সময়চিত্র-‘তাহারা’ সাধু, আমরাই শয়তান by আসিফ নজরুল
নতুন একটি টিভি চ্যানেল চব্বিশ ঘণ্টা খবর প্রচার করছে। সেখানে গোপন ক্যামেরায় পুলিশের ঘুষ গ্রহণের ছবি দেখানো হচ্ছে। এমন ছবি আমরা পত্রিকায়ও দেখছি বহু আগে থেকে। এরা ছিঁচকে ধরনের চোর, এমন চোর অবশ্যই আছে বাংলাদেশে। তবে দেশের হর্তাকর্তাদের কেউই এমন নন। তাঁরা ছিঁচকেও না, সিঁধেল চোরও না।
তাঁরা নিষ্কলুষ। তাঁদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হয় না টিভিতে-পত্রিকায়। ধরা সম্ভব না। কারণ তাঁরা সাধুপুরুষ। স্বয়ং উচ্চ আদালতেও তা প্রমাণ হয়েছে, হচ্ছে।
মাঝখানে ঝামেলা শুরু করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ধুমধাড়াক্কা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সাধুদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো সেই সরকারের আমলে! ভয়াবহ সব তথ্য উদ্ঘাটিত হলো, অকাট্য সব প্রমাণ দাখিল করা হলো। আসলে এ সবই ছিল যড়যন্ত্র! দেশে গণতন্ত্রের জোয়ার বওয়ামাত্র এই যড়যন্ত্র খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মান ফিরে এল, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হলো। তাঁরা সরকারের লোক। সরকারের লোক দুর্নীতি করেন না বাংলাদেশে, দুর্নীতি করে বিরোধী দল! কাজেই তাঁদের মামলা তো প্রত্যাহার হবেই! এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। থাকলে গোটা দেশ চুপ করে থাকত না এ ঘটনায়!
মামলা প্রত্যাহার হয়নি বিরোধী দলের। সরকারের দু-একজন বিচারিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই তাঁদেরও মামলা প্রত্যাহার করা যায়নি। আসলে তাঁরাও ছিলেন সাধুপুরুষ। উচ্চ আদালতে তাঁদের সাজা মাফ হয়েছে, হচ্ছে। এমনকি বিরোধী দলের যেসব মহাপুরুষের দুর্নীতির খবরে ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছিল সারা দেশে, তাঁদের সাজাও একে একে বাতিল হচ্ছে উচ্চ আদালতে।
উচ্চ আদালতের দোষ নেই। দুর্নীতি প্রমাণ করার দায়িত্ব আদালতের নয়। এই দায়িত্ব সরকারি আইনজীবীদের। তাঁদেরও দোষ নেই। মামলা ঠিকমতো দায়ের না হলে, দুর্নীতির প্রমাণ না থাকলে তাঁরা কী করবেন? দোষ যে তদন্তকারীদের তাও নয়। আইনে যেভাবে আছে, নির্দেশ যেভাবে ছিল, তাঁরা সেভাবেই মামলা করেছিলেন। আইন যাঁরা বানিয়েছিলেন, নির্দেশ যাঁদের ছিল, তাহলে কি তাঁদের দোষ? তাই বা বলি কী করে! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই অগ্নিপুরুষদের সততা আর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তাঁরা হিড়হিড় করে টেনে নিয়েছেন আদালতে, নির্জনবাস করিয়েছেন মাসের পর মাস, এমনকি খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টাও নাকি করেছেন! পর্বতসম সততা আর নৈতিক মনোবল ছিল বলেই না এসব অভিযোগে কেশাগ্র স্পর্শ করা হয়নি তাঁদের!
দোষ তাঁদের কারও নেই, ছিলও না। কারণ বাংলাদেশে ছিঁচকে চোর আছে, বড় দুর্নীতিবাজ কেউ নেই। ছিঁচকে চোরদের দিয়ে দেশের দুর্নীতির পরিমাপ হয় না। কাজেই যারা বাংলাদেশকে এত দিন দুর্নীতিতে প্রথম করেছে তারা ছিল যড়যন্ত্রকারী! বাংলাদেশে বড় সব যড়যন্ত্রে বিদেশিদের হাত থাকে। এখানেও নিশ্চয়ই ছিল। এমনও হতে পারে যে, যড়যন্ত্রকারীরা ছিল ভারতের দালাল, না হলে পাকিস্তানের দালাল!
২.
কালো টাকা আর পেশিশক্তিমুক্ত নির্বাচনের কথা বলত ষড়যন্ত্রকারীরা। নেতারা কেউই যে কালো টাকার মালিক না তা তো প্রমাণিত হচ্ছেই। তাঁরা এমনকি সন্ত্রাসীও না। এসব কথা গণতন্ত্র না থাকলে বোঝা যায় না। গত গণতন্ত্রের আমলে আমরা দেখেছি, ২১ আগস্টের ঘটনায় কেউ দায়ী ছিল না। দায়ী ছিল শুধু বিদেশি শক্তি। স্বয়ং উচ্চ আদালতের একজন বিচারক তদন্ত করে তাই জানিয়েছিলেন। স্বজাতিদের সম্মান রক্ষায় জানপ্রাণ এই বিচারপতির মূল্যায়ন হয়নি দেশে। এক/এগারো না হলে হয়তো তিনি সম্মানিত হতেন, প্রধান বিচারপতিও নাকি হওয়ার কথা ছিল তাঁর। অথচ নতুন গণতন্ত্রের যুগে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, তাঁরও শেষরক্ষা হবে। এ দেশে বড় মানুষেরা দুর্নীতি করে না।
দুর্নীতি করে ট্রাফিক সার্জেন্ট বা কেরানির মতো ছোট মানুষেরা। সন্ত্রাস করে জজ মিয়ারা। নতুন গণতন্ত্রের আমলেও তার কত প্রমাণ দেখছি আমরা! এই তো সেদিন এমপির গাড়িতে নাকি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ইব্রাহিম মিয়া। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছে, দোষ আসলে ইব্রাহিমেরই। এমপিরা দার্শনিক প্রজাতির মানুষ, লাইসেন্স করা অস্ত্র যেখানে-সেখানে ফেলে যেতেই পারেন। সেই অস্ত্র নিয়ে তুই ব্যাটা নাড়াচড়া করে মরলে এমপির কী দোষ! দোষ হলে হবে বড়জোর এমপির গাড়িচালক আর চামচাদের। তারা সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষেরা খুব খারাপ এ দেশে। পুলিশ তাই এদের গ্রেপ্তার করেছে, এমপিকে নয়।
ইব্রাহিমের বউ এখন আবোল-তাবোল বললেও এমপির কিছু হবে না! এমপিরা এ দেশে কখনো কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাননি। আজ পর্যন্ত কোনো আদালত তার প্রমাণ দিতে পারবেন না। যত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হোন না কেন, এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা যাদুবলে সাধুপুরুষ হয়ে যান। এখন যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, পিস্তলে এমপির হাতের ছাপ ছিল কি না, বুঝতে হবে, সেও যড়যন্ত্রকারী। কিংবা যুদ্ধাপরাধীর দোসর!
এমপিরা মাঝেমধ্যে চড়-থাপড় দেন বটে, ওসি-ডিসি, কন্ট্রাক্টর-ব্যবসায়ী এমনকি শিক্ষকদের গায়েও হাত তোলেন তাঁরা মাঝে মধ্যে। কিন্তু বুঝতে হবে, এটি দেশের ভালোর জন্যই। এমপিদের সঙ্গে বেয়াদবি করে, তাদের কোনো নির্দেশ না মেনে দেশের উন্নতি হবে কী করে! কারা খুনি, কোন মামলা নিতে হবে, কোন ব্যবসায়ী কাজ পাবে, প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয় তা এমপিদের চেয়ে ভালো কেউ বোঝে নাকি? যদি বুঝত তাহলে তারাই তো এমপি হতো! ঠিক কি না? তো এসব যারা বুঝবে না তারা যে সামান্য চড়-থাপড়ে পার পাচ্ছে এটাও তো অনেক!
