সাক্ষাৎকার-পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য দরকার by এম মোরশেদ খান
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : লোটন একরাম ও তৌফিকুর ইসলাম বাবর এম মোরশেদ খান। ২০০১-০৬ সময়ে চারদলীয় জোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। চট্টগ্রাম-৭ আসন থেকে চারবার সাংসদ নির্বাচিত হন।
সফল এ ব্যবসায়ী সমকালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন
সমকাল : চারদলীয় জোট সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা কি মহাজোট সরকার রক্ষা করছে বলে আপনি মনে করেন?
এম মোরশেদ খান :পররাষ্ট্রনীতি চলমান প্রক্রিয়া। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই এ নীতির পরিবর্তন হয় না। তবে সরকার পরিবর্তনের পর অনেক সময় 'কৌশলগত' পরিবর্তন হতে পারে। ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সঠিক অনুশীলনের অভাবে অনেক সময় পররাষ্ট্রনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। জোট সরকার আমলে আমরা সমতার ভিত্তিতে যে কোনো বিষয় নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছি। এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সমকাল :অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে অনেকে মনে করেন। এ থেকে আমরা কী ধরনের সুবিধা আদায় করতে পারি?
এম মোরশেদ খান :ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে পরিবর্তনশীল বিশ্বে রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। বিশেষ করে, ২০১২ সালে পাঁচটি ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের মধ্যে চারটি দেশে সরকারপ্রধানের পরিবর্তন বা নির্বাচন হচ্ছে। এরই মধ্যে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট পদে পুতিন তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ফ্রান্সে প্রায় দুই দশক পর ক্ষমতায় এসেছেন বামপন্থিরা। চীনে আগামী অক্টোবরে নতুন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হবেন। বছরের শেষদিকে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র্র আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশেষ করে, ফ্রান্স ও রাশিয়ায় পরিবর্তনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো চাপের মুখে পড়তে পারে। এর প্রভাব দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়াও আফগানিস্তানে আমেরিকান পলিসি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আলোচনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। ইরানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে না পেলে অবস্থা বিস্ফোরণোন্মুখ হতে পারে। একই সঙ্গে 'আরব বসন্ত'র ধাক্কায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সূচনা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিরাজমান অবস্থা নতুন করে বিশ্বশান্তি প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
এমন অবস্থায় ভূরাজনৈতিক কারণে শক্তিধর দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার নতুনভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কৌশলগত অবস্থান সামনে রেখে বাংলাদেশকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই।
সমকাল :জোট সরকারের আমলে আপনারা পূর্বমুখী হয়েছিলেন। সে সময় অভিযোগ উঠেছিল_ আপনারা প্রতিবেশী দেশ ভারতকে উপেক্ষা করেছেন?
এম মোরশেদ খান :'পূর্বমুখী' নীতি শব্দটি আমরাই প্রথম বলেছিলাম। ২০০১ সালে যেদিন আমি পররাষ্ট্র্রমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করি, সেদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে এটাই ছিল আমার প্রথম 'বাক্য'। পরিবর্তনশীল বিশ্বে একবিংশ শতাব্দী এশিয়ানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইস্তাম্বুল থেকে টোকিও পর্যন্ত অঞ্চলকে 'পূর্ব' বলে গণ্য করেছি। বিষয়টি মাথায় রেখেই খালেদা জিয়ার সরকার 'পূর্বমুখী' নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিল। এ উক্তির কেউ কেউ ভুল ব্যাখ্যা দিলেও পরবর্তী সময়ে তারাই এর গুরুত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং এটাকে নিজেদের 'পলিসি' হিসেবে নিতে দেখা গেছে।
সমকাল :বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি সঠিক পথে আছে বলে মনে করেন কি?
এম মোরশেদ খান :নীতি হিসেবে পার্থক্য বলব না। তবে কৌশল হিসেবে সরকারকে তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আর মনোযোগী হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
সমকাল :মহাজোট সরকারের শাসনকাল সাড়ে ৩ বছর অতিবাহিত করেছে। এ সময়ের মধ্যে পররাষ্ট্র বিষয়ে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
এম মোরশেদ খান :এ সময়ে পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। বর্তমানে বিশ্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম দায়িত্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ রক্ষা করে নতুন নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্র তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে বিদেশে শ্রমবাজার প্রসারিত করতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের করুণ অবস্থা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত ছিল বলে মনে করি। নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, শীর্ষ নেতৃত্বের আশ্বাসের পরও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা নিরসনের মতো বিষয়গুলোতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সময় আরও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারেনি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সমকাল :ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি ঝুলে যাওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন? বাংলাদেশের ব্যর্থতাটা কোথায়?
এম মোরশেদ খান :যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অতীতের অভিজ্ঞতা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। যেখানে ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত 'ইন্দিরা-মুজিব' চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, সেখানে তাড়াহুড়োর বিষয়টি বোধগম্য নয়। সন্দেহ নেই যে_ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রতিবেশী দুই দেশের অনেক সমস্যা থাকাটাই স্বাভাবিক। তিস্তার ব্যাপারে ভারতের প্রয়োজনীয় কমিটমেন্ট পরিলক্ষিত হয়নি। তা ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের ভারতনীতি কোন দফতর থেকে পরিচালিত হচ্ছে_ তা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের আগে কয়েক উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আলাদাভাবে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে সমন্বয়হীনতা পরিস্থিতিকে বেশ ঘোলাটে করেছিল। বাংলাদেশের প্রতি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতার সঙ্গে দেখা করে কথা বলার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উপদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্য অপমানজনক। তিস্তাসহ সব দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিরূপণ ও সমাধান করা বাঞ্ছনীয়।
সমকাল :ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
এম মোরশেদ খান :ভারতের পক্ষ থেকে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে না বলা হলেও টিপাইমুখসহ তিস্তা নদীর উৎসে বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার আগে দলনিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে পর্যালোচনা করতে হবে। এমনকি বাঁধ দেওয়ার আগে সংসদে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়_ এমন কোনো কার্যক্রম ভারত চালাবে না বলে আশা করি।
সমকাল :আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমার রায়ে বাংলাদেশের বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
এম মোরশেদ খান :বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারই ২০০২ সালে প্রথম সমুদ্র জরিপের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৬ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। সেই উদ্যোগের ধারাবাহিকতার অংশ আজকের এ সাফল্য। এখানে এককভাবে কারও কৃতিত্ব নেওয়ার সুযোগ নেই। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এখন সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে দৃষ্টি রাখতে হবে।
সমকাল :মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য বড় বাজার সৌদি আরবের ভিসা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এর কারণ কী?
এম মোরশেদ খান :মধ্যপ্রাচ্যের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগের অভাব, বিশেষ করে দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ না রাখার কারণে এমনটি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এ সম্পর্ক উন্নয়নে বিশ্বদরবারে, ওআইসিসহ বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের ভূমিকা যাতে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়; সেদিকে নজর রাখতে হবে।
সমকাল :মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো বন্ধ ছিল। বর্তমান শ্রমমন্ত্রীর মালয়েশিয়া সফরের পর আবার শ্রমিক পাঠানো শুরু হওয়ার আশা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
এম মোরশেদ খান :নেপাল, শ্রীলংকা, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মালয়েশিয়ায় আমাদের শ্রমিক পাঠাতে হয়। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যুগোপযোগী নীতিমালা তৈরি একান্ত প্রয়োজন। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে শ্রমিক পাঠানো উচিত।
সমকাল :পদ্মা সেতুতে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এম মোরশেদ খান :মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির যে অভিযোগ করেছে, তা বাংলাদেশের মানুষ জানার অধিকার রাখে। আশা করব, বিশ্বব্যাংকের চিঠি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।
সমকাল :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করেছেন। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
এম মোরশেদ খান :২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সম্পর্কোন্নয়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। তখন মিয়ানমারের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলে সহযোগিতার লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে চীন এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে হাইওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছিল। বর্তমানে হাইওয়ে নির্মাণসহ জ্বালানি, প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারতসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও যোগাযোগ স্থাপন প্রি-কন্ডিশন হওয়া উচিত।
সমকাল :এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ নৌবহর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে থাকবে বলে খবর বেরিয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
এম মোরশেদ খান :২০২০ সালে নৌবাহিনীর ৬০ ভাগ এশিয়া বা ভারত মহাসাগরে পাঠাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে সামনে এগোতে হবে।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক ও নিরাপত্তাগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে কি?
এম মোরশেদ খান :আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের হৃদ্যতাপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণগত সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা করে যাচ্ছে। এশিয়ান রিজিওনাল ফোরামে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে বহুপক্ষীয় নিরাপত্তাজনিত সম্পর্কও রয়েছে।
সমকাল :ভারতের সাহারা গ্রুপের ঢাকার চার পাশে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণে চুক্তির বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
এম মোরশেদ খান :সব সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। আবাসন খাতে দেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে যথেষ্ট সক্ষম। ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে সরকার জমি দিলে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো কী দোষ করেছে? এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়।
সমকাল : বিএনপি ক্ষমতায় এলে পররাষ্ট্রনীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনবে কি?
এম মোরশেদ খান :চলমান প্রক্রিয়ায় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে বিএনপি। বিশেষ করে সার্কভুক্ত আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এ ছাড়া এশিয়ান রিজিওনাল ফোরামসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ও ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে। বর্তমানে দলীয় বিবেচনায় কূটনীতিক নিয়োগের আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বিএনপি সরে আসবে।
সমকাল :তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলকে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন তারা। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
এম মোরশেদ খান :আমরা নিজেরা গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে না পারলে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।
সমকাল :সময় দেওয়ার জন্য সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
এম মোরশেদ খান :সমকালকেও ধন্যবাদ।
সমকাল : চারদলীয় জোট সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা কি মহাজোট সরকার রক্ষা করছে বলে আপনি মনে করেন?
এম মোরশেদ খান :পররাষ্ট্রনীতি চলমান প্রক্রিয়া। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই এ নীতির পরিবর্তন হয় না। তবে সরকার পরিবর্তনের পর অনেক সময় 'কৌশলগত' পরিবর্তন হতে পারে। ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সঠিক অনুশীলনের অভাবে অনেক সময় পররাষ্ট্রনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। জোট সরকার আমলে আমরা সমতার ভিত্তিতে যে কোনো বিষয় নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছি। এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সমকাল :অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে অনেকে মনে করেন। এ থেকে আমরা কী ধরনের সুবিধা আদায় করতে পারি?
এম মোরশেদ খান :ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে পরিবর্তনশীল বিশ্বে রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। বিশেষ করে, ২০১২ সালে পাঁচটি ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের মধ্যে চারটি দেশে সরকারপ্রধানের পরিবর্তন বা নির্বাচন হচ্ছে। এরই মধ্যে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট পদে পুতিন তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ফ্রান্সে প্রায় দুই দশক পর ক্ষমতায় এসেছেন বামপন্থিরা। চীনে আগামী অক্টোবরে নতুন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হবেন। বছরের শেষদিকে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র্র আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশেষ করে, ফ্রান্স ও রাশিয়ায় পরিবর্তনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো চাপের মুখে পড়তে পারে। এর প্রভাব দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়াও আফগানিস্তানে আমেরিকান পলিসি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আলোচনা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। ইরানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে না পেলে অবস্থা বিস্ফোরণোন্মুখ হতে পারে। একই সঙ্গে 'আরব বসন্ত'র ধাক্কায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সূচনা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিরাজমান অবস্থা নতুন করে বিশ্বশান্তি প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
এমন অবস্থায় ভূরাজনৈতিক কারণে শক্তিধর দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার নতুনভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কৌশলগত অবস্থান সামনে রেখে বাংলাদেশকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই।
সমকাল :জোট সরকারের আমলে আপনারা পূর্বমুখী হয়েছিলেন। সে সময় অভিযোগ উঠেছিল_ আপনারা প্রতিবেশী দেশ ভারতকে উপেক্ষা করেছেন?
এম মোরশেদ খান :'পূর্বমুখী' নীতি শব্দটি আমরাই প্রথম বলেছিলাম। ২০০১ সালে যেদিন আমি পররাষ্ট্র্রমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করি, সেদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে এটাই ছিল আমার প্রথম 'বাক্য'। পরিবর্তনশীল বিশ্বে একবিংশ শতাব্দী এশিয়ানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইস্তাম্বুল থেকে টোকিও পর্যন্ত অঞ্চলকে 'পূর্ব' বলে গণ্য করেছি। বিষয়টি মাথায় রেখেই খালেদা জিয়ার সরকার 'পূর্বমুখী' নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিল। এ উক্তির কেউ কেউ ভুল ব্যাখ্যা দিলেও পরবর্তী সময়ে তারাই এর গুরুত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং এটাকে নিজেদের 'পলিসি' হিসেবে নিতে দেখা গেছে।
সমকাল :বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি সঠিক পথে আছে বলে মনে করেন কি?
এম মোরশেদ খান :নীতি হিসেবে পার্থক্য বলব না। তবে কৌশল হিসেবে সরকারকে তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আর মনোযোগী হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
সমকাল :মহাজোট সরকারের শাসনকাল সাড়ে ৩ বছর অতিবাহিত করেছে। এ সময়ের মধ্যে পররাষ্ট্র বিষয়ে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
এম মোরশেদ খান :এ সময়ে পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। বর্তমানে বিশ্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম দায়িত্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ রক্ষা করে নতুন নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্র তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে বিদেশে শ্রমবাজার প্রসারিত করতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের করুণ অবস্থা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত ছিল বলে মনে করি। নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, শীর্ষ নেতৃত্বের আশ্বাসের পরও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা নিরসনের মতো বিষয়গুলোতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সময় আরও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারেনি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সমকাল :ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি ঝুলে যাওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন? বাংলাদেশের ব্যর্থতাটা কোথায়?
