গোলটেবিল বৈঠক-শিশুদের জন্য বিনিয়োগ ও সরকারের অঙ্গীকার

২৪ মে ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘শিশুদের জন্য বিনিয়োগ ও সরকারের অঙ্গীকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সহযোগিতায়ছিল সেভ দ্য চিলড্রেন, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সিএসআইডি। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।


যাঁরা অংশ নিলেন
ড. আকবর আলি খান
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
অর্থনীতিবিদ, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান
হাসানুল হক ইনু
সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
এম এ মান্নান
সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
রণজিৎ কুমার বিশ্বাস
সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
অধ্যাপক সাদেকা হালিম
কমিশনার, তথ্য কমিশন
ড. ফাহমিদা খাতুন
গবেষণা-প্রধান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ
ড. কাজী মারুফুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খন্দকার জহুরুল আলম
নির্বাহী পরিচালক, সিএসআইডি
মো. এমরানুল হক চৌধুরী
কনভেনর, সিআরজিএ ও নির্বাহী পরিচালক, উদ্দীপন
কাজী গিয়াস উদ্দিন
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি, সেভ দ্য চিলড্রেন
শামসুল আলম
ডেপুটি ডিরেক্টর, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স প্রোগ্রাম, সেভ দ্য চিলড্রেন
চৌধুরী মো. তাইয়ুব তাজাম্মুল
সিনিয়র ম্যানেজার, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স প্রোগ্রাম, সেভ দ্য চিলড্রেন
এম এম আমিনুল ইসলাম
চাইল্ড প্রোটেকশন স্পেশালিস্ট, ইউনিসেফ
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই শিশুদের জন্য কী করছি, কী করা উচিত, কী পরিকল্পনা আছে তাদের জন্য? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও বিনোদনের জন্য আমরা কীকরছি? বাস্তবতা হলো, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সময় উত্ত্যক্ত করা হয়। দুষ্কৃতকারীরা ছেলেমেয়েদের খারাপ কাজে ব্যবহার করে। সমাজে শিশুর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ শিশুদের ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা অছে। ২০২১ সালের জন্য লক্ষ্যমাত্রা আছে। প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ দিয়ে তাদের জন্য কী কাজ করা হয়, তা সরাসরি অনেকে দেখতে চায়, জানতে চায়। শিশুদের জন্য বরাদ্দ ও তার বাস্তবায়নের বিষয়ে বাজেটে বিবরণীমূলক একটি পৃথক অধ্যায় থাকা দরকার, যাতে বছর শেষে প্রকৃত অর্জন বের করা যায়।

রণজিৎ কুমার বিশ্বাস
শিশুদের জন্য বিনিয়োগ ও সরকারের অঙ্গীকার—এ দুটি বাক্যে কারও কোনো দ্বিমত বা সংশয় থাকার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতেই হবে। সরকারের অঙ্গীকার নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ, শিশুদের জন্য বিনিয়োগ না করলে যে ক্ষতি হবে, সেটি বিনিয়োগ-মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করে। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শিশুদের জন্য নানা রকম প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় বরাদ্দ পেয়ে যাচ্ছি। এখানে হয়তো আরেকটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে বরাদ্দ করা অর্থের কতটুকু কাজে লাগাতে পারছি বা এই অর্থের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না। তবে এ ধরনের আলোচনার আয়োজন হলে সরকার, এনজিও ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের মতামত দিতে পারে। এ থেকে সরকার তার সফল ও দুর্বল দিকগুলো বুঝতে পারে এবং সামনের দিনগুলোতে কাজ করতে সুবিধা হয়।
ইউনিয়ন স্তর পর্যন্ত আমাদের কাজের পরিধি রয়েছে। সেখানে যারা কাজ করেন, তাঁদের বলা হয় ইউনিয়ন সমাজকর্মী। অনেক মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন স্তর পর্যন্ত কর্মী নেই। ৮৯টি কার্যক্রম সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে রেখেছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ১৩টি কার্যক্রম সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় করছে।
দেশে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র আছে, যেখানে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুরা থাকতে পারে। সেখানে তাদের খওয়াদাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা আছে। অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের জন্য কিছু সংশোধনাগার আছে। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম আছে।
আরেকটি বড় কাজ শিশুদের জন্য শুরু করেছি। তা হলো দেশের প্রতিটি জেলায় সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র গড়ে তোলা। শিশুসহ অন্যরাও এখানে সেবা পাবে। প্রতিটি সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রে ১০ জন অটিস্টিক প্রতিবন্ধী শিশুকে লেখাপড়া করানোর স্কুল যুক্ত করা হয়েছে।
আমরা ৬৪টি জেলার সাধারণ স্কুলের সঙ্গে সমন্বয় করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পড়ালেখার সুযোগ করে দিচ্ছি। সাতটি শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় আছে। এখানে ২৭০ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষা গ্রহণ করছে। দেশে দুটি শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। যার মাধ্যমে ১১৫ জন প্রতিবন্ধীকে প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনসেবা প্রদান করা হচ্ছে। মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কেবল চট্টগ্রামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে ১১৫ জন শিশুকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। সরকারি শিশুসদন ও পরিবারকল্যাণকেন্দ্র যেগুলো আছে, সেখানে সরকারের বিধি অনুযায়ী কার্যক্রম করা হয়। এতিম ও দুস্থ শিশুদের জন্য আমরা কিছু কার্যক্রম করে থাকি।
শিশুদের কল্যাণে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনে দুটি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। একটি হলো শিশুদের জন্য ক্রীড়া কমপ্লেক্স। আমিনবাজারের পর ১২ একর জায়গার ওপর এটি তৈরি হবে। এ কাজ চলছে। শিশুদের জন্য আরেকটি আধুনিক কাজ করা হচ্ছে। তা হলো সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা নামে হাওয়া ও তারের মাধ্যমে ঐন্দ্রজালিক সুর তৈরি করা। এর মাধ্যমে শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা হবে। এই হলো শিশুদের কার্যক্রমের বিবরণ। আজকের এ আলোচনা থেকে অনেক বিষয় উঠে আসবে। এ বিষয়ের একটি নোট নেব। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে শিশুদের বিষয়টিতে মনোযোগ দেওয়া হয়। সেখানে এ বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
এখন বলবেন সেভ দ্য চিলড্রেনের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি, কাজী গিয়াস উদ্দিন।

কাজী গিয়াস উদ্দিন
সেভ দ্য চিলড্রেনের পক্ষে ১৯৭০ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ হচ্ছে। শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কার্যক্রম করি। দেশে যখন জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে, তখন শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নিরাপত্তার জন্য কাজ করি। এসব কাজ করতে গিয়ে আমাদের বিদেশি দাতা সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। এই দাতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন আসে। তারা জানতে চায়, সরকারের কী পরিমাণ রাজস্ব শিশুদের জন্য বরাদ্দ করা হয় এবং এর কত অংশ তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, নিরাপত্তা ও বিনোদনের জন্য ব্যয় করা হয়। শিশুদের জন্য আলাদা বাজেটের কথা বলছি না। যেটা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হলো, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ে কত শতাংশ শিশুদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বরাদ্দ করা অর্থ কোন কোন খাতে কতটা ব্যয় হচ্ছে। এর একটা স্বচ্ছ ধারণা বাজেট থেকে পেতে চাচ্ছি। শিশুদের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য এটা জানার প্রয়োজনীয়তা আমাদের আছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ শিশু। তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। ভবিষ্যতে এই শিশুরা কতটা সুনাগরিক হবে, কতটা ভালো মানুষ হয়ে দেশের সেবা করবে, তার পুরোটাই নির্ভর করবে তাদের জন্য বর্তমানে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারছি।

আব্দুল কাইয়ুম
সেভ দ্য সিলড্রেনের বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা ও তাদের শিশুভিত্তিক বিভিন্ন কাজের কথা জানলাম। এবার এ বিষয়ে আলোচনা করবেন খন্দকার জহুরুল আলম।

খন্দকার জহুরুল আলম
দেশে মোট শিশুর সংখ্যা কেউ ৪২, কেউ ৪৫, কেউ ৪৮ শতাংশ বলেন। যাই হোক না কেন। এই সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কাছাকাছি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শিশুদের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ আছে তা দৃশ্যমান নয়। তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ ও বাজেট নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু আমরা ঠিক বুঝতে পারি না কত শতাংশ অর্থ শিশুদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। শিশুদের জন্য আলাদা কোনো অধ্যায় না থাকায় আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। ভারতে শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট অধ্যায় আছে। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, এমনকি ঘানার মতো দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বাজেট অধ্যায় আছে। বিন্তু বাংলাদেশের বাজেটে কখনোই এটা দেখতে পাইনি। জেন্ডার, ডিজঅ্যাবিলিটি ইত্যাদি বিষয়ে পৃথক অধ্যায় এসেছে। কিন্তু শিশুদের বিষয়ে আসেনি। আরেকটি বিষয় হলো, যে বাজেট বরাদ্দ হলো, এর কতটা বাস্তবায়ন হলো। সে চিত্রটি কখনোই খুঁজে পাই না। আমরা বলতে চাচ্ছি, বাজেট উপস্থাপনের সময় শিশুদের জন্য যেন একটি আলাদা অধ্যায় রাখা হয়। সেখানে বরাদ্দ করা অর্থ এবং অর্থ বিনিয়োগের ধারাবাহিক পদ্ধতি বলা থাকবে।
শিশুদের জন্য একটা কমিশন থাকা দরকার, যেটা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এই কমিশন শিশুদের জন্য কী বাজেট হচ্ছে, কী বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটা পর্যবেক্ষণ করবে। শিশুদের সঙ্গে কথা বললে, তারা বলে তাদের জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত বছর বস্তিতে ছিল, এবারও বস্তিতে থাকে। গত বছর যেভাবে যে পরিবেশে লেখাপড়া করেছিল, এবারও সেই পরিবেশে লেখাপড়া করছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বাজেট তাদের জীবনে কী দিল?

আব্দুল কাইয়ুম
খন্দকার জহুরুল আলম শিশু কমিশনের কথা বলেছেন। মনে হয়, বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। এবার বলবেন কাজী মারুফুল ইসলাম।

কাজী মারুফুল ইসলাম
শিশুদের বরাদ্দ সম্পর্কে সবাই জানি। বরাদ্দ বাড়বে না কমবে, কমিশন হবে কি হবে না, পৃথক অধ্যায় থাকবে কি থাকবে না—এর জন্য কিছু বিবেচ্য বিষয় আছে। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিশু। এই শিশুরা ভবিষ্যতে শ্রমশক্তিতে পরিণত হবে। কীভাবে এই বিরাট জনশক্তিকে পরিচালনা করব, তার ওপর নির্ভর করবে তারা দেশকে কতটুকু সেবা দিতে পারবে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তুলনায় শিশুরা পিছিয়ে আছে। দেশের সংবিধানে সব নাগরিকের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। শিশুরা সে অধিকার কতটুকু ভোগ করতে পারছে, আজকে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। বাজেটে তাদের জন্য ‘বরাদ্দ’ না বলে ‘বিনিয়োগ’ বলতে চাই। কারণ, শিশুদের জন্য কতটুকু বিনিয়োগ হচ্ছে, বিনিয়োগের কত শতাংশ খরচ হচ্ছে, তাদের কল্যাণ কতটুকু হচ্ছে—এই বিষয়গুলো ‘বরাদ্দ’ শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় না। সুতরাং এটা বিনিয়োগ। বিনিয়োগের কতটুকু কার্যকর ব্যবহার হয়েছে। মুনাফা কী হয়েছে—এর হিসাব নিতে চাই। উন্নয়নের সূচকে বেশ কিছু জায়গায় যেমন শিক্ষা, শিশুমৃত্যুর হার ইত্যাদি কিছু জায়গায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে যাচ্ছে। এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ জিডিপি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সংগত কারণে বাজেট বাড়বে। জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তুলনা করলে যে পরিমাণ বাজেট বাড়ার কথা, সে পরিমাণ বাড়েনি। সরাসরি শিশুসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোয় কাজ করে দেখেছি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় এ হার হতাশাজনক। প্রতিটি বরাদ্দই শিশুদের ওপর পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। সে ক্ষেত্রে শিশুদের বরাদ্দ পৃথক করা কিছুটা কঠিন হয়। কিন্তু কিছু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ সরাসরি শিশুদের প্রভাবিত করে। এগুলোর একটি তালিকা করে আলাদা একটা অধ্যায় শিশুদের বিনিয়োগের বিষয়টি থাকলে সবার জন্য সুবিধা হবে।

আকবর আলি খান
আজকের আলোচনার বিষয়ের সঙ্গে আমি একমত। তবে এখানে বড় ধরনের কিছু বিভ্রান্তি কাজ করছে। প্রথম কথা হলো, একটি দেশের বাজেট শিশুদের, নারীদের জন্য আলাদা করে হয় না। বাজেট হয় দেশের জন্য। এখানে আমরা জানতে চাই, শিশুদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেটা হয়েছে কি না। বারবার শুনতে পাচ্ছি বাজেটের অধ্যায়। অধ্যায় বলে কিছু নেই। বাজেটের মধ্যে কতগুলো হিসাব এবং আইন আছে। আর বাজেট বোঝার জন্য আছে কতকগুলো সহায়ক দলিল। মহিলাদের জন্য জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন করা হয়। এটা সংসদে উপস্থাপন করা হয়, যা বাজেটের সহায়ক দলিল হিসেবে কাজ করতে পারে।
শিশুদের জন্য বাজেটে সহায়ক দলিল থাকতে পারে। সহায়ক দলিল নারীদের ক্ষেত্রে পেয়েছি। তবে যেটা পেয়েছি, এটা না পাওয়া ভালো ছিল। এটাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সেগুলো অর্থহীন মনে হয়েছে। কেন মনে হয়েছে? এর কারণ হলো, উদাহরণ হিসেবে বলি, উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রকল্পের নাম বেগুনবাড়ি খাল ও স্টাফ কলেজ। এ দুটি প্রকল্পের বরাদ্দের যথাক্রমে ২০ ও ১০ শতাংশ মহিলাদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়েছে। এর থেকে কোনো কিছু বের করা সম্ভব নয়। শিশুদের জন্য সহায়ক দলিল যদি থাকে, তাহলে সেই দলিলে থাকতে হবে, শিশুদের কী কী সুযোগ দরকার, গত বছর শিশুরা কী অবস্থায় ছিল, এ বছর কোথায় আছে। যদি মনে করি, শিশু পাচার রোধ জরুরি, তাহলে গত দুবছর পাচার পরিস্থিতি কী ছিল, এ বছর অবস্থা কী ইত্যাদি তথ্যের সমাবেশ করতে হবে। মহিলাদেরও বর্তমানের দলিল প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশে মহিলাদের কী পরিস্থিতি, তার ওপর একটি প্রতিবেদন দাখিল করা উচিত। প্রতিবেদন দাখিল করলে বেগুনবাড়ি খাল আর স্টাফ কলেজের মতো আজগুবি খাত মহিলাদের জন্য তৈরি হবে না। সমস্ত তথ্য দিতে হবে। এর মধ্যে শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পয়োনিষ্কাশনসহ যাবতীয় তথ্য দিতে হবে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সমাধানের কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সমাধানের সঠিক দিকনির্দেশনা থাকার পর কোথায় কত অর্থের প্রয়োজন, কী ধরনের সম্পদের প্রয়োজন, সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা থাকতে হবে। তাহলে বলতে পারব শিশুদের জন্য কোথায় কাজ হচ্ছে আর কোথায় কাজ হচ্ছে না। এ জন্য শিশুদের ওপর বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। এটি বাজেটের সঙ্গে মন্ত্রণালয় থেকে বের করা যেতে পারে।

আব্দুল কাইয়ুম
আকবর আলি খান শিশুদের সহায়ক দলিল, শিশুদের অবস্থা সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদন ইত্যাদি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলেছেন। এখন বলবেন মো. এমরানুল হক চৌধুরী।

মো. এমরানুল হক চৌধুরী
শিশুদের বাজেট বিষয়ে সরকারের অঙ্গীকার পরিষ্কার নয়। শিশুদের জন্য কতটুকু বাজেট, বাজেটের ভিত্তিগুলো কী, তা স্পষ্ট নয়। শিশুদের জন্য অনেক বেশি খরচ করার সুযোগ আছে। কারণ, তাদের জন্য যা খরচ হবে, তার পুরোটাই বিনিয়োগ। শিশুদের জন্য যদি সঠিক বিনিয়োগ না হয়, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ বিক্রি করে দেওয়া হবে। কারও হিসাবে বলা হচ্ছে জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ শিশু। কারও হিসাবে ৪৭ শতাংশ। তথ্যে ভুল থাকলে বাজেটে ভুল থাকবে। শিশুদের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। না করলে কী হবে বা এর দায় কে নেবে সে বিষয় কোনো সঠিক নির্দেশনা নেই।
স্কুলে যাওয়া শিশুর হার বেড়েছে। কিন্তু ৩৮ শতাংশ শিশু ঝরে পড়ছে। তাহলে প্রকৃত শিশুশিক্ষার হার কী, এর কোনো সঠিক চিত্র নেই। এই ৩৮ শতাংশের জন্য বাজেটে কী ব্যবস্থা আছে। বাজেটে তার কোনো নির্দেশনা নেই। সরকারের প্রশাসনযন্ত্রে এমন একটা জায়গা নেই, যেখানে শিশুদের বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। কমপক্ষে সাত থেকে দশটা মন্ত্রণালয় যেতে হবে তথ্যের জন্য। তার পরও সঠিক তথ্য পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ে একটা আলাদা পরিদপ্তর (ডাইরেক্টরেট) থাকলে সেখান থেকে হয়তো শিশুদের তথ্য পাওয়া যেত। ১০টা মন্ত্রণালয় শিশুদের বাজেটের সঙ্গে যুক্ত। বাজেটের সময় মন্ত্রণালয়গুলো এখান থেকে তথ্য পেতে পারত। আজকের এই গোলটেবিল বৈঠক থেকে এই দাবি জানাব, শিশুদের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যেন একটি আলাদা পরিদপ্তর (ডাইরেক্টরেট) অবশ্যই করা হয়।

আব্দুল কাইয়ুম
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ শিশুদের নিয়ে কিছু কাজ করেছে। এখন শুনব ফাহমিদা খাতুনের কাছ থেকে।

ফাহমিদা খাতুন
তথ্য নিয়ে কিছু আলোচনা এসেছে এখানে। এখানে দুটো সমস্যা রয়েছে। এক. অনেক দিন পর পর জনসংখ্যা গণনা হয়। দুই. শিশুদের সংজ্ঞা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। সরকারি তথ্যে শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত। এখানে তথ্যের ব্যাপক গরমিল দেখা যায়। ২০১১ সালে সরকারের জনসংখ্যা জরিপে বলা হয়েছে, শিশুর হার ৩০ শতাংশ। অন্যরা বলছে ৪৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে তথ্যে বিরাট পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি কোনো পরিকল্পনাই শিশুদের ক্ষেত্রে সঠিক হচ্ছে না।
সরকার শিশুদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও অর্থনৈতিক বরাদ্দ দেয়। ২০১০-১১-এর বাজেটে সরাসরি শিশুদের কল্যাণ হয়, সরকারের এমন কর্মসূচির বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ৪.১ শতাংশ। স্কুলে শিশুভর্তির হার বেড়েছে। এরা যদি শিক্ষিত হয়ে বের না হতে পারে, তাহলে বর্ধিত ভর্তির হার কোনো কাজে আসছে না। তা ছাড়া ধনী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা আমাদের বাজেটের মধ্যে আসছে না। শিশুমৃত্যু ও শিক্ষার হারের ক্ষেত্রে শহর, বস্তি, গ্রামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাই বাজেট বরাদ্দের সময় লক্ষ্য স্থির করতে হবে, কাদের জন্য কীভাবে অর্থ ব্যয় করা হবে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে বিভিন্ন বিষয় অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। কিন্তু শিশুদের বিষয়ে কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। কারণ, শিশুদের সব সময় প্রান্তিক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এম আমিনুল ইসলাম
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করার জন্য প্রতি পাঁচ বছরে আমাদের শিশুদের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়। সেখানেও ঠিক সময় দিতে ব্যর্থ হই। গত ১০ বছরে একটা দিতে পেরেছি। এবার অক্টোবর মাসে জমা দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে জরুরি তথ্য হলো, গত পাঁচ বছরে সরকার শিশুদের জন্য কোন কোন খাতে কত ব্যয় করেছে, সে তথ্যের জন্য ১৮টি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের তথ্য দিতে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে।
আমাদের শিশুনীতি রয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শিশুবিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ছিল। পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাস্তবায়ন কী হয়েছে বা হবে, সেটি আলাদা বিষয়। ২০১০-১১ সালের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মোট বরাদ্দ ১৪.৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে খুব সামান্য অংশ শিশুদের জন্য। জাতীয় গড় দিয়ে চিন্তা করলে সব শিশু উপকৃত হবে না। জাতীয় গড়ের ক্ষেত্রে, জন্মনিবন্ধনের কথা ধরা যাক। ২০০৬ সালে এটা ছিল ১০ শতাংশ। বর্তমানে সরকারি হিসাবে ৭৭ শতাংশ। কোনো কোনো জায়গায় ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত জন্মনিবন্ধন আছে। আবার সিলেটের চা-বাগান এলাকায় শিশুদের জন্মনিবন্ধন ১৪ শতাংশ। শহরের বস্তিগুলোতে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কাজেই জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ভৌগোলিক বরাদ্দ। শিশুদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের পিছিয়ে পড়া শিশুদের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

