স্মরণ-রক্তাক্ত দৃশ্যপটের পশ্চাদ্ভূমি by সেরনিয়াবাত প্রিয়াংকা তাজ ও তাজ ইমন আহমদ
কনকনে শীতের রাত। নৌকায় চলছেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর এক সহযোদ্ধা। সেরনিয়াবাতের সহযাত্রী ইউনুস তালুকদারের কাছে শুনেছি সেই স্মৃতির কথা, শুনেছি তাঁর মানবিক গুণাবলির কথা, একজন নেতা হিসেবে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা।
একসময়ে যেটা ছিল রব সেরনিয়াবাতের নির্বাচনী এলাকা (বাকেরগঞ্জ-১), সেখানকার বর্তমান সাংসদ তিনি। আমরা জানতে পেরেছি, রব সেরনিয়াবাত তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে কতটা কাছের ছিলেন।
পঁচাত্তর সালের ১৪ আগস্ট। আবদুর রব তখন ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব ও বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে; দিনের কর্মসূচির তালিকা ছিল খুবই দীর্ঘ—অফিসের কাজ, বঙ্গভবনে যাওয়া, মায়ের মিলাদে—এত ঝড়-ঝামেলার পর রাত ১০টা ৩০ মিনিটে এসে বরিশাল থেকে আগত তরুণদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। এই বৈঠকের মূল আলোচনার বিষয় ছিল বরিশালের গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন প্রসঙ্গ। আবদুর রব সেরনিয়াবাত রাজনৈতিকভাবে আজীবন বাম ঘরানার লোক ছিলেন। বরিশালের পাঁচটি গ্রামকে নিয়ে একটি সমতার ভিত্তিতে কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অবিরাম কাজ করে চলছিলেন। তিনি ওই পাঁচটি গ্রামের জমি ও অন্যান্য সম্পদ যৌথতার ভিত্তিতে একীভূত করে একটি সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সমবেত তরুণদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি অপশাসনের সেই ভয়াবহ কালপর্বগুলো রব সেরনিয়াবাত পাড়ি দিয়েছেন নিরবচ্ছিন্ন লড়াই ও আত্মত্যাগ দেখে দেখে। সম্ভবত ওই সময়কার অনাচার, অবিচার, বৈষম্য, লুণ্ঠন—তাঁর মধ্যে ন্যায়বিচার বোধের জন্ম দিয়েছিল। সম্পদ ও সম্পত্তির সুষম বণ্টনের চেতনা তাঁর মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল। তাঁর ন্যায়-চৈতন্যের অঙ্কুরের প্রকৃতি ও স্বভাব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে উদ্ভূত।
১৯৬৯ সালে—আওয়ামী লীগে যোগদানের আগে—তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ও বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং এই রাজনৈতিক দর্শন পরবর্তীকালে মন্ত্রী হিসেবে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলেছিল। ভূমিমন্ত্রী হিসেবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার পরিমাণ ১০০ বিঘায় সীমাবদ্ধ করার উদ্যোগের মধ্যে আমরা সেই ছায়াই দেখতে পাই। একজন আইনজীবী, ইসলামিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, সেরনিয়াবাত সমাজতন্ত্রের গুণকীর্তনে সব সময়েই অগ্রণী ছিলেন।
কলকাতার বেকার হোস্টেলের সেই একসঙ্গে থাকার দিনগুলো থেকেই তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছের বন্ধু, সুহূদ ও আস্থাজন। তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবন এবং শেখ মুজিবের মতো গগনস্পর্শী উদীয়মান রাজনৈতিক নেতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এই নিরাভরণ সারল্য এক আশ্চর্য গুণাবলি। তাঁদের সন্ধ্যাকালীন ভ্রমণের সময়, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি, মজার মজার কথা বলতেন, তখন তাঁর মনের সৌন্দর্য ফুটে উঠত।
