প্রতিক্রিয়া-দেশের স্বার্থেই উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন by জোবায়ের জামান
৬ আগস্ট প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম ছিল ‘বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার!’। সত্যি বলতে কি দেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ—দুটির ভবিষ্যৎই অন্ধকার। ৩ আগস্ট একই পত্রিকায় আনু মুহাম্মদের ‘উন্মুক্ত না, বিদেশি না, রপ্তানি না: কেন?’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখার মূল বক্তব্য দেশে উন্মুক্ত খননপদ্ধতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
স্বভাবতই প্রশ্ন, কেন একটি প্রমাণিত ও প্রচলিত প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে? তবে তিনি বলেননি কী পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন লাভজনক ? বরং ‘উপযুক্ত পদ্ধতিতে’ কয়লা উত্তোলনের কথা বলে পাশ কাটিয়ে গেছেন।
আনু মুহাম্মদ উন্মুক্ত খনিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা তথা জাতীয় স্বার্থের জন্য বড় হুমকি মনে করছেন! অতীতে তাঁর বিভিন্ন লেখায়ও উন্মুক্ত খনিকে এভাবেই চিত্রিত করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। কেবল আবেগ এবং অনুমান নয়, আধুনিক খনি ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে উত্থাপিত এসব বিষয়ের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
পানিসম্পদ
পানি ব্যবস্থাপনা খনি পরিচালন কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উন্মুক্ত খনিতে খনন কার্যক্রম পরিচালনা ও কাজের নিরাপদ পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন প্রয়োজন হয়। খনি এলাকায় পানির সম্ভাব্য উত্স, ব্যবহার এবং পানি উত্তোলনের হার ও প্রভাব মোকাবিলায় সম্ভাব্য প্রশমনমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষার আওতায় বিশ্লেষণ করে প্রকল্পের পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।
ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বাংলাদেশে নতুন নয়। ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২২০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে, যার বেশির ভাগই আসে ভূগর্ভস্থ উত্স থেকে। ঢাকা ওয়াসার বাইরে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়েও অসংখ্য বৈধ-অবৈধ গভীর নলকূপ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পানি উত্তোলন হচ্ছে নির্বিচারে, কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা ছাড়া। তাতে ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলেও ভূপৃষ্ঠে গাছপালা এবং শস্য উত্পাদন অসম্ভব হয়ে পড়ছে না, মরুকরণও হচ্ছে না।
খনি এলাকায় সৃষ্ট পরিশোধিত বা অপরিশোধিত পানি সাধারণত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খনির কাজে পুনর্ব্যবহার করা হয়। কেবল অতিরিক্ত পরিশোধিত পানি যথাযথ মানদণ্ড অনুসরণ করে পার্শ্ববর্তী নদী বা জলাশয়ে প্রবাহিত করা হয়। একটি খনির কারণে ‘পানির অভূতপূর্ব দূষণ, ...ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে’ ধরনের বক্তব্য যথার্থ ধরে নেওয়া হলে বাংলাদেশের উজানে ভারতের অসংখ্য খনির কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো অনেক আগেই ‘অভূতপূর্ব দূষণের’ শিকার হয়ে পড়ার কথা।
আবাদি জমি
আনু মুহাম্মদ লিখেছেন,‘উন্মুক্ত খনির কারণে ...কৃষিজমি বিনষ্ট হবে, ...বৃহত্তর অঞ্চলের জমি আবাদ অযোগ্য হবে, ...খাদ্য নিরাপত্তা বড় রকমের হুমকির মুখে পড়বে।’ উন্মুক্ত খনির কারণে দেশের সমগ্র উত্তরাঞ্চল ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হোক, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ুক তা কেউই চায় না! কিন্তু আসলেই কি তাই? এত ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে বিশ্বে শত শত উন্মুক্ত খনি কীভাবে পরিচালত হচ্ছে?
