জাতীয় সংসদ-অন্যকে অসম্মান করে কি নিজে সম্মানিত হওয়া যায়? by আলী রীয়াজ

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার দেশের কৃতবিদ্য মানুষ। শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে যখন তাঁর একটি মন্তব্যের জন্য ‘সংসদে এসে ১৬ কোটি মানুষের কাছে শর্তহীন ক্ষমা চাওয়ার জন্য’ বলা হয় তখন স্পিকারের আসনে তিনি (স্পিকার) ছিলেন না। ছিলেন না ডেপুটি স্পিকারও। ছিলেন স্পিকার প্যানেলের সদস্য সাংসদ আলী আশরাফ।


খবরটি পড়ে মনে হয়েছে, সংসদ সদস্যরা তাঁদের অধিকার রক্ষার নামে দেশের জন্য একটা ভয়াবহ ইঙ্গিত পাঠালেন। দেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা দেওয়া আছে সংসদ সদস্যরা তা সংকুচিত করার পথে আরেক কদম অগ্রসর হলেন। যে ভাষায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে সমালোচনা করা হয়েছে, তা উদ্বেগজনক। সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন যে সদস্য, কার্যত যিনি তখন স্পিকার, তিনি বলেছেন, ‘তিনি যেই হোন না কেন সার্বভৌম সংসদ অবমাননাকারীকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সংসদ সদস্যদের অবমাননা করা মানে জাতিকে অবমাননা করা। মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা।’ সাংসদ আলী আশরাফ আরও বলেন, ‘তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে গণতন্ত্রের আকাশে কালো মেঘ দেখা দেবে।’ বাংলাদেশে গণতন্ত্র কি এতটাই ভঙ্গুর যে সংসদ সদস্যদের সমালোচনা করলেই তা সংসদের অবমাননা বলে বিবেচিত হবে? একটা মন্তব্যেই ‘গণতন্ত্রের আকাশে কালো মেঘ’ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা কি সংগত? এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চাইছেন? কিসের দৃষ্টান্ত স্থাপন? এর চেয়েও উদ্বেগজনক হলো, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ওই অনুষ্ঠানে সংসদ ও সাংসদ সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি। একটি পত্রিকা তাঁর নামে মনগড়া প্রতিবেদন ছেপেছে আর সাংসদরো সেটা নিয়ে হইচই শুরু করে দিলেন। অবশ্য পরদিন ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী স্বীকার করেছেন, ভালোভাবে না জেনে এভাবে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো একজন সম্মানিত ব্যক্তির সমালোচনা করা ঠিক হয়নি। সেদিনের বক্তব্য নিয়ে গতকাল টিআইবিও ব্যাখ্যা দিয়েছে।
একজন শিক্ষকের প্রতি সাংসদদের এ আচরণে, বিশেষ করে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রতি সংসদের এই আচরণে আমার মনে হয়েছে যে দেশে স্বাধীনচেতা সৃষ্টিশীল শিক্ষকদের জন্য মুক্তচিন্তার দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। স্যারের প্রতি এই আচরণে ব্যক্তিগতভাবেও আমি মর্মাহত। আমি শিক্ষকতা করি। বারো বছর ধরে দেশের বাইরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ ও অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাংলাদেশে দু দফায় পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। সাংবাদিকতার পেশা ছেড়ে যে শিক্ষকতায় ফিরে এসেছি তাও এই পেশাকে ভালোবেসে। শিক্ষকতার প্রতি আমার আগ্রহ ও উৎসাহ তৈরি করেছেন যাঁরা, যাঁদের দেখে এই পথ বেছে নিয়েছি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁদের একজন। স্যারের নিষ্ঠা ও আত্মোৎসর্গ দেখে মনে হয়েছে এর চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে? কলেজ-জীবনে খুব কাছে থেকে স্যারকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৭৪-৭৫-৭৬ সালে স্যারের বাসার লেখকদের আড্ডায় কেটেছে অনেক সময়, মুগ্ধ বিস্ময়ে স্যারের কথা যেমন শুনেছি, তেমনি বেয়াদবের মতো তাঁর সঙ্গে বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছি। স্যার আমাদের বিতর্কে উৎসাহিত করেছেন। সেসব আড্ডায় একটা বিষয় শিখেছি, যা আমার ছাত্র (ও শিক্ষকতার) জীবনে সব সময় পাথেয় হয়ে আছে: যে নতুন প্রশ্ন করতে পারে না সে কী করে নতুন চিন্তার কথা ভাববে, নতুন কিছু আবিষ্কার করবে? স্যারের টেলিভিশন অনুষ্ঠান আনন্দমেলা, সপ্তবর্ণার পেছনের একজন হিসেবে ইফতেখার, লোদি, আমি, মোমেন (এবং এ রকম আরও অনেকে) কাজ করেছি, কণ্ঠস্বর পত্রিকার শেষ সংখ্যাটির প্রকাশনা উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান, তার আয়োজক ছিলাম রুদ্র আর আমি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রথম সময়টাতে স্যার আমাদের ডেকে নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন স্যারের সঙ্গে দেখা না হলেও পত্রিকার পাতায় স্যারের নাম দেখলেই পড়ি, এই আস্থা থেকে যে স্যারের কাছ থেকে আমাদের শেখার এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বড় শিক্ষকেরা কেবল ক্লাসরুমে পড়ান না, কেবল প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের মধ্যে পড়ান না। তাঁদের কাজ ও জীবন থেকেও অনেক কিছু শেখার থাকে। সায়ীদ স্যার তেমনি একজন শিক্ষক।
কতটা গভীর নিষ্ঠা আর ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন? যে দেশে পাঠাগার এখন মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি বললে লোকে ভিডিও লাইব্রেরি বোঝে সেখানে ঘরে ঘরে শিশু-কিশোরদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার কাজই একজন মানুষকে নমস্য করে তুলতে পারে। সে কাজ নিয়ে যে মানুষটি কয়েক দশক কাটিয়েছেন, সামাজিক আন্দোলনে সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন তাঁর যোগ্য সম্মান কী হতে পারে? বাংলাদেশের সার্বভৌম সংসদের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে রোববার তাঁকে তাঁর এই অবদানের যে প্রতিদান দিলেন তা দেখে আমার বারবার মনে হয়েছে, সংসদ ও সরকারি দল দেশের কাছে কী বার্তা পাঠাতে চাইছে? একজন সদস্য বলেছেন, ‘যিনি দেশের জন্য কিছু করতে পারেন না, দেশের মানুষের দায়িত্ব নিতে পারেন না, তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।’ কী করলে দেশের জন্য ‘কিছু করা’ হয়? দেশের জন্য দায়িত্ব নেওয়া হয়? সেটা কি কেবল রাজনীতি? কেবল সংসদ সদস্য হওয়া?
সরকারি দলের সদস্য এবং দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা শেখ সেলিম বলেছেন, ‘অধ্যাপক আবু সায়ীদ একজন শিক্ষক। ওই শিক্ষক যদি ছাত্রদের এভাবে পড়ান, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে বলতে পারছি না।’ প্রশ্নটি আমারও, একজন শিক্ষক যদি নিজে অন্যায় ও অসংগতির কথা বলতে না পারেন তবে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের তিনি কী শেখাবেন? জাতির ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে? শেখ সেলিম তাঁর বক্তব্যে কিছু বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বলেন, ‘এসব বুদ্ধিজীবী কিছু কিছু সময় জাতির বিবেক হয়ে যায়। এদের চালচলন, জীবনযাত্রা, গাড়ি-বাড়ির টাকার উৎস কোথায়? একজন শিক্ষকের তো এত গাড়ি-বাড়ি থাকার কথা না। সব টাকার উৎস সম্পর্কে তাদেরও জবাব দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীকে বলব, তাদের সেই টাকার উৎস খুঁজে বের করুন। তাদের জবাব দিতে হবে।’ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সাংসদদের বিরুদ্ধে দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য রেখেছেন, কারণ তিনি ঢালাওভাবে সাংসদদের ব্যাপারে কথা বলেছেন। একজন সাংসদ বলেছেন, ‘আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকে ভালো আছেন, আবার খারাপও আছেন। কিন্তু উনার এ ধরনের ঢালাও মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করছি।’ বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গে শেখ সেলিমের বক্তব্য কি একই ধরনের নয়? কারও অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন থাকলে তদন্ত করতে সরকারের তো আপত্তি থাকার কারণ নেই, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে সাংসদেরা নিজেদের অধিকার রক্ষার নামে অন্যদের কথা বলার অধিকার সংকুচিত করবেন? অন্যকে অসম্মান করে কি নিজের বা প্রতিষ্ঠানের সম্মান রক্ষা হয়?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.