সপ্তাহের হালচাল-বিএনপি কোন পথে যাবে by আব্দুল কাইয়ুম
মনে হয় বিএনপির শেষ আন্দোলনের শুরু হতে যাচ্ছে ১০ জুনের পর। ওই দিন তাদের চূড়ান্ত সময়সীমা (আলটিমেটাম) শেষ হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তারা জানিয়ে দিয়েছে যে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, এটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন।
এতে কোনো সমস্যা নেই বলে সরকার দাবি করছে। কারণ এ সরকারের অধীনে স্থানীয় ও উপনির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হয়েছে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হওয়ার কারণে।
এটা বিএনপির পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। তারা বারবার বলছে, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেটা আগের মতো হুবহু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু নির্দলীয় হতে হবে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যদি শুধু মুখে বলেন যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে তাঁরা রাজি, তাহলেও বিরোধী দল সংসদে যাবে এবং আলোচনায় বসবে।
আপাতদৃষ্টিতে বলা চলে এটা হচ্ছে না। অন্তত ঘোষিত আলটিমেটামের সময়সীমার মধ্যে নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত সরকারের দিক থেকে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করার বাস্তব ভিত্তি নেই। এ অবস্থায় বিরোধী দলের ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী ১০ জুনের পর থেকে হরতাল-ঘেরাও তথা সহিংস আন্দোলন শুরু হওয়ার কথা।
প্রশ্ন হলো, বিরোধী দল কি কঠোর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত? তাদের মূল নেতাদের অনেকেই এখন জেলে। বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁদের পক্ষে মাঠের আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া সহজ হবে না। তা ছাড়া সরকারও কঠোর অবস্থানে রয়েছে। উত্তাল আন্দোলনের পথে গেলে সরকার আরও ধরপাকড় করবে। নেতা-কর্মীরা সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারবে কি না?
হয়তো এ আশঙ্কার কথা ভেবেই বিএনপি তাদের আন্দোলনের ভিন্ন কৌশল গ্রহণের কথা চিন্তা করছে। ১১ জুনের সমাবেশকে মহাসমাবেশে রূপান্তরের কথা তারা ভাবছে। কিন্তু এ জন্য বেশি হাঁকডাক না দিয়ে বরং প্রচার ও জনসংযোগের মাধ্যমে তারা মানুষের বিশাল সমাবেশ ঘটাতে চায়। গত রোববার ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের জেলার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘জনগণ সরকারের ওপর অতিষ্ঠ। তারা এখন বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। তাই এখন এমন কোনো কর্মসূচিতে যাওয়া ঠিক হবে না, যাতে জনগণ কষ্ট পায়’ (প্রথম আলো, ৪ জুন)।
এর অর্থ যদি এই দাঁড়ায় যে, বিএনপি এই মুহূর্তে হরতাল বা ওই ধরনের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকবে, তাহলে বলতে হয় যে বিএনপি এই সময়কালের সবচেয়ে সঠিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনা থেকে শুরু করে চারদিকে যেভাবে গুম আর খুনের ঘটনা চলছে তাতে মানুষ আতঙ্কিত। সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুতে মানুষ সাংঘাতিক উদ্বিগ্ন। এর ওপর আছে জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্য। বিদ্যুৎ ঘাটতি। গ্যাস ঘাটতি। চাকরির বাজারে মন্দা। দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার। সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ে অসন্তোষ। অন্তর্দ্বন্দ্ব। প্রশাসনে দলীয়করণ। সুতরাং মানুষের মধ্যে এক ধরনের সরকারবিরোধী মনোভাব যে প্রবল তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু এই অসন্তোষ কাজে লাগানোর উপায় কী? এর আগে আমরা দেখেছি মানুষ প্রতিবাদ চায়, কিন্তু হরতাল চায় না। জ্বালাও-পোড়াও পছন্দ করে না। এ অবস্থায় বিরোধীদলীয় আন্দোলনের গতানুগতিক ধারা যান্ত্রিকভাবে চালিয়ে গেলে লাভ হবে না ক্ষতি হবে তা বিরোধী দলের ভেবে দেখার সময় এসেছে। সেদিক থেকে বিরোধী দল যদি মানুষকে বিরক্ত না করে বরং সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সমাবেশের শক্তি দিয়ে জিইয়ে রাখতে পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনে তার সুফল পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অনেকে একে ‘ঠান্ডা আন্দোলন’ ভাবতে পারেন। এটা ঠিক যে ‘গরম আন্দোলন’ অনেক সময় মিসফায়ার করে, অর্থাৎ ব্যর্থ হয়। ফলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা হতাশায় নিমজ্জিত হন। এই পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদের হাতকেই শক্তিশালী করে। অন্যদিকে গণ-অসন্তোষকে ধারণ করার মতো নেতৃত্ব দিতে পারলে তথাকথিত ‘ঠান্ডা’ আন্দোলনেও অবিশ্বাস্য ফল পাওয়া সম্ভব। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসই তার প্রমাণ। ২০০৭-২০০৮ সালে জরুরি আইনের সময় কোনো দলই তেমন কোনো গণ-আন্দোলন করেনি বা করতে পারেনি। মাঝখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠেছিল মাত্র, তাতে বোঝা গিয়েছিল মানুষ কতটা খেপে আছে। কিন্তু ওই উত্তাল আন্দোলনে কোনো দলীয় সম্পৃক্ততা ছিল না। আর সেই গরম আন্দোলনও দপ করে জ্বলে উঠেছিল ক্ষণিকের জন্য।
কিন্তু পরবর্তীকালে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং আওয়ামী লীগ ইদানীংকালের সবচেয়ে বড় বিজয় লাভ করে। এটা সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগের ধীরস্থির ও বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণের কারণে। পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের সময় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, খুনখারাবি, দলীয়করণসহ যাবতীয় অপকর্ম মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছিল। মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছিল। সেই অনুকূল পরিস্থিতি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তখন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিল। তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছিল। কারণ তারা জানত যে ভোটের সুযোগ পেলে মানুষ তাদের পক্ষে রায় দেবে। এটা উপলব্ধি করে সে অনুযায়ী রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে পারাই ছিল আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব।
পরিস্থিতি এখন উল্টো। ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের সামনে যেসব সুযোগ উপস্থিত হয়েছিল, আজ প্রায় সে রকম অনুকূল পরিস্থিতি বিএনপির সামনে। এখন তাদের মাথা গরম না করে বরং পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে অগ্রসর হতে হবে।
কিন্তু হরতাল-জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া সরকারকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে বাধ্য করা সম্ভব কি না, এ প্রশ্নটি এখানে বড় হয়ে উঠবে। অথবা সে রকম নির্বাচন আদায় করা গেলেও, রাজপথের বড় আন্দোলন ছাড়া নির্বাচনে জয় লাভ করা যায় কি না, সে বিষয়টি নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দুই রকম উদাহরণই আছে। এরশাদ হটানোর জন্য নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান করতে হয়েছিল। কিন্তু আবার বিপরীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভের জন্য আওয়ামী লীগকে যে রাজপথের আন্দোলনে যেতে হয়নি, সেটা আগেই বলেছি। কোন কৌশল কখন কাজে লাগবে, সেটা স্থির করার দায়িত্ব নেতৃত্বের।
সত্যিকারের গণ-আন্দোলন দলের বা কিছু নেতার ইচ্ছা অনুযায়ী গড়ে তোলা যায় না। আর তা ছাড়া আন্দোলন মানে শুধু হরতাল নয়। রাজপথ কাঁপানো বড় সমাবেশও অনেক সময় দু-চারটা হরতালের চেয়ে বেশি ফল দিতে পারে।
অনেক সময় দেখা যায় রাজপথের আন্দোলনে মানুষ নামতে চায় না, কিন্তু উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে মানুষ বিপ্লব পর্যন্ত করে ফেলে। এখন অনেকটা সে রকম পরিস্থিতি চলছে। মানুষ দেখছে সামনে নির্বাচন। ভোট দিয়েই মানুষ তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে। দরকার হলে ক্ষমতাসীনদের সরিয়ে দিতে পারে। তাহলে কেন বৃথা রাজপথের সহিংস আন্দোলনে নামবে?
সুতরাং, আসন্ন নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি গ্রহণ ও মানুষের অসন্তোষ ধারণ করে অগ্রসর হওয়াই এখন বিরোধী দলের অন্যতম কর্মসূচি হতে পারে। প্রতিবাদ আন্দোলন চলবে। দুচারটা নিরামিষ ধরনের হরতালেও সমস্যা নেই, যদি তাতে জনসম্পৃক্তি থাকে।
এই পটভূমিতে বলা যায় হরতাল হোক বা না হোক, ১০ জুলাইয়ের পর মূলত মানুষের মনোভাব একটি সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করতে থাকবে। সেই রূপটি কতটা বিরোধী দলের অনুকূলে আর কতটা ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে যাবে, তা নির্ভর করবে দুই জোটের কৌশল ও ভূমিকার ওপর। ক্ষমতাসীন দল ও জোট যদি চোখ বন্ধ রেখে চলতে থাকে, যদি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, যদি অসহনীয় লোডশেডিং কমাতে না পারে, যদি জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে আর হরতালের প্রয়োজন হবে না। তাদের ক্ষমতাচ্যুতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। সময় কম। তাদের বুঝেশুনে চলতে হবে।
আর অন্যদিকে মানুষের অসন্তোষ কাজে লাগানোর সঠিক রাজনৈতিক কৌশল নিতে না পারলে বিরোধী দল দেশ ও দেশের মানুষকে হতাশ করবে। উভয় পক্ষের সুমতি হবে বলে আমরা আশা করি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
এটা বিএনপির পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। তারা বারবার বলছে, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেটা আগের মতো হুবহু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু নির্দলীয় হতে হবে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যদি শুধু মুখে বলেন যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে তাঁরা রাজি, তাহলেও বিরোধী দল সংসদে যাবে এবং আলোচনায় বসবে।
আপাতদৃষ্টিতে বলা চলে এটা হচ্ছে না। অন্তত ঘোষিত আলটিমেটামের সময়সীমার মধ্যে নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত সরকারের দিক থেকে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করার বাস্তব ভিত্তি নেই। এ অবস্থায় বিরোধী দলের ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী ১০ জুনের পর থেকে হরতাল-ঘেরাও তথা সহিংস আন্দোলন শুরু হওয়ার কথা।
প্রশ্ন হলো, বিরোধী দল কি কঠোর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত? তাদের মূল নেতাদের অনেকেই এখন জেলে। বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁদের পক্ষে মাঠের আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া সহজ হবে না। তা ছাড়া সরকারও কঠোর অবস্থানে রয়েছে। উত্তাল আন্দোলনের পথে গেলে সরকার আরও ধরপাকড় করবে। নেতা-কর্মীরা সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারবে কি না?
হয়তো এ আশঙ্কার কথা ভেবেই বিএনপি তাদের আন্দোলনের ভিন্ন কৌশল গ্রহণের কথা চিন্তা করছে। ১১ জুনের সমাবেশকে মহাসমাবেশে রূপান্তরের কথা তারা ভাবছে। কিন্তু এ জন্য বেশি হাঁকডাক না দিয়ে বরং প্রচার ও জনসংযোগের মাধ্যমে তারা মানুষের বিশাল সমাবেশ ঘটাতে চায়। গত রোববার ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের জেলার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘জনগণ সরকারের ওপর অতিষ্ঠ। তারা এখন বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। তাই এখন এমন কোনো কর্মসূচিতে যাওয়া ঠিক হবে না, যাতে জনগণ কষ্ট পায়’ (প্রথম আলো, ৪ জুন)।
এর অর্থ যদি এই দাঁড়ায় যে, বিএনপি এই মুহূর্তে হরতাল বা ওই ধরনের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকবে, তাহলে বলতে হয় যে বিএনপি এই সময়কালের সবচেয়ে সঠিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনা থেকে শুরু করে চারদিকে যেভাবে গুম আর খুনের ঘটনা চলছে তাতে মানুষ আতঙ্কিত। সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুতে মানুষ সাংঘাতিক উদ্বিগ্ন। এর ওপর আছে জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্য। বিদ্যুৎ ঘাটতি। গ্যাস ঘাটতি। চাকরির বাজারে মন্দা। দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার। সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ে অসন্তোষ। অন্তর্দ্বন্দ্ব। প্রশাসনে দলীয়করণ। সুতরাং মানুষের মধ্যে এক ধরনের সরকারবিরোধী মনোভাব যে প্রবল তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু এই অসন্তোষ কাজে লাগানোর উপায় কী? এর আগে আমরা দেখেছি মানুষ প্রতিবাদ চায়, কিন্তু হরতাল চায় না। জ্বালাও-পোড়াও পছন্দ করে না। এ অবস্থায় বিরোধীদলীয় আন্দোলনের গতানুগতিক ধারা যান্ত্রিকভাবে চালিয়ে গেলে লাভ হবে না ক্ষতি হবে তা বিরোধী দলের ভেবে দেখার সময় এসেছে। সেদিক থেকে বিরোধী দল যদি মানুষকে বিরক্ত না করে বরং সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সমাবেশের শক্তি দিয়ে জিইয়ে রাখতে পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনে তার সুফল পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অনেকে একে ‘ঠান্ডা আন্দোলন’ ভাবতে পারেন। এটা ঠিক যে ‘গরম আন্দোলন’ অনেক সময় মিসফায়ার করে, অর্থাৎ ব্যর্থ হয়। ফলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা হতাশায় নিমজ্জিত হন। এই পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদের হাতকেই শক্তিশালী করে। অন্যদিকে গণ-অসন্তোষকে ধারণ করার মতো নেতৃত্ব দিতে পারলে তথাকথিত ‘ঠান্ডা’ আন্দোলনেও অবিশ্বাস্য ফল পাওয়া সম্ভব। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসই তার প্রমাণ। ২০০৭-২০০৮ সালে জরুরি আইনের সময় কোনো দলই তেমন কোনো গণ-আন্দোলন করেনি বা করতে পারেনি। মাঝখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠেছিল মাত্র, তাতে বোঝা গিয়েছিল মানুষ কতটা খেপে আছে। কিন্তু ওই উত্তাল আন্দোলনে কোনো দলীয় সম্পৃক্ততা ছিল না। আর সেই গরম আন্দোলনও দপ করে জ্বলে উঠেছিল ক্ষণিকের জন্য।
কিন্তু পরবর্তীকালে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং আওয়ামী লীগ ইদানীংকালের সবচেয়ে বড় বিজয় লাভ করে। এটা সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগের ধীরস্থির ও বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণের কারণে। পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের সময় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, খুনখারাবি, দলীয়করণসহ যাবতীয় অপকর্ম মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছিল। মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছিল। সেই অনুকূল পরিস্থিতি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তখন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিল। তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছিল। কারণ তারা জানত যে ভোটের সুযোগ পেলে মানুষ তাদের পক্ষে রায় দেবে। এটা উপলব্ধি করে সে অনুযায়ী রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে পারাই ছিল আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব।
পরিস্থিতি এখন উল্টো। ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের সামনে যেসব সুযোগ উপস্থিত হয়েছিল, আজ প্রায় সে রকম অনুকূল পরিস্থিতি বিএনপির সামনে। এখন তাদের মাথা গরম না করে বরং পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে অগ্রসর হতে হবে।
কিন্তু হরতাল-জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া সরকারকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে বাধ্য করা সম্ভব কি না, এ প্রশ্নটি এখানে বড় হয়ে উঠবে। অথবা সে রকম নির্বাচন আদায় করা গেলেও, রাজপথের বড় আন্দোলন ছাড়া নির্বাচনে জয় লাভ করা যায় কি না, সে বিষয়টি নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দুই রকম উদাহরণই আছে। এরশাদ হটানোর জন্য নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান করতে হয়েছিল। কিন্তু আবার বিপরীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভের জন্য আওয়ামী লীগকে যে রাজপথের আন্দোলনে যেতে হয়নি, সেটা আগেই বলেছি। কোন কৌশল কখন কাজে লাগবে, সেটা স্থির করার দায়িত্ব নেতৃত্বের।
সত্যিকারের গণ-আন্দোলন দলের বা কিছু নেতার ইচ্ছা অনুযায়ী গড়ে তোলা যায় না। আর তা ছাড়া আন্দোলন মানে শুধু হরতাল নয়। রাজপথ কাঁপানো বড় সমাবেশও অনেক সময় দু-চারটা হরতালের চেয়ে বেশি ফল দিতে পারে।
অনেক সময় দেখা যায় রাজপথের আন্দোলনে মানুষ নামতে চায় না, কিন্তু উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে মানুষ বিপ্লব পর্যন্ত করে ফেলে। এখন অনেকটা সে রকম পরিস্থিতি চলছে। মানুষ দেখছে সামনে নির্বাচন। ভোট দিয়েই মানুষ তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে। দরকার হলে ক্ষমতাসীনদের সরিয়ে দিতে পারে। তাহলে কেন বৃথা রাজপথের সহিংস আন্দোলনে নামবে?
সুতরাং, আসন্ন নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি গ্রহণ ও মানুষের অসন্তোষ ধারণ করে অগ্রসর হওয়াই এখন বিরোধী দলের অন্যতম কর্মসূচি হতে পারে। প্রতিবাদ আন্দোলন চলবে। দুচারটা নিরামিষ ধরনের হরতালেও সমস্যা নেই, যদি তাতে জনসম্পৃক্তি থাকে।
এই পটভূমিতে বলা যায় হরতাল হোক বা না হোক, ১০ জুলাইয়ের পর মূলত মানুষের মনোভাব একটি সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করতে থাকবে। সেই রূপটি কতটা বিরোধী দলের অনুকূলে আর কতটা ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে যাবে, তা নির্ভর করবে দুই জোটের কৌশল ও ভূমিকার ওপর। ক্ষমতাসীন দল ও জোট যদি চোখ বন্ধ রেখে চলতে থাকে, যদি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, যদি অসহনীয় লোডশেডিং কমাতে না পারে, যদি জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে আর হরতালের প্রয়োজন হবে না। তাদের ক্ষমতাচ্যুতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। সময় কম। তাদের বুঝেশুনে চলতে হবে।
আর অন্যদিকে মানুষের অসন্তোষ কাজে লাগানোর সঠিক রাজনৈতিক কৌশল নিতে না পারলে বিরোধী দল দেশ ও দেশের মানুষকে হতাশ করবে। উভয় পক্ষের সুমতি হবে বলে আমরা আশা করি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments