জিএম বীজ-হাইতিতে কারসাজি ভেস্তে গেছে by ফরিদা আখতার

শাবাশ হাইতির কৃষক, সালাম জানাই আপনাদের। এই বছরের শুরুতে ১২ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে কাছের একটি দেশ হাইতিতে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। আমাদের খুব মনে আছে সেই ভয়ানক দৃশ্য। ঘরবাড়ি চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিল, মানুষ মারা গিয়েছিল লাখে লাখে। যারা বেঁচে ছিল তাদের দুর্দশা দেখে আরও কষ্ট লেগেছে।


টেলিভিশনে এবং পত্রপত্রিকায় ছবি দেখে ও প্রতিবেদন পড়ে বিশ্বের মানুষের মন কেঁদেছিল। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তারা। খাদ্য, ওষুধ, কাপড়সহ জরুরি সব ধরনের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিল বিশ্বের মানুষ। একই সময়ে অনেক দেশে রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠেছিল, এই ভূমিকম্প কেন হলো? কেনই বা ভূমিকম্প হতে না হতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এটা কি তাঁদের নেহাত মানবতাবোধ, নাকি অন্য কিছু? ঠাকুর ঘরে কে রে...। প্রশ্ন উঠেছিল, এই ভূমিকম্প কি প্রাকৃতিক, নাকি এর সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহারের কোনো সম্পর্ক আছে? অবশ্য যাঁরা এই প্রশ্ন তুলেছেন, বিশেষ করে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, তাঁদের অনেক হুমকিরও সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমন কথাও নাকি বলা যাবে না। সে যাক।
দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পরও হাইতির মানুষের দরদির অভাব হয়নি। হাইতির কৃষকদের উপহার হিসেবে ৪৭৫ টন জিএম বীজ উপহার দেওয়ার জন্য বহুজাতিক জিএম বীজ ও কীটনাশক কোম্পানি মনসান্তো এগিয়ে এল। শুধু জিএম বীজ নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব সার ও কীটনাশক মিলে একটি উপহার উইনার প্রজেক্ট নামের একটি সংগঠন মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে হাইতির সরকারকে হস্তান্তর করার পরিকল্পনা করে। মনসান্তো প্রচার করতে থাকে যে এটা তাদের নেহাত উদারভাবে দেওয়া ‘উপহার’ বা গিফট। কিন্তু সবাই জানে এই পেটেন্ট করা বীজ থেকে ফসল হলে হাইতির কৃষকদের মনসান্তোকে রয়ালটি দিতে হবে। অর্থাৎ গুনে গুনে ডলার দিতে হবে। উপহার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও ব্যবসায়িক কাজ হিসেবে মনসান্তো হাইতির কয়েকটি এলাকায় জিএম ভুট্টা বীজ দিতে শুরু করেছে। এমন একটি বিশাল দুর্যোগের পর মনসান্তোর এই কর্মকাণ্ডের কারণে হাইতির কৃষকদের স্বাধীনভাবে ফসল উৎপাদনের অধিকার বলে আর কিছু থাকবে না। হাইতির পরিবেশবিদেরা এই উদ্যোগকে দ্বিতীয় ভূমিকম্প বলে আখ্যায়িত করেন।
তা ছাড়া এই উপহারের মধ্যে আরও একটু কিন্তু আছে। কৃষকেরা বুঝেছেন যে একবার এই বীজ ব্যবহার করে নিভরশীল হয়ে পড়লে এই বীজের সরবরাহকারী একমাত্র মনসান্তোই থাকবে। উপহার তো একবারই দেবে, পরে কৃষকের পকেট থেকেই কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার মনসান্তোর কাছে উপহার যাবে!
মনসান্তোর জন্য আফসোসের বিষয় হচ্ছে হাইতির কৃষকেরা মনসান্তোর এই বদান্যতায় মুগ্ধ হতে পারেননি। তাঁরা এই উপহারের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ তাঁরা মনসান্তোর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানেন, বিশেষ করে মনসান্তো এমন সব বিষাক্ত আগাছানাশক উৎপাদন করেছে, যার প্রভাব দীর্ঘদিন থেকে যায়। যেমন গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় গেরিলাদের মারার জন্য এজেন্ট অরেঞ্জের (Agent Orenge) প্রস্তুতকারক হিসেবে মনসান্তো যে ভূমিকা রেখেছে, হাইতির মানুষ তা জানে। ভিয়েতনাম সরকারের দাবি অনুযায়ী এজেন্ট অরেঞ্জের কারণে সেই সময় চার লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল কিংবা পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল এবং পাঁচ লাখ বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিয়েছে।
মনসান্তোর এই উপহারের মধ্যে জিএম ভুট্টা এবং জিএম টমেটো বীজ রয়েছে। জিএম ভুট্টাকে Maxim XO নামের fungicide বা ছত্রাকনাশক এবং টমেটো বীজে thiram নামের অতি বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান দ্বারা ট্রিট করা হয়েছে। এগুলো অতি ক্ষতিকর এবং তাই প্রতিরোধক পোশাক ছাড়া এই বিষ ব্যবহার করা যায় না, যা কৃষকের পক্ষে করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। কাজেই হাইতির কৃষকেরা জেনেশুনে এমন বিষাক্ত বীজ নিতে আগ্রহী নন। তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় দয়ার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। হাইতির কৃষক নেতা সাবানেজ জিন-ব্যাপ্টিস্টে আইপিএস নিউজ -এর কাছে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের স্থানীয় বীজ রক্ষা করতে চাই এবং কৃষকের জমির ওপর অধিকার রক্ষা করাও আমাদের কর্তব্য। হাইব্রিড এবং জিএমওর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমাদের দেশের ফসলের বৈচিত্র্য এবং কৃষিকে রক্ষা করতে হবে।’
কৃষকদের কথা হচ্ছে, বীজ ও পানি মানবতার সম্পদ। এই বীজ ও পানি নিয়ে কেউ ব্যবসা করবে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ বর্তমানে মাত্র গুটি কয় বহুজাতিক কোম্পানি যেমন মনসান্তো, সিনজেন্তা, ডু-পন্ট এবং বায়ার বিশ্বের বীজ ব্যবসার অর্ধেকেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে। মনসান্তো ইতিমধ্যে তুলা, ভুট্টা এবং সয়াবিনের ওপর ৬৫০টি পেটেন্ট নিয়েছে।
এ ঘটনায় বিরক্ত হয়ে পাপায় কৃষকেরা আন্দোলন করে ৬০ হাজার বস্তা (৪৭৫ টন) হাইব্রিড ভুট্টা ও সবজি বীজ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। http://www.foodsafetynews.com/2010/06/ haitian-farmers-burn-monsanto-hybrid-seeds/। হিনচে নামের একটি কৃষি শহরে কৃষকেরা লাল টি-শার্ট গায়ে দিয়ে মাথায় খড়ের হ্যাট পরে এই বীজগুলো প্রতীকীভাবে পুড়িয়ে দেন। http://planetgreen.discovery.com/food-health/whats-wrong-with-monsanto-helping-post-earthquake-haiti.html অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে জিএম বীজ আমদানির ব্যাপারে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মনে করেন, এর ফলে স্থানীয় জাতের বীজ ব্যবহার ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও হাইতিতে জিএমও ব্যবহারে কোনো আইনি বাধা নেই, তবুও হাইতির কৃষি মন্ত্রণালয় মনসান্তোর কাছে চিঠি দিয়ে রাউন্ড আপ-রেডি নিভরশীল বীজের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে জানতে চায়, তাদের দেওয়া বীজ জিএমও কি না। মনসান্তো এই চিঠির জবাবে আশ্বস্ত করেছে যে জিএম বীজ তারা দেবে না। শাবাশ!
হাইতির খাদ্য সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে নিজ দেশের উপযুক্ত খাদ্য উৎপাদন করার মতো খাদ্যনীতি প্রণয়ন করার দাবি উঠেছে। জিএম বীজ ব্যবহারের আগে মনে রাখতে হবে, একবার এই বীজ পরিবেশের মধ্যে ঢুকে গেলে তা যে ক্ষতি করে তা থেকে ফিরে আসা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তাই কৃষকদের এই সাবধানতা।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.