তারকাকুলে বৃহস্পতিখোঁজ by রণজিৎ বিশ্বাস

শুরুটাই সংকটে টানছে। উদ্ধরণদাবি তিন বাক্যের। তিনটির একটি বেছে নিয়ে শুরু করতে যাওয়ার জন্যই এই সূচনাসংকট। এক. ‘রাতের সব তারাই থাকে দিনের আকাশে। তবু তাদের দেখা যায় না মার্তণ্ডপ্রভায় হারিয়ে যাওয়ায়।’
এটি দিয়ে কি শুরু করা যায় আজ মাঠে গড়ানো এশিয়া কাপ ক্রিকেটের তারকাখোঁজ? হয়তো যায়।


কারণ, রণে নামা চার দেশই জনে জনে তারকা নামাবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন হয়তো বেরিয়ে আসবেন, যাঁর আলোয় সবার আলো ম্লান হবে। সূর্যের আলো যেমন তারার আলো হারিয়ে দেয়, তেমন না হলেও কারও কারও আলো হয়তো বিশেষভাবে চোখে পড়বে। তূণের সেরা তিরের মতো, অস্ত্রকুলে ব্রহ্মাস্ত্রের মতো।
করলে করা যাবে এটি দিয়ে শুরু, দেখা যাক আরও ভালো কিছু পাওয়া যায় কি না। দুই নম্বরটি হচ্ছে, ‘শত মূর্খপুত্রের চেয়ে এক গুণীপুত্র ভালো/ লক্ষ তারা আছে তবু এক চন্দ্রে আলো।’
চলবে কি না ভাবতে হচ্ছে। কারণ, এখানে মূর্খপুত্র কেউ নেই, যে যার মাপে সবাই গুণীপুত্র। এক চন্দ্রে আলো, সন্দেহ নেই; তবে কেউ একেবারেই কালো এখানে নয়। তৃতীয়টি মধুকে নিয়ে। তাঁর শিক্ষক ক্লাসে এই ছাত্রটিকে অনুপস্থিত দেখে পড়িয়ে আনন্দ পাচ্ছিলেন না। চৌকস চৌকস আরও যারা ছাত্র, গৌর-বঙ্ক প্রমুখ, ওরা বলছিল, আমরা তো আছি স্যার! স্যার বলেছিলেন, ‘অল অব ইউ আর স্টারস। বাট মধুসূদন ইজ দ্য জুপিটার।’ তারকা তোমরা সবাই, কিন্তু মধু হচ্ছে তারকাকুলে বৃহস্পতি।
হ্যাঁ। এখানে বোধহয় থামা যায়। পরিস্থিতিটা এ রকমই। সবাই তারকা, সবাই জ্বলবে, তার মাঝেই কেউ কেউ বলবে—তাকাও তোমরা আমার দিকে, দেখো, আমি কেমন জ্বলি।
তারকাদের জন্য চাদরটা খুব বড় করে বিছিয়ে অনেককে ঠাঁই দিতে চাই না। তাতে সমস্যা বাড়ে। বিচারও হয় না ঠিকমতো। এখনো যে বিচারের মতো বিচার হবে, দাবি করা দূরে থাক, ভাবার সাহসও নেই লেখকের। তবু কবুল করার একটি কথা আছে। এসব কথায় কোনো শেষ কথা হয় না। চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত থাকে না। তা ছাড়া সেই কথাটির প্রণিধানযোগ্যতাও মান্য করি, ‘এভরিবডি ইজ এনটাইটেলড টু হিজ কমেন্ট।’ সবার মত সবার। সবার আছে সে অধিকার।
সেই জোরেই আমার তারকাখোঁজ-এ আমি খুব বেশি নাম মাথায় রাখব না। সামাল দিতে কষ্ট হবে। মাঝেমধ্যে অচিনপুরে যাওয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় সমাপ্ত ত্রিদেশীয় সিরিজের সাত ম্যাচে ২০.৪৩ গড়ে ১৪৩ পাওয়া শচীনকে নিয়ে আমি একটি শব্দও বলব না।
আমার ফর্দটি মাত্র ১০ জনের। তালিকা পরে আসুক, তার আগে নির্বাচনের ‘র‌্যাশনাল’ যার মাতৃভাষিক রূপান্তর শুদ্ধ হবে কি না জানি না, হতে পারে যুক্তিবিচার, সেটি আগে বলি।
প্রীতিময় ও অগ্রমান্য জালাল আহমেদ চৌধুরীর ব্যবহারের আগে একটি শব্দ ক্রিকেটের বঙ্গভাষিক অভিধায় আমি পাইনি। পেয়েই আমার চমৎকার মনে হয়েছে। ‘ধবলধোলাই’। ‘White wash’-এর বাংলা। দুবাইয়ে, ওয়ানডে ক্রিকেটে যে দলের কোনো ভয়াবহতা নেই, সেই ইংল্যান্ডের হাতে পাকিস্তানের ধবলধোলাই ও ত্রিদেশীয় সিরিজে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের জবর ধোলাই, কঠিন ধোলাই অথবা আচ্ছা ধোলাইয়ের কথা মাথায় রেখে আমি তালিকাটি তৈরি করেছি।
তাদের মধ্যে শ্রীলঙ্কার তারকা বেশি পড়ে গেছে। সাঙ্গাকারা, মাহেলা, দিলশান ও মালিঙ্গা। পাকিস্তানের হাফিজ, ইউনুস ও আজমল। ভারতের কোহলি ও রায়না এবং বাংলাদেশের সাকিব। অপেক্ষাকৃত নতুন কিন্তু যাঁরা ভালো খেলছেন, কখনো কখনো দৃষ্টিও কাড়ছেন—আরও নিরবচ্ছিন্নতায় দেখার জন্য তাঁদের দাবির মুখেও বললাম—তোরা এক পাশে থাক। অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু বিশ্বস্ততা নেই, তেমন কয়েকজনকেও বলতে হলো—গত ১০-১২ ম্যাচে তোমরা এমন কিছু করোনি যে তোমাদের দিকে তাকাতে হবে। দুই গ্রুপ থেকে তোমরা যদি কেউ ভালো করে ফেলো, সেটি হবে আমাদের জন্য বোনাস। দ্বিতীয় গ্রুপে আছেন শেবাগ, মিসবাহ, গম্ভীর, আফ্রিদি ও তামিম।
অভিনিবেশে পর্যবেক্ষণ তালিকায় লক্ষণীয়, অধিনায়ক রাখা হয়েছে মাত্র একজনকে, তা-ও তিনি ব্যাটসম্যানশিপ ও দলের সংকট মোচনের বিরল যোগ্যতায় একেবারে হেঁটে হেঁটেই এশিয়া শুধু নয়, বিশ্বের যেকোনো দলে ঢুকে যেতে পারেন। মাহেলা জয়াবর্ধনে। ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে অলরাউন্ডার রাখা হয়েছে তিনজন—সাকিব, হাফিজ ও রায়না। মাহেলাকে নিয়ে ব্যাটসম্যান পাঁচজন। অন্য চারজন—সাঙ্গাকারা, দিলশান, কোহলি ও ইউনুস। বিশুদ্ধ বোলার দুজন। মালিঙ্গা ও আজমল।
অলরাউন্ডারদেরও গোনায় নিলে তালিকার আশি ভাগ ব্যাটসম্যান। কারণ আছে। গোনা বলের ক্রিকেট, বোলাররা যেন ক্ষিপ্ত না হন, মূলত ব্যাটসম্যান ও অলরাউন্ডারদের ক্রিকেট। যুক্তি, টেস্ট ম্যাচ ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে প্রতিপক্ষকে দুবার ঘায়েল করতেই হয়, ব্যাটের জোরে সেখানে জয়ের শোর তোলা যায় না। ড্র করলে করা যায়। কিন্তু এক দিনের ম্যাচে প্রতিপক্ষের কোনো উইকেট না ফেলেও ব্যাটসম্যানশিপের অবিশ্বাস্য জোরে জয়টাকে বিশ্বাস করা যায়। কীভাবে সম্ভব, যদিও ব্যাপারটা তাত্ত্বিক ও একাডেমিক, বয়ানের জন্য বাক্যব্যয়ের প্রয়োজন নেই। তার পরও দুজন বোলার, একজন পেসার ও একজন স্পিনার তালিকায় রাখার কারণ, ব্যাটসম্যানদের আনন্দ মৃগয়ায়ও যেকোনো দিন ওঁরা সর্বনাশের সুনামি নামাতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.