেনা (সুবেদার) তাঁর ওপর চড়াও হয়। এবং অগ্রসরমাণ নজরুল ইসলাম ভূঁইয়ার দলের ওপর আক্রমণ চালায়।
এমন সময় সেখানে বাসে করে হাজির হলো আরও কিছু পাকিস্তানি সেনা। তখন তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেল। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক এ এস এম নাসিম গুরুতর আহত হলেন। আক্রমণের তীব্রতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিশৃঙ্খল। তাঁর দলের চারটি প্লাটুনের মধ্যে অক্ষত শুধু একটি প্লাটুন। অন্যদিকে দুই অধিনায়ক পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে। তাঁরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। চরম বিপর্যয়কর অবস্থা।
মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া বিচলিত হলেন না। মাথা ঠান্ডা রেখে ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সতর্কতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। অক্ষত প্লাটুন নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। তাঁর সাহসিকতায় উজ্জীবিত হলেন সহযোদ্ধারা। শেষ পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর পর্যুদস্ত হয় সব পাকিস্তানি সেনা।
সেদিন মো. নজরুল ইসলামের সাহসিকতা ও বীরত্বে কে এম সফিউল্লাহ, এ এস এম নাসিমসহ অনেকের জীবন বেঁচে যায়। যুদ্ধে ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ১৪ জন বন্দী হয়। মুক্তিবাহিনীর দুজন শহীদ ও ১১ জন আহত হন।
মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার ফোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে আবার যুদ্ধে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২১।
মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই থেকে যান। লেফটেন্ট্যান্ট কর্নেল হিসেবে অবসর নেন। বর্তমানে জাতীয় সংসদ সদস্য। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার ডৌকার চর গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা—বাওয়াকুর, স্টেশন রোড, নরসিংদী। বাবার নাম আবদুল হাকিম, মা আকতারুন নেছা। স্ত্রী ফারজানা নজরুল। তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com