উন্মুক্ত খনিতে তুলনামূলকভাবে অধিক জমির প্রয়োজন হয়, কিন্তু সেটি পর্যায়ক্রমিক ও সাময়িক। কয়লা বা অন্য খনিজ উত্তোলনের পর পর্যায়ক্রমিক পুনর্ভরণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে জমি আগের উত্পাদনশীলতায় ফিরিয়ে আনা যায়। ফলে কৃষি উত্পাদন সাময়িকভাবে হ্রাস পেলেও দীর্ঘমেয়াদে উত্পাদন ব্যবস্থায় বড় ধরনের হেরফের হয় না বরং সার্বক্ষণিক সেচসুবিধাসহ পরিকল্পিত আধুনিক কৃষিব্যবস্থায় উত্পাদন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, খনি উন্নয়নের ফলে খনি পূর্ব ও পরবর্তী ভূমি ব্যবহারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। কৃষিজমির পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেলেও বনভূমি ও জলাভূমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে; জমির অনেক পরিকল্পিত ব্যবহারও সম্ভব হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তাও প্রয়োজন। নির্বিচারে কৃষিজমি এবং জলাভূমি ভরাট করে বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্প (পূর্বাচলে জমির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার হেক্টর) বা অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য যেখানে হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়লা সম্পদ আহরণে কয়েক হাজার হেক্টর জমি ব্যবহারের পর উত্পাদনশীল ব্যবহারে ফিরিয়ে নেওয়া গেলে তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জমি যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় কৃষিসহ অন্যান্য উত্পাদনশীল ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা।
প্রাণবৈচিত্র্য
আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ...এসিড ড্রেনেজসহ পানির দূষণযজ্ঞে প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি সমগ্র দেশের প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করবে। উন্মুক্ত একটি বা দুটি খনির কারণে দেশজুড়ে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হলে টেক্সটাইলস, চামড়া বা অন্যান্য শিল্পের নির্বিচার দূষণ বাংলাদেশের প্রতিবেশগত ভারসাম্য অসংখ্যবার নষ্ট করেছে ধরে নেওয়া যায়!
সাধারণভাবে সালফাইডসমৃদ্ধ শিলা, কয়লা বা কয়লার বর্জ্য উন্মুক্ত পরিবেশে অক্সিজেন ও পানির সংস্পর্শে এলে সৃষ্ট বিক্রিয়ায় এসিডসমৃদ্ধ ড্রেনেজ (এএমডি) সৃষ্টি হতে পারে। খনি উন্নয়নের কারণে কী পরিমাণে ‘এএমডি’ সৃষ্টি হবে বা আদৌ হবে কিনা তা কয়লা বা অন্য খনিজ এবং উপরিস্থিত ভূগর্ভস্থ শিলার প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বিস্তারিত সমীক্ষা ব্যতীত তা নিশ্চিত করে কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়।
খনিশিল্পে এসিড মাইন ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি রয়েছে। সমপ্রতি (জুন, ২০০৯) বিশ্বের বৃহৎ মাইনিং কোম্পানিগুলোর সমন্বয়ে গঠিত গ্রুপ ‘ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর এসিড প্রিভেনশন’ (আইএনএপি) এসিড মাইন ড্রেনেজ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ‘গ্লোবাল এসিড রক ড্রেনেজ’ (জিএআরডি) নামে একটি দিকনির্দেশনামূলক দলিল প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এসব দিকনির্দেশনা অনুসরণে তৈরি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে খনি উন্নয়নে সৃষ্ট প্রভাব যথাযথভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব।
এটা অত্যন্ত আশার কথা, বাংলাদেশের কয়লা উন্নত মানের, এতে পরিবেশদূষণকারী সালফারের পরিমাণ অনেক কম। বড়পুকুরিয়ার বিপুল পরিমাণ স্তূপীকৃত কয়লা থেকে অথবা খনি উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উত্তোলিত ভূগর্ভস্থ শিলা থেকে ‘এএমডি’ সৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। যদিও কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনা ছাড়া তা খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়েছিল বা হচ্ছে। বড়পুকুরিয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে এ ধরনের ভূতাত্ত্বিক অবস্থায় খনি উন্নয়নের কারণে ‘এএমডি’ সৃষ্টির সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবু বিস্তারিত সমীক্ষা যদি এ ধরনের সম্ভাবনা নির্দেশ করে, তবে তা যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সফলভাবে প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
খনির ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা কোনো অপরিবর্তনীয় দলিল নয়, সময়ে সময়ে খনি উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপে তা পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে থাকে। দেশের জ্বালানি বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এসব ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার নিরপেক্ষ কারিগরি মূল্যায়ন প্রয়োজন। এবং এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদেরই এগিয়ে আসা উচিত।
কয়লার চাহিদা
আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ..‘.উন্মুক্ত পদ্ধতির অপরিহার্য পরিণতি বিপুল অংশের রপ্তানি।’ এ ক্ষেত্রেও তিনি দেশে কয়লার প্রকৃত চাহিদাকে বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশে ইটভাটায় বর্তমানে বছরে চার থেকে পাঁচ মিলিয়ন টন কয়লার ব্যবহার রয়েছে, যা মূলত উচ্চ সালফারসমৃদ্ধ পরিবেশদূষণকারী নিম্নমানের আমদানিকৃত কয়লা। তা ছাড়া দেশীয় কয়লা সহজলভ্য হলে বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য বছরে আট থেকে দশ মিলিয়ন টন কয়লার চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে (সাধারণভাবে বড়পুকুরিয়া মানের কয়লায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদনে বছরে প্রায় তিনি মিলিয়ন টন কয়লা প্রয়োজন)। তবে রাতারাতি কোনো উন্মুক্ত খনিতেই সর্বোচ্চ উত্তোলন সম্ভব নয়, এ সক্ষমতা অর্জনে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগে। কয়লা উত্তোলন পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। তাই উন্মুক্ত খনি মানেই বিপুল পরিমাণ কয়লার রপ্তানি নয়, বরং বলা যায় দেশের সীমিত কয়লা সম্পদের সর্বোচ্চ উত্তোলন এবং সর্বোত্তম ব্যবহারের নিশ্চয়তা।
দেশের কয়লা কী পদ্ধতিতে উত্তোলিত হবে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ধারিত হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট কয়লা ক্ষেত্রের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা, কারিগরি, সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যাপক অনুসন্ধানের পরই কেবল তা নির্ধারিত হতে হবে। তবে কয়লা ক্ষেত্রের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা উপযোগী হলে দেশের সীমিত সম্পদের বিবেচনায় উন্মুক্ত পদ্ধতিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯১ সালে ভারতের ‘সেন্ট্রাল কোল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এবং জার্মানির রাইনব্রাউন ইঞ্জিনিয়ারিং বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বছরে ছয় মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে বড়পুকুরিয়ার উত্তোলনযোগ্য কয়লার পাঁচ-ছয় শতাংশও উত্তোলন সম্ভব হবে না। ব্রিটিশ ফার্ম ওয়ার্ডেল আর্মস্ট্রংও ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে পাঁচ-ছয় শতাংশের বেশি উত্তোলন সম্ভব নয় বলেছিল। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া ভূগর্ভস্থ খনিতে তা-ই হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ জাতীয় সম্পদ অপচয়ের এ দায় কার?
জোবায়ের জামান: ভূতত্ত্ববিদ।
আনু মুহাম্মদ উন্মুক্ত খনিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা তথা জাতীয় স্বার্থের জন্য বড় হুমকি মনে করছেন! অতীতে তাঁর বিভিন্ন লেখায়ও উন্মুক্ত খনিকে এভাবেই চিত্রিত করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। কেবল আবেগ এবং অনুমান নয়, আধুনিক খনি ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে উত্থাপিত এসব বিষয়ের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
পানিসম্পদ
পানি ব্যবস্থাপনা খনি পরিচালন কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উন্মুক্ত খনিতে খনন কার্যক্রম পরিচালনা ও কাজের নিরাপদ পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন প্রয়োজন হয়। খনি এলাকায় পানির সম্ভাব্য উত্স, ব্যবহার এবং পানি উত্তোলনের হার ও প্রভাব মোকাবিলায় সম্ভাব্য প্রশমনমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষার আওতায় বিশ্লেষণ করে প্রকল্পের পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।
ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বাংলাদেশে নতুন নয়। ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২২০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে, যার বেশির ভাগই আসে ভূগর্ভস্থ উত্স থেকে। ঢাকা ওয়াসার বাইরে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়েও অসংখ্য বৈধ-অবৈধ গভীর নলকূপ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পানি উত্তোলন হচ্ছে নির্বিচারে, কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা ছাড়া। তাতে ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলেও ভূপৃষ্ঠে গাছপালা এবং শস্য উত্পাদন অসম্ভব হয়ে পড়ছে না, মরুকরণও হচ্ছে না।
খনি এলাকায় সৃষ্ট পরিশোধিত বা অপরিশোধিত পানি সাধারণত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খনির কাজে পুনর্ব্যবহার করা হয়। কেবল অতিরিক্ত পরিশোধিত পানি যথাযথ মানদণ্ড অনুসরণ করে পার্শ্ববর্তী নদী বা জলাশয়ে প্রবাহিত করা হয়। একটি খনির কারণে ‘পানির অভূতপূর্ব দূষণ, ...ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে’ ধরনের বক্তব্য যথার্থ ধরে নেওয়া হলে বাংলাদেশের উজানে ভারতের অসংখ্য খনির কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো অনেক আগেই ‘অভূতপূর্ব দূষণের’ শিকার হয়ে পড়ার কথা।
আবাদি জমি
আনু মুহাম্মদ লিখেছেন,‘উন্মুক্ত খনির কারণে ...কৃষিজমি বিনষ্ট হবে, ...বৃহত্তর অঞ্চলের জমি আবাদ অযোগ্য হবে, ...খাদ্য নিরাপত্তা বড় রকমের হুমকির মুখে পড়বে।’ উন্মুক্ত খনির কারণে দেশের সমগ্র উত্তরাঞ্চল ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হোক, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ুক তা কেউই চায় না! কিন্তু আসলেই কি তাই? এত ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে বিশ্বে শত শত উন্মুক্ত খনি কীভাবে পরিচালত হচ্ছে?
উন্মুক্ত খনিতে তুলনামূলকভাবে অধিক জমির প্রয়োজন হয়, কিন্তু সেটি পর্যায়ক্রমিক ও সাময়িক। কয়লা বা অন্য খনিজ উত্তোলনের পর পর্যায়ক্রমিক পুনর্ভরণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে জমি আগের উত্পাদনশীলতায় ফিরিয়ে আনা যায়। ফলে কৃষি উত্পাদন সাময়িকভাবে হ্রাস পেলেও দীর্ঘমেয়াদে উত্পাদন ব্যবস্থায় বড় ধরনের হেরফের হয় না বরং সার্বক্ষণিক সেচসুবিধাসহ পরিকল্পিত আধুনিক কৃষিব্যবস্থায় উত্পাদন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, খনি উন্নয়নের ফলে খনি পূর্ব ও পরবর্তী ভূমি ব্যবহারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। কৃষিজমির পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেলেও বনভূমি ও জলাভূমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে; জমির অনেক পরিকল্পিত ব্যবহারও সম্ভব হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তাও প্রয়োজন। নির্বিচারে কৃষিজমি এবং জলাভূমি ভরাট করে বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্প (পূর্বাচলে জমির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার হেক্টর) বা অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য যেখানে হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়লা সম্পদ আহরণে কয়েক হাজার হেক্টর জমি ব্যবহারের পর উত্পাদনশীল ব্যবহারে ফিরিয়ে নেওয়া গেলে তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জমি যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় কৃষিসহ অন্যান্য উত্পাদনশীল ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা।
প্রাণবৈচিত্র্য
আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ...এসিড ড্রেনেজসহ পানির দূষণযজ্ঞে প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি সমগ্র দেশের প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করবে। উন্মুক্ত একটি বা দুটি খনির কারণে দেশজুড়ে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হলে টেক্সটাইলস, চামড়া বা অন্যান্য শিল্পের নির্বিচার দূষণ বাংলাদেশের প্রতিবেশগত ভারসাম্য অসংখ্যবার নষ্ট করেছে ধরে নেওয়া যায়!
সাধারণভাবে সালফাইডসমৃদ্ধ শিলা, কয়লা বা কয়লার বর্জ্য উন্মুক্ত পরিবেশে অক্সিজেন ও পানির সংস্পর্শে এলে সৃষ্ট বিক্রিয়ায় এসিডসমৃদ্ধ ড্রেনেজ (এএমডি) সৃষ্টি হতে পারে। খনি উন্নয়নের কারণে কী পরিমাণে ‘এএমডি’ সৃষ্টি হবে বা আদৌ হবে কিনা তা কয়লা বা অন্য খনিজ এবং উপরিস্থিত ভূগর্ভস্থ শিলার প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বিস্তারিত সমীক্ষা ব্যতীত তা নিশ্চিত করে কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়।
খনিশিল্পে এসিড মাইন ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি রয়েছে। সমপ্রতি (জুন, ২০০৯) বিশ্বের বৃহৎ মাইনিং কোম্পানিগুলোর সমন্বয়ে গঠিত গ্রুপ ‘ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর এসিড প্রিভেনশন’ (আইএনএপি) এসিড মাইন ড্রেনেজ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ‘গ্লোবাল এসিড রক ড্রেনেজ’ (জিএআরডি) নামে একটি দিকনির্দেশনামূলক দলিল প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এসব দিকনির্দেশনা অনুসরণে তৈরি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে খনি উন্নয়নে সৃষ্ট প্রভাব যথাযথভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব।
এটা অত্যন্ত আশার কথা, বাংলাদেশের কয়লা উন্নত মানের, এতে পরিবেশদূষণকারী সালফারের পরিমাণ অনেক কম। বড়পুকুরিয়ার বিপুল পরিমাণ স্তূপীকৃত কয়লা থেকে অথবা খনি উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উত্তোলিত ভূগর্ভস্থ শিলা থেকে ‘এএমডি’ সৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। যদিও কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনা ছাড়া তা খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়েছিল বা হচ্ছে। বড়পুকুরিয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে এ ধরনের ভূতাত্ত্বিক অবস্থায় খনি উন্নয়নের কারণে ‘এএমডি’ সৃষ্টির সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবু বিস্তারিত সমীক্ষা যদি এ ধরনের সম্ভাবনা নির্দেশ করে, তবে তা যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সফলভাবে প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
খনির ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা কোনো অপরিবর্তনীয় দলিল নয়, সময়ে সময়ে খনি উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপে তা পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে থাকে। দেশের জ্বালানি বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এসব ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার নিরপেক্ষ কারিগরি মূল্যায়ন প্রয়োজন। এবং এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদেরই এগিয়ে আসা উচিত।
কয়লার চাহিদা
আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ..‘.উন্মুক্ত পদ্ধতির অপরিহার্য পরিণতি বিপুল অংশের রপ্তানি।’ এ ক্ষেত্রেও তিনি দেশে কয়লার প্রকৃত চাহিদাকে বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশে ইটভাটায় বর্তমানে বছরে চার থেকে পাঁচ মিলিয়ন টন কয়লার ব্যবহার রয়েছে, যা মূলত উচ্চ সালফারসমৃদ্ধ পরিবেশদূষণকারী নিম্নমানের আমদানিকৃত কয়লা। তা ছাড়া দেশীয় কয়লা সহজলভ্য হলে বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য বছরে আট থেকে দশ মিলিয়ন টন কয়লার চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে (সাধারণভাবে বড়পুকুরিয়া মানের কয়লায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদনে বছরে প্রায় তিনি মিলিয়ন টন কয়লা প্রয়োজন)। তবে রাতারাতি কোনো উন্মুক্ত খনিতেই সর্বোচ্চ উত্তোলন সম্ভব নয়, এ সক্ষমতা অর্জনে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগে। কয়লা উত্তোলন পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। তাই উন্মুক্ত খনি মানেই বিপুল পরিমাণ কয়লার রপ্তানি নয়, বরং বলা যায় দেশের সীমিত কয়লা সম্পদের সর্বোচ্চ উত্তোলন এবং সর্বোত্তম ব্যবহারের নিশ্চয়তা।
দেশের কয়লা কী পদ্ধতিতে উত্তোলিত হবে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ধারিত হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট কয়লা ক্ষেত্রের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা, কারিগরি, সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যাপক অনুসন্ধানের পরই কেবল তা নির্ধারিত হতে হবে। তবে কয়লা ক্ষেত্রের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা উপযোগী হলে দেশের সীমিত সম্পদের বিবেচনায় উন্মুক্ত পদ্ধতিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯১ সালে ভারতের ‘সেন্ট্রাল কোল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এবং জার্মানির রাইনব্রাউন ইঞ্জিনিয়ারিং বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বছরে ছয় মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে বড়পুকুরিয়ার উত্তোলনযোগ্য কয়লার পাঁচ-ছয় শতাংশও উত্তোলন সম্ভব হবে না। ব্রিটিশ ফার্ম ওয়ার্ডেল আর্মস্ট্রংও ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে পাঁচ-ছয় শতাংশের বেশি উত্তোলন সম্ভব নয় বলেছিল। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া ভূগর্ভস্থ খনিতে তা-ই হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ জাতীয় সম্পদ অপচয়ের এ দায় কার?
জোবায়ের জামান: ভূতত্ত্ববিদ।
No comments