গোধূলির ছায়াপথে-জীবনটাই কৌতুক by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
জীবনটাই তো কৌতুক। পিতার মতো আমিও কৌতুকপ্রিয়। রবিউল ঢাকার ছবির প্রথম দিককার সফল কৌতুক অভিনেতা। শতাধিক ছবিতে তার হাস্যরস সৃষ্টির প্রতিভা আর্কাইভে পাওয়া যাবে। তার কৃতিত্ব: কুলোর মতো কান দুটোকে সে তালে তালে নাচাতে পারত। দিন কতক চেষ্টা করেও সফল হলাম না।
তবে একটা করতে গিয়ে পেলাম আরেকটি। নাক নাচাতে শিখলাম। এখনো পারি। কৌতুকাভিনেতা হলে নাক নাচিয়েই ভুবন নাচাতাম বৈকি। বাবু সুরঞ্জিত মওদুদকে বলেছেন, ‘গ্রেট জোকার’। মওদুদ হেসেই অস্থির। বললেন, মন্ত্রিসভাকে ‘কচিকাঁচার মেলা’ বলায় তাঁর পার্টিতেই সম্ভাষণটি সংগ্রহ করেছেন তিনি। দুজনকে গানের ঘরে পেলে গাইতাম: ‘ও তুই, যারে আঘাত হানলিরে মনে, সেজন কি তোর পর/ ও তুই ভোমর হয়া হানলি কাঁটা, সেই না ফুলের পর/ ওরে বন্ধু সেজন কি তোর পর’। সুরঞ্জিত তাঁর গাড়িতে একবার নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর গ্রামে। আর মওদুদ বাল্যবন্ধু।
মার্কিনপ্রবাসী মেয়ে সামিরা আর আমি যাচ্ছি রংপুর বাসে করে। ঢাকা না ছাড়তেই গাবতলীতে দেখি শ-দুয়েক শ্রমিক দাঁড়িয়ে কোদাল ও ঝুড়ি হাতে, সাতসকালে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যকর্ম প্রত্যাশায়। মেয়ে অবাক ও ব্যথিত। এঁদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা বাড়ি ফিরে যাবেন। ‘গিন্নি, আজ কাজ হয়নি’। গিন্নির গালে হাত, তাহলে উপায়? এক বেলা উপোস। জীবনকে নিয়ে বিধাতার একি কৌতুক।
গাবতলীতে আরও ছিল সদ্যছিলানো শসা। ঢাকাইয়া পোলা কাছাকাছি এসে বলল: ‘ছিইল্যা লবণ লাগাইয়া দিমু’। কৌতুক হলেও বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। যতই যাচ্ছি রংপুরের দিকে, সবুজ শ্যামল সুন্দর দৃশ্যাবলি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। নতুন শহরে আসতেই চোখে পড়ে কর্মপ্রত্যাশীর কোদাল, ঝুড়ি, শুকনো মুখ। রাজনীতি ও আশপাশের লোকজনদের দেখার জন্য টেলিভিশনের টক শোগুলোতে চোখ রাখেন সবাই। পোশাক, বাক্যালাপ গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখছেন ঢাকা-রাজশাহী-লন্ডন-নিউইয়র্ক-সিডনিতে অপেক্ষারত বাঙালি দর্শক। কৌতুকের আবরণে বিভাষিত একেকজনের বক্তব্য। আওয়ামী লীগকে কেউ ধুয়ে দিচ্ছেন; কেউ বিএনপিকে, কেউ জামায়াতকে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন সেন্ট্রাল জেলে। কেউ অনর্থের মূল শনাক্ত করে বাতিল করে দিতে চাচ্ছেন ধর্মটিকেই। জামাতা আশরাফ কায়সারের এত ভক্ত জানা ছিল না। নিউইয়র্কে বাঙালিরা দল বেঁধে শুনছেন ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’র শো। রাজনীতির ও আশপাশের কুশীলব প্রতিদিন শোনাচ্ছেন নতুন নতুন কাহিনি।
অথচ রংপুর অথবা কুড়িগ্রামে পৌঁছে দেখি যে তিমিরে সেই তিমিরেই আমরা। বয়স্ক লোকগুলো লেংটি পরে, এক বেলা খেয়েছে, আরেক বেলার খবর নেই। এদের কাছে সুরঞ্জিত-মওদুদ-আবুল বারাকাতের সুভাষিত বক্তব্য মূল্যহীন। ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় গিয়েছিলাম ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে গান শুনতে ফেরদৌসী-নাশিদ ও আমি। পথে রাস্তাজুড়ে লম্বা প্রসেশন। ভাগ্যবিড়ম্বিত না-খাওয়া লোকগুলো ছুটে এসেছে রাজধানী কলকাতায়। প্ল্যাকার্ডে ছোট লেখা: ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’। হায়রে! কবে দুই বঙ্গের নিরন্নের মুখে জুটবে অন্ন, বস্ত্রহীনের কাছে পৌঁছাবে কাপড়, কমলাপুরের সহস্র ঘরহীন মানুষের জুটবে ঘর, কবে গাইব তৃপ্তিভরে স্বাধীনতার গান।
বলি এবার রংপুরে হাটুরেদের কথা। সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, বেশির ভাগ বয়স্ক। বললেন, রংপুর বিভাগ হয়েছে নামেই। কোনো কিছুই নতুন চোখে পড়েনি। কেরামতুল্লা শাহের মাজারে বসে আছেন ভোরের নামাজ শেষে কয়েকজন। বললেন, ধর্মের গভীরে কেউ ঢুকতে চায় না, বেশির ভাগ খোলস নিয়ে ব্যস্ত। তবে বাঁচোয়া এই যে ধর্মের শিকড় অনেক গভীরে, এর উত্পাটন কেয়ামতের আগে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মুন্সিপাড়ায় কবরস্থানে খুঁজতে যাই পিতৃবন্ধু মোশাররফ হোসেন প্রধান, রংপুরের শ্রেষ্ঠ সন্তান খেরাজ আলী, তাঁর ছেলে রংপুরে আব্বাসউদ্দীন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা মকবুল আলী ও কোচবিহারে ফেলে আসা স্বজনদের কবর। এরশাদের বাবা-মাও। সেখানে দুই বন্ধু তর্ক জুড়ে দিয়েছেন ভিন্ন বিষয়ের ওপর, তা হলো ইরানের ওপর পশ্চিমের রণহুংকার। হাতে আমার তসবি ও টুপি দেখে তর্কে যোগদানের অনুপযুক্ত মনে করলেন ওঁরা। কেমন করেই বা জানবেন যে গত বছর প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছি আমি। ইরানকে সামরিকভাবে স্পর্শ করা হবে মারাত্মক ভুল, মেসেজটি পৌঁছাতে চেষ্টা করেছি ওয়াশিংটনে।
রংপুর সেন্ট্রাল রোটারি ক্লাবের ইনস্টলেশন সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতার আগে প্রচুর বক্তা। সমাগত অতিথিরা বক্তৃতার চেয়ে গানে আগ্রহী। সামিরা গাইলেন কয়েকটি গান। ঘড়ি এগিয়েই চলেছে। বললাম: বক্তৃতা একটিই, দলাদলি ভুলে যাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে যাই। নতুন করে গাই পুরোনো গান। দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র দিলীপকুমার রায় [নজরুলের বন্ধু], যে সুরে গানটি গাইতেন তা আমার জানা, একটু দুলকি চালে। সবাই গাইলাম: ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা..., ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ/ ও মা তোমার চরণ দুটি, বক্ষে আমার ধরি’।
জীবন তো ক্ষণিকের, ক্ষণটুকু পেরোলেই চলে যাব কোন পার থেকে কোন পারে, নবী বলছেন। তাঁর আহ্বান মিলেমিশে চলার, সবার মতামত শোনার পর অভীষ্ট যাত্রাপথ নির্ধারণের। তুলাদণ্ডের বরখেলাপ যেন না হয়। ‘আদ্যগুরু পিতারে মাতা জনম দাতা বাপে ....’ উত্তরাঞ্চলের পালাগানের প্রথমাংশ। পিতাকে জেনেছি আদ্যগুরু। দীর্ঘদিন বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে করেছেন কৌতুক। প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন: কবি গোলাম মুস্তাফা, জসীমউদ্দীন, বরকত উল্লাহ, ইব্রাহিম খান, বেদারউদ্দিন, আবদুল লতিফ, সোহরাব হোসেন, আবদুল আহাদ, সমরদাস, আজিজুর রহমান, আসাদুদ্দৌলা শিরাজী, ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা, আবদুল করিম, এম এ আজম, নাজির আহমেদ, ফতেহ লোহানী ও আরও অনেকে।
কোনো কিছুতেই বিচলিত নই। জীবনটাই কৌতুক।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
মার্কিনপ্রবাসী মেয়ে সামিরা আর আমি যাচ্ছি রংপুর বাসে করে। ঢাকা না ছাড়তেই গাবতলীতে দেখি শ-দুয়েক শ্রমিক দাঁড়িয়ে কোদাল ও ঝুড়ি হাতে, সাতসকালে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যকর্ম প্রত্যাশায়। মেয়ে অবাক ও ব্যথিত। এঁদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা বাড়ি ফিরে যাবেন। ‘গিন্নি, আজ কাজ হয়নি’। গিন্নির গালে হাত, তাহলে উপায়? এক বেলা উপোস। জীবনকে নিয়ে বিধাতার একি কৌতুক।
গাবতলীতে আরও ছিল সদ্যছিলানো শসা। ঢাকাইয়া পোলা কাছাকাছি এসে বলল: ‘ছিইল্যা লবণ লাগাইয়া দিমু’। কৌতুক হলেও বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। যতই যাচ্ছি রংপুরের দিকে, সবুজ শ্যামল সুন্দর দৃশ্যাবলি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। নতুন শহরে আসতেই চোখে পড়ে কর্মপ্রত্যাশীর কোদাল, ঝুড়ি, শুকনো মুখ। রাজনীতি ও আশপাশের লোকজনদের দেখার জন্য টেলিভিশনের টক শোগুলোতে চোখ রাখেন সবাই। পোশাক, বাক্যালাপ গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখছেন ঢাকা-রাজশাহী-লন্ডন-নিউইয়র্ক-সিডনিতে অপেক্ষারত বাঙালি দর্শক। কৌতুকের আবরণে বিভাষিত একেকজনের বক্তব্য। আওয়ামী লীগকে কেউ ধুয়ে দিচ্ছেন; কেউ বিএনপিকে, কেউ জামায়াতকে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন সেন্ট্রাল জেলে। কেউ অনর্থের মূল শনাক্ত করে বাতিল করে দিতে চাচ্ছেন ধর্মটিকেই। জামাতা আশরাফ কায়সারের এত ভক্ত জানা ছিল না। নিউইয়র্কে বাঙালিরা দল বেঁধে শুনছেন ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’র শো। রাজনীতির ও আশপাশের কুশীলব প্রতিদিন শোনাচ্ছেন নতুন নতুন কাহিনি।
অথচ রংপুর অথবা কুড়িগ্রামে পৌঁছে দেখি যে তিমিরে সেই তিমিরেই আমরা। বয়স্ক লোকগুলো লেংটি পরে, এক বেলা খেয়েছে, আরেক বেলার খবর নেই। এদের কাছে সুরঞ্জিত-মওদুদ-আবুল বারাকাতের সুভাষিত বক্তব্য মূল্যহীন। ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় গিয়েছিলাম ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে গান শুনতে ফেরদৌসী-নাশিদ ও আমি। পথে রাস্তাজুড়ে লম্বা প্রসেশন। ভাগ্যবিড়ম্বিত না-খাওয়া লোকগুলো ছুটে এসেছে রাজধানী কলকাতায়। প্ল্যাকার্ডে ছোট লেখা: ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’। হায়রে! কবে দুই বঙ্গের নিরন্নের মুখে জুটবে অন্ন, বস্ত্রহীনের কাছে পৌঁছাবে কাপড়, কমলাপুরের সহস্র ঘরহীন মানুষের জুটবে ঘর, কবে গাইব তৃপ্তিভরে স্বাধীনতার গান।
