সময়চিত্র-দুই নেত্রী: বিরোধের শেষ কোথায় by আসিফ নজরুল
আগে দাওয়াত দিয়েছেন বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া। তার ঠিক পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দাওয়াত রমজান উপলক্ষে। এর আগেও তাঁরা একে অপরকে দাওয়াত দিয়েছেন। কদাচিৎ তা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বহু বছর ধরে দাওয়াত আর কবুল করা হয় না। তাঁরা এতই অপছন্দ করেন একে অপরকে যে দাওয়াত কবুলের প্রশ্নই আসে না।
পৃথিবীতে নেলসন ম্যান্ডেলা-ডি ক্লার্ক বৈঠক সম্ভব। নেতানিয়াহু আর ইয়াসির আরাফাতের বৈঠকও হয়েছে। বহু বছর আদর্শিক যুদ্ধে লড়েছেন তাঁরা। তীব্র আর দীর্ঘস্থায়ী সেই যুেদ্ধ একজনের বাহিনীর হাতে অন্যজনের মৃত্যুও হতে পারত। তার পরও তাঁরা শান্তির আলোচনায় বসেছেন। বড় নেতাদের পরিচয় এমনই। আমাদের দুই নেত্রীও বড় নেতা। কিন্তু তাঁরা এতই বড় যে একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারেন না। বাংলা প্রবাদ আছে, এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারে না। দুই নেত্রীর প্রতাপ বাঘের মতো। শেখ হাসিনার আমলে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে তাই গুলি করা হয়েছে, আবার খালেদা জিয়ার আমলে শেখ হাসিনাকে একেবারে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বর্তমান আমলে খালেদাকে ৪০ বছরের বাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছে (আমার ধারণা, এই আমলে তাঁকে এমনকি নাজিমউদ্দীন রোডের ‘বাড়ী’তে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে)। আবার খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনারও হয়তো একই পরিণতি হবে!
এসব আশঙ্কা সামান্য হলেও লঘু হতে পারত রমজান মাসের দাওয়াত গ্রহণ করা হলে। মনের তাগিদে না হোক, স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও শেখ হাসিনা হাজির হতে পারতেন খালেদা জিয়ার দাওয়াতে। খালেদা জিয়াকেও তখন যেতে হতো শেখ হাসিনার দাওয়াতে। কারও কি একচুল সমস্যা বা ক্ষতি হতো এতে? হতো না। দেশের মানুষ বরং কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত। আর কে জানে তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা হলে কিছুটা সমব্যথীও হতে পারতেন একে অপরের। তাঁদের বুদ্ধিশুদ্ধি নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে বেশি। একসময় হয়তো এও বুঝতে পারতেন যে তাঁদের দুজনের (এবং দেশের মানুষের) জীবন অনেক বেশি স্বস্তিকর হতে পারে পারস্পরিক সম্পর্কে অসুস্থতার অবসানে।
২.
আমাদের এসব আশা পূর্ণ হবে না। দাওয়াত পাওয়ার কয়েক দিন পরই শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিরোধী দলের নেত্রী এবং সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত বলেছেন। পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হয়েছে, দুই কারণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেছেন। এক. খালেদা জিয়ার জন্ম ভারতে। দুই. তিনি সংবিধান ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন। খালেদা জিয়ার (এবং জাতির) ভাগ্য ভালো যে তাঁর জন্ম পাকিস্তানে নয়। পাকিস্তানে হলে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ মারাত্মক হয়ে উঠত। কেউ কেউ তখন এই দাবিও তুলতে পারত যে তাঁকে পাকিস্তানে প্রত্যর্পণ করা হোক! ভারতে তিনি জন্মেছিলেন বলে এ নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি হওয়ার কথা না।
কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টি কিছুটা সিরিয়াস! সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সর্বোচ্চ আইনকে ছুড়ে ফেলার কথা বলা যায় না। খালেদা জিয়া পঞ্চদশ সংশোধনীর সমালোচনা করেছেন। এর মাধ্যমে সংবিধানকে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো বানানো হয়েছে বলে পরের বাক্যে সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন। সরল বিশ্বাসে বিচার করলে মনে হতে পারে যে তিনি পঞ্চদশ সংশোধনী ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন, সংবিধানকে নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু কিছু বিধান অগণতান্ত্রিক, অগ্রহণযোগ্য এবং পরিত্যাজ্য—এমন কথা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও শাহদীন মালিকের মতো আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। খালেদা জিয়াও যদি বলতেন, তিনি জনগণের রায় নিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করবেন, তাহলে তাঁকে দোষারোপ করার সুযোগ কেউ পেত না। এখন তাঁর বক্তব্যের শুধু একটি লাইন বেছে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে এই প্রচারণা চালানো সম্ভব যে তিনি সংবিধানই ছুড়ে দিতে চেয়েছেন। এই প্রচারণাই এখন চালানো হচ্ছে এবং এই সুযোগে তার দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য খালেদা জিয়া নিজে কিছুটা হলেও দায়ী। অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ একটি পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি কেমন করে শব্দচয়নে অসতর্ক ও স্বেচ্ছাচারী থাকেন?
