কলকাতার চিঠি-অন্য এক মমতা by অমর সাহা
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের এক বিরাট ঝড় তুলে ক্ষমতায় এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালের এপ্রিল-মে মাসের বিধানসভা নির্বাচনে ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা বামফ্রন্টকে পরাস্ত করে ২০ মে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
মমতা এক লড়াকু নেত্রী; সৎ, আদর্শবাদী—সে কথা প্রশ্নাতীত। ক্ষমতা গ্রহণের পর মমতা পরিবর্তনের এক ঝড়ও বইয়ে দিয়েছেন রাজ্যব্যাপী। পশ্চিমবঙ্গের দুটি প্রধান সমস্যা দার্জিলিংয়ের পৃথক রাজ্যের আন্দোলন এবং মাওবাদীদের আন্দোলন বন্ধ করে তিনি আন্দোলনকারীদের দিয়েছেন নতুন পথের দিশা। দার্জিলিং নিয়ে তিনি গড়েছেন পৃথক জিটিএ বা গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। মাওবাদীদের জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। তাতে সাড়াও মিলেছে। শীর্ষ মাওবাদী নেতা কিষেনজি যৌথ বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন তাঁর আমলে, গত বছরের ২৪ নভেম্বর। কিষেনজির সহযোগী নারী মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতও আত্মসমর্পণ করেছেন শুক্রবার। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম সমস্যারও সমাধান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কলকাতাকে লন্ডন আর উত্তরবঙ্গকে সুইজারল্যান্ড বানানোরও প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। রাজ্যে শিল্পতালুক গড়ারও উদ্যোগ নিয়েছেন। এতকিছুর মধ্যেও যেন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে মমতার উদ্যোগের। কথাবার্তার।
যে মমতা সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম নিয়ে আন্দোলন করে সফলতা পেয়েছেন, সেই মমতার হাবভাব যেন একটু একটু করে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।
হুগলির সিঙ্গুরে টাটা মোটরসকে সস্তায় ন্যানো গাড়ি তৈরির কারখানা গড়ার জন্য ৯৯৭ একর জমি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। এই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মমতা সিঙ্গুর থেকে টাটাকে বিদায় করে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। নন্দীগ্রামে রাসায়নিক শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করে সেখানেও শিল্পাঞ্চল করতে দেয়নি মমতা। আর এসব আন্দোলনে সেদিন মমতার হাতিয়ার ছিল ধর্মঘট, বন্ধ্, রেল রোকো, সড়ক অবরোধ ইত্যাদি। সিঙ্গুর আন্দোলন করতে গিয়ে মমতা একটানা ২৫ দিন অনশন করেছেন। কলকাতার টাটা সেন্টারের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। টাটার পণ্য বয়কট করার ডাক দিয়েছেন। যে মমতা হরতাল-ধর্মঘটকে আন্দোলনের হাতিয়ার করেছেন, সেই মমতা এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছেন—হয়েছেন আরেক মমতা। অন্য এক মমতা। এখন তিনি হরতাল-ধর্মঘটের চরম বিরোধী। শুধু কি তাই, ধর্মঘটিদের বেতন কাটারও উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ২৪ ঘণ্টার শিল্প-ধর্মঘটের ডাক দেয় ১১টি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন। এর মধ্যে ছিল বাম দলসহ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনও। এই ধর্মঘটের আগেই মমতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, রাজ্যের কোনো সরকারি কর্মী ধর্মঘটে অংশ নিলে তাদের এক দিনের বেতন কাটার পাশাপাশি তাদের চাকরিতে ছেদও ঘটানো হতে পারে। ধর্মঘটের পরে এবার অনুপস্থিত কর্মীদের এক দিনের বেতন কাটা এবং চাকরির বয়স এক দিন কমানোর নির্দেশ জারি করেছে রাজ্য সরকার। শোকজ করেছেন কর্মীদের। এই নিয়ে গোটা দেশে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। প্রশ্ন উঠেছে, লড়াকু মমতা ক্ষমতা গ্রহণের পর বেমালুম ভুলে গেছেন তাঁর আন্দোলনের হাতিয়ারের কথা। ধর্মঘট করা তো ভারতের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তো এই রাজ্যে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেনি। তবে কেন ধর্মঘট বন্ধের উদ্যোগ মমতার? যদিও এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে মতামত দিতে কার্পণ্য করেননি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসু। বলেছেন, ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার যেমন অধিকার আছে, তেমনি না দেওয়ারও অধিকার আছে।
শুধু কি তাই? মমতা এখন ফারাক্কার পানি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, স্লুইস গেট ভাঙার কারণে অতিরিক্ত পানি চলে গেছে বাংলাদেশে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদমন্ত্রী পবন বনশাল ফারাক্কা ঘুরে এসে মমতার এই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছেন। বলেছেন, দুটি স্লুইস গেট ভেঙে যাওয়ার ঘটনা নিছকই একটি দুর্ঘটনা। যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশে গেছে, এতে কোনো চিন্তার কারণ নেই। এর ফলে পানিসংকট দেখা দেবে না বা বিদ্যুৎ উৎপাদনেও সমস্যা হবে না।’
মমতা আপত্তি তুলেছেন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিরও। গত সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন হওয়ার কথা থাকলেও মমতার আপত্তির কারণে তা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে থাকা ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়েরও কথা হয়। এখন মমতা ছিটমহল বিনিময়েও বিরোধিতা করছেন।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত মমতার এই ভূমিকায় প্রচণ্ড খেপে গিয়ে বলেছেন, ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে তাঁরা রাজ্যব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, সবকিছুতেই মমতা একটু পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগাতে চাইছেন। কিন্তু কেন এমন হলো? মমতা তো লড়াকু নেত্রী। আন্দোলন করে তিনি নিজেকে আজ এই শিখরে তুলেছেন। তার পরও কেন তিনি বাধা দিচ্ছেন। কেনই বা চালাচ্ছেন তাঁদের শরিক কংগ্রেসের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ? আর এই যুদ্ধের কারণে রাজ্য মন্ত্রিসভার কংগ্রেসদলীয় এক মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সেই মন্ত্রী পদত্যাগের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যেই ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেন মমতার বিরুদ্ধে।
এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, এই বিরোধিতা করাও মমতার আরেকটি রাজনীতি। বরাবরই মমতা যেটা ভাবেন, তিনি সেটা করার চেষ্টা করেন। পর্যবেক্ষকেরাও মনে করেন, মমতার এই পরিবর্তনের পেছনে লুক্কায়িত রয়েছে অন্য কারণ। তাঁদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে মমতা রাজ্যের উন্নয়নের জন্য যতটুকু আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলেন, ততটুকু পাচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় সরকারও আর পাঁচটি রাজ্যের কথা ভেবে ঢালাওভাবে একটি রাজ্যকে অতিরিক্ত আর্থিক সাহায্য দিতে পারছেন না। কারণ, সেখানেও রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সীমাবদ্ধতা। ফলে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর একটা ঠান্ডা লড়াই অব্যাহতই রয়েছে। এদিকে, আর্থিক সংকটের কারণে মমতা তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপে রাখার জন্যই মমতার হয়তো এই রাজনৈতিক খেলা।
সর্বশেষ এক রাজনৈতিক খেলা খেলেছেন মমতার দলের শীর্ষ নেতা, কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। তিনি দিল্লিতে একটি ইংরেজি পত্রিকার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে গত বুধবার বলেছেন, আগাম লোকসভার ভোটে আপত্তি নেই তৃণমূলের। আগাম ভোট হলে বরং খুশি হবে তৃণমূল। দেশব্যাপী কংগ্রেসবিরোধী হাওয়া জোরদার হওয়ায় অন্তর্বর্তী ভোটে গেলে আপত্তি নেই তাঁদের। এ কথার দ্বারা তৃণমূল বোঝাতে চেয়েছে, কংগ্রেসের অবস্থান আর এখন টেকসই নয়। গত বছর এবং এ বছরের ১০ রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া লোকসংখ্যার দিক থেকে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের ব্যাপক পরাজয়ের কারণেই রেলমন্ত্রীর ওই মন্তব্য বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। কারণ, এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে টিকিয়ে রাখার মূল অস্ত্র মমতার হাতে। মমতার রয়েছে ১৯ জন সাংসদ। তাঁরা ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলেই মনমোহন সিংয়ের সরকারের পতন অনিবার্য। সে দিকটা বিবেচনা করেই সম্ভবত ওই মন্তব্য করেছেন রেলমন্ত্রী। যদিও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজন পরের দিনই বলেছেন, কোনো অন্তর্বর্তী নির্বাচনের প্রশ্ন নেই। ইউপিএ সরকার তাদের মেয়াদ পূর্ণ করবে। আগামী ২০১৪ সালেই হবে লোকসভার নির্বাচন।
তাই মমতার এসব ভূমিকায় এখন মমতাকেই নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মমতা কি পারবেন এসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে রাজ্যবাসীর মনজয় করতে? নাকি আবার শুরু হবে নতুন করে পরিবর্তনের হাওয়া?