এমপিরা মহাজ্ঞানীও। সরকারি দলের এমপিরা আরও জ্ঞানী। তাঁরা আইনবেত্তার চেয়ে ভালো আইন বোঝেন, চিকিত্সকের চেয়ে বেশি চিকিৎসা বোঝেন, ইতিহাসবিদদের চেয়ে বেশি ইতিহাস বোঝেন, আমলাদের চেয়ে বেশি প্রশাসন বোঝেন। তাঁরা সর্বজ্ঞানী! তবে তাঁদের চেয়ে বড় জ্ঞানী কেউ নেই তা নয়। প্রধানমন্ত্রী আছেন। বিরোধী দলের এমপিদের জন্য বিরোধী দলের নেত্রী আছেন। তাঁদের কোনো কথার সামান্য নড়চড় করেন না তাই এমপিরা! আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের কথা শোনার মতো বোকা নন তাঁরা।
এমপি-মন্ত্রী-হর্তাকর্তারা সব গুণে গুণী। সব দোষের ঊর্ধ্বে তাঁরা। এমন পোড়া দেশে এই অসামান্য সত্য বুঝতে না পারলে দোষ আমাদেরই।
৩.
আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের আরও দোষ আছে। সামান্য ট্রাফিক জ্যামে দুই-তিন ঘণ্টা দেরি হলে আমরা অধৈর্য হয়ে উঠি। মানুষে মানুষে কিলবিল করা আমাদের দেশ! যারা রাস্তাঘাট-গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি কিছুই পাচ্ছে না তারা তো কোনো চেঁচামেচি করে না? সুবোধ বালকের মতো তারা অন্ধকারে রাত কাটায়, ‘বায়োগ্যাসে’ রান্না করে, পচা পানি খেয়ে হজম করে। তারা ভোটের দিন ভোট দেয়, দলবেঁধে জনসভায় যায়, মনের সুখে প্রজননচর্চা করে, অসুখ হলে শান্তভাবে ইন্তেকাল করে।
সমস্যা আমাদের শহরের সাধারণ মানুষদের। আমরা গ্রামের মানুষের মতো সুনাগরিক হতে পারি না, রথী-মহারথীদের মতো সুশীলও হতে পারি না। ট্রাফিক জ্যামে ল্যাপটপ খুলে গাড়িতে অফিস করার যোগ্যতা নেই আমাদের। জেনারেটর কিনে বিদ্যুৎ সমস্যা দূর করার সামর্থ্য নেই, গ্যাস যায় না এমন জায়গায় থাকার ক্ষমতা নেই, দ্রব্যমূল্য বাড়লে বেশি দামে দ্রব্য কেনার বুদ্ধি নেই। শহরে ভিড় বাড়লে প্যারিস-লন্ডন এমনকি ব্যাংককে যাওয়ার মুরোদ নেই! আমাদের সব চাওয়া কেবল সরকারের কাছে। সেখানে একটা হেরফের হলে আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি, ভাঙচুর শুরু করে দিই। আরে, দ্রব্যমূল্য-বিদ্যুৎ-গ্যাসের সমস্যা তো আগের সরকারের তৈরি! আগের সরকারের আমলেরটা তার আগের সরকারের তৈরি। এই সামান্য সত্যটা বুঝতে পারি না আমরা। রেগে গিয়ে একবার একে আরেকবার ওকে ক্ষমতায় বসাই আমরা। কারও ভিশন-মিশন বোঝার ধৈর্য পর্যন্ত নেই আমাদের।
আমাদের সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা বোঝার ক্ষেত্রে। আমরা বুঝতে চাই না গ্যাস-বিদ্যুৎ-দ্রব্যমূল্য কিংবা কোমলমতিদের খুনোখুনি নিয়ে সরকারকে পড়ে থাকলে চলে না। বাঙালি জাতিকে উদ্ধারে কার কী অবদান, কোন চেতনা কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়, কোন দেশের দালালদের কীভাবে ঠেকানো যায়, দেশ রক্ষার্থে কাকে হামলা, কার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, এ ধরনের কত উঁচুমার্গীয় চিন্তায় দিন কাটে আমাদের রথী-মহারথীদের! আমরা ছাপোষা মানুষ। এসব না বুঝে খামাখাই সরকারের ওপর রুষ্ট হই আমরা।
আমরা খানিকটা ইতর প্রজাতিরও। আমাদের উদ্ধারের চিন্তায় সারা শহর নিশ্চল করে দিয়ে দামি গাড়িবহরে ছুটে বেড়ান হর্তা-কর্তা মহাজনেরা। তবু কেন রাগে মাথা খারাপ হয় আমাদের, মনের মুখে ফোটে অশ্রাব্য শব্দাবলি?
আমাদের আসলে বুঝতে হবে, তারা সাধু, আমরাই শয়তান।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মাঝখানে ঝামেলা শুরু করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ধুমধাড়াক্কা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সাধুদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো সেই সরকারের আমলে! ভয়াবহ সব তথ্য উদ্ঘাটিত হলো, অকাট্য সব প্রমাণ দাখিল করা হলো। আসলে এ সবই ছিল যড়যন্ত্র! দেশে গণতন্ত্রের জোয়ার বওয়ামাত্র এই যড়যন্ত্র খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মান ফিরে এল, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হলো। তাঁরা সরকারের লোক। সরকারের লোক দুর্নীতি করেন না বাংলাদেশে, দুর্নীতি করে বিরোধী দল! কাজেই তাঁদের মামলা তো প্রত্যাহার হবেই! এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। থাকলে গোটা দেশ চুপ করে থাকত না এ ঘটনায়!
মামলা প্রত্যাহার হয়নি বিরোধী দলের। সরকারের দু-একজন বিচারিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই তাঁদেরও মামলা প্রত্যাহার করা যায়নি। আসলে তাঁরাও ছিলেন সাধুপুরুষ। উচ্চ আদালতে তাঁদের সাজা মাফ হয়েছে, হচ্ছে। এমনকি বিরোধী দলের যেসব মহাপুরুষের দুর্নীতির খবরে ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছিল সারা দেশে, তাঁদের সাজাও একে একে বাতিল হচ্ছে উচ্চ আদালতে।
উচ্চ আদালতের দোষ নেই। দুর্নীতি প্রমাণ করার দায়িত্ব আদালতের নয়। এই দায়িত্ব সরকারি আইনজীবীদের। তাঁদেরও দোষ নেই। মামলা ঠিকমতো দায়ের না হলে, দুর্নীতির প্রমাণ না থাকলে তাঁরা কী করবেন? দোষ যে তদন্তকারীদের তাও নয়। আইনে যেভাবে আছে, নির্দেশ যেভাবে ছিল, তাঁরা সেভাবেই মামলা করেছিলেন। আইন যাঁরা বানিয়েছিলেন, নির্দেশ যাঁদের ছিল, তাহলে কি তাঁদের দোষ? তাই বা বলি কী করে! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই অগ্নিপুরুষদের সততা আর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তাঁরা হিড়হিড় করে টেনে নিয়েছেন আদালতে, নির্জনবাস করিয়েছেন মাসের পর মাস, এমনকি খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টাও নাকি করেছেন! পর্বতসম সততা আর নৈতিক মনোবল ছিল বলেই না এসব অভিযোগে কেশাগ্র স্পর্শ করা হয়নি তাঁদের!
দোষ তাঁদের কারও নেই, ছিলও না। কারণ বাংলাদেশে ছিঁচকে চোর আছে, বড় দুর্নীতিবাজ কেউ নেই। ছিঁচকে চোরদের দিয়ে দেশের দুর্নীতির পরিমাপ হয় না। কাজেই যারা বাংলাদেশকে এত দিন দুর্নীতিতে প্রথম করেছে তারা ছিল যড়যন্ত্রকারী! বাংলাদেশে বড় সব যড়যন্ত্রে বিদেশিদের হাত থাকে। এখানেও নিশ্চয়ই ছিল। এমনও হতে পারে যে, যড়যন্ত্রকারীরা ছিল ভারতের দালাল, না হলে পাকিস্তানের দালাল!
২.
কালো টাকা আর পেশিশক্তিমুক্ত নির্বাচনের কথা বলত ষড়যন্ত্রকারীরা। নেতারা কেউই যে কালো টাকার মালিক না তা তো প্রমাণিত হচ্ছেই। তাঁরা এমনকি সন্ত্রাসীও না। এসব কথা গণতন্ত্র না থাকলে বোঝা যায় না। গত গণতন্ত্রের আমলে আমরা দেখেছি, ২১ আগস্টের ঘটনায় কেউ দায়ী ছিল না। দায়ী ছিল শুধু বিদেশি শক্তি। স্বয়ং উচ্চ আদালতের একজন বিচারক তদন্ত করে তাই জানিয়েছিলেন। স্বজাতিদের সম্মান রক্ষায় জানপ্রাণ এই বিচারপতির মূল্যায়ন হয়নি দেশে। এক/এগারো না হলে হয়তো তিনি সম্মানিত হতেন, প্রধান বিচারপতিও নাকি হওয়ার কথা ছিল তাঁর। অথচ নতুন গণতন্ত্রের যুগে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, তাঁরও শেষরক্ষা হবে। এ দেশে বড় মানুষেরা দুর্নীতি করে না।
দুর্নীতি করে ট্রাফিক সার্জেন্ট বা কেরানির মতো ছোট মানুষেরা। সন্ত্রাস করে জজ মিয়ারা। নতুন গণতন্ত্রের আমলেও তার কত প্রমাণ দেখছি আমরা! এই তো সেদিন এমপির গাড়িতে নাকি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ইব্রাহিম মিয়া। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছে, দোষ আসলে ইব্রাহিমেরই। এমপিরা দার্শনিক প্রজাতির মানুষ, লাইসেন্স করা অস্ত্র যেখানে-সেখানে ফেলে যেতেই পারেন। সেই অস্ত্র নিয়ে তুই ব্যাটা নাড়াচড়া করে মরলে এমপির কী দোষ! দোষ হলে হবে বড়জোর এমপির গাড়িচালক আর চামচাদের। তারা সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষেরা খুব খারাপ এ দেশে। পুলিশ তাই এদের গ্রেপ্তার করেছে, এমপিকে নয়।
ইব্রাহিমের বউ এখন আবোল-তাবোল বললেও এমপির কিছু হবে না! এমপিরা এ দেশে কখনো কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাননি। আজ পর্যন্ত কোনো আদালত তার প্রমাণ দিতে পারবেন না। যত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হোন না কেন, এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা যাদুবলে সাধুপুরুষ হয়ে যান। এখন যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, পিস্তলে এমপির হাতের ছাপ ছিল কি না, বুঝতে হবে, সেও যড়যন্ত্রকারী। কিংবা যুদ্ধাপরাধীর দোসর!
এমপিরা মাঝেমধ্যে চড়-থাপড় দেন বটে, ওসি-ডিসি, কন্ট্রাক্টর-ব্যবসায়ী এমনকি শিক্ষকদের গায়েও হাত তোলেন তাঁরা মাঝে মধ্যে। কিন্তু বুঝতে হবে, এটি দেশের ভালোর জন্যই। এমপিদের সঙ্গে বেয়াদবি করে, তাদের কোনো নির্দেশ না মেনে দেশের উন্নতি হবে কী করে! কারা খুনি, কোন মামলা নিতে হবে, কোন ব্যবসায়ী কাজ পাবে, প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয় তা এমপিদের চেয়ে ভালো কেউ বোঝে নাকি? যদি বুঝত তাহলে তারাই তো এমপি হতো! ঠিক কি না? তো এসব যারা বুঝবে না তারা যে সামান্য চড়-থাপড়ে পার পাচ্ছে এটাও তো অনেক!
এমপিরা মহাজ্ঞানীও। সরকারি দলের এমপিরা আরও জ্ঞানী। তাঁরা আইনবেত্তার চেয়ে ভালো আইন বোঝেন, চিকিত্সকের চেয়ে বেশি চিকিৎসা বোঝেন, ইতিহাসবিদদের চেয়ে বেশি ইতিহাস বোঝেন, আমলাদের চেয়ে বেশি প্রশাসন বোঝেন। তাঁরা সর্বজ্ঞানী! তবে তাঁদের চেয়ে বড় জ্ঞানী কেউ নেই তা নয়। প্রধানমন্ত্রী আছেন। বিরোধী দলের এমপিদের জন্য বিরোধী দলের নেত্রী আছেন। তাঁদের কোনো কথার সামান্য নড়চড় করেন না তাই এমপিরা! আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের কথা শোনার মতো বোকা নন তাঁরা।
এমপি-মন্ত্রী-হর্তাকর্তারা সব গুণে গুণী। সব দোষের ঊর্ধ্বে তাঁরা। এমন পোড়া দেশে এই অসামান্য সত্য বুঝতে না পারলে দোষ আমাদেরই।
৩.
আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের আরও দোষ আছে। সামান্য ট্রাফিক জ্যামে দুই-তিন ঘণ্টা দেরি হলে আমরা অধৈর্য হয়ে উঠি। মানুষে মানুষে কিলবিল করা আমাদের দেশ! যারা রাস্তাঘাট-গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি কিছুই পাচ্ছে না তারা তো কোনো চেঁচামেচি করে না? সুবোধ বালকের মতো তারা অন্ধকারে রাত কাটায়, ‘বায়োগ্যাসে’ রান্না করে, পচা পানি খেয়ে হজম করে। তারা ভোটের দিন ভোট দেয়, দলবেঁধে জনসভায় যায়, মনের সুখে প্রজননচর্চা করে, অসুখ হলে শান্তভাবে ইন্তেকাল করে।
সমস্যা আমাদের শহরের সাধারণ মানুষদের। আমরা গ্রামের মানুষের মতো সুনাগরিক হতে পারি না, রথী-মহারথীদের মতো সুশীলও হতে পারি না। ট্রাফিক জ্যামে ল্যাপটপ খুলে গাড়িতে অফিস করার যোগ্যতা নেই আমাদের। জেনারেটর কিনে বিদ্যুৎ সমস্যা দূর করার সামর্থ্য নেই, গ্যাস যায় না এমন জায়গায় থাকার ক্ষমতা নেই, দ্রব্যমূল্য বাড়লে বেশি দামে দ্রব্য কেনার বুদ্ধি নেই। শহরে ভিড় বাড়লে প্যারিস-লন্ডন এমনকি ব্যাংককে যাওয়ার মুরোদ নেই! আমাদের সব চাওয়া কেবল সরকারের কাছে। সেখানে একটা হেরফের হলে আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি, ভাঙচুর শুরু করে দিই। আরে, দ্রব্যমূল্য-বিদ্যুৎ-গ্যাসের সমস্যা তো আগের সরকারের তৈরি! আগের সরকারের আমলেরটা তার আগের সরকারের তৈরি। এই সামান্য সত্যটা বুঝতে পারি না আমরা। রেগে গিয়ে একবার একে আরেকবার ওকে ক্ষমতায় বসাই আমরা। কারও ভিশন-মিশন বোঝার ধৈর্য পর্যন্ত নেই আমাদের।
আমাদের সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা বোঝার ক্ষেত্রে। আমরা বুঝতে চাই না গ্যাস-বিদ্যুৎ-দ্রব্যমূল্য কিংবা কোমলমতিদের খুনোখুনি নিয়ে সরকারকে পড়ে থাকলে চলে না। বাঙালি জাতিকে উদ্ধারে কার কী অবদান, কোন চেতনা কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়, কোন দেশের দালালদের কীভাবে ঠেকানো যায়, দেশ রক্ষার্থে কাকে হামলা, কার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, এ ধরনের কত উঁচুমার্গীয় চিন্তায় দিন কাটে আমাদের রথী-মহারথীদের! আমরা ছাপোষা মানুষ। এসব না বুঝে খামাখাই সরকারের ওপর রুষ্ট হই আমরা।
আমরা খানিকটা ইতর প্রজাতিরও। আমাদের উদ্ধারের চিন্তায় সারা শহর নিশ্চল করে দিয়ে দামি গাড়িবহরে ছুটে বেড়ান হর্তা-কর্তা মহাজনেরা। তবু কেন রাগে মাথা খারাপ হয় আমাদের, মনের মুখে ফোটে অশ্রাব্য শব্দাবলি?
আমাদের আসলে বুঝতে হবে, তারা সাধু, আমরাই শয়তান।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments