সাদাকালো-পোশাক শিল্পের নয়া আইনে শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্বের নিরসন চাই by আহমদ রফিক
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে অনেকে গালভরা কথা বলে থাকেন। কারণ আর কিছু নয়, বিশ্ববাজারে পোশাক শিল্পের প্রবেশ। কিন্তু এর পেছনে সূচনা-পর্বের করুণ কাহিনী কারো মনে থাকে না। কলকাতার সমাজসেবী অধ্যাপক শান্তিময় রায়ের ভাষায়- এখানে ঘটেছে 'নীরব গ্রামীণ নারী বিপ্লব'।
কিন্তু কী চড়া দামে তা আমরা জানি, তবে কায়েমি স্বার্থের সুবিধাভোগী শ্রেণী কখনো সেসব উল্লেখ করে না। বেঁচে থাকার টানে গ্রাম থেকে আসা পোশাক শ্রমিক তরুণীদের ওপর চলেছে দৈহিক নির্যাতন (কখনো নালায় বা ঝোপের আড়ালে লাশ- সে কথা কেউ মনে রেখেছে বলে মনে হয় না) আর লাগাতার অর্থনৈতিক শোষণ। উপার্জন হারানোর ভয়ে অসহায় মেয়েরা ট্রেড ইউনিয়নে সংঘবদ্ধ হতে চায়নি।
অন্যদিকে আমার চেনাজানা অনেক রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোনোভাবে দাঁড় করানো একটি 'গার্মেন্ট কারখানা' থেকে দুটো, দুটো থেকে তিনটার ধারাবাহিক প্রসার ঘটিয়ে বিস্তর বিত্তের অধিকারী। ভেবে দেখুন কী পরিমাণ শোষণ, কী পরিমাণ মুনাফার কল্যাণে এমনটা সম্ভব! যতটা মুনাফা ততটা শোষণ এবং আরো মুনাফা। প্রয়োজনের মাত্রা ছাড়িয়ে পর্বতপ্রমাণ বিত্তের সঞ্চয়। খামাখা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিল উঠতি বাঙালি ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত শ্রেণী? স্বাধীন বাংলায় কোনো সরকারই জাতীয় শোষণের ও নির্যাতনের ভয়াবহতা অবসানে নজর দেয়নি।
এখনো কি খুব একটা দিচ্ছে? কিন্তু নানা কারণে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কারণে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি স্থানীয় কারণে। পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ, অঘটন, ভাঙচুর, দাহ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ালে খুব মুশকিল। প্রাথমিক অসহায়তা এখন আর ততটা নেই। মনে আছে খুব পরিচিত একজন বাম রাজনীতির নেতাকে বলেছিলাম এই নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়াতে। তাঁর নেতিবাচক জবাবের পেছনে যুক্তি ছিল। ছিল নারী শ্রমিকদের অসহায় অনিচ্ছার কথা। সংঘবদ্ধ হতে গিয়ে চাকরি হারানোর ভয়। কিন্তু এখন অবস্থা অনেকটা পালটেছে।
তবু তা কতটা ইতিবাচক পোশাক শ্রমিকদের পক্ষে! এখন হয়তো আগের মতো কথায় কথায় পোশাক শিল্পের তরুণী শ্রমিকের লাশ পড়ে না বা তাকে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয় না। তবু পরিবেশ পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। নির্যাতনের ঘটনা বা শ্রমিক নেতার গুম হওয়ার ঘটনা মাঝেমধ্যে হলেও ঘটে। এই তো কয়দিন আগে একজন শ্রমিক নেতার লাশ পড়ল, যে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব পর্যন্ত দারুণ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার সংস্থা তো নিয়মিত ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। সরকারকে হুঁশিয়ার করছে। কাজেই একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি হচ্ছে।
এসব ঘটনার প্রভাব পড়ছে আন্তর্জাতিক মহলে। যেকোনো সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের জন্য এগুলো সুখবর নয়। তা ছাড়া পোশাক শিল্প দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত। এখানে উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা, কাজ বন্ধ, আগুন-ভাঙচুর জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। কারখানা মালিক মুনাফায় যে পরিমাণ মোটাসোটা, তাতে শ্রমিকদের শায়েস্তা করতে এক মাস কারখানা বন্ধ রাখা তাঁর জন্য অসম্ভব নয়। কিন্তু এতে ক্ষতি দেশের, ক্ষতি সরকারের। ক্ষতি অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশে। অবশ্য ক্ষতি বিদেশি লেনদেনে মালিক পক্ষেরও।
হতে পারে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করেই শেষ পর্যন্ত বর্তমানে সরকার পোশাক শ্রমিকদের সুবিধা বাড়ানো ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন করতে যাচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের বেশ কিছু দিক থেকে সুবিধা বাড়বে। যেমন- চাকরির বিধিবিধানের ক্ষেত্রে, তেমনি অর্থনৈতিক বিষয়ে। বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি, বাজারদর ও জীবনযাপনের মৌল খাতে যে পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি, তাতে সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের 'রাজা' হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের জৈবনিক কষ্ট কিছুটা কমবে, এই যা।
কিন্তু এতেই মহা উৎকণ্ঠা মালিকপক্ষের। কারণ তাঁদের দেদার মুনাফার দড়িতে একটু টান পড়বে। তাই তাঁরা এ সংশোধনীর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে, যাতে সরকার নতুন আইন পাস করতে না পারে। তাঁরা দলবলে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তাদের কথা, এ আইন পাস হলে পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। অদ্ভুত, যুক্তিহীন বক্তব্য। আসল কথা, মুনাফায় কিছুটা কমতি দেখা দেবে। আর তাতেই তাঁদের শিরঃপীড়া।
আশ্চর্য, শুধু মালিক ফেডারেশনই নয়, বিজেএমইএ পর্যন্ত এ আইন পাসের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। কারণ একটাই। তারা তাদের পাহাড়-প্রমাণ মুনাফা কমাতে রাজি নয়। তারা যেমন হিসাব কষে দেখাচ্ছে যে সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ফলে পোশাক শিল্পের ক্ষতি বৃদ্ধি হবে, তেমনি পাল্টা হিসেবে এমনটিও দেখানো সম্ভব যে সংশোধিত আইনে তাদের মুনাফার পরিমাণ কিছুটা কমবে, পোশাক শিল্পের উৎপাদন ও রপ্তানি আয়ে কমতি দেখা দেবে না। বরং তাতে শ্রমিকদের কাজে উৎসাহ বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও বাড়বে।
পূর্বতন আইনের সংশোধন ঘটছে শ্রমিকের সাধারণ কর্মসময় (ঘণ্টা হিসাবে), ওভারটাইম, গ্র্যাচুইটি, ছাঁটাই, অপসারণ, পদত্যাগ, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ, ভবিষ্যৎ তহবিল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। খসড়া প্রস্তাবের প্রতিটি বিষয় নিয়ে কিছুটা দড়ি টানাটানি চলতেই পারে; কিন্তু মালিকপক্ষের ঢালাও প্রত্যাখ্যান যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। বরং আলোচনার মাধ্যমে একটা যুক্তিসংগত রফা হতে পারে। কিন্তু না, তারা রাজি নয়।
একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। প্রচলিত আইনে অতিরিক্ত কাজের (ওভারটাইমের) জন্য শ্রমিক তার মূল মজুরি মহার্ঘ্য ভাতা ইত্যাদির দ্বিগুণ হারে পাবে। এটা বহুদিনের প্রচলিত ব্যবস্থা। খসড়া আইনে এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনা অর্থাৎ শ্রমিকের জন্য নতুন সুবিধা যোগ করা হয়নি। অথচ মলিকপক্ষের হঠাৎ আবদার যে এ ক্ষেত্রে শুধু মূল মজুরির (বেসিক পে) দ্বিগুণ হারে ওভারটাইমের টাকা দেওয়া হবে। অর্থাৎ মালিকপক্ষ আরো মুনাফা কমাতে চায় শ্রমিকের প্রাপ্ত সুযোগ কমিয়ে। এটা কেন শ্রমিক মানবে।
তবে সাধারণ কর্মসময় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দৈনিক মোট আট ঘণ্টার পরিবর্তে যে সাত ঘণ্টার প্রস্তাব খসড়ায় করা হয়েছে, যা নিয়ে মালিকপক্ষের আপত্তি তাতে আগের অবস্থা বহাল রাখার বিষয়ে শ্রমিক ও সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের উৎপাদন ঘাটতির অভিযোগ সঠিক নয়। কারণ তারা তাদের প্রয়োজনীয় উৎপাদন মাত্রা ঠিক রাখতে অতিরিক্ত সময় অর্থাৎ ওভারটাইমের সাহায্য নেবেন। এতে উৎপাদন কমবে না, কিন্তু খরচ কিছুটা বাড়বে ওভারটাইমের বাড়তি ভাতার জন্য। সরকার এ ক্ষেত্রে নমনীয় হতে পারে।
একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো যে প্রতিটি মালিকপক্ষ বা বিজেএমইএ যেসব যুক্তি খাড়া করে শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত নয়া সুবিধা বাতিল করতে চাচ্ছে, সেখানে কিন্তু তাদের মুনাফার কমতির কথা বলা হচ্ছে না। একই কথা বারবার বলা হচ্ছে যে নয়া বিধানে দেশের ক্ষতি হবে। যেমন- 'উৎপাদন কমবে, রপ্তানি অর্ডার বাতিল হবে, স্টকলট বাড়বে, জিডিপিতে ধস নামবে' ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে এসব যুক্তি একেবারে ধোপে টেকে না।
তারা কখনো ভেবে দেখতে রাজি নয় যে নয়া বিধানে মুনাফার হার কিছুটা কমবে, এই যা। এ পর্যন্ত পোশাক খাতে লাগামহীন মুনাফা অর্জনের কারণে মালিকদের যে অবিশ্বাস্য শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে- দ্রুত এক থেকে একাধিক কারখানা তৈরি হয়েছে, তা যে ব্যবসার সাধারণ নিয়মে পড়ে না, হিসাবে মেলে না, সে কথা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মালিকরা ভেবে দেখতে নারাজ। আসলে অস্বাভাবিক মুনাফায় অভ্যস্ত হিসাবি মন কিছুতেই ছাড় দিতে রাজি নয়।
একটি বহু উচ্চারিত কথা- শ্রমিক-মালিক সহমর্মিতা অর্থাৎ পরস্পরকে যুক্তিগ্রাহ্য ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ব্যক্তি, দেশ, দশের সবার জন্যই মঙ্গলকর। বেশি টান পড়লে দড়ি ছিঁড়ে যায়। একইভাবে অতি শোষণের পরিণতি শোষিতের দিক থেকে পুঞ্জীভূত অসন্তোষের বিস্ফোরণ। এতে শ্রমিকের যতটা ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি কারখানা মালিকের, ক্ষতি দেশের তথা জাতীয় পর্যায়ে সরকারের। শেষোক্ত দুই পক্ষের উচিত এ অপ্রিয় সত্য অনুধাবন করা।
গত কয়েক বছরেও এই বিশেষ শিল্প খাতে ধর্মঘট, শ্রমিক অসন্তোষ, কারখানা ভাঙচুর থেকে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া ও রপ্তানি চুক্তি বরবাদ হওয়ার মতো নেতিবাচক বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে কারখানা মালিকদের খসড়া আইন সম্পর্কে তাঁদের পদক্ষেপ ঠিক করা উচিত বলে মনে করি। সংঘাতের পথ যেমন রাজনীতির পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, তেমনি শিল্প খাতেও তা লাভজনক হওয়ার কথা নয়। আর ওই বিবেচনা থেকে একচেটিয়া মুনাফানির্ভর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানোও দরকার।
প্রসঙ্গত, অন্য দু-একটি শিল্প খাতের মুনাফার হার মনে রেখে তবেই পোশাক শিল্পের লাভালাভ বিবেচনা করা উচিত। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একসময় ওষুধ শিল্পে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মুনাফা মার্জিন রেখে ওষুধের দাম নির্ধারণ করা হতো। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মরে যায়নি, বরং তাদের ধীরগতির স্থায়ী বিকাশ ঘটেছে। ওই খাতের শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধায় ঘাটতি পড়েনি। আসলে অতি লাভের বিষয়টি সমাজের পক্ষে রাষ্ট্রের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়, সহনযোগ্যও নয়। এ সত্য মালিকপক্ষের বুঝে নেওয়া জরুরি।
এসব কারণে পোশাক শিল্প খাতের মালিকদের পাশাপাশি শ্রমিক স্বার্থের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রাখা উচিত। এ দুইয়ের সমন্বিত স্বার্থে জাতীয় স্বার্থপূরণ। সে জন্যই মালিকদের বা তাঁদের প্রতিনিধিদের দেনদরবারে প্রধানমন্ত্রী বা শ্রমমন্ত্রী যেন ভেসে না যান। তাঁদের খসড়া শ্রম আইনে বড়সড় পরিবর্তন না ঘটিয়ে সামান্য কিছু অদলবদলের মধ্য দিয়ে শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেওয়ার পথই সরকারের জন্য সঠিক পন্থা হবে বলে আমরা মনে করি।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
অন্যদিকে আমার চেনাজানা অনেক রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোনোভাবে দাঁড় করানো একটি 'গার্মেন্ট কারখানা' থেকে দুটো, দুটো থেকে তিনটার ধারাবাহিক প্রসার ঘটিয়ে বিস্তর বিত্তের অধিকারী। ভেবে দেখুন কী পরিমাণ শোষণ, কী পরিমাণ মুনাফার কল্যাণে এমনটা সম্ভব! যতটা মুনাফা ততটা শোষণ এবং আরো মুনাফা। প্রয়োজনের মাত্রা ছাড়িয়ে পর্বতপ্রমাণ বিত্তের সঞ্চয়। খামাখা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিল উঠতি বাঙালি ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত শ্রেণী? স্বাধীন বাংলায় কোনো সরকারই জাতীয় শোষণের ও নির্যাতনের ভয়াবহতা অবসানে নজর দেয়নি।
এখনো কি খুব একটা দিচ্ছে? কিন্তু নানা কারণে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কারণে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি স্থানীয় কারণে। পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ, অঘটন, ভাঙচুর, দাহ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ালে খুব মুশকিল। প্রাথমিক অসহায়তা এখন আর ততটা নেই। মনে আছে খুব পরিচিত একজন বাম রাজনীতির নেতাকে বলেছিলাম এই নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়াতে। তাঁর নেতিবাচক জবাবের পেছনে যুক্তি ছিল। ছিল নারী শ্রমিকদের অসহায় অনিচ্ছার কথা। সংঘবদ্ধ হতে গিয়ে চাকরি হারানোর ভয়। কিন্তু এখন অবস্থা অনেকটা পালটেছে।
তবু তা কতটা ইতিবাচক পোশাক শ্রমিকদের পক্ষে! এখন হয়তো আগের মতো কথায় কথায় পোশাক শিল্পের তরুণী শ্রমিকের লাশ পড়ে না বা তাকে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয় না। তবু পরিবেশ পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। নির্যাতনের ঘটনা বা শ্রমিক নেতার গুম হওয়ার ঘটনা মাঝেমধ্যে হলেও ঘটে। এই তো কয়দিন আগে একজন শ্রমিক নেতার লাশ পড়ল, যে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব পর্যন্ত দারুণ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার সংস্থা তো নিয়মিত ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। সরকারকে হুঁশিয়ার করছে। কাজেই একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি হচ্ছে।
এসব ঘটনার প্রভাব পড়ছে আন্তর্জাতিক মহলে। যেকোনো সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের জন্য এগুলো সুখবর নয়। তা ছাড়া পোশাক শিল্প দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত। এখানে উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা, কাজ বন্ধ, আগুন-ভাঙচুর জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। কারখানা মালিক মুনাফায় যে পরিমাণ মোটাসোটা, তাতে শ্রমিকদের শায়েস্তা করতে এক মাস কারখানা বন্ধ রাখা তাঁর জন্য অসম্ভব নয়। কিন্তু এতে ক্ষতি দেশের, ক্ষতি সরকারের। ক্ষতি অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশে। অবশ্য ক্ষতি বিদেশি লেনদেনে মালিক পক্ষেরও।
হতে পারে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করেই শেষ পর্যন্ত বর্তমানে সরকার পোশাক শ্রমিকদের সুবিধা বাড়ানো ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন করতে যাচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের বেশ কিছু দিক থেকে সুবিধা বাড়বে। যেমন- চাকরির বিধিবিধানের ক্ষেত্রে, তেমনি অর্থনৈতিক বিষয়ে। বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি, বাজারদর ও জীবনযাপনের মৌল খাতে যে পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি, তাতে সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের 'রাজা' হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের জৈবনিক কষ্ট কিছুটা কমবে, এই যা।
কিন্তু এতেই মহা উৎকণ্ঠা মালিকপক্ষের। কারণ তাঁদের দেদার মুনাফার দড়িতে একটু টান পড়বে। তাই তাঁরা এ সংশোধনীর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে, যাতে সরকার নতুন আইন পাস করতে না পারে। তাঁরা দলবলে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তাদের কথা, এ আইন পাস হলে পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। অদ্ভুত, যুক্তিহীন বক্তব্য। আসল কথা, মুনাফায় কিছুটা কমতি দেখা দেবে। আর তাতেই তাঁদের শিরঃপীড়া।
আশ্চর্য, শুধু মালিক ফেডারেশনই নয়, বিজেএমইএ পর্যন্ত এ আইন পাসের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। কারণ একটাই। তারা তাদের পাহাড়-প্রমাণ মুনাফা কমাতে রাজি নয়। তারা যেমন হিসাব কষে দেখাচ্ছে যে সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ফলে পোশাক শিল্পের ক্ষতি বৃদ্ধি হবে, তেমনি পাল্টা হিসেবে এমনটিও দেখানো সম্ভব যে সংশোধিত আইনে তাদের মুনাফার পরিমাণ কিছুটা কমবে, পোশাক শিল্পের উৎপাদন ও রপ্তানি আয়ে কমতি দেখা দেবে না। বরং তাতে শ্রমিকদের কাজে উৎসাহ বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও বাড়বে।
পূর্বতন আইনের সংশোধন ঘটছে শ্রমিকের সাধারণ কর্মসময় (ঘণ্টা হিসাবে), ওভারটাইম, গ্র্যাচুইটি, ছাঁটাই, অপসারণ, পদত্যাগ, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ, ভবিষ্যৎ তহবিল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। খসড়া প্রস্তাবের প্রতিটি বিষয় নিয়ে কিছুটা দড়ি টানাটানি চলতেই পারে; কিন্তু মালিকপক্ষের ঢালাও প্রত্যাখ্যান যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। বরং আলোচনার মাধ্যমে একটা যুক্তিসংগত রফা হতে পারে। কিন্তু না, তারা রাজি নয়।
একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। প্রচলিত আইনে অতিরিক্ত কাজের (ওভারটাইমের) জন্য শ্রমিক তার মূল মজুরি মহার্ঘ্য ভাতা ইত্যাদির দ্বিগুণ হারে পাবে। এটা বহুদিনের প্রচলিত ব্যবস্থা। খসড়া আইনে এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনা অর্থাৎ শ্রমিকের জন্য নতুন সুবিধা যোগ করা হয়নি। অথচ মলিকপক্ষের হঠাৎ আবদার যে এ ক্ষেত্রে শুধু মূল মজুরির (বেসিক পে) দ্বিগুণ হারে ওভারটাইমের টাকা দেওয়া হবে। অর্থাৎ মালিকপক্ষ আরো মুনাফা কমাতে চায় শ্রমিকের প্রাপ্ত সুযোগ কমিয়ে। এটা কেন শ্রমিক মানবে।
তবে সাধারণ কর্মসময় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দৈনিক মোট আট ঘণ্টার পরিবর্তে যে সাত ঘণ্টার প্রস্তাব খসড়ায় করা হয়েছে, যা নিয়ে মালিকপক্ষের আপত্তি তাতে আগের অবস্থা বহাল রাখার বিষয়ে শ্রমিক ও সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের উৎপাদন ঘাটতির অভিযোগ সঠিক নয়। কারণ তারা তাদের প্রয়োজনীয় উৎপাদন মাত্রা ঠিক রাখতে অতিরিক্ত সময় অর্থাৎ ওভারটাইমের সাহায্য নেবেন। এতে উৎপাদন কমবে না, কিন্তু খরচ কিছুটা বাড়বে ওভারটাইমের বাড়তি ভাতার জন্য। সরকার এ ক্ষেত্রে নমনীয় হতে পারে।
একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো যে প্রতিটি মালিকপক্ষ বা বিজেএমইএ যেসব যুক্তি খাড়া করে শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত নয়া সুবিধা বাতিল করতে চাচ্ছে, সেখানে কিন্তু তাদের মুনাফার কমতির কথা বলা হচ্ছে না। একই কথা বারবার বলা হচ্ছে যে নয়া বিধানে দেশের ক্ষতি হবে। যেমন- 'উৎপাদন কমবে, রপ্তানি অর্ডার বাতিল হবে, স্টকলট বাড়বে, জিডিপিতে ধস নামবে' ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে এসব যুক্তি একেবারে ধোপে টেকে না।
তারা কখনো ভেবে দেখতে রাজি নয় যে নয়া বিধানে মুনাফার হার কিছুটা কমবে, এই যা। এ পর্যন্ত পোশাক খাতে লাগামহীন মুনাফা অর্জনের কারণে মালিকদের যে অবিশ্বাস্য শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে- দ্রুত এক থেকে একাধিক কারখানা তৈরি হয়েছে, তা যে ব্যবসার সাধারণ নিয়মে পড়ে না, হিসাবে মেলে না, সে কথা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মালিকরা ভেবে দেখতে নারাজ। আসলে অস্বাভাবিক মুনাফায় অভ্যস্ত হিসাবি মন কিছুতেই ছাড় দিতে রাজি নয়।
একটি বহু উচ্চারিত কথা- শ্রমিক-মালিক সহমর্মিতা অর্থাৎ পরস্পরকে যুক্তিগ্রাহ্য ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ব্যক্তি, দেশ, দশের সবার জন্যই মঙ্গলকর। বেশি টান পড়লে দড়ি ছিঁড়ে যায়। একইভাবে অতি শোষণের পরিণতি শোষিতের দিক থেকে পুঞ্জীভূত অসন্তোষের বিস্ফোরণ। এতে শ্রমিকের যতটা ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি কারখানা মালিকের, ক্ষতি দেশের তথা জাতীয় পর্যায়ে সরকারের। শেষোক্ত দুই পক্ষের উচিত এ অপ্রিয় সত্য অনুধাবন করা।
গত কয়েক বছরেও এই বিশেষ শিল্প খাতে ধর্মঘট, শ্রমিক অসন্তোষ, কারখানা ভাঙচুর থেকে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া ও রপ্তানি চুক্তি বরবাদ হওয়ার মতো নেতিবাচক বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে কারখানা মালিকদের খসড়া আইন সম্পর্কে তাঁদের পদক্ষেপ ঠিক করা উচিত বলে মনে করি। সংঘাতের পথ যেমন রাজনীতির পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, তেমনি শিল্প খাতেও তা লাভজনক হওয়ার কথা নয়। আর ওই বিবেচনা থেকে একচেটিয়া মুনাফানির্ভর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানোও দরকার।
প্রসঙ্গত, অন্য দু-একটি শিল্প খাতের মুনাফার হার মনে রেখে তবেই পোশাক শিল্পের লাভালাভ বিবেচনা করা উচিত। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একসময় ওষুধ শিল্পে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মুনাফা মার্জিন রেখে ওষুধের দাম নির্ধারণ করা হতো। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মরে যায়নি, বরং তাদের ধীরগতির স্থায়ী বিকাশ ঘটেছে। ওই খাতের শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধায় ঘাটতি পড়েনি। আসলে অতি লাভের বিষয়টি সমাজের পক্ষে রাষ্ট্রের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়, সহনযোগ্যও নয়। এ সত্য মালিকপক্ষের বুঝে নেওয়া জরুরি।
এসব কারণে পোশাক শিল্প খাতের মালিকদের পাশাপাশি শ্রমিক স্বার্থের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রাখা উচিত। এ দুইয়ের সমন্বিত স্বার্থে জাতীয় স্বার্থপূরণ। সে জন্যই মালিকদের বা তাঁদের প্রতিনিধিদের দেনদরবারে প্রধানমন্ত্রী বা শ্রমমন্ত্রী যেন ভেসে না যান। তাঁদের খসড়া শ্রম আইনে বড়সড় পরিবর্তন না ঘটিয়ে সামান্য কিছু অদলবদলের মধ্য দিয়ে শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেওয়ার পথই সরকারের জন্য সঠিক পন্থা হবে বলে আমরা মনে করি।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
No comments