অমর সাহা, প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
যে মমতা সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম নিয়ে আন্দোলন করে সফলতা পেয়েছেন, সেই মমতার হাবভাব যেন একটু একটু করে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।
হুগলির সিঙ্গুরে টাটা মোটরসকে সস্তায় ন্যানো গাড়ি তৈরির কারখানা গড়ার জন্য ৯৯৭ একর জমি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। এই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মমতা সিঙ্গুর থেকে টাটাকে বিদায় করে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। নন্দীগ্রামে রাসায়নিক শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করে সেখানেও শিল্পাঞ্চল করতে দেয়নি মমতা। আর এসব আন্দোলনে সেদিন মমতার হাতিয়ার ছিল ধর্মঘট, বন্ধ্, রেল রোকো, সড়ক অবরোধ ইত্যাদি। সিঙ্গুর আন্দোলন করতে গিয়ে মমতা একটানা ২৫ দিন অনশন করেছেন। কলকাতার টাটা সেন্টারের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। টাটার পণ্য বয়কট করার ডাক দিয়েছেন। যে মমতা হরতাল-ধর্মঘটকে আন্দোলনের হাতিয়ার করেছেন, সেই মমতা এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছেন—হয়েছেন আরেক মমতা। অন্য এক মমতা। এখন তিনি হরতাল-ধর্মঘটের চরম বিরোধী। শুধু কি তাই, ধর্মঘটিদের বেতন কাটারও উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ২৪ ঘণ্টার শিল্প-ধর্মঘটের ডাক দেয় ১১টি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন। এর মধ্যে ছিল বাম দলসহ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনও। এই ধর্মঘটের আগেই মমতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, রাজ্যের কোনো সরকারি কর্মী ধর্মঘটে অংশ নিলে তাদের এক দিনের বেতন কাটার পাশাপাশি তাদের চাকরিতে ছেদও ঘটানো হতে পারে। ধর্মঘটের পরে এবার অনুপস্থিত কর্মীদের এক দিনের বেতন কাটা এবং চাকরির বয়স এক দিন কমানোর নির্দেশ জারি করেছে রাজ্য সরকার। শোকজ করেছেন কর্মীদের। এই নিয়ে গোটা দেশে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। প্রশ্ন উঠেছে, লড়াকু মমতা ক্ষমতা গ্রহণের পর বেমালুম ভুলে গেছেন তাঁর আন্দোলনের হাতিয়ারের কথা। ধর্মঘট করা তো ভারতের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তো এই রাজ্যে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেনি। তবে কেন ধর্মঘট বন্ধের উদ্যোগ মমতার? যদিও এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে মতামত দিতে কার্পণ্য করেননি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসু। বলেছেন, ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার যেমন অধিকার আছে, তেমনি না দেওয়ারও অধিকার আছে।
শুধু কি তাই? মমতা এখন ফারাক্কার পানি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, স্লুইস গেট ভাঙার কারণে অতিরিক্ত পানি চলে গেছে বাংলাদেশে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদমন্ত্রী পবন বনশাল ফারাক্কা ঘুরে এসে মমতার এই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছেন। বলেছেন, দুটি স্লুইস গেট ভেঙে যাওয়ার ঘটনা নিছকই একটি দুর্ঘটনা। যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশে গেছে, এতে কোনো চিন্তার কারণ নেই। এর ফলে পানিসংকট দেখা দেবে না বা বিদ্যুৎ উৎপাদনেও সমস্যা হবে না।’
মমতা আপত্তি তুলেছেন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিরও। গত সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন হওয়ার কথা থাকলেও মমতার আপত্তির কারণে তা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে থাকা ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়েরও কথা হয়। এখন মমতা ছিটমহল বিনিময়েও বিরোধিতা করছেন।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত মমতার এই ভূমিকায় প্রচণ্ড খেপে গিয়ে বলেছেন, ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে তাঁরা রাজ্যব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, সবকিছুতেই মমতা একটু পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগাতে চাইছেন। কিন্তু কেন এমন হলো? মমতা তো লড়াকু নেত্রী। আন্দোলন করে তিনি নিজেকে আজ এই শিখরে তুলেছেন। তার পরও কেন তিনি বাধা দিচ্ছেন। কেনই বা চালাচ্ছেন তাঁদের শরিক কংগ্রেসের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ? আর এই যুদ্ধের কারণে রাজ্য মন্ত্রিসভার কংগ্রেসদলীয় এক মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সেই মন্ত্রী পদত্যাগের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যেই ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেন মমতার বিরুদ্ধে।
এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, এই বিরোধিতা করাও মমতার আরেকটি রাজনীতি। বরাবরই মমতা যেটা ভাবেন, তিনি সেটা করার চেষ্টা করেন। পর্যবেক্ষকেরাও মনে করেন, মমতার এই পরিবর্তনের পেছনে লুক্কায়িত রয়েছে অন্য কারণ। তাঁদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে মমতা রাজ্যের উন্নয়নের জন্য যতটুকু আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলেন, ততটুকু পাচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় সরকারও আর পাঁচটি রাজ্যের কথা ভেবে ঢালাওভাবে একটি রাজ্যকে অতিরিক্ত আর্থিক সাহায্য দিতে পারছেন না। কারণ, সেখানেও রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সীমাবদ্ধতা। ফলে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর একটা ঠান্ডা লড়াই অব্যাহতই রয়েছে। এদিকে, আর্থিক সংকটের কারণে মমতা তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপে রাখার জন্যই মমতার হয়তো এই রাজনৈতিক খেলা।
সর্বশেষ এক রাজনৈতিক খেলা খেলেছেন মমতার দলের শীর্ষ নেতা, কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। তিনি দিল্লিতে একটি ইংরেজি পত্রিকার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে গত বুধবার বলেছেন, আগাম লোকসভার ভোটে আপত্তি নেই তৃণমূলের। আগাম ভোট হলে বরং খুশি হবে তৃণমূল। দেশব্যাপী কংগ্রেসবিরোধী হাওয়া জোরদার হওয়ায় অন্তর্বর্তী ভোটে গেলে আপত্তি নেই তাঁদের। এ কথার দ্বারা তৃণমূল বোঝাতে চেয়েছে, কংগ্রেসের অবস্থান আর এখন টেকসই নয়। গত বছর এবং এ বছরের ১০ রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া লোকসংখ্যার দিক থেকে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের ব্যাপক পরাজয়ের কারণেই রেলমন্ত্রীর ওই মন্তব্য বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। কারণ, এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে টিকিয়ে রাখার মূল অস্ত্র মমতার হাতে। মমতার রয়েছে ১৯ জন সাংসদ। তাঁরা ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলেই মনমোহন সিংয়ের সরকারের পতন অনিবার্য। সে দিকটা বিবেচনা করেই সম্ভবত ওই মন্তব্য করেছেন রেলমন্ত্রী। যদিও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজন পরের দিনই বলেছেন, কোনো অন্তর্বর্তী নির্বাচনের প্রশ্ন নেই। ইউপিএ সরকার তাদের মেয়াদ পূর্ণ করবে। আগামী ২০১৪ সালেই হবে লোকসভার নির্বাচন।
তাই মমতার এসব ভূমিকায় এখন মমতাকেই নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মমতা কি পারবেন এসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে রাজ্যবাসীর মনজয় করতে? নাকি আবার শুরু হবে নতুন করে পরিবর্তনের হাওয়া?
অমর সাহা, প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
No comments