বলি এবার রংপুরে হাটুরেদের কথা। সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, বেশির ভাগ বয়স্ক। বললেন, রংপুর বিভাগ হয়েছে নামেই। কোনো কিছুই নতুন চোখে পড়েনি। কেরামতুল্লা শাহের মাজারে বসে আছেন ভোরের নামাজ শেষে কয়েকজন। বললেন, ধর্মের গভীরে কেউ ঢুকতে চায় না, বেশির ভাগ খোলস নিয়ে ব্যস্ত। তবে বাঁচোয়া এই যে ধর্মের শিকড় অনেক গভীরে, এর উত্পাটন কেয়ামতের আগে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মুন্সিপাড়ায় কবরস্থানে খুঁজতে যাই পিতৃবন্ধু মোশাররফ হোসেন প্রধান, রংপুরের শ্রেষ্ঠ সন্তান খেরাজ আলী, তাঁর ছেলে রংপুরে আব্বাসউদ্দীন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা মকবুল আলী ও কোচবিহারে ফেলে আসা স্বজনদের কবর। এরশাদের বাবা-মাও। সেখানে দুই বন্ধু তর্ক জুড়ে দিয়েছেন ভিন্ন বিষয়ের ওপর, তা হলো ইরানের ওপর পশ্চিমের রণহুংকার। হাতে আমার তসবি ও টুপি দেখে তর্কে যোগদানের অনুপযুক্ত মনে করলেন ওঁরা। কেমন করেই বা জানবেন যে গত বছর প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছি আমি। ইরানকে সামরিকভাবে স্পর্শ করা হবে মারাত্মক ভুল, মেসেজটি পৌঁছাতে চেষ্টা করেছি ওয়াশিংটনে।
রংপুর সেন্ট্রাল রোটারি ক্লাবের ইনস্টলেশন সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতার আগে প্রচুর বক্তা। সমাগত অতিথিরা বক্তৃতার চেয়ে গানে আগ্রহী। সামিরা গাইলেন কয়েকটি গান। ঘড়ি এগিয়েই চলেছে। বললাম: বক্তৃতা একটিই, দলাদলি ভুলে যাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে যাই। নতুন করে গাই পুরোনো গান। দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র দিলীপকুমার রায় [নজরুলের বন্ধু], যে সুরে গানটি গাইতেন তা আমার জানা, একটু দুলকি চালে। সবাই গাইলাম: ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা..., ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ/ ও মা তোমার চরণ দুটি, বক্ষে আমার ধরি’।
জীবন তো ক্ষণিকের, ক্ষণটুকু পেরোলেই চলে যাব কোন পার থেকে কোন পারে, নবী বলছেন। তাঁর আহ্বান মিলেমিশে চলার, সবার মতামত শোনার পর অভীষ্ট যাত্রাপথ নির্ধারণের। তুলাদণ্ডের বরখেলাপ যেন না হয়। ‘আদ্যগুরু পিতারে মাতা জনম দাতা বাপে ....’ উত্তরাঞ্চলের পালাগানের প্রথমাংশ। পিতাকে জেনেছি আদ্যগুরু। দীর্ঘদিন বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে করেছেন কৌতুক। প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন: কবি গোলাম মুস্তাফা, জসীমউদ্দীন, বরকত উল্লাহ, ইব্রাহিম খান, বেদারউদ্দিন, আবদুল লতিফ, সোহরাব হোসেন, আবদুল আহাদ, সমরদাস, আজিজুর রহমান, আসাদুদ্দৌলা শিরাজী, ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা, আবদুল করিম, এম এ আজম, নাজির আহমেদ, ফতেহ লোহানী ও আরও অনেকে।
কোনো কিছুতেই বিচলিত নই। জীবনটাই কৌতুক।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments