কণ্ঠস্বর-তালগাছটা আমার by রাহাত খান
আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের বক্তব্য, এসব দুঃসহ অভিজ্ঞতার কারণেই নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত সরকারের ওপর তাদের আস্থা নেই। আর বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত মনে করে, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে দলীয় সরকারের প্রতি তাদের আস্থা নেই।
আগে প্রত্যাখ্যান করলেও এখন হাবভাব দেখে মনে হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে তাদের
তেমন আপত্তি নেই
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই ইস্যুটি বেশ কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে রাজনীতির প্রধান বিরোধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের বাকি এখনও দেড় বছরের কাছাকাছি। আগে কখনও ইস্যুটিকে নির্বাচনের এত আগে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসরণ করে মহাজোট সরকারের গরিষ্ঠ অংশের সম্মতি ও অনুমোদনে নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে এই সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সাংঘর্ষিক বলে সাংঘর্ষিক! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি পার্লামেন্টে বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি এবং জামায়াত যেন প্রাণ ফিরে পেল। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের বিপক্ষে টুকরা-ফাকরা দু'একটি ইস্যু ছাড়া আন্দোলন করার মতো আর কোনো ইস্যু ছিল না। দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির দরুন জনদুর্ভোগ বিরাজমান। তবে মুশকিল হচ্ছে সেটা আগের তুলনায় অনেক কম। বিএনপি-জামায়াতের বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি ও জনদুর্ভোগ নিয়ে কথা বলার আরও উপায় নেই এ জন্য যে, তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ের দুই টার্মের কোনো টার্মেই এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎও তারা উৎপাদন করেনি। কেন করেনি সেটা বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের একটা প্রশ্ন। উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করাসহ সব অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতারই কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বিদ্যুৎ। দুই টার্মের দীর্ঘ দশ বছরে বিএনপি-জামায়াত কেন বাংলাদেশের মতো দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশের জন্য এক কিলো বিদ্যুৎও উৎপাদন করল না_ এটা এক রহস্য। এই রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার আশঙ্কা। তাই সম্ভবত বিদ্যুৎজনিত কারণে জনদুর্ভোগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে তেমন ট্যাঁ-টুঁ করে না।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ইস্যু হিসেবে দুর্নীতি? হ্যাঁ, বর্তমান সরকারের আমলে সর্বস্তরে দুর্নীতি বিরাজমান। তবে দুর্নীতির বিশ্ব রেকর্ড তো হাওয়া ভবন তথা বিএনপির করা। এই ইস্যু নিয়ে বেশি নড়াচড়া করার বিপদ আছে। বিএনপি-জামায়াত সেটা বিলক্ষণ জানে। আর থাকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে পাল্টা যে বক্তব্য আসবে, জঙ্গিবাদ, রাজনীতিক হত্যা, গুম, ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট, ঘাটে ঘাটে চাঁদা আদায় ইত্যাদি_ সেই বক্তব্য বিএনপি-জামায়াতের জন্য খুব একটা সুখপ্রদ হবে না।
জুৎসই ইস্যু না পেয়ে বিএনপি-জামায়াত বাস্তবিকই খুব উদ্বেগ-দুশ্চিন্তায় ছিল। তাদের হাতে কত কাজ! 'বেচারা সব যুদ্ধাপরাধী'কে বাঁচাতে হবে! হাইতির বেবিডকের বাংলাদেশি কাউন্টার পার্টকে করতে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী! তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে, পাশাপাশি চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে নানা কায়দায় নন-কানেকটিভিটি বা বিচ্ছিন্নতার যে একটি কঠিন দেয়াল বিএনপি-জামায়াত তুলেছিল, সেই দেয়াল যে ক্রমে ক্রমে ভেঙে ফেলছে আওয়ামী লীগ তথা বর্তমান মহাজোট সরকার! ভারত এবং বিশ্ব-সংশ্লিষ্টতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি প্রবলভাবে উপকৃত হয়, তাহলে বিএনপি-জামায়াতের কারও চাকরি থাকবে! দেশও যে মহাবিপদে আছে সেটি বিএনপি-জামায়াত ছাড়া বোঝে ক'জন! কাজেই সরকারের বিপক্ষে আন্দোলনে নামার, আন্দোলনে নেমে বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি তছনছ করে তোলার, দেশকে একটা ভীতিকর অচলাবস্থার দিকে নেওয়ার একটা জুৎসই ইস্যু চাইছিল বিএনপি-জামায়াত। সেই ইস্যু তারা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে। মক্কেলের নাম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার!
বর্তমান সরকারের আমলে নিজেদের নির্দলীয়, নিরপেক্ষ শক্তিশালী অবস্থান ধারাবাহিকভাবে প্রতিপন্ন করে চলেছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন। শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বাধীনে সম্পন্ন হওয়া সিটি করপোরেশন, পৌর, উপজেলা, ইউনিয়ন ও উপনির্বাচনগুলোতে বিএনপি যে আওয়ামী লীগের প্রায় সমানসংখ্যক আসনে জয়ী হয়েছে, সেটি নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী অবস্থান এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বর্তমান মহাজোট সরকারের কোনোরকম হস্তক্ষেপ না করার কারণেই সম্ভব হয়েছে। কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আমলেও একই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ধারা বহাল রয়েছে। এর পরও বিএনপি শামসুল হুদা ও রকিবউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা একটি সোনার হরিণ চায়। সোনার হরিণটির নাম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশের একটি বৃহৎ পত্রিকা-গোষ্ঠীকেন্দ্রিক তথাকথিত সুশীল সমাজও ইশারা-ইঙ্গিতে নির্দলীয়, অনির্বাচিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই নির্বাচনের আগে অধিষ্ঠিত দেখতে চায় বলে মনে হয়। বাংলাদেশে সদ্য বিদায় নেওয়া এবং সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ। অতীতে এবং বর্তমানে এই বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
নির্বাচন করার কথা নির্বাচন কমিশনেরই। নির্বাচনকালীন তিন মাস স্থায়ী সরকারের কাজ নির্বাচন কমিশনকে তার চাহিদা ও ইচ্ছা মোতাবেক সাহায্য-সহযোগিতা জুগিয়ে যাওয়া এবং সরকারের প্রাত্যহিক রুটিন কাজগুলো করে যাওয়া। নির্বাচনের সময়কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমনকি কোনো পলিসিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ারও বিধান নেই। বাংলাদেশ ছাড়া দুনিয়ার সব দেশেই এই নিয়ম চালু রয়েছে।
নির্বাচন করবেই নির্বাচন কমিশন। তাহলেও নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছে কেন? ১৯৯৬ সালে এই দাবি তুলেছিল আওয়ামী লীগ। ২০১২ সালে এই দাবি তুলেছে বিএনপি-জামায়াত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি তুলে দিয়েছে সুপিীম কোর্টের রায় বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার কারণে। তারা এখন একদা তাদের সেই সোনার হরিণটি আর চাইছে না। অভিজ্ঞতার আলোকে আওয়ামী লীগ দেখেছে, গণআন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে বিএনপি পার্লামেন্টে এককভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি এমনভাবে করেছিল, যাতে এই নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার ইচ্ছা করলে আমলা ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় সংবিধানের ঊধর্ে্ব উঠে যেতে পারে, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিতে পারে, দেশের পলিসিগত সিদ্ধান্ত নিতেও কোনো বাধা থাকবে না তাদের।
আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা কল্পনাপ্রসূত কিছু নয়। সেটা আমরা গত কয়েকটি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেছি বৈকি। সংবিধানের ঊধর্ে্ব উঠে গিয়ে, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিয়ে কয়েকটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাজে-কর্মে প্রায় দানবীয় হয়ে উঠেছিল। ব্যতিক্রম শুধু বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং সাবেক প্রশাসন সদস্য আবু হেনা। বাকি সবাই বিশেষ করে বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন তো স্বেচ্ছাচারিতা, ষড়যন্ত্র এবং দানবীয় কর্মকাণ্ডের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির ইয়েসউদ্দিনের আমলে করা প্রায় এক কোটি ভুয়া ভোট বাতিল করে নতুন ভোটার লিস্ট ও আইডি কার্ড প্রবর্তন করে একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে দিতে সমর্থ হয়েছিল বটে, সেই নির্বাচন গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছিল। তবে ফখরুদ্দীন সরকার তিন মাসের জায়গায় দু'বছর ক্ষমতায় থেকে নির্বিচার দুর্নীতি, রাজনীতি ধ্বংস এবং রাজনীতিক-নির্যাতনের যেসব কর্মকাণ্ড করেছে তা যে কোনো বিচারেই হিংস্র ও দানবীয় বলে প্রতিপন্ন হতে পারে।
আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের বক্তব্য, এসব দুঃসহ অভিজ্ঞতার কারণেই নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত সরকারের ওপর তাদের আস্থা নেই। আর বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত মনে করে, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে দলীয় সরকারের প্রতি তাদের আস্থা নেই। আগে প্রত্যাখ্যান করলেও এখন হাবভাব দেখে মনে হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে তাদের তেমন আপত্তি নেই। তবে নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নামে দলীয় সরকার? কখনও না। কভি নেহি। নেভার, নেভার!
এই হচ্ছে নির্বাচনকালীন সময়কার সরকার পদ্ধতি নিয়ে রাজনীতির দুই পক্ষ-প্রতিপক্ষের অবস্থান। এতদিন আন্দোলন করার মতো জুৎসই কোনো ইস্যু বিএনপি-জামায়াতের ছিল না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিটি সাংবিধানিকভাবে বিলুপ্ত হওয়া মাত্র বিএনপি-জামায়াত যেন তাদের কাঙ্ক্ষিত ইস্যুটি পেয়ে গেছে। আন্দোলন করার মতো সাংগঠনিক জোর তাদের আছে কি নেই সেটি পরের কথা। এখন সরকারের সামান্য ব্যর্থতা, সামান্য বিচ্যুতি দেখলেই আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি তো তাদের আছেই, তারা জনগণের দ্বারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত বর্তমান সরকারকে আন্দোলনের হুমকি দেয়, গণঅভ্যুত্থান ও সরকার পতনের আলটিমেটাম দিয়ে চলেছে।
মাঝে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। দুটি দলের নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মুখোমুখি, বলা চলে মারমুখী অবস্থান দেখে উভয় পক্ষকে বলেছেন সংলাপে বসতে। বলেছেন হরতাল বা এ জাতীয় জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এবং অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর কোনো প্রোগ্রাম না দিতে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মেসেজটি অত্যন্ত পরিষ্কার। নির্বাচনে সব দলেরই অংশগ্রহণ থাকতে হবে এবং যে কোনো রাজনৈতিক সংকট মীমাংসা করতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের সংলাপে বসতে হবে। সংলাপই হচ্ছে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের একমাত্র গণতান্ত্রিক পথ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু দিন দুই আগে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের খেলা কাউকে আর খেলতে দেওয়া হবে না। একই দিনে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, দিতে তো হবেই, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নাও। বলাবাহুল্য, বর্তমান মহাজোট সরকারকে উদ্দেশ করেই কথাটা বলা। আর সংলাপে বসা? হ্যাঁ, সংলাপে বসতে তো আপত্তি নেই, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সরকার মেনে নিক, বিএনপি অবশ্যই সংলাপে বসে যাবে। অর্থাৎ বিচারে রাজি আছি, কিন্তু তালগাছটা যে আমার, সেটা আগে স্বীকার করে নিতে হবে। বিএনপির কথাগুলো বিচিত্র! উদ্ভট। তালগাছ নিয়ে বিবাদ এবং বিচার_ সেখানে তালগাছের মালিকানা যদি কোনো পক্ষ পেয়ে যায়, তাহলে সংলাপে বসার দরকারটা কী!
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
তেমন আপত্তি নেই
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই ইস্যুটি বেশ কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে রাজনীতির প্রধান বিরোধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের বাকি এখনও দেড় বছরের কাছাকাছি। আগে কখনও ইস্যুটিকে নির্বাচনের এত আগে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসরণ করে মহাজোট সরকারের গরিষ্ঠ অংশের সম্মতি ও অনুমোদনে নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে এই সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সাংঘর্ষিক বলে সাংঘর্ষিক! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি পার্লামেন্টে বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি এবং জামায়াত যেন প্রাণ ফিরে পেল। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের বিপক্ষে টুকরা-ফাকরা দু'একটি ইস্যু ছাড়া আন্দোলন করার মতো আর কোনো ইস্যু ছিল না। দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির দরুন জনদুর্ভোগ বিরাজমান। তবে মুশকিল হচ্ছে সেটা আগের তুলনায় অনেক কম। বিএনপি-জামায়াতের বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি ও জনদুর্ভোগ নিয়ে কথা বলার আরও উপায় নেই এ জন্য যে, তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ের দুই টার্মের কোনো টার্মেই এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎও তারা উৎপাদন করেনি। কেন করেনি সেটা বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের একটা প্রশ্ন। উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করাসহ সব অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতারই কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বিদ্যুৎ। দুই টার্মের দীর্ঘ দশ বছরে বিএনপি-জামায়াত কেন বাংলাদেশের মতো দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশের জন্য এক কিলো বিদ্যুৎও উৎপাদন করল না_ এটা এক রহস্য। এই রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার আশঙ্কা। তাই সম্ভবত বিদ্যুৎজনিত কারণে জনদুর্ভোগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে তেমন ট্যাঁ-টুঁ করে না।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ইস্যু হিসেবে দুর্নীতি? হ্যাঁ, বর্তমান সরকারের আমলে সর্বস্তরে দুর্নীতি বিরাজমান। তবে দুর্নীতির বিশ্ব রেকর্ড তো হাওয়া ভবন তথা বিএনপির করা। এই ইস্যু নিয়ে বেশি নড়াচড়া করার বিপদ আছে। বিএনপি-জামায়াত সেটা বিলক্ষণ জানে। আর থাকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে পাল্টা যে বক্তব্য আসবে, জঙ্গিবাদ, রাজনীতিক হত্যা, গুম, ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট, ঘাটে ঘাটে চাঁদা আদায় ইত্যাদি_ সেই বক্তব্য বিএনপি-জামায়াতের জন্য খুব একটা সুখপ্রদ হবে না।
জুৎসই ইস্যু না পেয়ে বিএনপি-জামায়াত বাস্তবিকই খুব উদ্বেগ-দুশ্চিন্তায় ছিল। তাদের হাতে কত কাজ! 'বেচারা সব যুদ্ধাপরাধী'কে বাঁচাতে হবে! হাইতির বেবিডকের বাংলাদেশি কাউন্টার পার্টকে করতে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী! তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে, পাশাপাশি চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে নানা কায়দায় নন-কানেকটিভিটি বা বিচ্ছিন্নতার যে একটি কঠিন দেয়াল বিএনপি-জামায়াত তুলেছিল, সেই দেয়াল যে ক্রমে ক্রমে ভেঙে ফেলছে আওয়ামী লীগ তথা বর্তমান মহাজোট সরকার! ভারত এবং বিশ্ব-সংশ্লিষ্টতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি প্রবলভাবে উপকৃত হয়, তাহলে বিএনপি-জামায়াতের কারও চাকরি থাকবে! দেশও যে মহাবিপদে আছে সেটি বিএনপি-জামায়াত ছাড়া বোঝে ক'জন! কাজেই সরকারের বিপক্ষে আন্দোলনে নামার, আন্দোলনে নেমে বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি তছনছ করে তোলার, দেশকে একটা ভীতিকর অচলাবস্থার দিকে নেওয়ার একটা জুৎসই ইস্যু চাইছিল বিএনপি-জামায়াত। সেই ইস্যু তারা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে। মক্কেলের নাম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার!
বর্তমান সরকারের আমলে নিজেদের নির্দলীয়, নিরপেক্ষ শক্তিশালী অবস্থান ধারাবাহিকভাবে প্রতিপন্ন করে চলেছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন। শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বাধীনে সম্পন্ন হওয়া সিটি করপোরেশন, পৌর, উপজেলা, ইউনিয়ন ও উপনির্বাচনগুলোতে বিএনপি যে আওয়ামী লীগের প্রায় সমানসংখ্যক আসনে জয়ী হয়েছে, সেটি নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী অবস্থান এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বর্তমান মহাজোট সরকারের কোনোরকম হস্তক্ষেপ না করার কারণেই সম্ভব হয়েছে। কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আমলেও একই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ধারা বহাল রয়েছে। এর পরও বিএনপি শামসুল হুদা ও রকিবউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা একটি সোনার হরিণ চায়। সোনার হরিণটির নাম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশের একটি বৃহৎ পত্রিকা-গোষ্ঠীকেন্দ্রিক তথাকথিত সুশীল সমাজও ইশারা-ইঙ্গিতে নির্দলীয়, অনির্বাচিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই নির্বাচনের আগে অধিষ্ঠিত দেখতে চায় বলে মনে হয়। বাংলাদেশে সদ্য বিদায় নেওয়া এবং সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ। অতীতে এবং বর্তমানে এই বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
নির্বাচন করার কথা নির্বাচন কমিশনেরই। নির্বাচনকালীন তিন মাস স্থায়ী সরকারের কাজ নির্বাচন কমিশনকে তার চাহিদা ও ইচ্ছা মোতাবেক সাহায্য-সহযোগিতা জুগিয়ে যাওয়া এবং সরকারের প্রাত্যহিক রুটিন কাজগুলো করে যাওয়া। নির্বাচনের সময়কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমনকি কোনো পলিসিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ারও বিধান নেই। বাংলাদেশ ছাড়া দুনিয়ার সব দেশেই এই নিয়ম চালু রয়েছে।
নির্বাচন করবেই নির্বাচন কমিশন। তাহলেও নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছে কেন? ১৯৯৬ সালে এই দাবি তুলেছিল আওয়ামী লীগ। ২০১২ সালে এই দাবি তুলেছে বিএনপি-জামায়াত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি তুলে দিয়েছে সুপিীম কোর্টের রায় বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার কারণে। তারা এখন একদা তাদের সেই সোনার হরিণটি আর চাইছে না। অভিজ্ঞতার আলোকে আওয়ামী লীগ দেখেছে, গণআন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে বিএনপি পার্লামেন্টে এককভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি এমনভাবে করেছিল, যাতে এই নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার ইচ্ছা করলে আমলা ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় সংবিধানের ঊধর্ে্ব উঠে যেতে পারে, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিতে পারে, দেশের পলিসিগত সিদ্ধান্ত নিতেও কোনো বাধা থাকবে না তাদের।
আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা কল্পনাপ্রসূত কিছু নয়। সেটা আমরা গত কয়েকটি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেছি বৈকি। সংবিধানের ঊধর্ে্ব উঠে গিয়ে, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিয়ে কয়েকটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাজে-কর্মে প্রায় দানবীয় হয়ে উঠেছিল। ব্যতিক্রম শুধু বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং সাবেক প্রশাসন সদস্য আবু হেনা। বাকি সবাই বিশেষ করে বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন তো স্বেচ্ছাচারিতা, ষড়যন্ত্র এবং দানবীয় কর্মকাণ্ডের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির ইয়েসউদ্দিনের আমলে করা প্রায় এক কোটি ভুয়া ভোট বাতিল করে নতুন ভোটার লিস্ট ও আইডি কার্ড প্রবর্তন করে একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে দিতে সমর্থ হয়েছিল বটে, সেই নির্বাচন গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছিল। তবে ফখরুদ্দীন সরকার তিন মাসের জায়গায় দু'বছর ক্ষমতায় থেকে নির্বিচার দুর্নীতি, রাজনীতি ধ্বংস এবং রাজনীতিক-নির্যাতনের যেসব কর্মকাণ্ড করেছে তা যে কোনো বিচারেই হিংস্র ও দানবীয় বলে প্রতিপন্ন হতে পারে।
আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের বক্তব্য, এসব দুঃসহ অভিজ্ঞতার কারণেই নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত সরকারের ওপর তাদের আস্থা নেই। আর বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত মনে করে, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে দলীয় সরকারের প্রতি তাদের আস্থা নেই। আগে প্রত্যাখ্যান করলেও এখন হাবভাব দেখে মনে হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে তাদের তেমন আপত্তি নেই। তবে নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নামে দলীয় সরকার? কখনও না। কভি নেহি। নেভার, নেভার!
এই হচ্ছে নির্বাচনকালীন সময়কার সরকার পদ্ধতি নিয়ে রাজনীতির দুই পক্ষ-প্রতিপক্ষের অবস্থান। এতদিন আন্দোলন করার মতো জুৎসই কোনো ইস্যু বিএনপি-জামায়াতের ছিল না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিটি সাংবিধানিকভাবে বিলুপ্ত হওয়া মাত্র বিএনপি-জামায়াত যেন তাদের কাঙ্ক্ষিত ইস্যুটি পেয়ে গেছে। আন্দোলন করার মতো সাংগঠনিক জোর তাদের আছে কি নেই সেটি পরের কথা। এখন সরকারের সামান্য ব্যর্থতা, সামান্য বিচ্যুতি দেখলেই আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি তো তাদের আছেই, তারা জনগণের দ্বারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত বর্তমান সরকারকে আন্দোলনের হুমকি দেয়, গণঅভ্যুত্থান ও সরকার পতনের আলটিমেটাম দিয়ে চলেছে।
মাঝে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। দুটি দলের নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মুখোমুখি, বলা চলে মারমুখী অবস্থান দেখে উভয় পক্ষকে বলেছেন সংলাপে বসতে। বলেছেন হরতাল বা এ জাতীয় জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এবং অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর কোনো প্রোগ্রাম না দিতে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মেসেজটি অত্যন্ত পরিষ্কার। নির্বাচনে সব দলেরই অংশগ্রহণ থাকতে হবে এবং যে কোনো রাজনৈতিক সংকট মীমাংসা করতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের সংলাপে বসতে হবে। সংলাপই হচ্ছে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের একমাত্র গণতান্ত্রিক পথ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু দিন দুই আগে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের খেলা কাউকে আর খেলতে দেওয়া হবে না। একই দিনে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, দিতে তো হবেই, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নাও। বলাবাহুল্য, বর্তমান মহাজোট সরকারকে উদ্দেশ করেই কথাটা বলা। আর সংলাপে বসা? হ্যাঁ, সংলাপে বসতে তো আপত্তি নেই, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সরকার মেনে নিক, বিএনপি অবশ্যই সংলাপে বসে যাবে। অর্থাৎ বিচারে রাজি আছি, কিন্তু তালগাছটা যে আমার, সেটা আগে স্বীকার করে নিতে হবে। বিএনপির কথাগুলো বিচিত্র! উদ্ভট। তালগাছ নিয়ে বিবাদ এবং বিচার_ সেখানে তালগাছের মালিকানা যদি কোনো পক্ষ পেয়ে যায়, তাহলে সংলাপে বসার দরকারটা কী!
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments