পঞ্চম সংশোধনী-আমার জাতীয়তা ও বন্দুকের নল by জাফর ইমাম
জাতীয়তার পরিচয়ে আমরা বাঙালি। যদিও দেশের মোট জনসংখ্যার সামান্য অংশ বিভিন্ন আদিবাসী উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক। বিশ্বের সব দেশে এই সামান্য মিশ্রণ আছে। তবে এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা যে নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়ে বাঙালি, সে ইতিহাস স্মরণাতীতকালের। এটা শুধু বাংলা ভাষার ওপর ভিত্তি করে নয়।
আমার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, জীবনব্যবস্থা সব কিছুতে বাঙালিপনার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। আমার বাঙালিত্ব ষড়ঋতুতে মিশে আছে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কে না শুনেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ বঙ্গবন্ধুর সেই দৃপ্ত ঘোষণা—‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, আমার মৃত্যুর পর আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ো।’
যুদ্ধের পর পেলাম বাহাত্তরের সংবিধান, পেলাম আত্মপরিচয়ের সোপান। কিন্তু রক্তস্নাত এই অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য শত্রুর ষড়যন্ত্র সফল হলো ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বন্দুকের গর্জনে শুধু বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজনকে কেড়ে নিয়েই ছাড়ল না, একে একে ধসে পড়তে লাগল স্বাধীনতার সব অর্জন। পৃথিবীতে যা কোনো দেশে কোনো দিন ঘটেনি, তা-ই ঘটল আমাদের সংবিধানের ভাগ্যে। সংবিধান স্থগিত হলো না, তবুও এর বিধানকে তোয়াক্কা না করে ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে ফরমান জারি করলেন। এরপর বিচারপতি সায়েম, তারপর জেনারেল জিয়া। আর প্রয়োজনমতো মার্শাল ল ফরমান জারি করতে থাকলেন খোদ সংবিধানেরই বিভিন্ন বিধান সংশোধন করে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬-এর পরিবর্তন করে আমাদের নাগরিক পরিচয় ‘বাংলাদেশি’ করলেন। অনুচ্ছেদ ৯-এ বলা ছিল, বাঙালি হবে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। পরিবর্তন করে তা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হলো। এরপর থেকে পাসপোর্ট ও প্রজাতন্ত্রের অফিশিয়াল কার্যক্রমে জাতীয়তা হিসেবে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটা প্রচলিত হলো। এর মাধ্যমে মুষ্টিমেয় উপজাতিদের অজুহাতে আমাদের হাজার হাজার বছরের পরিচয় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মাটিচাপা দেওয়া হলো।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই জাতীয়তাবাদের পরিচয়ের যেটুকু আমরা ফিরে পেয়েছি, সেখানে রয়েছে বড় ধরনের এক বিভ্রান্তি। জেনারেল জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীতে অনুচ্ছেদ ৬ ও ৯ যেরূপ ধারণ করল হাইকোর্টের রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তা বাতিল করলে বাহাত্তরের সংবিধানের পূর্বরূপ ফিরে এসেছিল। তবে আপিল বিভাগ অনুচ্ছেদ ৯-এর বাহাত্তরের অবস্থান ঠিক রেখে পঞ্চম সংশোধনীতে আনীত অনচ্ছেদ ৬-কে মার্জনা করে বাঁচিয়ে দিল এই যুক্তিতে যে, অনুচ্ছেদ ৬ বর্তমান অবস্থায় না টিকলে লাখ লাখ পাসপোর্ট পরিবর্তনসহ সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ হবে।
তাহলে কী পেলাম আমরা। অনুচ্ছেদ ৬ বেঁচে রইল। কারও কারও খোঁড়া যুক্তিতে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি নিয়ে অনুচ্ছেদ ৯ ঘুমিয়ে থাকুক। আর পঞ্চম সংশোধনীতে আনীত অনুচ্ছেদ ৬-এর বিভ্রান্তিকর বিধান (নাগরিক হিসেবে ‘বাংলাদেশি’) অনুযায়ী পাসপোর্টসহ সব রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য অফিশিয়াল কার্যক্রমে জাতীয়তা ‘বাংলাদেশি’ লিখে বগলদাবা করে বুক ফুলিয়ে অনুচ্ছেদ ৯-এ বর্ণিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর উপায় রইল না। তাই বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যথার্থই লিখেছেন (কালের কণ্ঠ, ২ আগস্ট, ২০১০), বাঙালি নয়, বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশি। কয়েক বছর আগে বিবিসির জরিপের ফলাফলে বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে পরিচয় পেয়েছিলেন, সেটা হয়তো ভুল ছিল। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ভারতীয়। আমরা বাংলাদেশি। তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব কোথায়?
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এই মামলায় আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার আগে তাঁর লেখায় (প্রথম আলো, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১০) সংবিধান থেকে বন্দুকের নল সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট মহলকে। তিনি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এর আওতায় সংশোধিত চতুর্থ তফসিলের অধ্যায় ৩ক ও ১৮ ও সপ্তম সংশোধনীর বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন। সে প্রসঙ্গ টেনে বলতে হয় যে আমাদের সংবিধান পূর্ণাঙ্গভাবে একটি লিখিত সংবিধান। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষমতার ভাগাভাগি, রাষ্ট্র ও জনগণের পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব প্রজাতন্ত্রের পদ, ক্ষমতা, নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং কার অবর্তমানে কে পদ অলংকরণ করবেন ইত্যাদি সবিস্তারে লিখিত আছে।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে যে রায় দিয়েছেন, আপিল বিভাগ তা সঠিক মর্মে গ্রহণ করেছেন। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের আওতায় চতুর্থ তফসিলে সংযোজিত অনুচ্ছেদ ৩ক ও ১৮-কেও অবৈধ মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন। এটুকু করতে গিয়ে তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা এ রকম:
(ক) অনুচ্ছেদ ১৪২ অনুযায়ী, সংবিধানের যেকোনো বিধান সংশোধন করা যাবে বা নতুন বিধান সংযোজন করা যাবে, তবে সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ১৫০ ক্ষমতা প্রয়োগ করে চতুর্থ তফসিলের পরিধি বাড়ানো যাবে না। কারণ, অনুচ্ছেদ ১৫০ ও চতুর্থ তফসিল সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি কার্যকর করার জন্য এবং তা শুধু ২৬ মার্চ, ১৯৭১ থেকে বর্তমান সংবিধান কার্যকর হওয়ার দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের সব কার্যক্রমের আইনগত বৈধতা দেওয়ার জন্য। সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর অনুচ্ছেদ ১৫০ ও চতুর্থ তফসিলের দরজা বন্ধ।
(খ) এটা বলতে গিয়ে হাইকোর্ট অনুচ্ছেদ ১৫০ ও চতুর্থ তফসিলের ১ থেকে ১৭ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা করে এই মতামতে উপনীত হয় যে ক্ষমতা জবরদখলকারীরা তাঁদের খামখেয়ালির মাধ্যমে সংবিধানের ওইরূপ সংশোধন করেছেন এবং এর মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্রের স্থান দখল করেছে। কোর্ট আরও বলেছেন, সংবিধান পবিত্র। কারণ, এটা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনসংবলিত। এই সংবিধান মার্শাল ল-এর লগ বুক হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে না।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আপিল বিভাগ তাঁর রায়ে একদিকে হাইকোর্টের দেওয়া চতুর্থ তফসিলের সংশোধিত অধ্যায় ৩ক ও ১৮ অবৈধ ঘোষণা সঠিক মর্মে গ্রহণ করে মার্শাল ল-কে বাংলাদেশের জনগণ এমনকি সেনাবাহিনীরও সম্মান ও আত্মমর্যাদাবিরুদ্ধ মর্মে অভিমত দিয়েছেন; অপরদিকে অনুচ্ছেদ ১৫০ ও চতুর্থ তফসিলের সংশোধিত অধ্যায় ৩ক ও ১৮ সম্পর্কে হাইকোর্টের ব্যাখ্যা ও অভিমত (findings and observations) বাতিল করেছেন। কেন বাতিল করেছেন, আমাদের কাছে তা বোধগম্য নয়। অধিকন্তু আপিল বিভাগ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ সময়ে মার্শাল ল-এর আওতায় অনেক আইনগত প্রক্রিয়া ও কাজকে মার্জনা করেছেন। প্রশ্ন থেকে যায়, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর নেওয়া কোনো আইনগত প্রক্রিয়া, তা যতই জনকল্যাণমূলক হোক না কেন বৈধ হয় কীভাবে? হাইকোর্টও ওই সময়ের কিছু কাজকে মার্জনা করেছিলেন অস্থায়ীভাবে, তবে তা বৈধ বলে নয়, বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য।
অনুচ্ছেদ ১৫০-এর আওতায় আনীত চতুর্থ তফসিলের অধ্যায় ৩ক ও ১৮-কে হাইকোর্টের অবৈধ ঘোষণাটুকু গ্রহণ করে তত্সংক্রান্ত হাইকোর্টে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও অভিমত (findings and observations) বাতিল হওয়ার ফলে ভবিষ্যতে কোনো উচ্চাভিলাষী শক্তির ক্ষমতা দখল ও সংবিধান স্থগিত করে অনুচ্ছেদ ১৫০ বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলির বৈধতা দেওয়ার সুযোগ গ্রহণের একটা জানালা খোলা রইল বলে আমাদের আশঙ্কা হয়। শেষ পর্যন্ত বন্দুকের নলের ছায়া সংবিধান থেকে সরানো গেল না বলেই মনে হয়।
জাফর ইমাম: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
যুদ্ধের পর পেলাম বাহাত্তরের সংবিধান, পেলাম আত্মপরিচয়ের সোপান। কিন্তু রক্তস্নাত এই অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য শত্রুর ষড়যন্ত্র সফল হলো ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বন্দুকের গর্জনে শুধু বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজনকে কেড়ে নিয়েই ছাড়ল না, একে একে ধসে পড়তে লাগল স্বাধীনতার সব অর্জন। পৃথিবীতে যা কোনো দেশে কোনো দিন ঘটেনি, তা-ই ঘটল আমাদের সংবিধানের ভাগ্যে। সংবিধান স্থগিত হলো না, তবুও এর বিধানকে তোয়াক্কা না করে ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে ফরমান জারি করলেন। এরপর বিচারপতি সায়েম, তারপর জেনারেল জিয়া। আর প্রয়োজনমতো মার্শাল ল ফরমান জারি করতে থাকলেন খোদ সংবিধানেরই বিভিন্ন বিধান সংশোধন করে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬-এর পরিবর্তন করে আমাদের নাগরিক পরিচয় ‘বাংলাদেশি’ করলেন। অনুচ্ছেদ ৯-এ বলা ছিল, বাঙালি হবে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। পরিবর্তন করে তা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হলো। এরপর থেকে পাসপোর্ট ও প্রজাতন্ত্রের অফিশিয়াল কার্যক্রমে জাতীয়তা হিসেবে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটা প্রচলিত হলো। এর মাধ্যমে মুষ্টিমেয় উপজাতিদের অজুহাতে আমাদের হাজার হাজার বছরের পরিচয় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মাটিচাপা দেওয়া হলো।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই জাতীয়তাবাদের পরিচয়ের যেটুকু আমরা ফিরে পেয়েছি, সেখানে রয়েছে বড় ধরনের এক বিভ্রান্তি। জেনারেল জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীতে অনুচ্ছেদ ৬ ও ৯ যেরূপ ধারণ করল হাইকোর্টের রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তা বাতিল করলে বাহাত্তরের সংবিধানের পূর্বরূপ ফিরে এসেছিল। তবে আপিল বিভাগ অনুচ্ছেদ ৯-এর বাহাত্তরের অবস্থান ঠিক রেখে পঞ্চম সংশোধনীতে আনীত অনচ্ছেদ ৬-কে মার্জনা করে বাঁচিয়ে দিল এই যুক্তিতে যে, অনুচ্ছেদ ৬ বর্তমান অবস্থায় না টিকলে লাখ লাখ পাসপোর্ট পরিবর্তনসহ সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ হবে।
তাহলে কী পেলাম আমরা। অনুচ্ছেদ ৬ বেঁচে রইল। কারও কারও খোঁড়া যুক্তিতে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি নিয়ে অনুচ্ছেদ ৯ ঘুমিয়ে থাকুক। আর পঞ্চম সংশোধনীতে আনীত অনুচ্ছেদ ৬-এর বিভ্রান্তিকর বিধান (নাগরিক হিসেবে ‘বাংলাদেশি’) অনুযায়ী পাসপোর্টসহ সব রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য অফিশিয়াল কার্যক্রমে জাতীয়তা ‘বাংলাদেশি’ লিখে বগলদাবা করে বুক ফুলিয়ে অনুচ্ছেদ ৯-এ বর্ণিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর উপায় রইল না। তাই বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যথার্থই লিখেছেন (কালের কণ্ঠ, ২ আগস্ট, ২০১০), বাঙালি নয়, বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশি। কয়েক বছর আগে বিবিসির জরিপের ফলাফলে বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে পরিচয় পেয়েছিলেন, সেটা হয়তো ভুল ছিল। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ভারতীয়। আমরা বাংলাদেশি। তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব কোথায়?
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এই মামলায় আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার আগে তাঁর লেখায় (প্রথম আলো, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১০) সংবিধান থেকে বন্দুকের নল সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট মহলকে। তিনি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এর আওতায় সংশোধিত চতুর্থ তফসিলের অধ্যায় ৩ক ও ১৮ ও সপ্তম সংশোধনীর বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন। সে প্রসঙ্গ টেনে বলতে হয় যে আমাদের সংবিধান পূর্ণাঙ্গভাবে একটি লিখিত সংবিধান। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষমতার ভাগাভাগি, রাষ্ট্র ও জনগণের পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব প্রজাতন্ত্রের পদ, ক্ষমতা, নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং কার অবর্তমানে কে পদ অলংকরণ করবেন ইত্যাদি সবিস্তারে লিখিত আছে।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে যে রায় দিয়েছেন, আপিল বিভাগ তা সঠিক মর্মে গ্রহণ করেছেন। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের আওতায় চতুর্থ তফসিলে সংযোজিত অনুচ্ছেদ ৩ক ও ১৮-কেও অবৈধ মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন। এটুকু করতে গিয়ে তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা এ রকম:
(ক) অনুচ্ছেদ ১৪২ অনুযায়ী, সংবিধানের যেকোনো বিধান সংশোধন করা যাবে বা নতুন বিধান সংযোজন করা যাবে, তবে সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ১৫০ ক্ষমতা প্রয়োগ করে চতুর্থ তফসিলের পরিধি বাড়ানো যাবে না। কারণ, অনুচ্ছেদ ১৫০ ও চতুর্থ তফসিল সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি কার্যকর করার জন্য এবং তা শুধু ২৬ মার্চ, ১৯৭১ থেকে বর্তমান সংবিধান কার্যকর হওয়ার দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের সব কার্যক্রমের আইনগত বৈধতা দেওয়ার জন্য। সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর অনুচ্ছেদ ১৫০ ও চতুর্থ তফসিলের দরজা বন্ধ।
(খ) এটা বলতে গিয়ে হাইকোর্ট অনুচ্ছেদ ১৫০ ও চতুর্থ তফসিলের ১ থেকে ১৭ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা করে এই মতামতে উপনীত হয় যে ক্ষমতা জবরদখলকারীরা তাঁদের খামখেয়ালির মাধ্যমে সংবিধানের ওইরূপ সংশোধন করেছেন এবং এর মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্রের স্থান দখল করেছে। কোর্ট আরও বলেছেন, সংবিধান পবিত্র। কারণ, এটা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনসংবলিত। এই সংবিধান মার্শাল ল-এর লগ বুক হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে না।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আপিল বিভাগ তাঁর রায়ে একদিকে হাইকোর্টের দেওয়া চতুর্থ তফসিলের সংশোধিত অধ্যায় ৩ক ও ১৮ অবৈধ ঘোষণা সঠিক মর্মে গ্রহণ করে মার্শাল ল-কে বাংলাদেশের জনগণ এমনকি সেনাবাহিনীরও সম্মান ও আত্মমর্যাদাবিরুদ্ধ মর্মে অভিমত দিয়েছেন; অপরদিকে অনুচ্ছেদ ১৫০ ও চতুর্থ তফসিলের সংশোধিত অধ্যায় ৩ক ও ১৮ সম্পর্কে হাইকোর্টের ব্যাখ্যা ও অভিমত (findings and observations) বাতিল করেছেন। কেন বাতিল করেছেন, আমাদের কাছে তা বোধগম্য নয়। অধিকন্তু আপিল বিভাগ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ সময়ে মার্শাল ল-এর আওতায় অনেক আইনগত প্রক্রিয়া ও কাজকে মার্জনা করেছেন। প্রশ্ন থেকে যায়, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর নেওয়া কোনো আইনগত প্রক্রিয়া, তা যতই জনকল্যাণমূলক হোক না কেন বৈধ হয় কীভাবে? হাইকোর্টও ওই সময়ের কিছু কাজকে মার্জনা করেছিলেন অস্থায়ীভাবে, তবে তা বৈধ বলে নয়, বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য।
অনুচ্ছেদ ১৫০-এর আওতায় আনীত চতুর্থ তফসিলের অধ্যায় ৩ক ও ১৮-কে হাইকোর্টের অবৈধ ঘোষণাটুকু গ্রহণ করে তত্সংক্রান্ত হাইকোর্টে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও অভিমত (findings and observations) বাতিল হওয়ার ফলে ভবিষ্যতে কোনো উচ্চাভিলাষী শক্তির ক্ষমতা দখল ও সংবিধান স্থগিত করে অনুচ্ছেদ ১৫০ বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলির বৈধতা দেওয়ার সুযোগ গ্রহণের একটা জানালা খোলা রইল বলে আমাদের আশঙ্কা হয়। শেষ পর্যন্ত বন্দুকের নলের ছায়া সংবিধান থেকে সরানো গেল না বলেই মনে হয়।
জাফর ইমাম: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
No comments