এম মোরশেদ খান :যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অতীতের অভিজ্ঞতা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। যেখানে ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত 'ইন্দিরা-মুজিব' চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, সেখানে তাড়াহুড়োর বিষয়টি বোধগম্য নয়। সন্দেহ নেই যে_ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রতিবেশী দুই দেশের অনেক সমস্যা থাকাটাই স্বাভাবিক। তিস্তার ব্যাপারে ভারতের প্রয়োজনীয় কমিটমেন্ট পরিলক্ষিত হয়নি। তা ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের ভারতনীতি কোন দফতর থেকে পরিচালিত হচ্ছে_ তা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের আগে কয়েক উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আলাদাভাবে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে সমন্বয়হীনতা পরিস্থিতিকে বেশ ঘোলাটে করেছিল। বাংলাদেশের প্রতি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতার সঙ্গে দেখা করে কথা বলার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উপদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্য অপমানজনক। তিস্তাসহ সব দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিরূপণ ও সমাধান করা বাঞ্ছনীয়।
সমকাল :ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
এম মোরশেদ খান :ভারতের পক্ষ থেকে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে না বলা হলেও টিপাইমুখসহ তিস্তা নদীর উৎসে বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার আগে দলনিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে পর্যালোচনা করতে হবে। এমনকি বাঁধ দেওয়ার আগে সংসদে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়_ এমন কোনো কার্যক্রম ভারত চালাবে না বলে আশা করি।
সমকাল :আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমার রায়ে বাংলাদেশের বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
এম মোরশেদ খান :বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারই ২০০২ সালে প্রথম সমুদ্র জরিপের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৬ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। সেই উদ্যোগের ধারাবাহিকতার অংশ আজকের এ সাফল্য। এখানে এককভাবে কারও কৃতিত্ব নেওয়ার সুযোগ নেই। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এখন সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে দৃষ্টি রাখতে হবে।
সমকাল :মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য বড় বাজার সৌদি আরবের ভিসা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এর কারণ কী?
এম মোরশেদ খান :মধ্যপ্রাচ্যের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগের অভাব, বিশেষ করে দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ না রাখার কারণে এমনটি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এ সম্পর্ক উন্নয়নে বিশ্বদরবারে, ওআইসিসহ বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের ভূমিকা যাতে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়; সেদিকে নজর রাখতে হবে।
সমকাল :মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো বন্ধ ছিল। বর্তমান শ্রমমন্ত্রীর মালয়েশিয়া সফরের পর আবার শ্রমিক পাঠানো শুরু হওয়ার আশা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
এম মোরশেদ খান :নেপাল, শ্রীলংকা, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মালয়েশিয়ায় আমাদের শ্রমিক পাঠাতে হয়। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যুগোপযোগী নীতিমালা তৈরি একান্ত প্রয়োজন। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে শ্রমিক পাঠানো উচিত।
সমকাল :পদ্মা সেতুতে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এম মোরশেদ খান :মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির যে অভিযোগ করেছে, তা বাংলাদেশের মানুষ জানার অধিকার রাখে। আশা করব, বিশ্বব্যাংকের চিঠি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।
সমকাল :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করেছেন। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
এম মোরশেদ খান :২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সম্পর্কোন্নয়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। তখন মিয়ানমারের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলে সহযোগিতার লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে চীন এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে হাইওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছিল। বর্তমানে হাইওয়ে নির্মাণসহ জ্বালানি, প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারতসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও যোগাযোগ স্থাপন প্রি-কন্ডিশন হওয়া উচিত।
সমকাল :এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ নৌবহর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে থাকবে বলে খবর বেরিয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
এম মোরশেদ খান :২০২০ সালে নৌবাহিনীর ৬০ ভাগ এশিয়া বা ভারত মহাসাগরে পাঠাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে সামনে এগোতে হবে।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক ও নিরাপত্তাগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে কি?
এম মোরশেদ খান :আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের হৃদ্যতাপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণগত সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা করে যাচ্ছে। এশিয়ান রিজিওনাল ফোরামে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে বহুপক্ষীয় নিরাপত্তাজনিত সম্পর্কও রয়েছে।
সমকাল :ভারতের সাহারা গ্রুপের ঢাকার চার পাশে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণে চুক্তির বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
এম মোরশেদ খান :সব সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। আবাসন খাতে দেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে যথেষ্ট সক্ষম। ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে সরকার জমি দিলে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো কী দোষ করেছে? এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়।
সমকাল : বিএনপি ক্ষমতায় এলে পররাষ্ট্রনীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনবে কি?
এম মোরশেদ খান :চলমান প্রক্রিয়ায় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে বিএনপি। বিশেষ করে সার্কভুক্ত আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এ ছাড়া এশিয়ান রিজিওনাল ফোরামসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ও ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে। বর্তমানে দলীয় বিবেচনায় কূটনীতিক নিয়োগের আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বিএনপি সরে আসবে।
সমকাল :তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলকে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন তারা। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
এম মোরশেদ খান :আমরা নিজেরা গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে না পারলে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।
সমকাল :সময় দেওয়ার জন্য সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
এম মোরশেদ খান :সমকালকেও ধন্যবাদ।
No comments