সিপিডির সুপারিশ-নীতি পর্যালোচনা ও সংস্কারে উদ্যোগ চাই
জাতীয় বাজেট সামনে রেখে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডি। পলিসি সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের সুপারিশ এখানে তুলে ধরা হলো। উন্নয়ন কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলাফলের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে নীতি পর্যালোচনা এবং নীতি সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ
উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি অপরিহার্য কার্যক্রম হিসেবে বিবেচিত হয়। নব্বইয়ের দশকে প্রথম প্রজন্মের সংস্কারের মধ্য দিয়ে বহু উন্নয়নশীল দেশ তাদের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে উন্মুক্ত করেছে। ধীরে ধীরে এটি উপলব্ধি হয়েছে_ দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার ব্যতিরেকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না। প্রথম প্রজন্মের সংস্কার কর্মসূচিগুলোর প্রত্যাশিত ফলাফলের জন্যও দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার মূলত প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সম্প্রতি বহু উন্নয়নশীল দেশ এ লক্ষ্যে বিভিন্ন আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্মরণযোগ্য, এ প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন কৌশলের অংশ হিসেবে ২০০৭-০৮ সময়কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিভিন্নমুখী সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল। এ সংস্কার কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়ন সম্ভাবনা জোরদার করা। এ লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠিত হয়েছিল। এগুলো হলো_ বাংলাদেশ বেটার বিজনেস ফোরাম এবং রেগুলেটরি রিফর্মস কমিটি। এ কমিটিগুলো সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা এবং খাতভিত্তিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত নীতি ও আইন সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে এবং রূপকল্প ২০২১-এর ভিত্তিতে বেশ কিছু খাতে নীতি সংস্কারের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার, রূপকল্প-২০২১ এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রকাশনা যেমন তিনটি বাজেট বক্তৃতা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ১০ বছর মেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে এর গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব উদ্যোগের লক্ষ্য হিসেবে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দারিদ্র্য বিমোচন করা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা বেগবান করার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু বর্তমান সরকার তার মেয়াদের দ্বিতীয়ার্ধে চলে এসেছে, সেহেতু নীতি সংস্কারের পর্যালোচনা করার এটাই উপযুক্ত সময়।
বর্তমান বিশ্লেষণের তিনটি উদ্দেশ্য হলো_
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের নীতি এবং সংস্কারের উদ্যোগগুলোকে চিহ্নিত করা, সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা সম্ভব :ক. সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনা সংক্রান্ত সংস্কার নীতিমালা; খ. অর্থনৈতিক সুশাসন সংক্রান্ত সংস্কার নীতিমালা; এবং গ. উন্নয়ন প্রশাসন সংক্রান্ত সংস্কার নীতিমালা।
ওপরের প্রেক্ষাপটে নীতি উদ্যোগ ও নীতি সংস্কার গ্রহণের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত অর্জিত অগ্রগতির মূল্যায়ন করা।
নীতি সংস্কার ও নীতি উদ্যোগ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় এবং বাস্তবায়ন সম্পর্কে মতামত প্রদান করা। পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর সময়কালে বেশ কিছু নীতি সংস্কার এবং নীতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।
প্রথমত, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো_ সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় খাত, জনপ্রশাসন, ভূমি সংস্কার এবং ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা। দ্বিতীয়ত, যেসব ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার অনেকটাতে সংস্কারের গতি ছিল মন্থর। যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার কাজের অগ্রগতি হয়েছে, সেগুলো অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পরিপূরক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ_ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপির ক্ষেত্রে সম্পদ সংগ্রহের সামর্থ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যা ছিল একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপগুলো দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রত্যাশিত ফল দিতে পারেনি।
তৃতীয়ত, কিছু সংস্কার এবং নীতি, যেগুলো উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক, অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থসংশ্লিষ্টদের বিরোধিতার কারণে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কিছু কিছু সংস্কার ও নীতি উদ্যোগ নেওয়ার পরও প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী করা যায়নি। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। বাড়ছে উদ্বেগ। চতুর্থত, সংস্কার সফল করার জন্য যে পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া দরকার, সে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন, ভ্যাট আইন ক্যাবিনেটে পাস হয়েছে এবং ২০১৫ সাল নাগাদ বাস্তবায়িত হবে। এর জন্য অন্তর্বর্তী সময়ে প্রচুর প্রস্তুতিমূলক কাজের প্রয়োজন। তাছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও সংস্কার কাজ অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
পঞ্চমত, কিছু কিছু নীতি উদ্যোগ এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থান নেওয়ার পরও সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযথ উদ্যোগের অভাব দেখা যাচ্ছে। যেমন, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ঋরহধহপরধষ জবঢ়ড়ৎঃরহম অপঃ-এর খসড়া এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। অথচ পুঁজিবাজারে সুশাসন এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার জন্য এর দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। একইভাবে, প্রস্তাবিত ডিমিউচুয়ালাইজেশন (পুঁজিবাজারে মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং লেনদেনের পৃথকীকরণ), আইন প্রণয়ন এবং ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে আইন শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি কার্যক্রমে আরও বেশি উদ্যোগী ভূমিকার প্রয়োজন।
ষষ্ঠত, বিভিন্ন বাধার কারণে অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যেমন, জনপ্রশাসনের সংস্কার সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব বিচারে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।
সপ্তমত, সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইন কাঠামোর ব্যাপারে একটি সাধারণ সমালোচনা হলো_ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব আইন পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে করা হয়নি। স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা না করার ফলে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে খসড়া তৈরির প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকার কারণে বারবার খসড়া সংশোধনের প্রয়োজন পড়েছে। এর ফলে আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন পিছিয়ে পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে টেলিকমিউনিকেশন্স আইনের কথা বলা যেতে পারে। এটি ২০০৬ সালে তৈরি হয়ে ২০১০ সালে সংশোধন হয়েছে এবং বর্তমানে এর আরেক দফা সংশোধন চলছে। একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও। যেমন, ইউনিয়ন পরিষদ এবং মিউনিসিপ্যালিটি আইন ইত্যাদি বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও সময়ের প্রয়োজনে নীতি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু আইনের গুণগত মান নিশ্চিত করে প্রত্যাশিত ফল প্রাপ্তি অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায়, সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও নীতি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা সম্ভব, কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব, বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং সংস্কারকে সমন্বিত ও কার্যকরী করার ক্ষেত্রে সহযোগী যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তাতে ঘাটতি থাকার কারণে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সরকারের ঈপ্সিত কার্যক্রম, যা বিভিন্ন নীতিপত্রে এবং ঘোষণাপত্রে উলি্লখিত হয়েছে, তার বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে থমকে গেছে। মেনে নিতে হবে যে, বাংলাদশের উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাকে বেগবান করতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব সংস্কারের মাধ্যমে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সম্পদ আহরণে দক্ষতা এবং সম্পদ ব্যবহারে উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের তাদের ঘোষিত নীতি সংস্কার এবং নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করা দরকার এবং অসম্পন্ন কাজগুলো সম্পাদনে আরও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ সংক্রান্ত যে কমিটি করা হয়েছে, সেটি এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে এবং রূপকল্প ২০২১-এর ভিত্তিতে বেশ কিছু খাতে নীতি সংস্কারের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার, রূপকল্প-২০২১ এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রকাশনা যেমন তিনটি বাজেট বক্তৃতা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ১০ বছর মেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে এর গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব উদ্যোগের লক্ষ্য হিসেবে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দারিদ্র্য বিমোচন করা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা বেগবান করার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু বর্তমান সরকার তার মেয়াদের দ্বিতীয়ার্ধে চলে এসেছে, সেহেতু নীতি সংস্কারের পর্যালোচনা করার এটাই উপযুক্ত সময়।
বর্তমান বিশ্লেষণের তিনটি উদ্দেশ্য হলো_
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের নীতি এবং সংস্কারের উদ্যোগগুলোকে চিহ্নিত করা, সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা সম্ভব :ক. সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনা সংক্রান্ত সংস্কার নীতিমালা; খ. অর্থনৈতিক সুশাসন সংক্রান্ত সংস্কার নীতিমালা; এবং গ. উন্নয়ন প্রশাসন সংক্রান্ত সংস্কার নীতিমালা।
ওপরের প্রেক্ষাপটে নীতি উদ্যোগ ও নীতি সংস্কার গ্রহণের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত অর্জিত অগ্রগতির মূল্যায়ন করা।
নীতি সংস্কার ও নীতি উদ্যোগ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় এবং বাস্তবায়ন সম্পর্কে মতামত প্রদান করা। পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর সময়কালে বেশ কিছু নীতি সংস্কার এবং নীতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।
প্রথমত, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো_ সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় খাত, জনপ্রশাসন, ভূমি সংস্কার এবং ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা। দ্বিতীয়ত, যেসব ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার অনেকটাতে সংস্কারের গতি ছিল মন্থর। যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার কাজের অগ্রগতি হয়েছে, সেগুলো অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পরিপূরক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ_ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপির ক্ষেত্রে সম্পদ সংগ্রহের সামর্থ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যা ছিল একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপগুলো দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রত্যাশিত ফল দিতে পারেনি।
তৃতীয়ত, কিছু সংস্কার এবং নীতি, যেগুলো উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক, অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থসংশ্লিষ্টদের বিরোধিতার কারণে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কিছু কিছু সংস্কার ও নীতি উদ্যোগ নেওয়ার পরও প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী করা যায়নি। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। বাড়ছে উদ্বেগ। চতুর্থত, সংস্কার সফল করার জন্য যে পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া দরকার, সে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন, ভ্যাট আইন ক্যাবিনেটে পাস হয়েছে এবং ২০১৫ সাল নাগাদ বাস্তবায়িত হবে। এর জন্য অন্তর্বর্তী সময়ে প্রচুর প্রস্তুতিমূলক কাজের প্রয়োজন। তাছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও সংস্কার কাজ অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
পঞ্চমত, কিছু কিছু নীতি উদ্যোগ এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থান নেওয়ার পরও সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযথ উদ্যোগের অভাব দেখা যাচ্ছে। যেমন, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ঋরহধহপরধষ জবঢ়ড়ৎঃরহম অপঃ-এর খসড়া এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। অথচ পুঁজিবাজারে সুশাসন এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার জন্য এর দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। একইভাবে, প্রস্তাবিত ডিমিউচুয়ালাইজেশন (পুঁজিবাজারে মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং লেনদেনের পৃথকীকরণ), আইন প্রণয়ন এবং ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে আইন শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি কার্যক্রমে আরও বেশি উদ্যোগী ভূমিকার প্রয়োজন।
ষষ্ঠত, বিভিন্ন বাধার কারণে অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যেমন, জনপ্রশাসনের সংস্কার সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব বিচারে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।
সপ্তমত, সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইন কাঠামোর ব্যাপারে একটি সাধারণ সমালোচনা হলো_ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব আইন পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে করা হয়নি। স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা না করার ফলে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে খসড়া তৈরির প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকার কারণে বারবার খসড়া সংশোধনের প্রয়োজন পড়েছে। এর ফলে আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন পিছিয়ে পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে টেলিকমিউনিকেশন্স আইনের কথা বলা যেতে পারে। এটি ২০০৬ সালে তৈরি হয়ে ২০১০ সালে সংশোধন হয়েছে এবং বর্তমানে এর আরেক দফা সংশোধন চলছে। একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও। যেমন, ইউনিয়ন পরিষদ এবং মিউনিসিপ্যালিটি আইন ইত্যাদি বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও সময়ের প্রয়োজনে নীতি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু আইনের গুণগত মান নিশ্চিত করে প্রত্যাশিত ফল প্রাপ্তি অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায়, সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও নীতি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা সম্ভব, কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব, বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং সংস্কারকে সমন্বিত ও কার্যকরী করার ক্ষেত্রে সহযোগী যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তাতে ঘাটতি থাকার কারণে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সরকারের ঈপ্সিত কার্যক্রম, যা বিভিন্ন নীতিপত্রে এবং ঘোষণাপত্রে উলি্লখিত হয়েছে, তার বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে থমকে গেছে। মেনে নিতে হবে যে, বাংলাদশের উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাকে বেগবান করতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব সংস্কারের মাধ্যমে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সম্পদ আহরণে দক্ষতা এবং সম্পদ ব্যবহারে উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের তাদের ঘোষিত নীতি সংস্কার এবং নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করা দরকার এবং অসম্পন্ন কাজগুলো সম্পাদনে আরও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ সংক্রান্ত যে কমিটি করা হয়েছে, সেটি এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
No comments