১৪ আগস্ট রাতে তিনি তাঁর এলাকার লোকদের সঙ্গে যখন আলাপ করছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘যদি মিঞা ভাইয়ের দ্বিতীয় বিপ্লব সফল হয়, দেশ বাঁচবে, আমরাও বেঁচে যাব...আর যদি তা ব্যর্থ হয়, আমাদের কেউই বাঁচবে না।’ আবদুর রব বুঝেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ঝুঁকির মাত্রা। জাতীয় পুনর্গঠন-প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রের মৌল উপাদানগুলোকে কাটছাঁট করা হয়েছিল। এ ধরনের র্যাডিকেল পরিবর্তন দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাদের মনঃপূত হয়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার মানসে আবদুর রব এর আগে শেখ মণির সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। অনেক বছর পরে এই দুজনই আগের মতোই দৃঢ়চিত্ত ও কর্তব্যে অবিচল—দ্বিতীয় বিপ্লবের পেছনে তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন।
১৪ আগস্টের গভীর রাতে শুরু হওয়া বরিশাল থেকে আগত তরুণদের এই বৈঠক ১৫ আগস্টের ভোর পর্যন্ত চলেছিল। মিটিং শেষে তাঁর ভাতিজা জাহাঙ্গীর সেরনিয়াবাত তাঁকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। জাহাঙ্গীর তখন বরিশালের তরুণ উদীয়মান নেতা। আবদুর রব জাহাঙ্গীরকে বরিশালের উন্নয়নে কাজ করে যেতে এবং বিশেষভাবে সংখ্যালঘুদের দেখভাল করার নির্দেশ দিলেন। জাহাঙ্গীর যখন বিদায় নিলেন তখন রাত তিনটা।
এসব বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তার অশুভ পরিকল্পনা তাঁর চিন্তার মধ্যেও ছিল না। তাঁর পরিবারই ছিল তাঁর ঠাঁই এবং নিরাপদ স্বর্গসম। তাঁর প্রিয় স্ত্রী আমেনাকে তিনি এ জগতের সব অনুরাগ-সিক্ত আহ্লাদে ভরিয়ে দিতেন। কখনোই তাঁকে কোনো রকম কষ্ট সইতে দিতেন না। তাঁর ছেলেমেয়েরা যাতে নষ্ট হয়ে না যায়, সে বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি যখন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তখন তাঁর সন্তানদের তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের ব্যবস্থা করে রেখেছি, আর কিছু আশা কোরো না। ধনসম্পদ ও সম্পত্তির পুঞ্জীভবনের বিপরীত দিকে ঝুঁকো না।’ বিদ্যাশিক্ষার ওপর তিনি খুবই গুরুত্ব দিয়ে তাঁর সন্তানদের বোঝাতেন। রাজনীতিতে প্রবেশের প্রসঙ্গ এলে তিনি তাঁর সন্তানদের উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত—কোনোটাই করেননি। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে তিনি ছিলেন একেবারেই মৃদু স্বভাবের।
আবদুর রব তাঁর নয় সন্তানের মধ্যে তিনজনকে নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তাঁর মেয়ে বেবী, ছেলে আরিফ আর আরজু তাঁর স্বামী শেখ মণির সঙ্গে মৃত্যুবরণ করলেন। আবদুর রবের নাতি সুকান্ত বাবু, রিন্টু (আমির হোসেন আমুর একজন আত্মীয়) এবং লক্ষ্মীর মাও (বাড়ির কাজের তত্ত্বাবধানকারী) আবদুর রবের সঙ্গে মারা যান। প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁর অনেক সন্তানই খুবই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল এবং চিরজীবনের মতো তাঁদের নিষ্পাপ চিত্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে বোবা কান্নায় কিংবা কখনো ওই দৃশ্য, ওই মৃত্যুর মোকাবিলা তাদের জীবনকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে!
