বই পায়নি লাখ লাখ শিক্ষার্থীঃ সরকারের অঙ্গীকার পূরণ হলো না
শেষ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার গরমিল থেকেই গেল। জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে বছরের প্রথম কার্যদিবসে দেশের সব ছাত্রছাত্রীর হাতে বই তুলে দিয়ে সরকারের অঙ্গীকার পূরণ করার কথা বলেছিলেন তিনি। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এই প্রথম শিক্ষাবর্ষের শুরুর কার্যদিবসে ক্লাস শুরু হতে যাচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে একটি দিন বা একটি ঘণ্টা হেলায় নষ্ট করতে দেয়া যাবে না। কিন্তু জানুয়ারি মাসের আধাআধি পর্যন্ত একটি বইও পায়নি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী। বই না পেয়ে কোমলমতি শিশুরা কান্নাকাটি করেছে, অভিভাবকরা বিচলিত হয়েছেন—এসব খবর ছাপা হয়েছে পত্র-পত্রিকায়। এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ শেষে ১৫ জানুয়ারি দেশের অনুমোদনপ্রাপ্ত সব ধরনের প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীর হাতে পৌঁছে যাবে বোর্ডের বিনামূল্যের বই। এ ব্যাপারেও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। চুন খেয়ে মুখ পোড়ার পর দই দেখলে যা হয়।
একটি পাঠ্যবইও পায়নি এমন লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে শুধু কিন্ডারগার্টেন স্কুলেরই রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ ছাত্রছাত্রী। এদিকে সরকারি-বেসরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কেউই পায়নি সব বিষয়ের বই। জানা গেছে, ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই ছাপার কাজই গত ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত শুরু করেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২ জানুয়ারি মাত্র ৬৫ ভাগ প্রাথমিক পর্যায়ের বই সারা দেশের স্কুলে পৌঁছাতে পেরেছে। ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮৬ ভাগ বই পৌঁছাতে পেরেছেন মুদ্রণকারীরা দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, সরকারি স্কুলগুলোতে গড়ে বই পেয়েছে প্রায় ৭০ ভাগ ছাত্রছাত্রী। অন্যদিকে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি থেকে বলা হয়েছে, শতকরা ৫০ ভাগ শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত কোনো পাঠ্যবই পায়নি, যারা পেয়েছে তারাও পায়নি সব বিষয়ের বই। সব মিলিয়ে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ফলে সরকার ঘোষিত অঙ্গীকার পূরণ দূরের কথা, শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ হয়েছে। এনসিটিবি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যেও রয়েছে অসঙ্গতি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ এবং মুদ্রণকারী ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে সময়ের কাজ সময়ে করা সম্ভব হয়নি।
যথাসময়ে বই দিতে না পারায় স্বভাবতই অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের চাপের মুখে পড়েছেন শিক্ষকরা। সরকারের নির্দেশে শিক্ষাবর্ষের প্রথম কার্যদিবস থেকে যথারীতি ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু বইয়ের অভাবে পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানে পুরনো বইয়ের সাহায্য নেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে শিশুদের। নতুন বই পাওয়া থেকে বঞ্চিত শিশুরা যে মানসিক বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে একমাত্র মনোবিদরাই তার পরিমাপ করতে পারেন। বই বিতরণের আগাম ঘোষণায় তারা আনন্দে উদ্বেল ছিল। শেষ পর্যন্ত আশাভঙ্গের কারণে সংশ্লিষ্ট শিশুর হতাশা ও বিষণ্নতার বোধ কতটা কষ্টকর হয়ে উঠেছে তা কিছুটা আঁচ করতে পারছেন মা-বাবা ও শিক্ষকরা। পড়াশোনার পাশাপাশি এ মনস্তাত্ত্বিক যাতনার কথা মাথায় রেখেই মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা দেয়া উচিত ছিল। শিক্ষামন্ত্রী কেন বিষয়টি বিবেচনায় আনেননি কিংবা আগেভাগে অব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেননি তা কারও বোধগম্য নয়। এখন সরকারকে যে করেই হোক, জানুয়ারির এক সপ্তাহ থাকতেই সম্পূর্ণভাবে বই বিতরণের কাজ শেষ করতে হবে। কারণ তখন থেকে পুরোদমে ক্লাস শুরু করতে না পারলে যথাসময়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় সিলেবাস শেষ করা কঠিন হবে। মাধ্যমিক পর্যায়েও যারা সব বিষয়ের বই পায়নি তাদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নিতে হবে। উপরন্তু অনুমোদন পায়নি এমন বিদ্যালয়ের অসংখ্য শিশুর কী হবে তা নিয়েও ভাবতে হবে সরকারকে। আমাদের মানতেই হবে, শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার।
No comments