তবে শুধু এই কথার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর রুষ্ট হয়েছেন আমার তা মনে হয় না। সংবিধান ছুড়ে ফেলার কথা বলার আগে থেকেই তাঁদের সম্পর্ক তিক্ত। এই তিক্ততা ব্যাপক এবং সংক্রামক, যা থেকে দুই দলের বড় নেতারাও মুক্ত নন। এমনিতে বড় নেতাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের আন্তরিক ও সম্মানজনকভাবে কথা বলতে দেখি। গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে গেলে তাঁরা আবার কিছুটা দুই নেত্রীর মতো করে আক্রমণাত্মকভাবে কথা বলেন। এমন ধারণা সমাজে রয়েছে যে তিক্তভাবে অন্য দলের নেত্রীকে তাঁরা আক্রমণ করে কথা বলেন আসলে নিজ নেত্রীকে খুশি করার জন্য! নেত্রী এবং এসব নেতার কথা শুনে প্রভাবিত হন সারা দেশের কর্মী, এমনকি সমর্থকেরাও।
দুই নেত্রীর অসুস্থ সম্পর্ক গোটা দেশকে এভাবে বিভক্ত করে রেখেছে। এর সুযোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহল নিয়েছে। এরশাদের নয় বছর টিকে থাকা এবং জেনারেল মইনের নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দেশে এসেছে অংশত দুই নেত্রীর সুসম্পর্কের অভাবের কারণে। দুই নেত্রীর খারাপ সম্পর্ক দেশকে ক্ষতিগ্রস্তও করছে নানাভাবে। হরতাল বা সংঘাতের রাজনীতির সরাসরি ক্ষতির কথা আমরা জানি। এ ছাড়া নগ্ন দলীয়করণ, নির্বাচনে জেতার জন্য মুনাফাখোর, দুর্নীতিবাজ বা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া, ক্ষমতার জন্য বিদেশি শক্তিগুলোর কাছে নিজ দেশের স্বার্থ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিকিয়ে দেওয়া, এসব নানা ক্ষতিকর কাজের পেছনেও দুই নেত্রীর তীব্র সংঘাত কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রাখে।
এ ছাড়া পরস্পরকে মাইনাস করার কাজে সরকারের উদ্যম, শক্তি, সময়ের অনেকাংশ তাঁরা ব্যয় করে ফেলেন। ফলে সুশাসন ও জনকল্যাণমূলক কাজে তাঁদের পূর্ণ সম্ভাবনা কখনো তাঁরা কাজে লাগাতে পারেন না। বরং ক্ষমতায় এসে তাঁদের একজন অন্যজনের উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন এমন নজিরও বিরল নয়।
৩.
এক-এগারোর আগে তাই বহু মহল থেকে তৃতীয় শক্তির উত্থানের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হতো। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেপথ্য শক্তি নিষ্ঠুর ও অগণতান্ত্রিক পন্থায় দুই নেত্রীকে মাইনাস করার চেষ্টা চালায়। ফলে তৃতীয় শক্তির ধারণাই বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য হতে থাকে এর পর থেকে। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দুই নেত্রীর কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি এই হতাশাজনক সত্যই এক-এগারোর ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হতে থাকে।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা এখনো দুর্বল। বাম ও প্রগতিশীল দলগুলো মধ্যে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর যে সম্ভাবনা ছিল, তা ইতিমধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এদের কেউ কেউ দুই বড় দলের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বেছে নিয়েছে। কেউ কেউ রাজনীতি থেকে প্রায় নির্বাসন নিয়েছেন। অন্যরা টিকে আছেন টিম টিম করে।
দুই নেত্রী ছাড়া তাই গত্যন্তর নেই আমাদের। তাতে হয়তো সমস্যা ছিল না। পৃথিবীতে অনেক দেশ যুগের পর যুগ মূলত দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় টিকে আছে। কিছু অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশে আসল নেতা মাত্র দুজনই। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে, আমাদের দুই দল বা দুই নেত্রী এখন আর দ্বিদলীয় ব্যবস্থায়ও বিশ্বাসী নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর নির্যাস একদলের প্রকট প্রাধান্য চাপিয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে বিএনপিবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা আরও পাকাপাকি হবে। সে চেষ্টা যে করা হবে, তার বিভিন্ন ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি। বিএনপি তা প্রতিরোধে সক্ষম হলে প্রতিশোধও নেওয়ার চেষ্টা করবে। পঞ্চদশ সংশোধনী যদি হয় আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো, তাহলে আমরা আশঙ্কা করতে পারি যে ষষ্ঠদশ সংশোধনী করার সুযোগ পেলে বিএনপিও সংবিধানকে তার নিজস্ব ম্যানিফেস্টোতে পরিণত করার চেষ্টা করবে।
এক বনে এক বাঘই থাকবে। সেটি হয় শেখ হাসিনা, না হলে খালেদা জিয়া। এমন প্রস্তুতির আলামত ২১ আগস্টে ছিল, অন্যভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীতেও আছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও থাকবে। কিন্তু এই যুদ্ধে প্রাণ অতিষ্ঠ হবে সাধারণ মানুষের। তবু আমাদের জয়ধ্বনি দিতে হবে দুই নেত্রীর যেকোনো একজনকে!
আমরা কি চাই না তাঁদের জয়ধ্বনি? চাই। কিন্তু তার আগে চাই পেটভর্তি খাবার, আলো-বাতাসে ভরা ঘর, দ্রুতগামী শহর, সুস্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আর বিদেশে গর্বিত পরিচয়। দুই নেত্রীকে দুই যুগ ধরে আমরা বিশ্বাস করে এসব দায়িত্ব দিয়েছি। অল্পই তাঁরা আমাদের দিতে পেরেছেন। যদি অন্তত জাতীয় স্বার্থে তাঁরা মিলেমিশে কাজ করতেন, তাহলে এর চেয়ে অনেক বেশি আমাদের দিতে পারতেন তাঁরা। দুঃখ এখানেই।
৪.
দুই নেত্রীর যুগ স্বাভাবিক নিয়মে শেষ হবে একসময়। এক যুগ বা দুই যুগ পর তাঁদের পরের প্রজন্ম হয়তো আসবেন ক্ষমতায়। হয়তো জয়-তারেক কিংবা পুতুল-জোবাইদা। পরের প্রজন্ম কি পারবেন একে অন্যকে সহ্য করতে? পৃথিবীর অন্য বহু দেশের মতো জাতীয় ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করতে? অতীতমুখী রাজনৈতিক বিতর্কে লিপ্ত না থেকে উৎপাদন আর উন্নয়নকর্মে সারা দেশের মানুষের সামর্থ্যকে নিয়োজিত রাখতে?
নতুন দুই নেত্রী আসতে আসতে আমার প্রজন্ম বৃদ্ধ হবে। ১৯৭১ সালে যাঁদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স ছিল, তাঁদের অধিকাংশ পরলোকগমন করবেন। শুধু পতাকা আর মানচিত্র নয়, তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন শোষণমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য। এমন এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের আর কত কাল অপেক্ষা করতে হবে? সে সময় যদি মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ আর বেঁচে না থাকেন, এই দুঃখ কোথায় রাখব আমরা!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসব আশঙ্কা সামান্য হলেও লঘু হতে পারত রমজান মাসের দাওয়াত গ্রহণ করা হলে। মনের তাগিদে না হোক, স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও শেখ হাসিনা হাজির হতে পারতেন খালেদা জিয়ার দাওয়াতে। খালেদা জিয়াকেও তখন যেতে হতো শেখ হাসিনার দাওয়াতে। কারও কি একচুল সমস্যা বা ক্ষতি হতো এতে? হতো না। দেশের মানুষ বরং কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত। আর কে জানে তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা হলে কিছুটা সমব্যথীও হতে পারতেন একে অপরের। তাঁদের বুদ্ধিশুদ্ধি নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে বেশি। একসময় হয়তো এও বুঝতে পারতেন যে তাঁদের দুজনের (এবং দেশের মানুষের) জীবন অনেক বেশি স্বস্তিকর হতে পারে পারস্পরিক সম্পর্কে অসুস্থতার অবসানে।
২.
আমাদের এসব আশা পূর্ণ হবে না। দাওয়াত পাওয়ার কয়েক দিন পরই শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিরোধী দলের নেত্রী এবং সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত বলেছেন। পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হয়েছে, দুই কারণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেছেন। এক. খালেদা জিয়ার জন্ম ভারতে। দুই. তিনি সংবিধান ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন। খালেদা জিয়ার (এবং জাতির) ভাগ্য ভালো যে তাঁর জন্ম পাকিস্তানে নয়। পাকিস্তানে হলে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ মারাত্মক হয়ে উঠত। কেউ কেউ তখন এই দাবিও তুলতে পারত যে তাঁকে পাকিস্তানে প্রত্যর্পণ করা হোক! ভারতে তিনি জন্মেছিলেন বলে এ নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি হওয়ার কথা না।
কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টি কিছুটা সিরিয়াস! সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সর্বোচ্চ আইনকে ছুড়ে ফেলার কথা বলা যায় না। খালেদা জিয়া পঞ্চদশ সংশোধনীর সমালোচনা করেছেন। এর মাধ্যমে সংবিধানকে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো বানানো হয়েছে বলে পরের বাক্যে সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন। সরল বিশ্বাসে বিচার করলে মনে হতে পারে যে তিনি পঞ্চদশ সংশোধনী ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন, সংবিধানকে নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু কিছু বিধান অগণতান্ত্রিক, অগ্রহণযোগ্য এবং পরিত্যাজ্য—এমন কথা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও শাহদীন মালিকের মতো আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। খালেদা জিয়াও যদি বলতেন, তিনি জনগণের রায় নিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করবেন, তাহলে তাঁকে দোষারোপ করার সুযোগ কেউ পেত না। এখন তাঁর বক্তব্যের শুধু একটি লাইন বেছে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে এই প্রচারণা চালানো সম্ভব যে তিনি সংবিধানই ছুড়ে দিতে চেয়েছেন। এই প্রচারণাই এখন চালানো হচ্ছে এবং এই সুযোগে তার দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য খালেদা জিয়া নিজে কিছুটা হলেও দায়ী। অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ একটি পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি কেমন করে শব্দচয়নে অসতর্ক ও স্বেচ্ছাচারী থাকেন?
তবে শুধু এই কথার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর রুষ্ট হয়েছেন আমার তা মনে হয় না। সংবিধান ছুড়ে ফেলার কথা বলার আগে থেকেই তাঁদের সম্পর্ক তিক্ত। এই তিক্ততা ব্যাপক এবং সংক্রামক, যা থেকে দুই দলের বড় নেতারাও মুক্ত নন। এমনিতে বড় নেতাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের আন্তরিক ও সম্মানজনকভাবে কথা বলতে দেখি। গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে গেলে তাঁরা আবার কিছুটা দুই নেত্রীর মতো করে আক্রমণাত্মকভাবে কথা বলেন। এমন ধারণা সমাজে রয়েছে যে তিক্তভাবে অন্য দলের নেত্রীকে তাঁরা আক্রমণ করে কথা বলেন আসলে নিজ নেত্রীকে খুশি করার জন্য! নেত্রী এবং এসব নেতার কথা শুনে প্রভাবিত হন সারা দেশের কর্মী, এমনকি সমর্থকেরাও।
দুই নেত্রীর অসুস্থ সম্পর্ক গোটা দেশকে এভাবে বিভক্ত করে রেখেছে। এর সুযোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহল নিয়েছে। এরশাদের নয় বছর টিকে থাকা এবং জেনারেল মইনের নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দেশে এসেছে অংশত দুই নেত্রীর সুসম্পর্কের অভাবের কারণে। দুই নেত্রীর খারাপ সম্পর্ক দেশকে ক্ষতিগ্রস্তও করছে নানাভাবে। হরতাল বা সংঘাতের রাজনীতির সরাসরি ক্ষতির কথা আমরা জানি। এ ছাড়া নগ্ন দলীয়করণ, নির্বাচনে জেতার জন্য মুনাফাখোর, দুর্নীতিবাজ বা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া, ক্ষমতার জন্য বিদেশি শক্তিগুলোর কাছে নিজ দেশের স্বার্থ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিকিয়ে দেওয়া, এসব নানা ক্ষতিকর কাজের পেছনেও দুই নেত্রীর তীব্র সংঘাত কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রাখে।
এ ছাড়া পরস্পরকে মাইনাস করার কাজে সরকারের উদ্যম, শক্তি, সময়ের অনেকাংশ তাঁরা ব্যয় করে ফেলেন। ফলে সুশাসন ও জনকল্যাণমূলক কাজে তাঁদের পূর্ণ সম্ভাবনা কখনো তাঁরা কাজে লাগাতে পারেন না। বরং ক্ষমতায় এসে তাঁদের একজন অন্যজনের উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন এমন নজিরও বিরল নয়।
৩.
এক-এগারোর আগে তাই বহু মহল থেকে তৃতীয় শক্তির উত্থানের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হতো। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেপথ্য শক্তি নিষ্ঠুর ও অগণতান্ত্রিক পন্থায় দুই নেত্রীকে মাইনাস করার চেষ্টা চালায়। ফলে তৃতীয় শক্তির ধারণাই বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য হতে থাকে এর পর থেকে। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দুই নেত্রীর কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি এই হতাশাজনক সত্যই এক-এগারোর ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হতে থাকে।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা এখনো দুর্বল। বাম ও প্রগতিশীল দলগুলো মধ্যে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর যে সম্ভাবনা ছিল, তা ইতিমধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এদের কেউ কেউ দুই বড় দলের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বেছে নিয়েছে। কেউ কেউ রাজনীতি থেকে প্রায় নির্বাসন নিয়েছেন। অন্যরা টিকে আছেন টিম টিম করে।
দুই নেত্রী ছাড়া তাই গত্যন্তর নেই আমাদের। তাতে হয়তো সমস্যা ছিল না। পৃথিবীতে অনেক দেশ যুগের পর যুগ মূলত দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় টিকে আছে। কিছু অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশে আসল নেতা মাত্র দুজনই। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে, আমাদের দুই দল বা দুই নেত্রী এখন আর দ্বিদলীয় ব্যবস্থায়ও বিশ্বাসী নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর নির্যাস একদলের প্রকট প্রাধান্য চাপিয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে বিএনপিবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা আরও পাকাপাকি হবে। সে চেষ্টা যে করা হবে, তার বিভিন্ন ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি। বিএনপি তা প্রতিরোধে সক্ষম হলে প্রতিশোধও নেওয়ার চেষ্টা করবে। পঞ্চদশ সংশোধনী যদি হয় আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো, তাহলে আমরা আশঙ্কা করতে পারি যে ষষ্ঠদশ সংশোধনী করার সুযোগ পেলে বিএনপিও সংবিধানকে তার নিজস্ব ম্যানিফেস্টোতে পরিণত করার চেষ্টা করবে।
এক বনে এক বাঘই থাকবে। সেটি হয় শেখ হাসিনা, না হলে খালেদা জিয়া। এমন প্রস্তুতির আলামত ২১ আগস্টে ছিল, অন্যভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীতেও আছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও থাকবে। কিন্তু এই যুদ্ধে প্রাণ অতিষ্ঠ হবে সাধারণ মানুষের। তবু আমাদের জয়ধ্বনি দিতে হবে দুই নেত্রীর যেকোনো একজনকে!
আমরা কি চাই না তাঁদের জয়ধ্বনি? চাই। কিন্তু তার আগে চাই পেটভর্তি খাবার, আলো-বাতাসে ভরা ঘর, দ্রুতগামী শহর, সুস্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আর বিদেশে গর্বিত পরিচয়। দুই নেত্রীকে দুই যুগ ধরে আমরা বিশ্বাস করে এসব দায়িত্ব দিয়েছি। অল্পই তাঁরা আমাদের দিতে পেরেছেন। যদি অন্তত জাতীয় স্বার্থে তাঁরা মিলেমিশে কাজ করতেন, তাহলে এর চেয়ে অনেক বেশি আমাদের দিতে পারতেন তাঁরা। দুঃখ এখানেই।
৪.
দুই নেত্রীর যুগ স্বাভাবিক নিয়মে শেষ হবে একসময়। এক যুগ বা দুই যুগ পর তাঁদের পরের প্রজন্ম হয়তো আসবেন ক্ষমতায়। হয়তো জয়-তারেক কিংবা পুতুল-জোবাইদা। পরের প্রজন্ম কি পারবেন একে অন্যকে সহ্য করতে? পৃথিবীর অন্য বহু দেশের মতো জাতীয় ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করতে? অতীতমুখী রাজনৈতিক বিতর্কে লিপ্ত না থেকে উৎপাদন আর উন্নয়নকর্মে সারা দেশের মানুষের সামর্থ্যকে নিয়োজিত রাখতে?
নতুন দুই নেত্রী আসতে আসতে আমার প্রজন্ম বৃদ্ধ হবে। ১৯৭১ সালে যাঁদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স ছিল, তাঁদের অধিকাংশ পরলোকগমন করবেন। শুধু পতাকা আর মানচিত্র নয়, তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন শোষণমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য। এমন এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের আর কত কাল অপেক্ষা করতে হবে? সে সময় যদি মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ আর বেঁচে না থাকেন, এই দুঃখ কোথায় রাখব আমরা!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments