বিদ্যুৎ উৎপাদন কমছেঃ আমরা যাচ্ছি কোথায়


বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুত্ উত্পাদনের যেসব স্থাপনা চালু ছিল গত এক বছরে সেগুলোর মোট উত্পাদন দৈনিক ৫শ’ থেকে ৬শ’ মেগাওয়াট কমে গেছে। আবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে টেন্ডার সম্পন্ন হওয়া এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চুক্তি সম্পাদনের ধারাবাহিকতায় ভাড়া ও ক্ষুদ্র বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো থেকে এক বছরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে দৈনিক ৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সরবরাহ।
কিন্তু নতুন যুক্ত হওয়া বিদ্যুত্ হিসাবে নিয়েও যোগফল এক বছর আগের উত্পাদনের চেয়ে দৈনিক একশ’ থেকে দেড়শ’ মেগাওয়াট কম থেকে যাচ্ছে। এই পরিষ্কার হিসাবটা বেরিয়ে এসেছে গতকাল আমার দেশ-এ প্রকাশিত ‘বিদ্যুত্ উত্পাদনে অধোগতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে। এতে দেখা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৫ দিন আগে ২০০৮ সালের শেষ দিন অর্থাত্ ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যাকালীন পিক আওয়ারে বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়েছে ৩৮৮২ মেগাওয়াট। মহাজোট সরকারের কল্যাণে এক বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যাকালীন পিক আওয়ারে বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়েছে ৩৬৯০ মেগাওয়াট। মহাজোট সরকারের বর্ষপূর্তির দিন ৫ জানুয়ারি পিক আওয়ারে বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ৩৫৬৩ মেগাওয়াট। ১৩ জাুনয়ারি এবং ১৪ জানুয়ারি পিক আওয়ারে বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে যথাক্রমে ৩৫৫২ মেগাওয়াট এবং ৩৬১০ মেগাওয়াট।

দেখা যাচ্ছে, চারদলীয় জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ঘুরে মহাজোট সরকারের আমলে যোগ হওয়া নতুন বিদ্যুতের সরবরাহ মহাজোট সরকারের আগের সময়ের বিদ্যুত্ উত্পাদনের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সেনাসমর্থিত জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তো বটেই, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলেও বিদ্যুত্ খাত নিয়ে বহু আষাঢ়ে গল্প ছাড়ানো হয়েছিল। বিএনপির তত্কালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চরিত্র হননের জন্য যেসব অস্ত্র তখন বিরামহীনভাবে ব্যবহার করা হতো, তার মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষষ্ট ছিল জোট সরকারের আমলে বিদ্যুত্ খাতে তথাকথিত পুকুরচুরির কাহিনী। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৫ বছর সময়কালে বিদ্যুত্ খাতে সাকুল্যে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ গল্প ছড়ানো হয়, এ সময়ে নাকি শুধু বিদ্যুত্ খাত থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই মিথ্যা গল্প দেশের মানুষকে গেলানোর চেষ্টায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও মহাজোট সরকারের সময় বয়ে গেছে বলেই তারা বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়ানোর জন্য কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি।
বিদ্যুত্ উত্পাদনের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, চালু বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো ঠিকমত সচল রাখা গেলে তাত্ক্ষণিকভাবে দৈনিক ৫/৬শ’ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুত্ উত্পাদন করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতির ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং গ্যাসের অব্যাহত সরবরাহ। যে কোনো মূল্যে বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। এর পাশাপাশি নতুন করে বসাতে হবে ডিজেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র। নতুন বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে বৈঠক ছাড়া আর কিছু হচ্ছে কিনা আমরা জানি না। তবে পুরনো প্ল্যান্টগুলো যে ঠিকমত চলছে না তা বোঝা যায় উত্পাদন হ্রাসের ধরন দেখে। কেন বিদ্যমান উত্পাদন ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না সে তথ্যও জানানো হচ্ছে না জাতিকে। মাঝখানে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বেশ জোরেশোরে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু এখন যেন সরকার বিষয়টি ভুলেই গেছে। কালেভদ্রেও পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নিয়ে কোনো কথা শোনা যায় না। সরকার যদি ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানির আশ্বাসকে বিরাট ‘অর্জন’ মনে করে বসে থাকে তবে গোটা জাতিকে ভুগতে হবে। তারচেয়ে বরং বিদ্যুত্ প্লান্টের যন্ত্রপাতি মেরামতের দিকে নজর দিলে বাস্তব ফল পাওয়া যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিদ্যুত্ সঙ্কট একটা নিরেট বাস্তবতা। এ পরিস্থিতিতে উত্পাদন বাড়ানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, আগের উত্পাদন ক্ষমতাই ধরে রাখা যাচ্ছে না—এ কেমন কথা! এরপরও যদি মহাজোট সরকার এক বছরের মহাসাফল্য নিয়ে গর্বে মেতে ওঠে তবে শুধু একটা জিজ্ঞাসাই অবশিষ্ট থাকে—আমরা যাচ্ছি কোথায়!

No comments

Powered by Blogger.