চরাচর-পুরান ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজ পাঠাগার by পাভেল রহমান

ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ সংস্কারে ব্রাহ্মসমাজের একটা বিশাল ভূমিকা ছিল। বলা চলে ব্রাহ্মসমাজের হাত দিয়েই ভারতবর্ষের নবজাগরণ শুরু হয়। রাজা রামমোহন রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ নবজাগরণের। ১৮৯০ সালের ২৮ জানুয়ারি শহরের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করে একটি বিশেষ সভা করা হয়।


সেই সভার সিদ্ধান্তে পাঠাগারের নামকরণ করা হয় রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন সম্পাদক অভয় চন্দ্র দাস এ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবিহারী করের লেখা পূর্ববঙ্গের 'ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্ত' বইয়ে উল্লেখ আছে, ১৮৬৯ সালে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে হিসাবে এখন পাঠাগারটির বয়স ১৪৩ বছর। ব্রাহ্মসমাজের কাছে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী এ পাঠাগারটিই হচ্ছে ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো পাঠাগার। ২০০৪ সালে দেশের ৯৩টি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মধ্যে সরকার এ পাঠাগারটিকে অন্তর্ভুক্ত করে। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত রাজা রামমোহন রায় পাঠাগারে একসময় প্রায় ৩০ হাজার বই ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাঠাগার ভবনটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে। তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য এবং তাদের এ দেশীয় দালালরা মিলে এ পাঠাগারেও লুটপাট চালায়। এখনো এ পাঠাগারটিতে প্রায় পাঁচ হাজার বই রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এ পাঠাগারটিতে একসময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এ ছাড়া কবি বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, অধ্যাপক আবদুল হাই, সুফি মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমানসহ অনেকের পদচারণে মুখর হতো রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার। ১৯২৬ সালে রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার দেখতে পুরান ঢাকায় এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২৪ সালে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্য দেবী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এ পাঠাগার সংলগ্ন মন্দিরে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের অভাবে এ পাঠাগারটি এখন ধ্বংসের মুখে। ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল পাঠাগার ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে রাজউক নোটিশ পাঠায়। এ নোটিশে ভবনটিকে তিন মাসের মধ্যে ভেঙে ফেলার কথাও বলা হয়। ২০০৯ সালের প্রথম দিকে কর্তৃপক্ষ ভবনটিকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয়। সেই সঙ্গে নতুন ভবন করে পাঠাগারটি নতুন করে চালু করার কথাও বলা হয়। এ সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় নগর উন্নয়ন কমিটি। এটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হওয়ায় ভাঙার বিপক্ষে অবস্থান নেয় তারা। এরপর অনিশ্চয়তার গহ্বরে যেন হারিয়ে গেল ইতিহাসের এই পুরনো পাঠাগারটি। গণগ্রন্থাগার সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৬৮টি গণগ্রন্থাগারসহ সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে গ্রন্থাগার আছে প্রায় ৩৭৪টি। এই পাঠাগারগুলোর বেশির ভাগ এখন ধ্বংসের পথে। ৬৮টি গণগ্রন্থাগারের ৩২টি পাঠাগারেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য রয়েছে মিলনায়তন। শুধু সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী পাঠাগারগুলো। শিক্ষার আলোয় দেশকে এগিয়ে নিতে চাইলে এসব পাঠাগার সচল করতে হবে।
পাভেল রহমান

No comments

Powered by Blogger.