হাসানুল হক ইনু
শিশুদের শ্রেণীবিভাগ আছে। যেমন দরিদ্র শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, শ্রবণপ্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, এতিম শিশু, শ্রমিক শিশু, অটিস্টিক বেবি ইত্যাদি। এসব শিশুকে বিবেচনায় নিয়ে বাজেট করতে হবে। সরাসরি শিশুদের কল্যাণের জন্য বরাদ্দ ৪.১ শতাংশ। সবার সঙ্গে একমত যে এটি যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে জিডিপির ব্যয় ২.৫ শতাংশ। বিগত ২০ বছর ধরে প্রায় একই ধারা রয়েছে। যেখানে উন্নয়নশীল দেশে এটি ৪ থকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত। শিশুদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখন আর ধীরে চলার সুযোগ নেই। একবারে কিছুটা বেশি বাড়িয়ে ফেলতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে সেভাবে হয়নি। এখন সময় এসেছে এ জায়গাটিতে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সংসদ সদস্যসহ সবাইকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, বিনোদন—এই কয়েকটি জায়গায় জোর দিতে চাই।
আমাদের শিশু নীতিমালা ও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ রয়েছে। এ দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে শিশুদের বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি ভাবতে হবে। ৮০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২০ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ মানবসম্পদের জন্য এ ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে। দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে, টয়লেট, পানি, ফ্যান, জানালার গ্রিল ইত্যাদি নেই। ফলে শিশুরা সেখানে পড়ালেখার ভালো পরিবেশ পাচ্ছে না। এখানে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সবশেষে বলতে চাই, শিশুদের উন্নয়ন ও কল্যাণের জায়গাগুলোতে সংসদ সদস্য, জনসাধারণ সবাই মিলে একসঙ্গে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যাতে শিশুদের প্রকৃত মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

সাদেকা হালিম
এখন পর্যন্ত শিশুদের সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করে। অথচ এ দুটি মন্ত্রণালয় হলো দন্তহীন মন্ত্রণালয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হয় সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে। কিন্তু তাদের প্রতিযোগিতা করতে হয় অনেক শক্তিশালী মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। এই মন্ত্রণালয়গুলোর কাজ আদায় করার ক্ষমতা কতটুকু আছে, সেটি একটি প্রশ্ন। শিশুদের কেবল শিশু হিসেবে দেখা হয়। সমাজে শিশুকে মূল্যায়ন করা হয় না। মেয়েশিশু আরও বেশি অবহেলিত।
দেশকে শিক্ষার ক্ষেত্রে পঙ্গু করে দেওয়ার একটি বড় কারণ হলো দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবে শিক্ষক নিয়োগ। একজন মেধাহীন শিক্ষক যত বছর শিক্ষকতা করবেন, তত বছর শিশুরা তাঁর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি কখনো শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবেন না। আমাদের শিশুর ভবিষ্যৎ আমরা ধ্বংস করতে পারি না। যে মানুষটি ২৫ থেকে ৩০ বছর সেবা দেবেন, তাঁকে অনেক যাচাইবাছাই করে নিতে হবে। কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে কোনো রকম ছাড় দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এটা যদি চলতে থাকে, তাহলে এটা হবে আত্মঘাতী কাজ। তাই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বস্তির শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, যে শিশুরা বাসায়, দোকানে, কারখানায় কাজ করে, যে শিশুটি পথের ধারে লাল গোলাপ বিক্রি করে, বাজেটে তার জন্য কোথায় বলা আছে? এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ব্যাপক হারে শিশুশ্রম ও অনৈতিক কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেখাশোনার কোনো ব্যবস্থা নেই।

