কালের বিচার ও সৃজনশীলতা by আতাউর রহমান


নিজেকে নিজে চেনা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বোধহয় সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথের ‘কে তুমি মেলেনি উত্তর’ অথবা ‘পেল না উত্তর’ নিয়ে আমরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিই। এই এক দুরূহ দার্শনিক প্রশ্ন, যার সমাধান আমাদের জানা নেই। এক অর্থে আমরা এই প্রশ্ন নিয়ে জন্মগ্রহণ করি, আবার উত্তরহীন প্রশ্ন নিয়ে জগত্ ও জীবন থেকে বিদায় গ্রহণ করি।
মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা আছে, নিজের কাজকে প্রায় অতুলনীয় মনে করা। এই ঘটনা প্রবল ‘আমিত্ব’ বোধ থেকে ঘটে থাকে। আত্মকরুণা যেমন মানুষের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি এই ‘আমি’কে বড় করে দেখাটাও ক্ষতিকর। সম্ভবত সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে বলেছেন—সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। আত্মঅহঙ্কারকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক্ করে দেয়াটা খুব কঠিন কাজ। নির্লোভ হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব; কিন্তু নন-পজিটিভ হওয়াটা দুষ্কর হয়ে পড়ে। ‘গান্ধী মাই ফাদার’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। শেষ দৃশ্যে গান্ধী-পুত্র হরিদাস মৃতপ্রায় অবস্থায় স্টেশনের প্লাটফর্মে পড়ে আছে, পথচারীরা ভাবছে নামগোত্রহীন এই অসহায় ব্যক্তিটির জন্য যদি কিছু করা যায়, সুতরাং সবাই জিজ্ঞেস করছে, হরিদাসের বাবার নাম কী; উত্তরে তিনি বলেন, বাপুজী। সবাই হোঃ হোঃ করে হেসে চলে যাচ্ছিল আর ভাবছিল লোকটির মাথায় ছিট্ আছে। বাপুজী তো সমগ্র ভারতবর্ষের পিতা। বাপুজী কী করে রাস্তায় শায়িত এই ব্যক্তির পিতা হতে পারে? অর্থাত্ বাপুজী ব্যক্তিজীবনে স্বত্বত্যাগী হতে গিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষের স্বত্ব নিয়ে বসে আছেন; অবশ্য ঐহিক অর্থে নয়, পারত্রিক অর্থে। এই একই চলচ্চিত্রের আরেকটি দৃশ্য অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী। গান্ধী স্ত্রী কস্তুরাবা যখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন, পাশের ঘরে তখন গান্ধীজিকে খবরটা দেয়া হয়। গান্ধীজির উত্তাল জীবনের নির্ভরযোগ্য সঙ্গী ছিলেন এই মহিলা। গান্ধী খবরটা শুনে আস্তে আস্তে পাশের ঘরে গেলেন, তার চোখে কোনো জল নেই, তিনি শান্ত ও স্তব্ধ। ধীরে ধীরে ভূমিতে আসন গ্রহণ করে তিনি সদ্য-মৃত স্ত্রীর মাথাটি কোলে তুলে নিয়ে ঊর্ধ্বে শূন্যের দিকে তাকালেন। ব্যস, এই পর্যন্তই। আমার মনে হয়েছিল, শূন্যের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকানোটা ছিল গগনবিদারী আর্তনাদের চেয়ে অনেক বেশি হৃদয়স্পর্শী, মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব শব্দ ওই দৃষ্টির-দুঃখকে সম্মান জানানোর জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনই আমার মনে হয়েছিল সর্বজনের গান্ধী তথা বাপুজী কি আসলেই ব্যক্তি গান্ধীকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন? একই প্রশ্ন আমাকে মাঝে মাছে বিব্রত করে; মহান সিদ্ধার্থ কি ‘আত্মকে’ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক্ করে সত্যিই নির্বাণ লাভ করে পরম আলোকপ্রাপ্ত হতে পেরেছিলেন! তিনি নিশ্চিতভাবে পরম আলোকপ্রাপ্ত মহাপুরুষ ছিলেন এবং ব্যক্তি স্বত্বকে ত্যাগ করে সারা বিশ্বের স্বত্বকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর ক্ষেত্রে হয়তো একই ঘটনা ঘটেছিল। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, অহঙ্কার ও আমিত্ববোধ যদি মানুষ ত্যাগ করতে পারে তবে সে অনেক হাল্কা বোধ করে এবং তখন মনের মধ্যে এক প্রশান্ত আনন্দের উদ্ভব হয়। দুঃখের বিষয় হলো, সাধারণ মানুষ সেটা পারে না। পারিবারিক আড্ডায় প্রায়ই দেখা যায়, উপস্থিত প্রায় সবাই কেবল নিজেদের কীর্তির কথা বলতে থাকে। কে কত পরিমাণ ভূ-সম্পত্তির মালিক, কার ক’টা অ্যাপার্টমেন্ট আছে, কার ছেলেমেয়ে বিদেশে কোন্ বিখ্যাত বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে—এসবেরই বিস্তারিত বিবরণ শোনা যায়। আমি মনে করি, আলোচনা ও আড্ডার বিষয় হিসেবে এসব কোনোটাই নিন্দনীয় নয়। ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকে গর্ববোধ করে এবং অনেক সময় ওদের সম্পর্কে বানিয়ে কথা বলে। বোঝা যায়, অপত্য স্নেহই এ ধরনের অতিশয়োক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খুব খারাপ অথচ জনপ্রিয় মানুষের মৃত্যুর পর শোকসভায় গিয়ে আমাদের তার সম্পর্কে প্রশংসাসূচক ভালো ভালো কথা বলতে হয়। এর একটা যুক্তি আছে। আমরা মনে করি, মৃত্যুর পর মানুষের সব অপরাধ দুগ্ধধৌত হয়ে যায়। আরেকটি মিথ্যাচারের শিকার আমি নিজেই ক’দিন আগে হয়েছি। এ হলো আমার নিজের ক্ষেত্রে একটি ছোট্ট ঘটনা। মঞ্চ-নাটকের কথা। কোনো একটি মঞ্চ-নাটক দেখে আমাকে নাটকটি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে বলা হলো। আমি নাটকটির কোনো সমালোচনাই করতে পারলাম না, সব ভালো ভালো কথা বলে কর্তব্য সম্পাদন করলাম। আমি ভেবেছি, আমার সমালোচনা শুনে যদি উদ্যোক্তারা দুঃখ পায় এবং সেজন্য আমি বিরূপ আলোচনা থেকে বিরত থেকেছি। নৈতিক দিক থেকে কাজটি অনুচিত হয়েছিল। আসলে সমালোচনা গ্রহণ করার মতো আমাদের অনেকেরই সহিষ্ণুতা বা মনের জোর নেই। নাটকের নির্দেশক ও অভিনেতারা এই হীনমন্যতায় ভোগে। একজন নাট্য-নির্দেশক হিসেবে আমার নাটকের সমালোচনা করলে প্রথম প্রথম আমার মন খারাপ হতো। আমার নির্দেশিত চলতি একটি নাটকের প্রথম মঞ্চায়নে প্রচুর সমালোচনা হলো। কেউ কেউ আমাকে ধিক্কারও দিল, অথচ এই নাটকটি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক। আমাদের সরকারের উদ্যোগে সম্প্রতি এই প্রযোজনা বিদেশের একটি বড় নাট্যোত্সবে মঞ্চায়িত হয়েছে। আমি মনে করি, একটি শিল্প কাজের সর্বশেষ বিচারক হলো দর্শক ও শ্রোতৃমণ্ডলী এবং তাদের কষ্টিপাথরে টিকে গেলে সেই শিল্প কাজটি দীর্ঘজীবী হয়। আসলে সৃজনশীলতার জগতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সময়ের পদযাত্রায় তার বিচার হয়ে যায়। আমরা সবাই মনে করি, আমার কাজই শ্রেষ্ঠ। এই মনে করাটা দোষের নয়, মনে জোর পাওয়া যায়। যে কোনো সৃজনশীল কাজের আসল বিচার হয় দর্শক-শ্রোতার কষ্টিপাথরে এবং টিকে থাকার পরীক্ষা হয় কালের অভিযাত্রায়।

লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.