তাঁর বড় ছেলে হাসানাত, যিনি শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পেরেছিলেন, তিনি সবকিছুর সাক্ষী। তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। চোখের সামনে তাঁর বাবা আর আত্মীয়-পরিজনের মরদেহ পুলিশ সরিয়ে নিচ্ছে। আবদুর রব তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশালে তাঁর পিতৃপুরুষের ভিটেমাটির অংশীদার হিসেবে যা রেখে গেছেন, তা ছাড়া ব্যাংকে সঞ্চয় হিসেবে ৩১৪ ঢাকা পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের সেদিনের সেই কালো দিবসের ৩৫তম বার্ষিকীতে আমরা দেশপ্রেমিক ও শহীদের নাতি-নাতনিরা, আমাদের দেশের নাগরিকদের প্রতি এই আহ্বান জানাতে চাই, আসুন, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করি।
যখন আমরা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মতো মানুষের কথা বলি, তখন আমরা নিজেদের তাঁদের কাজের মূল্যায়ন করতে সক্ষম করে তুলি; তাঁরা কেমন ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে আমরা রক্তাক্ত দৃশ্যপটের পশ্চাদ্ভূমির দিকে তাকাই।
সেরনিয়াবাত প্রিয়াংকা তাজ: আবদুর রব সেরনিয়াবাতের নাতনি।
তাজ ইমন আহমদ: বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নাতি।
পঁচাত্তর সালের ১৪ আগস্ট। আবদুর রব তখন ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব ও বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে; দিনের কর্মসূচির তালিকা ছিল খুবই দীর্ঘ—অফিসের কাজ, বঙ্গভবনে যাওয়া, মায়ের মিলাদে—এত ঝড়-ঝামেলার পর রাত ১০টা ৩০ মিনিটে এসে বরিশাল থেকে আগত তরুণদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। এই বৈঠকের মূল আলোচনার বিষয় ছিল বরিশালের গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন প্রসঙ্গ। আবদুর রব সেরনিয়াবাত রাজনৈতিকভাবে আজীবন বাম ঘরানার লোক ছিলেন। বরিশালের পাঁচটি গ্রামকে নিয়ে একটি সমতার ভিত্তিতে কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অবিরাম কাজ করে চলছিলেন। তিনি ওই পাঁচটি গ্রামের জমি ও অন্যান্য সম্পদ যৌথতার ভিত্তিতে একীভূত করে একটি সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সমবেত তরুণদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি অপশাসনের সেই ভয়াবহ কালপর্বগুলো রব সেরনিয়াবাত পাড়ি দিয়েছেন নিরবচ্ছিন্ন লড়াই ও আত্মত্যাগ দেখে দেখে। সম্ভবত ওই সময়কার অনাচার, অবিচার, বৈষম্য, লুণ্ঠন—তাঁর মধ্যে ন্যায়বিচার বোধের জন্ম দিয়েছিল। সম্পদ ও সম্পত্তির সুষম বণ্টনের চেতনা তাঁর মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল। তাঁর ন্যায়-চৈতন্যের অঙ্কুরের প্রকৃতি ও স্বভাব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে উদ্ভূত।
১৯৬৯ সালে—আওয়ামী লীগে যোগদানের আগে—তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ও বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং এই রাজনৈতিক দর্শন পরবর্তীকালে মন্ত্রী হিসেবে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলেছিল। ভূমিমন্ত্রী হিসেবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার পরিমাণ ১০০ বিঘায় সীমাবদ্ধ করার উদ্যোগের মধ্যে আমরা সেই ছায়াই দেখতে পাই। একজন আইনজীবী, ইসলামিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, সেরনিয়াবাত সমাজতন্ত্রের গুণকীর্তনে সব সময়েই অগ্রণী ছিলেন।
কলকাতার বেকার হোস্টেলের সেই একসঙ্গে থাকার দিনগুলো থেকেই তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছের বন্ধু, সুহূদ ও আস্থাজন। তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবন এবং শেখ মুজিবের মতো গগনস্পর্শী উদীয়মান রাজনৈতিক নেতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এই নিরাভরণ সারল্য এক আশ্চর্য গুণাবলি। তাঁদের সন্ধ্যাকালীন ভ্রমণের সময়, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি, মজার মজার কথা বলতেন, তখন তাঁর মনের সৌন্দর্য ফুটে উঠত।
১৪ আগস্ট রাতে তিনি তাঁর এলাকার লোকদের সঙ্গে যখন আলাপ করছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘যদি মিঞা ভাইয়ের দ্বিতীয় বিপ্লব সফল হয়, দেশ বাঁচবে, আমরাও বেঁচে যাব...আর যদি তা ব্যর্থ হয়, আমাদের কেউই বাঁচবে না।’ আবদুর রব বুঝেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ঝুঁকির মাত্রা। জাতীয় পুনর্গঠন-প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রের মৌল উপাদানগুলোকে কাটছাঁট করা হয়েছিল। এ ধরনের র্যাডিকেল পরিবর্তন দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাদের মনঃপূত হয়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার মানসে আবদুর রব এর আগে শেখ মণির সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। অনেক বছর পরে এই দুজনই আগের মতোই দৃঢ়চিত্ত ও কর্তব্যে অবিচল—দ্বিতীয় বিপ্লবের পেছনে তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন।
১৪ আগস্টের গভীর রাতে শুরু হওয়া বরিশাল থেকে আগত তরুণদের এই বৈঠক ১৫ আগস্টের ভোর পর্যন্ত চলেছিল। মিটিং শেষে তাঁর ভাতিজা জাহাঙ্গীর সেরনিয়াবাত তাঁকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। জাহাঙ্গীর তখন বরিশালের তরুণ উদীয়মান নেতা। আবদুর রব জাহাঙ্গীরকে বরিশালের উন্নয়নে কাজ করে যেতে এবং বিশেষভাবে সংখ্যালঘুদের দেখভাল করার নির্দেশ দিলেন। জাহাঙ্গীর যখন বিদায় নিলেন তখন রাত তিনটা।
এসব বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তার অশুভ পরিকল্পনা তাঁর চিন্তার মধ্যেও ছিল না। তাঁর পরিবারই ছিল তাঁর ঠাঁই এবং নিরাপদ স্বর্গসম। তাঁর প্রিয় স্ত্রী আমেনাকে তিনি এ জগতের সব অনুরাগ-সিক্ত আহ্লাদে ভরিয়ে দিতেন। কখনোই তাঁকে কোনো রকম কষ্ট সইতে দিতেন না। তাঁর ছেলেমেয়েরা যাতে নষ্ট হয়ে না যায়, সে বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি যখন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তখন তাঁর সন্তানদের তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের ব্যবস্থা করে রেখেছি, আর কিছু আশা কোরো না। ধনসম্পদ ও সম্পত্তির পুঞ্জীভবনের বিপরীত দিকে ঝুঁকো না।’ বিদ্যাশিক্ষার ওপর তিনি খুবই গুরুত্ব দিয়ে তাঁর সন্তানদের বোঝাতেন। রাজনীতিতে প্রবেশের প্রসঙ্গ এলে তিনি তাঁর সন্তানদের উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত—কোনোটাই করেননি। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে তিনি ছিলেন একেবারেই মৃদু স্বভাবের।
আবদুর রব তাঁর নয় সন্তানের মধ্যে তিনজনকে নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তাঁর মেয়ে বেবী, ছেলে আরিফ আর আরজু তাঁর স্বামী শেখ মণির সঙ্গে মৃত্যুবরণ করলেন। আবদুর রবের নাতি সুকান্ত বাবু, রিন্টু (আমির হোসেন আমুর একজন আত্মীয়) এবং লক্ষ্মীর মাও (বাড়ির কাজের তত্ত্বাবধানকারী) আবদুর রবের সঙ্গে মারা যান। প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁর অনেক সন্তানই খুবই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল এবং চিরজীবনের মতো তাঁদের নিষ্পাপ চিত্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে বোবা কান্নায় কিংবা কখনো ওই দৃশ্য, ওই মৃত্যুর মোকাবিলা তাদের জীবনকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে!
তাঁর বড় ছেলে হাসানাত, যিনি শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পেরেছিলেন, তিনি সবকিছুর সাক্ষী। তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। চোখের সামনে তাঁর বাবা আর আত্মীয়-পরিজনের মরদেহ পুলিশ সরিয়ে নিচ্ছে। আবদুর রব তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশালে তাঁর পিতৃপুরুষের ভিটেমাটির অংশীদার হিসেবে যা রেখে গেছেন, তা ছাড়া ব্যাংকে সঞ্চয় হিসেবে ৩১৪ ঢাকা পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের সেদিনের সেই কালো দিবসের ৩৫তম বার্ষিকীতে আমরা দেশপ্রেমিক ও শহীদের নাতি-নাতনিরা, আমাদের দেশের নাগরিকদের প্রতি এই আহ্বান জানাতে চাই, আসুন, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করি।
যখন আমরা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মতো মানুষের কথা বলি, তখন আমরা নিজেদের তাঁদের কাজের মূল্যায়ন করতে সক্ষম করে তুলি; তাঁরা কেমন ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে আমরা রক্তাক্ত দৃশ্যপটের পশ্চাদ্ভূমির দিকে তাকাই।
সেরনিয়াবাত প্রিয়াংকা তাজ: আবদুর রব সেরনিয়াবাতের নাতনি।
তাজ ইমন আহমদ: বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নাতি।
No comments