আব্দুল কাইয়ুম
শিক্ষকেরা আমাদের শিশুদের জীবন গড়েন। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এবার বলবেন শামসুল আলম।

শামসুল আলম
গত ২০-২২ বছর ধরে শিশুদের সঙ্গে কাজ করছি। প্রতি সপ্তাহে তাদের সঙ্গে কথা হয়। সম্প্রতি শিশুদের অভিযোগ হলো, শিশুনীতি হচ্ছে, জন্মনিবন্ধন হচ্ছে, আরও অনেক কিছু হচ্ছে। স্কুলে ভর্তি হতে পারব তো? শিশুরা প্রতিনিয়ত এই প্রশ্ন আমাকে করছে। আমার কাছে এটি একটি বিরাট প্রশ্ন।
মানবাধিকার সনদ তৈরি হওয়ার পরও শিশু অধিকার সনদ কেন তৈরি হলো। নিশ্চয়ই শিশুদের আলাদা কোনো চাহিদা আছে। সেই চাহিদা পূরণের জন্য কীভাবে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এটা কীভাবে বাজেট থেকে বের করব। যদি বিনিয়োগ পরিষ্কার না হয়, কীভাবে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। যে বিনিয়োগই হোক না কেন, সেখানে আবার দুর্নীতি হচ্ছে। সেটা শিশুদের ওপর কী প্রভাব ফেলছে? সেটি নিয়ে ভাবা হচ্ছে না।
বরাদ্দ বাড়বে কী কমবে, সেটি আলাদা প্রশ্ন। যে বরাদ্দ আছে, সেটি কাদের জন্য। কোন পর্যায়ের শিশুর কতটুকু উপকার হবে। কাদের কতটুকু প্রভাবিত করবে—এই বড় প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই আজকে শিশুদের জন্য বিনিয়োগের পরিমাণ জানা দরকার।

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
শিশুর সার্বিক উন্নয়নে বিনিয়োগ কথাটিকে সমর্থন করছি। বিনিয়োগ হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য। শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন যে খাতেই খরচ হোক না কেন, সেটা হবে বিনিয়োগ। আমরা ও আমাদের চেয়ে ধনী, বিভিন্নভাবে ক্ষমতার অধিকারী, তাদের শিশুদের কথা বাজেটে বলার দরকার নেই। বলতে হবে পিছিয়ে পড়া শিশুদের কথা। এরাই আমাদের চিন্তার কারণ।
বাংলাদেশ হচ্ছে একটা বৈষম্যপূর্ণ দেশ। এখানে যারা ধনী, তারাই শিক্ষিত হয়। বাকিরা বিভিন্নভাবে পিছিয়ে পড়ে। পিছিয়ে রাখার বড় হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষানীতিতে অনেক এগিয়েছি। শ্রমিক, পথ ও পাহাড়ি শিশু, চর, হাওর ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, অতিদরিদ্র শিশু—এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুর কথা শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে। এই শিক্ষানীতি মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। সংসদে পাস হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য আইনের দরকার। বাজেট আলাদা না করে বরং সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। শিশুদের কোথায় কী সমস্যা আছে এবং কত বরাদ্দ দরকার।
শিক্ষাবৃত্তির সমস্যা নিয়ে অনেকে বলেছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন থেকে শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। গত বছর শুরু করেছি। এ বছর বেশি পরিমাণ দেওয়ার কথা। সমস্যা হচ্ছে, যারা খুব ভালো করেছে, তাদের কিছু টাকা দিতে পারি। কিন্তু এই টাকা তার পরিবার খরচ করে ফেলবে। এ জন্য তাদের পরিবারকে প্রতিষ্ঠানে কাজ দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কিছু শিশুর কল্যাণ করছে। এটি শিশুর উন্নয়ন নয়। এ জায়গাটিতে ভাবতে হবে। শিক্ষা এখনো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে, এটিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ পরিবর্তন গ্রহণ করতে চায় না। বরং পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। সবকিছু শুধু আলোচনা করলে হবে না। এ কাজগুলো করার জন্য সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে।

চৌধুরী মো. তাইয়ুব তাজাম্মুল
শিশু অধিকার বাস্তবায়ন করতে হলে একটা সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। শিশুদের অধিকার নিয়ে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো আন্দোলন হয়নি। তাই শিশুরা সব সময় দৃষ্টির অন্তরালে থেকে গেছে। বাজেটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। শিশুদের বিষয় নিয়ে কখনো কথা হয়েছে মনে পড়ে না। শিশুদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য কল্যাণমুখী কাজ হচ্ছে কি না, সেটি দেখার বিষয় রয়েছে। আদৌ কোনো কাজ হলো কি না, সেটা কোনোভাবে বোঝা যায় না। এর কোনো ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ন হয় না। আমরা যেটা চাই, তা হলো বাজেটে কমপক্ষে এমন একটা পদ্ধতি থাকবে, যা থেকে ধারণা করা যায়, শিশুদের জন্য কী পরিমাণ অর্থ রাখা হলো, কী পরিমাণ খরচ হলো এবং তা থেকে শিশুরা কতটুকু উপকৃত হলো। এসব বিশ্লেষণ করতে হলে জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা একটা অধ্যায় থাকা দরকার ।
শিশু বাজেট আলাদা কোনো বাজেটের ধারণা নয়—এটা সরকার জাতীয় বাজেটে যেসব বরাদ্দ দিয়েছে তার মধ্যে শিশুদের উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য কতটা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে এবং এসব কার্যক্রম প্রকৃতপক্ষে শিশুদের প্রয়োজন পর্যাপ্তভাবে মেটাতে পারছে কি না তা অনুসন্ধান করার প্রাথমিক ধাপ।
শিশুর অধিকার ও সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নীতি-অঙ্গীকারসমূহ পালনে কতটুকু কাজ করছে তা মূল্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার।

আব্দুল কাইয়ুম
এবার বলবেন এম এ মান্নান।

এম এ মান্নান
কোনো বিষয়ের জন্য আলাদা করে বাজেট করার অবকাশ বোধ হয় বাজেটে খুব একটা থাকে না। বাজেট হলো একটা সামগ্রিক বিষয়। শিশুদের প্রয়োজন সম্পর্কে, তাদের জন্য খরচ করা সম্পর্কে কারও কোনো দ্বিমত নেই। তারা জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের জন্য যা খরচ করা হবে, এর সবটাই বিনিয়োগ। ভবিষ্যতে তারাই শ্রমশক্তি হিসেবে কাজ করবে। আমাদের যে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী আছে, তা দিয়ে শিশুরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে। এখান থেকে তাদের কল্যাণের দিকটিতে আরও বিশেষভাবে নজর দেওয়া যেতে পারে। শিশুদের উপবৃত্তি নিয়ে আপনাদের মতো আমিও প্রশ্ন তুলেছিলাম। স্কুলে এমন অনেক পরিবারের ছেলেমেয়ে পড়ে, যারা আরও পাঁচটি শিশুকে পড়াতে পারে। কিন্তু নানা রকম জটিলতার জন্য এটা করতে পারে না। শিশুদের বিনোদনের ক্ষেত্রে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। তাদের মানসিক বিকাশের জন্য অবশ্যই বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে।

আকবর আলি খান
শিশুদের জন্য কত খরচ হলো, এর হিসাবের বিষয়টি এসেছে। এটি হিসাব করতে গেলে অনেক অর্থ ব্যয় হবে। শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য পুলিশের বরাদ্দ। এখানে শিশুদের বরাদ্দ শূন্য বলা যাবে না। আবার পুলিশ শিশুদের অধিকার হরণ করছে। তাহলে কীভাবে হিসাব করবেন। সে ক্ষেত্রে শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য পুলিশের বিশেষ ইউনিট থাকতে পারে। তাদের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সেবা পাওয়ার বিষয়টি আসছে। এই সেবা পেতে হলে প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। কোনো বিশেষ এলাকার বঞ্চিত শিশুদের অবস্থা ওই এলাকার প্রতিনিধিরা সরকারের নজরে আনতে পারেন। শিশুদের প্রয়োজনগুলো খুঁজে বের করতে হবে। সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনায় অনেক মূল্যবান মতামত এসেছে। বেশ কিছু পরামর্শ এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে একটি গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.